এক
হঠাৎ করেই মেয়েটি নিজেকে কুরুপা ভাবতে শুরু করলো । যারা খুব সুন্দর তাদের দিকে চোখ মেলে তাকাতে খুব ভয় হতে লাগল তাঁর । কেন সে এমন হয়ে গেল , জানে না সে । মনোরোগ বদ্যিকে বললে , তিনি হয়তো বলবেন , এর উৎপত্তি কথা । ঈর্ষা , দুঃখ কিংবা বিরক্তি ! অথবা আরও কত কি !
তাঁর বয়সী সব মেয়ে বেনী দুলিয়ে স্কুলে যেত । সেও যেত । একদিন তাই যেতে যেতে বাড়ী ফিরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করলো, আর স্কুলে যাবে না সে । যাবে না আর সদলবলে বন্ধুদের সাথে পায়ে হেঁটে হেঁটে । প্রথম প্রথম তাঁর বাবা মা তার এই বলাটাকে নিছক ছেলেমানুষী খেয়াল বলেই ধরে নিয়েছিলেন । যাক , দু চার দিন । তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে ।
একদিন , দু দিন, তিন দিন যেতে যেতে প্রায় সপ্তাহ শেষ হতে চলল । সে বসে রয়েছে তাঁর ধনুকভাঙ্গা পণ নিয়ে । মা আড়ালে ডেকে নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রেখে গভীর মমতা ভরে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রুমকি মা তোর ? স্কুলে যাচ্ছিস না ক্যান ?
রুমকি কোন উত্তর দেয় না । কেবলই নিজের পায়ের নখ দু পায়ে খুঁটতে থাকে ।
মা আবারও জানতে চান , কেউ কিছু বলেছে ? এই ধর পাড়ার আজে বাজে ছেলেরা ।
সে মাথা নাড়ালো । তার মানে না । না । কেউ কিছু বলে নি ।
তাহলে , কি ? কোন স্যার আপা বকেছেন ? পড়া পারিস নি স্কুলে ? কান মলা খেয়েছিস ?
না । নাহ !
না তো না , তাহলে হ্যাঁ টা কি , বল , বল আমায় । মা যেন এবার বেজায় উষ্ণ । উদ্বিগ্ন তো বটেই । আর তিনটে ছেলে মেয়ে ঠিক ঠিক পড়ালেখা করেছে । স্কুল কলেজে যায় আসে যে যার মত । বিকেলে প্রাইভেট টিউটর এর কাছে পড়তে বসে । আর কি যে হোল তাদের এই ছোটো মেয়েটির !
রহমান সাহেব আর আর স্ত্রী রাশেদা বেগম পাড়ার আর দশটা বাবা মার মতই । যারা ছেলেপুলের কল্যাণকে জীবনের পরম ব্রত হিসেবে মনে ধারণ করেছেন । তাদের ছেলেমেয়েরা লেখা পড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশ আর দশের মুখ উজ্জ্বল করবে !
