হরিশপুর গ্রামে আজকাল তাপমাত্রা এতো বেড়েছে যে বুটলি নামের বেড়ালটা কোনরকমে মাছের আইশ -কাঁটা ,মাংসের চর্বি ইত্যাদি উছিস্ট খাদ্য উপাদান গুলো গ্রহণ করে বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলেছে । মৃতিকা এতো উত্তপ্ত থাকে যে টিপ টিপ করে অথবা দৌড়ে গিয়ে সেই খাবারে মুখ দেয়া সম্ভব নয় । তার সিধান্ত নেবার আগেই পাখনা মেলে দাঁড় কাক পাতিকাক এসে ছোঁ মেড়ে সেই খাবার গুলো নিয়ে যায় ।এক সময় এই গ্রামে অনেক বাঁশ ঝাড় ছিলো তখন নেংটি ইদুর ও পোকামাকড় খেয়ে বাঁচার সুযোগ ছিলো এখন সেই সুযোগ আর নেই ।সময়ের ব্যবধানে লোপ পেয়েছে খাদ্য চক্রের বণ্টন । বড্ড অসহায়ের মত ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে বুটলি সুকুর মায়ের দিকে । এই বাড়িতে সুকু ও তার মা ছাড়া কেউ বুটলিকে দেখতে পারেনা ।সুকুর বড় ভাই তাকে কতদিন গালমন্দ ও প্রহার করেছে বস্তাতে পুরে জঙ্গলে ফেলে এসেছে ।তবু বুটলি নিলজ্জের মত ফিরে এসেছে এই বাড়িতেই । কিন্তু, ইদানিং অসহ্য গরম পড়েছে তাতে এই পরিবারের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে বুঝি বহুদূরের অচেনা অন্ধকারের পথে ।বুটলি বুঝি আর কখনো দেখতে পাবেনা রজনী গন্ধার ডাটার মত চিকন দেহে ডালিয়া ফুলের মত সুকুর নিষ্পাপ ্মুখটি । এই খরতাপে তার চোখ বেয়ে কফটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে । ক্ষুধার জ্বালায় পেট টা মোচড় দিয়ে উঠে । মনের অজান্তে ম্যাও ধ্বনি তোলে কিন্তু উচ্চ শব্দে কাঁদতে পারেনা তার কণ্ঠনালি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে । তার শরীরের রক্তগুলো শুষে নিচ্ছে যেন খুধার্ত সূর্য । কিছুদিন আগেই শিলাবৃষ্টিতে গ্রাম জুড়ে বোরো ধান নষ্ট হয়েছে । নির্বাচনী দন্দে এই গ্রামে কয়েকটি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ।শহরে রানা প্লাজা নামক একটি ভবন ধ্বসে এই গ্রামের কয়েকজন শ্রমিকের অকাল মৃত্যু হয়েছে । আরও কিছু বিকৃত ঘটনা ঘটেছে যা প্রকাশ করার মত নয় । ইতিহাসে অলিখিত দুর্ভিক্ষের লগ্ন এসেছে তা বুটলি বেশ ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারে ।তাইতো গভীর রাতে তার ঘুম টুটে যায় কান্নার সুরে প্রচার করে দুর্ভিক্ষের বাত্রা ।দুশ্চিন্তায় রাতে সে ঘুমাতে পাড়েনা । এদিকে কল্লা বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ , জোনাকিদের পাখনার লাল নীল আলো বড্ড ভালো লাগে বুটলির । মাঝে মাঝে চাঁদকে ভেঙচি কাটে । সে যখন হাঁটে চাঁদ তার সাথে সাথে হাঁটে সে থেমে গেলে চাঁদ থমকে দাঁড়ায় । এটা যে তার বোঝার ভুল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না জেনে আনন্দে লুটিপুটি খায় বুটলি । তারাদের সাথে চোখ টিপা টিপি খেলে সে । তার চোখে চোখ রেখে অনেক তারা আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ে । অনেক সময় গাছের ডাল ঝাঁকিয়ে মৌ মাছিদের বিরক্ত করে সে । গুণগুণ করে মৌ মাছিরা তাকে বলে বুটলি