-আচ্ছা ভাইয়া, রুমাপুর সাথে রিলেশানটা ব্রেক আপ হলো কেন?
নোটপ্যাডে কিছু একটা লিখছিলাম। এই প্রশ্নে হঠাৎ করেই আঙুল থেমে গেল। কটমট করে তার দিকে তাকালাম। আমার রাগী রাগী চাহনি দেখে বুঝতে পারলো, প্রশ্নটা ছুড়ে কী অপরাধই না করেছে সে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকাটা তার সাহসে কুলালো না। মাথা নীচু করে নিশ্চুপ বসে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললাম, আরেক কাপ চা নিয়ে আয়, যা...
চা এসেছে, ও আসে নি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ফুপি জিজ্ঞেস করলো, তোরা এই মোবাইল, ইন্টারনেট বা ফেইসবুকে কী পাস বলতো? যার জন্যে সারাদিনই তা নিয়ে বসে থাকতে হবে! চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলাম, ফুপি, লাভলি কোথায়?
বিকেল থেকেই রুমে একা একা বসে আছি। বাইরে বেরুনোর কোন ইচ্ছেও হয় নি। এই বাড়িতে তিনজন মানুষ। আরেকজন আছে, রেশাদ ভাই। প্রায় দশ বছর ধরে পড়ে আছে সিঙ্গাপুর! লোকটার অনেক টাকা পয়সা দরকার। টাকা পয়সার অভাবে বিয়েটা পর্যন্ত করতে পাচ্ছে না। কিন্তু ফুপার এত টাকা পয়সা দরকার নেই, তা উনার দুই দুটা রাইসমিল ঘুরলেই বুঝা যায়। ফুপা প্রায়ই রেশাদ ভাইকে বলেন, কী হবে এতো টাকা পয়সা দিয়ে?
এই মুহুর্তে ফেইসবুকিং কিংবা লেখালেখি কিছুই ভালো লাগছে না। দেয়ালে বাঁধাই করা রেশাদ ভাইয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি। বিদেশি টাকায় স্বাস্থ্যের উন্নতি বেশ ভালোই হয়েছে। শেষবার দেশে আসার পর তোলা ছবি।
খাবার টেবিলে ডাক পড়লো। আমার বিপরীত দিকে লাভলির চেয়ার। ও মুখ তুলে তাকাচ্ছে না, খেয়েই যাচ্ছে। খাবার টেবিলে এমন নীরবতা আমার ফুপার পছন্দ নয়। নীরবতা ভেঙে ফুপা নিজেই কথা বলতে শুরু করলেন। অ্যাই রাহাত, তুমি কি শিববাড়ির পোড়া মন্দিরটা দেখেছো? আমি না সূচকভাবে মাথা ঝাঁকালাম। বেশ তাহলে লাভলিকে সাথে নিয়ে কাল একবার দেখে এসো।
ফুপির কাছে এই পোড়া মন্দিরের কথা অনেকবার শুনেছি। কথিত আছে, এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য নাকি নরবলি দিতে হয়েছিল! তৎকালীন হিন্দু রাজা শিবের উপাসনা করতো। তো সে রাজা শিব মন্দির স্থাপনে মনস্থির করলে স্বপ্নযোগে দেখতে পায় যে, মন্দির প্রতিষ্ঠায় তাকে নরবলি দিতে হবে। যথা আজ্ঞা পালিত হয়।
#
পরিত্যক্ত দালান, চুন, ইট, পলেস্তরা ইত্যাদি খসে পড়ছে। দেয়ালের গায়ে শৈবাল, ছত্রাক জন্মেছে। পুরো বাড়ি ঝোপঝাড়ে ছাওয়া। দিনের বেলাতেই এক ধরনের ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। বাড়ির একেবারে উত্তর প্রান্তে সেই মন্দির।
-লাভলি, এখানে আসতে তোর ভয় লাগে নাহ্?