বেশ এমনটাই চলছিল । কিন্তু কি যে হল শেষ মেষ এসে এ মেয়েটির বেলায় । কি যে চায় সে , কি বা আছে তার মনের চোরা কুঠুরিতে , তা খুঁজে বের করাই যেন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারের সবার কাছে ।
রুমকির ছোট চাচা ডাক্তার । রুমকিকে নিয়ে যাওয়া হবে তাঁর কাছে । তিনি ঢাকায় সরকারি মেডিক্যাল কলেজে চাকুরি করেন আর বিকেলে বাসার নীচ তলার চেম্বারে রুগী দেখেন । পরিবারে কারো কোন কঠিন অসুখ বিশুক হলে সবাই ছুটে যায় তার কাছে । তাইই নিয়ম ।
ডাঃ আরমান তার বড় ভাই মানে রুমকির বাবাকে টেলিফোনে বললেন , রুমকিকে তার কাছে নিয়ে আসতে । অনেক সময় চোখ খারাপ, মাথা ব্যথা কিংবা ভেতরে ভেতরে কোন জটিল অসুখ বিশুক বাসা বাঁধলে এমনটি হতে পারে । এসব শুনে টুনে তো রুমকির বাবা মার আত্মা খাঁচা ছাড়া । যা হোক , সব কিছুকেই সাহসের সাথে মোকাবিলা করতেই তো হবে । তা না হলে আর কি উপায় ।
রুমকি গোঁ ধরলো , যাবে না । যাবে না সে । অতদূর বাসে জার্নি করতে তার ভারী কষ্ট হয় । বমি লাগে । মাথা ঘোরে । মা বললেন, খালি পেটে যাবি , তাহলে বমি আসবে না । আর সাথে কমলা লেবু, টক মিষ্টি চকলেট আর ঘ্রান নেবার জন্য কাগজী লেবু আর লেবু পাতা দেব । দেখবি বমি বমি ভাবটাব সব পালাবে ।
রুমকি মাথা নেড়ে বলল , না যাবে না , কিছুতেই যাবে না সে ।
বাবা বললেন , একটা মাইক্রোবাস ভাড়া নেই । যখন খারাপ লাগবে তখনই তা থামিয়ে নেমে পড়া যাবে । আর তোর মজাই লাগবে । বিল ঝিল , নদী , পাখী সব , সব হাতের নাগালের কাছে দেখতে দেখতে যেতে পারবি ।
বাবার কথা গুলো মনে ধরলো বটে রুমকির । কিন্তু নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য , জোরে আরও জোরে শোরে মাথা নাড়িয়ে সে বলল , যাবে না , কিছুতেই যাবে না সে , কোথাও ।
রাশেদা বেগম ভাবলেন , এইসব জেদী ছেলেমেয়েদের বাগে আনার একটাই উপায় আছে । আর তা হোল পেটানো । কিন্তু এর অসুবিধা আছেও ঢের । রুমকির বাবা মেয়ে অন্ত প্রাণ । যদি কোন ছেলে মেয়েদের গায়ে হাত দেবার খবর তিনি পান , তাহলে দশ দিন তার স্ত্রীর সাথে কথা বন্ধ ।
দুই
এত ভাবনার পরও একটা পোনের ছুঁই ছুঁই বয়সের মেয়ে যে কবিতা ভালবাসবেনা , গান ভালবাসবে না , তাতো আর হয় না ।
রুমকির এখন তো আর আগের মতো পরীক্ষায় প্রথম হবার বালাই নেই । তাই অফুরত্ন অবসর । আর বাড়ীতে সেই স্কুলে না যাবার ঘোষণা দেয়ার পর , সব ভাই বোনেরা তাকে নিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে থাকে । বেশ সমঝে চলে তাঁকে । আগে মায়ের পেট মোছা ছোট্ট মেয়ে বলে যারা তাকে খেপাতো কিনবা একটু ঈর্ষাও করতো তারা সবাই ভালবেসে বেসে ভরিয়ে তুলতে চায় যেন তাঁকে । বিষয়টা খুব এনজয় করে রুমকি ।