হুল খাবি নাকি ? সুকুর দেয়া বুটলি নামটি শুনলে তার বুকটা আনন্দে ভরে যায় । সৃষ্টির সেরা জীব মানব প্রাণীর থেকে পাওয়া একটি নাম বেড়ালের অনেক ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করে সে । তাছাড়া এই রাতে কিছু খাবারও জোটে তার । রাতে সে নিজেকে স্বাধীন মনে করে কারন এই রাতে তাকে কেউ ঢিল ছোড়ে না , গাল মন্দ করেনা , লাঠি বা ঝাঁটা নিয়ে তারা করেনা । তবুও রাত শেষ হবার অপেক্ষায় থাকে সে ।সকালে তার মনিবের দুষ্টু মেয়ে সুকুর কোলে বসে ছড়া শোনার জন্য ,বকবক শোনার জন্য ভোরের সূর্যের প্রতীক্ষায় থাকে সে । গভীর রাত্রে সুকুকে বড্ড বেশি মনে পড়লে পাশে পেয়ারা গাছের ডালে চড়ে ভ্যান্টিলেটর এর ছিদ্র দিয়ে সুকুকে দেখার চেষ্টা করে বুটলি । গরমের মৌসুমে গাছে চড়তে কোন সমস্যা হয়না তার কিন্তু শীতকালে ডাল ভিজে থাকার জন্য একবার মাটিতে পড়ে গিয়ে পিছনের ডান পা ভেঙ্গে গিয়েছিলো তার । সুকু তার পায়ে ব্যাথা নাশক গাছ বেঁধেদিয়েছিলো । বুটলি ম্যাও ম্যাও করে বলতে চেষ্টা করেছিলো যে গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙ্গেছে । কিন্তু সুকু তার ভাষা বোঝেনা স্বজাতিদের গাল মন্দ করে বলেছিল বুটলির পা যে ভেঙ্গেছে তার পা যদি ভাঙ্গে বুঝবে কত কষ্ট । ভোরে মোরগ ও পাখিদের কূজনে মুখরিত এই গ্রাম গত রাত্রের এই শ্যামা গ্রামটি যেন ফায়ার এন্ড লাভলী মেখে ফকফকে ফর্সা হয়েছে । সুকু হাতে একটু মাজন নিয়ে পুকুর পাড়ে আসতেই বুটলি তার পায়ের কাছে ঘুরাঘুরি শুরু করেছে । সুকুর পায়ের নুপুররে অঙ্গ ঘেঁসে সুকুকে বোঝাতে চায়ছে আমি চলে এসেছি । সুকু তার সাথে কোন কথা বলছেনা । বুটলির বুক ফেটে কান্না চলে আসচ্ছে । অভিমানে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে । সুকু হাতমুখ ধুয়ে বুটলিকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল ঃ তুই আর আমাদের বাসায় আসিস নে । আব্বা তোকে পছন্দ করেনা । কাল রাতে অন্য বেড়ালে মাছ খেয়েছে কিন্তু দোষ তোর কাঁধে পড়েছে । আব্বা তোকে মেড়ে ফেলতে চেয়েছে ।তোকে আমি খুব ভালবাসি বুটলি ,চলে যাস এই গ্রাম ছেড়ে । বুটলি ম্যাও ম্যাও করে বলতে চেষ্টা করলো আমি নির্দোষ । এই প্রথম বুটলির ভাষা সুকু বুঝেছে বলল আমি জানি তুই অপরাধী নয় । কিন্তু মানুষের আদালতে অনেক অনেক নির্দোষ মানুষ সাজা ভোগ করে । তুই তো একটি বেড়াল । কে দেবে তোর দাম এই সমাজে , কে কথা বলবে তোর পক্ষ হয়ে । মানুষের সংসারে মানুষ মানুষের দাস । আর তুই তো একটি বেড়াল রে বুটলি পাড়লে আমাকে ক্ষমা করিস । আচ্ছা ঠিক আছে গ্রাম ছেড়ে না গেলেও আমাদের বাড়িতে আর জাবিনা কথা দে । বুটলি মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো আর যাবনা । সুকুর কোল থেকে নেমে পাশের একটি সজনে গাছের উঠে পড়লো । কিছুক্ষণ পড়ে সুকু ও সুকুর বাবা মই নিয়ে এলো বাড়ির বাইরে হাঁড়িতে ঝুলানো গোলা কবুতরের বাচ্চা গুলো বাড়িতে খাবার জন্য বা বিক্রির জন্য অথবা কবুতর গুলোর রোগবালায় হয়েছে কি না পরিক্ষা করার জন্য ।