-নাহ্, ভয় লাগবে কেন? আমি তোমার মতো ভীরু ভাই নাকি... হি হি
যাক গত বিকেলের আগ পর্যন্ত আর মেয়েটা এমন সহজ হয় নি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বলতো কাল সে প্রশ্ন করেছিলি কেন? ওর লাজুক হাসির মুখটা ওড়নার কোণা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করলো, না এমনি, এমনিতেই জানতে চেয়েছিলাম। বাদ দাও, বলেই মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি তার পিছু নিলাম।
#
সে অনেক কাহিনী। আমার আর রুমার মধ্যে অনেক অমিল ছিল। তার চেয়ে বড় কথা, ও আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। চ্যাটবক্সে রিপ্লাই দিতে দেরি হলেই চিল্লাচিল্লি শুরু করতো। তার ধারণা ছিল, আমি ফেইসবুকে এসে অন্যান্য মেয়েদের সময় দেই ইত্যাদি ইত্যাদি। ফোন ওয়েটিং পেলে তো তুলকালাম কান্ড শুরু করে দিতো। তারপর..., লাভলির উৎস্যুক চোখের জিজ্ঞাসা। তারপর আর কি! একটা সময় দেখলাম, আমাদের আর চলছে না। ব্যস, হয়ে গেল...
-তাছাড়া...
-তাছাড়া কী? আমাদের রুচিবোধের মধ্যেও যথেষ্ট ফাঁরাক ছিল। এই যেমন, আমি রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পছন্দ করি আর রুমা হানি সিং। আমি বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকি আর ওর পার্টি, রেস্টুরেন্ট!
ভাঙনের গল্পে গল্পে সূর্যটা হেলে পড়েছে। মন পোড়ানোর গল্প শেষ করার আগেই তাড়া দিল লাভলি, চলো ভাইয়া এবার উঠি।
#
রাত সাড়ে বারোটা। লাভলির রুমে লাইট জ্বলছে। নক করতেই দরজা খোলে দিল। কিছু বলবে ভাইয়া? না মানে, এত রাত পর্যন্ত জেগে আছিস! তাই ভাবলাম, কী করছিস দেখে যাই। ইয়ে, একটা বই পড়ছিলাম...
আনন্দমোহন কলেজে এবারই ভর্তি হয়েছে সে। বুক সেলফে রবীন্দ্র, নজরুল এবং হুমায়ুন আহমেদ সমগ্র! বুঝেছি, বইয়ের পোকা ওর মাথায় কেমনভাবে বসেছে!
-তুই কি সারা রাত এভাবে বই পড়ে কাটাস?
-হুউউম! তবে মাঝে মাঝে, অবসরে...
-ওহ্, তাইলেতো ভালোই...
-আচ্ছা ভাইয়া হুমায়ুন আহমেদের কোন বইটা তোমার ভালো লাগে?
-এইতো... আমার আছে জল!
-গুড।
ভবঘুরে বাউন্ডুলেদের মত আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো আমার কর্মও নয়, বিশেষ পছন্দেরও নয়। ফুপির অনেক জোরাজুরিতেই ময়মনসিংহে আসা। শেষ কবে এসেছিলাম, তা মনেই পড়ছে না।
ধোবাউড়া থেকে জেলা শহরে আসার জন্য বাস রয়েছে। আমাকে এগিয়ে দেবার জন্য বাস স্টপ পর্যন্ত এসেছে বাপ মেয়ে। বাস ছাড়ার আগ মুহুর্তে লাভলি হাত বাড়িয়ে দিল। হাতে রেপিং পেপারো মোড়ানো গিফট। পাগলি কোথাকার এসবের কী দরকার ছিল?
বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই শিহাব ভাইয়ের ফোন, তাড়াতাড়ি ঢাকায় আয়। সেকেন্ড প্রুফটা দেখে দিতে হবে যে।
#
ঢাকায় এসেই ব্যস্ততা। গল্প সংকলনটা প্রেসে যাবার আগ পর্যন্ত ব্যস্ততার শেষ ছিল না। প্রুফ দেখার পর আবার ফ্ল্যাপে ছবি দিতে হবে। যে কয়টা ছবি আগের তোলা ছিল, তা শিহাব ভাইয়ের পছন্দ হল না। শেষে নতুন করে ছবি তুলতে হল।
অনেকদিন পর আজ লম্বা করে একটা ঘুম দিতে পারবো ভেবে বিছানায় কাত হলাম। এপাশ ওপাশ করে ঘুম আসছে না। হঠাৎ করেই মনে পড়লো লাভলির দেওয়া গিফটের কথা।
রেপিং পেপার খুলতেই দেখলাম, হুমায়ুন আহমেদের বই "আমার আছে জল"। কোন ফাঁকে মুখ ফসকে বলেছিলাম যে, এই বইটা আমার পছন্দের...