গীতাঞ্জলি মেলে ধরে রুমকি সেই সব গান খুঁজে ফিরলো যা তার মনের সাথে মিশে গেছে । ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদ খানি /তারায় তারায় খচিত / স্বর্ণে রত্নে শোভন লোভন জানি/ বর্ণে বর্ণে রচিত’। একটুকু পরে থামল সে । আবার বইয়ের পাতায় দু চোখ বুলাল । আবার , আবার । তারপর মনে মনে গুন গুন করে গাইতে লাগল সুরে সুরে সেই গান । তারপর এক সময় কি এক নাম না জানা কষ্টে ভরে গেল তাঁর মন। কেবলি সুন্দরের কথা , সুন্দরের জয়গান । পৃথিবী সুন্দর । তার তারাভরা রাত আর আকাশ সব সব সুন্দর । অন্ধকার পৃথিবী তারার আলোয় আলোময় হয়ে যায় । আর সে , সেই বোধহয় কেবলই অন্ধকারে ডুবে থাকে ।
ফুলের কাছে গেল রুমকি । তাঁদের একটা সুন্দর ছোট্ট ফুলের বাগান আছে , উঠোনের একপাশে । তাতে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ফোটে নানান রকমের ফুল । চন্দ্র মল্লিকা , গাঁদা , ডালিয়া , কসমস । এখন শীতের সময় , তাই যত ঘুম কুমারী শীত ফুল । তবে গোলাপ , হাস্নুহেনা আর গন্ধরাজের দেখা হরদম মেলে । বাগানের চাবিটা থাকে বড় ভাইয়ার হাতে । মানে সেইই এটার মালিক । বাগানের মাটি চষা , দেশী গোবর থেকে বিলেতি সার মিশানো , চারা গাছ লাগানো কিংবা বিঁচি ছিটিয়ে চারা বানানো , নিড়িয়ে দেয়া , কাঁচি দিয়ে বড় মাথা বাহারি পাতা বাহারগুলোকে দৃষ্টি নন্দন করা এসব , সব কিছু ভাইয়া আপন হাতে আর আপন মনেই করে । ভাইয়ার বাগানের ফুল তোলা বাড়ন আর সেখানে যেতেও লাগে তার অনুমতি । রুমকির জন্য এখন সব ফ্রি । বাগানের গেটের একটা বাড়তি চাবি গতকাল ভাইয়া তাঁকে গিফট করেছে । তার মানে রুমকির এখন ফুলে ফুলে প্রজাপতি হয়ে উড়তে কোন বাঁধা নেই । নেই সময়েরও আর টানপোড়ন ।
রুমকি এ ফুল থেকে ও ফুল , ও ফুল থেকে সে ফুলে ঘুরে ফিরে । ফুলের সুবাস বুকে ধরে দুষ্টু ভ্রমরের মত। কোন ফুলকে একটু কষ্ট দিলে , সে যেন বলে উঠে ; আহা , তুমিও তো আমার মতই ফুল । আমায় ব্যথা দিলে , দেখবে একটু পরে তুমিই নিজেই কষ্ট পাচ্ছো । তাই তো , রুমকি এখন সেই পাপড়িচ্যূত গোলাপি লাল কসমসটার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছে ।
পাশেই গোলাপ সারি । ওরা কিন্তু আছে বেশ । কোন চিন্তা ভাবনা নেই । নিজেকে উজাড় করে সাজিয়ে বসে আছে , সবাই তাঁকে দেখছে দেখুক । আহা , সেই সবার চোখে পড়ার কত সুখ । রুমকির ক্লাসের সেই সব সুন্দরী মেয়েগুলোর মত । ওদের যেন হাসি , উচ্ছাস আর আনন্দের শেষ নেই যেন। সবাই দেখছে তাদেরকে । কেউ কেউ এগিয়ে আসছে আপন উৎসাহে বন্ধুত্ব করতে । কিন্তু তার কাছে তো তেমন কেউ আসে না । কেবল ইংরেজি গ্রামার না পারলে বা ইলেকট্রিক ম্যাথের কোন জটিলতায় আবদ্ধ হলেই কেবল তার কাছে ছুটে আসা । আগে ভাল লাগতো তার এসব , এখন লাগে না । মনে হয় আসল ভালবাসা তার সাথে নয় , কেবল কাজের ভালবাসা । গোলাপগুলোকে দেখে রুমকির মনটা ভাল হওয়ার চেয়ে আবার নতুন করে খারাপ হয়ে গেল ।
ঘরে ফিরে কি ভেবে সেই সাদা খাতার পাতায় কলম বুলালো সে । লিখে ফেলল এ মুহূর্তের যন্ত্রণার কথা । মন আজ ভাল নেই , ভাল নেই /আকাশেতে মেঘ নেই , মেঘ মেঘ রং নেই / মেঘ জল খেলা নেই /হাতে হাত রাখা নেই , নেই নেই / মন আজ ভাল নেই !