বুটলি মিটমিট করে দেখছে সুকু ও সুকুর বাবাকে । অন্য দিনের মত হলে এখুনি সুকুর পায়ের কাছে ঘুরঘুরি করতো সে । কবুতরের বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে মজা লুটত । আজ মন ভালো নেই বুটলির গত রাতে ঘুমও ভালো হয়নি । বাতাসে ভেসে আসা দসলা সাপের আঁশটে গন্ধ পেয়ে সজাগ হলো । ম্যাও ম্যাও করে শব্দ করে সুকুর বাবা কে বোঝাতে চেষ্টা করলো ওই হাঁড়িতে হাত ভরবেন না সাপ আছে , শুনুন আমার কথা মই থেকে নেমে যান ।এসব বলতে বলতে এক লাফে গাছ থেকে নেমে দেয়াল বেয়ে সুকুদের চালে উঠে সুকুর বাবার মুখো মুখি হয়ে ম্যাও ম্যাও করতে লাগলো । সুকুর বাবা বুটলিকে গাল মন্দ শুরু করলো । বুটলিকে বলল তোর কপাল ভালো মই এ চড়ে আছি নইলে তোর কপালে দুঃখ ছিলো বুটলি । বুটলির বুঝতে বাকি রইলোনা যে সে মই থেকে নামবেনা । বুটলি চাল থেকে এক লাফে খড়ের গাদার উপর গিয়ে কবুতরের হাড়ি বরাবর একটি জাম্প দিয়ে হাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো । হাড়িটি ভুমি কম্পের মত দুলে উঠলো । ফোঁস ফোঁস গো গো শব্দ কিছু ক্ষণ হবার পড়ে । দশ্লার পেঁচি খেয়ে হাড়ি থেকে মাটিতে পড়লো বুটলি । মাটিতে পড়েও দশলা হার মানেনা বুটলিও হার মানেনা । একটি লাঠি হাতে নিয়ে সুকুর বাবা দশলাকে মাড়ার পথ পাচ্ছেনা কারণ বুটলিকে সে লাটিমের লত্তির মত করে পেঁচিয়ে আছে । প্রতিবেশি একজন এসে সুকুর বাবার হাত থেকে লাঠিটি কেড়ে দশলার মাথা মাটির সাথে চেপে ধড়লো । দশলার প্যাঁচ ঢিলে হলো ।বুটলি ম্যাও ম্যাও করে ঘূর্ণি খেতে লাগলো ।বুটলির বাম চোখ দিয়ে রক্ত ঝড়ছে । সবাই নিশ্চিত ছোবল বুটলির চোখে লেগেছিল । বুটলি হাত জোর করে জীবনের শেষ ক্ষমা চেয়ে এক চোখে সুকুর মুখটা দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যে অনন্ত কালের স্বাধীন রাতের কোলে ঢলে পড়লো বুটলি ।আর কোনদিন পেয়ারা গাছের ডালে চড়ে ভ্যান্টিলেটর এর ছিদ্র দিয়ে সুকুকে দেখার চেষ্টা করবেনা সে । কখনো আর সুকুদের বাড়িতে যাবেনা । বুটলি একটি বেড়াল হয়ে সুকুকে দেয়া কথা রেখেছে সামান্য মাছের এঁটো কাঁটা ও সুকুর ভালবাসার প্রতিদানে বুটলির জীবনের বলিদান মানুষের বিবেককে নাড়া দিতে না পাড়লেও সুকুর পরিবারের সকলের চোখ থেকে কফটা অশ্রু ঝড়াতে পেড়েছে । একটি বেড়াল এর চেয়ে বড় কি প্রতিদান দিতে পাড়ত জানানেই আমার মত সামান্য এক গুণটানা নৌকার ।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আখতারুজ্জামান সোহাগ
ভালোবাসার প্রতিদান দিয়ে গেল বুটলি, যে কি না একটা বিড়াল আর প্রতিদানটা দিয়ে গেল সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে। গল্পের শেষে এসে তবু কিছুটা সান্ত্বনা নিয়ে ফিরলাম, বিড়ালটা তবু ক’ফোটা চোখের জল সাথে পেল যাদের জন্য সে তার জীবনটাকে উৎসর্গ করেছে তাদের কাছ থেকে।
খুব ভালো লেগেছে আপনার গল্প। ভালো থাকবেন, শুভকামনা রইল।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।