বইয়ের মলাট ওল্টালেই দেখতে পেলাম লিখা,"... ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়, বাঁধিব স্বপন পাশে।"
মনে মনে হাসলাম, বাহ! পাগলিটা কী চিন্তা করে দেখেছো? সামনে এগিয়ে গেলে যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করবে তা কে জানতো?
"প্রিয় রাহাত,
হৃদয়ের কোটরে খুব নীরবে নিভৃতেই প্রবেশ তোমার। কবি- হৃদয়, পদ্মকমল জানি। স্নিগ্ধ কোমল পদ্মাসনে ঠাঁই নেওয়ার যে নির্লিপ্ত ইচ্ছা, তা মেরে ফেলার মত আততায়ী হতে পারি নি। তাই ক্ষমিয়ো...
ফেইসবুকের টাইমলাইন, কোন লিটলম্যাগে যখন দেখতে পাই সে নাম, তখন বড়ই ঈর্ষা জাগে। এ নাম তো রক্তকালিতে আমার হৃদয় পাতে খোদাই করা, তার স্থান অন্য কোথাও হবে কেন!
আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমার হৃদয় সাগরে ঢেউ তোলার ক্ষমতা তুমিই রাখো, প্রিয় কবি। তুমিই... যে মানুষটা ছবি দেখে কাঁদে, চোখের জলে বইয়ের পাতা ভেজায়- সেই মানুষটাই দখল নিতে পারে আমার হৃদ রাজ্যের!
জানি, আমি তোমার মত শব্দকর নই। কলমের আঁচড় কিংবা কী- বোর্ডের উপর আঙুল চালিয়ে মুহুর্তেই যে ছবি আঁকতে পারও, তা আমার পক্ষে সাত জন্মেও হবে না। তাই যা বুঝাতে চাইছি বা চেয়েছি, তা আমার শব্দ দারিদ্রতায় হয়ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। তবুও বুঝিয়ো...
চাঁদ নয় জোছনা হতে চাই। দয়া করে মেঘ ডেকে তাড়িয়ে দিও না।
আমি তোমারই প্রতীক্ষায়...
ইতি-
লাভলি"
হঠাৎ করেই নিঃশ্বাস থেমে যাবার উপক্রম হলো। বুঝতে পারছি না, কী করা উচিত। লাভলিকে আমি কবেকার সেই ছোট্টটিই ভেবে আসছি। এখন দেখছি সে আর হাওয়াই মিঠাই চেয়ে নাছোড়বান্ধা শৈশবে আটকে নেই। অনুজা তন্নীর পুতুল চুরি করে নিজের ব্যাগে ঢুকানো জেদি মেয়েটি কবেই হঠাৎ করেই তরুণী হয়ে গেছে! যার হৃদয়ের প্রতিটি কুঠুরি এখন প্রেমে প্রেমে পূর্ণ হয়ে আছে। ভীত সন্ত্রস্ত হরিণ শাবকের মতো প্রণয়কাতর হৃদয় যে আমারই মন গহীনে আশ্রয় লাভের জন্য ছুটছে, তাও কি জানা ছিল! তার ভেতরে একটা গভীর ও প্রশান্ত নদী রয়েছে, যে নদীতে ইচ্ছে হলেই ভাসানো যেতে পারে হৃদয় ভেলা...
#
আজ মেলায় খুব ভীড় নেই। এখনও জমে ওঠে নি খুব। শিহাব প্রকাশনীর স্টলে বসে পত্রিকা পড়ছি। হঠাৎ করেই রিনিঝিনি সুরে কেউ একজন বলে ওঠলো, "নীল জোছনার গল্প" বইটা দেবেন?
মাথা তোলতেই দেখি, লাভলি.....!
তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলাম, জানিয়ে আসলেই পারতে....
সা...র....প্রা....ই...জ!
কিন্তু ও কি জানে, ওর জন্যেও আমি একটা সারপ্রাইজ রেখেছি! আমার তৃতীয় বই, প্রথম গল্প সংকলন, "নীল জোছনার গল্প" এর উৎসর্গ পত্রে যে তারই নাম!
"মহারাণী, লাভলিকে.....
১৩জানুয়ারি২০১৫।