তারপর আর একটু ভেবে আর একটু ভেবে লিখে ফেললো -মন আজ ভাল নেই , ভাল নেই /
মন জুড়ে জল নেই, টিপ জল / জল টিপ ডেকে ডেকে অকারণ /তাঁর কাছে আসা নেই , নেই নেই/ভালবাসা নেই / মন আজ ভাল নেই !
তাঁর কাছে আসা নেই লিখতে গিয়ে তাঁর শ্যামলা মুখটায় দোল খেল এক অপার্থিব সৌন্দর্যের ছোঁয়া । তা সে দেখতে পেল না বটে । কিন্তু সূর্য আলো ভরা আকাশ তাঁকে ঠিকই দেখতে পেলো। আর তাঁর হয়ে ছোট্ট একটা আলোর রশ্মি এসে ছুঁইয়ে দিল তার কপোল !
তিন
মন ভাল নেই তার । কালো মেয়েদের জন্য নাকি বর মেলেনা । সবার কাছে শোনা । দেখাও । পাশের বাড়ীর সকিনা দাদী , যিনি প্রতি সপ্তাহে একবার না একরার রুমকিদের বাড়ীর পেছনে জঙ্গল ভরা বিশাল খোলা জমিটার মধ্যে এসে ঔষধি গাছ খুঁজেন সকাল দুপুর , তিনিও যাবার বেলায় এক গ্লাস চিনি লেবুর শরবত খেয়ে মহা তৃপ্তিতে রুমকির মার সাথে একদণ্ড গল্পো জুড়ে দিলেন । আর তারপর এক ফাঁকে বলে বসলেন , কি গো বউ তোমার মেয়ের ব্যামো গেল । আমার কাছে দাও । এমন গাছরা খাওয়াবো যে মন খারাপ টারাপ রোগ টোগ , বাপ বাপ বলে দৌড় দেবে ।
এসব শুনে রুমকির মা কেবল হাসেন । ম্লান হাসি । কোথায় ভেবে রেখেছিলেন তিনি , মেয়ে তার এত মেধাবী । সে হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জীনিয়র হবে । আর আজ কি তার দশা । লেখাপড়া বাদ ছাদ দিয়ে কোথায় কোথায় সে ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন মনে ।
যাহোক এত চিন্তার কথা তো আর বাহিরের একজন মানুষকে বলা যায় না । একান ওকান আর সেকান হতে হতে ডাল পালা মেলে চলে যাবে তা হাজার হাজার কানে । শেষ মেশ হয়তো বা রটেই যাবে , রুমকি পাগল হয়ে গেছে । তাকে পাগলা গারদে পাঠাতে হবে । উহ, এসব মনে করতেই রাশেদা বেগমের বুকটা চিন চিন করে ওঠে । আলাই বালাই ! আলাই বালাই। মনে মনে আল্লার রহম মাগেন তিনি ।
সকিনা দাদী যাবার সময় বলে যান , অ বউ জিনে ধরে নিতো মেয়েরে তোমার ? দেখছ না সেই কি বড় তেতুল গাছ ঐ ছইমুদ্দিনের বাড়ীত । ব্যাটা নিমক হারাম , অজাত। জানে ঐ গাছে অজাত কুজাত পিশাসের বাস । না , সে কাছ কাটবে না । কত মাইয়া বউয়ের যে ক্ষ্যাতি করলো সে গাছ । কিন্তু সেই গোয়ারটার এক কথা , বাপের হাতের গাছ । কাটার আগে মোর নিজের মাথাটা আগে ক্যাইট্যা ফেলাও গো তোমরা । সারা দিন গাছের তলায় ফুকুর , ফাকুর । শোয়া বসা । যেন গাছের সাথে নিকা হইছে তার । বেকুপ ব্যাটা পোয়া , এ জন্যিই তো জীবনভর একা থাকলি। বিয়া শাদী সন্তান কিছুরই স্বাদ পালিনা হারামজাদা । একরাশ প্যাচাল পারতে পারতে মস্ত গাছ গাছালির রাখা বোচকাটা বগলে তুলে গলি পথে হাঁটা দেন তিনি ।
রুমকির মার মনে বুড়ী সকিনা চাচীর কথাগুলো মনে ধরে বেশ । তাইতো , এই পৃথিবীতে কি কেবল মানুষ বাস করে । মানুষ ছাড়াও এখানে নাকি আছে অনেক দৈত্য দানো, আছে ভূত পেত্নী আর জীন পরী । থাকে থাকুক । কে তাদের মানা করেছে । কিন্তু তাই বলে পরের মেয়ে ঝির দিকে চোখ তুলে চাওয়া । তোদের মা ঝির দিকে কি মানুষ চোখ তুলেছে ! ভালবেসে তুলে নিয়ে এসেছে তাদের কোন সুন্দরী কন্যেকে । নাহ , এসব কাহিনী তো খুব কমই শোনা যায় । কিন্তু ওই যে তেতুল গাছ আর রাতবিরেতে তার ঘন কালো শন শন পাতারা কেন যেন অচেনা জগতের কাহিনী শোনায় ।
রাশেদা বেগম স্থির করেলেন , যেভাবে হোক, যত শত রকম অনুনয় বিনয় আর মোনা সোনা করে তিনি ছইমুদ্দিনকে দিয়ে ঐ গাছ কাটাবেনই । প্রয়োজনে ভাল টাকা পয়সা দেবেন। কাঁচা পয়সার এত লোভ কি এড়াতে পারবে সে ?
সেদিন চাঁদনী রাত । হাজারো তারা আর এক চাঁদ সুন্দরী মিলে যেন আলোর সমুদ্র বানিয়েছে গোটা আকাশটাকে । লাল, সোনালি , গোলাবি লাল , নীল সবুজ রাশি রাশি আলোর সারি । ওরা আপন মনে গান গাইছে আর মনের খুশীতে নেচে নেচে মস্ত আকাশটাকে মাতাল করে ফেলছে । আকাশের সেই আলো একটু একটু করে লক্ষ কোটি পিদিম হয়ে মাটির এই অন্ধকার পৃথিবীটাকে আলোময় করে তুলছে ।
রাশেদা বেগম অনেক রাতে কি মনে করে বাহিরের খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন । দাঁড়তেই তার দু চোখ স্থির । কে জেন । এক অন্ধকার ছায়া মূর্তি । কে সে ? ইচ্ছে না থাকলেও তার দু চোখ উড়ে ঊড়ে গেল সেই ছইমুদ্দিনের তেতুল গাছের শাখে । কি দেখলেন তিনি । যা দেখতে পেলেন , তা যেন এ জীবনেও দেখেন নি । আলোয় আলোয় মাখামাখি হয়ে সেই অদ্ভুত মস্ত গাছটা যেন একটা চকচকে সোনা আলোর প্রতিমা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে , দূরে অনেক দূরে । আহা , কি তার শোভা । কি তার অপরূপ রুপ । এমন আকাশ আর চাঁদের আলো মাখা অরুপ রুপের আধার চোখে পড়েনি তো তার কোন কালে !
একটা আলো জ্বেলে দিল কে যেন । রুমকি ? তুই ? কি করছিস একা একা এখানে ? ভয় করেছে না তোর ।
মেয়ে বলল , তোমার ভয় করছে না মা ?
মা মাথা নাড়ালেন। না , নাহ তার কোন ভয় করছে না।
মেয়ে তখন মায়ের হাত ধরে বল্ল, দেখেছো তো মা ছইমুদ্দিন কাকুর তেতুল গাছের আলো ! এমন মধুর আলো দেখেছো মা কোনদিন ? আমিও দেখিনি । আজই প্রথম দেখতে পেলেম । আর দেখ , বাজে মানুষগুলো মূর্খের মত ঐ তেতুল গাছের পিছে লেগে থাকে ।
রাশেদা বেগম মনে মনে প্রমাদ গুনলেন । ভাগ্যিস মেয়ে জানে না তাঁর আজকের ইচ্ছের কথা !
চার
বাড়ীর এক কোণে ছোট্ট একটা পুকুর । তার ঘাটটা বাঁধানো নয় । তবে কাঠ আর বাঁশ দিয়ে সুন্দর বেদী বানানো । সেখানে একাকী বসে থাকা যায় । কাপড় কাঁচা যায় । টিফিন কেরিয়ারের বড় বাটিতে জল তুলে তা গায়ে ঢালা যায় । দু পা জলে ভিজিয়ে জলের সাথে আপন মনে সখ্যতা করাও যায় । জলের পাশেই একটা দীঘল জাম গাছের বাস। বাহারী পাতাগুলো তার সময় পেলেই জলের সাথে গল্পো জুড়ে দেয়। তা দেখে হিংসেয় মরে দূরের নারকোল গাছের লম্বা লম্বা পাতাগুলো । ওরাও জলের সাথে সখ্যতা পাতাতে চায় ।
দিনের আকাশ নারকেল পাতার বুকের কষ্ট যেন বুঝতে পারে । তাই কখনও অনেক অনেক বৃষ্টির ফোটায় ভিজিয়ে দেয় তার সারা শরীর । জলে , জলে একবুক জল নিয়ে পাতারা খিল খিল করে হাসি হাসে আর জাম গাছের পাতাদের দেখায় ।
রিমকির আজ দু পা জলে ভিজিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে না । গান গাইলে কি গান গাইত সে ? এই ছুঁই ছুঁই আষাঢ়ে সে আষাঢ়েরই গান গাইতো । সঞ্চারী থেকে । রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের পরে/ নব তৃণ দলে বাদলের ছায়া পড়ে/এসেছে, এসেছে এই কথা বলে প্রান/এসেছে, এসেছে উঠিতেছে এই গান/নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে/ আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে । গাইব না গাইব না করে কখন যেন সে গেয়ে উঠলো সেই জলের গান। তাঁর প্রিয় গান !
জলের মাছেরা সব নাওয়া খাওয়া ভুলে ভিড় বসালো ঘাটের চারপাশ ঘিরে । আর ভেসে চলা হাসের দল ! ওরাও গান শুনতে বড়ই ভালবাসে । যে গান গাইতে জানে না, সে কি আর নাচতে জানে ? মনের মধ্যে গানের সুর মেলতে হয় আগে । তারপর তো দেহের শত খেলা। জল ব্যাঙ আর কুনো ব্যাঙের দল ওরাও যেন কোথা থেকে বেড়িয়ে এল। ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ বলে সমস্বরে গাইল তাদের মত করে তাদের ভাললাগার গান । কাক পক্ষী কোকিল এর মতো গাইতে পারে না বটে , কিন্তু সকালের কা কা ? ঘুম তোমাদের ভাঙ্গিয়ে দেবেই । সেও সুযোগ পেয়ে গেয়ে উঠলো কোকিলেরও আগে । ঊড়ছে কোকিল , উড়ছে । পাশের বাড়ীর ছেলেটির মেলে দেয়া আকাশ ঘুড়ীর সাথে সাথে , উড়ছে উড়ুক ।
কোঁকরা এলোমেলো চুলের ছেলেটি বোধহয় ভেসে আসা সুরের পথ ধরে ঘাটের কাছাকাছি এসেছিল। তাঁর এক হাতে নাটাই আর অন্য হাতে ঘুড়ী আর সুতো । উড়ন্ত পাখা মেলে দেয়া ঘুড়ীকে বাগে আনতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয় । সে আজ যেন পণই করেছে , যে করে হোক সেই ভেসে আসা গানের মেয়েকে দেখতেই হবে । দেখতেই হবে । তাঁকে না দেখলে যেন জীবন তার হয়ে যাবে বৃথা । ফুলহীন । গানহীন । ছন্দহীন ।
মেয়েটি তাঁকে দেখে চমকে উঠে বলল , ঘুড়ী ওড়ানো বন্ধ করলে কেন ? বেশ তো উড়ছিল তোমার রঙিন ঘুড়ী পাখীর পাখা মেলে মেঘহীন নীল সাদা আকাশে।
ছেলেটি বলল , তোমার জন্য ! তোমার গানের কথা ভেবে , তোমার কথা ভেবে সব দিলেম বন্ধ করে । বল তো কতকাল ধরে খুঁজছি তোমায় । কত যুগ ধরে । কিন্তু তার আগে বল , গান কেন বন্ধ করলে সোনার মেয়ে ।
মেয়েটি লজ্জা আর গভীর অনুরাগে মাটির বুকে চোখ রেখে বললে , তোমার পায়ের শব্দ পেয়ে ! তোমার পায়ের শব্দ পেয়ে !
এরপর জলের গান আর আকাশের ঘুড়ী নিয়ে তারা হাজারো হাজারো গল্প কইল । আর তো বলা যায় না । সন্ধ্যে প্রায় এল ঘনিয়ে !
ছেলেটি তখন বলল , রোজ রোজ তো আর এমন করে লেখাপড়া বাদ দিয়ে কেবলই গান গাওয়া আর ঘুড়ির সুতোর পাখা মেলানো চলবে না ।
মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বলল , হ্যাঁ চলবে না , নাই তো ? তবে , তাহলে কি হবে ?, মেয়েটি কান্না ভরা দু চোখে জানতে চাইল ।
ছেলেটি বলল , কিচ্ছু হবে না । তোমার মত তুমি গাইবে । জলের গান। নদীর গান । আকাশের গান । ফুলের আর বাতাসের গান । মাটির গান । আর আমি দূর, অনেক অনেক দূর থেকেও সেই ভেসে আসা সুর শুনতে পাব ।
মেয়েটি জানতে চাইল সেই আকাশ নীল ছেলেটির কাছে , সে তার জন্য কি করবে ?
ছেলেটি বলল , আমি আমার মতই আকাশের বুকে রঙিন পাখনা মেলা ঘুড়ী মেলে মেলে দূর অনেক দূর থেকে তোমায় দেখা দেব । যেমন করে , আগেও অনেকবার দেখেছো আমায় । চিনতে পারো নি এই যা ।
মেয়েটি মাথা নাড়াল । তার কোমর অব্দি দীঘল চুলের সারি , নদীর ধেউয়ের মতো চার পাশটা ঝর্না ধারায় ভরিয়ে দিল । আর সেই দুষ্টু ছেলেটি তা গভীর মুগ্ধতার চোখ মেলে দেখতেই থাকল আর দেখতেই থাকল । সে দেখার যেন শেষ নেই ।
যাবার আগে সেই পাগল ছেলেটি পাগল মেয়েটির চুলের ফাঁকে গুঁজে দিল মনকুমারীর ফুল । হলুদ আর লাল রঙে মাখানো । সেই গাঁদা আর গোলাপের রঙের মত !
পাঁচ
মা বললেন, কোথায় ছিলি রুমকি এতক্ষণ ? তোকে খুঁজে খুঁজে সারা । তারপর মেয়ের চুলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন , ওমা , কি সুন্দর ফুল । কোথায় পেলি ? তোকে ফুল পড়লে এত সুন্দর দেখায় জানি নি তো আগে ।
রুমকি তার গোলাবি লাল কপোল মেলে বললে , তাহলে আমাকে রোজ রোজ এমন একটা বুনো ফুল চুলে পড়তে দেবে ?
মা বললেন , পড়িস , কে মানা করেছে তোকে ? কিন্তু কোথায় পাবি রোজ রোজ এমন সুন্দর ফুল ?
রুমকি লাজ রাঙা সুরে বলল , একজন দেবে ?
কে দেবে মা আর জানতে চাইলেন না । মেয়ে আবার আগের মতো হেসে খেলে দিন কাটাক তাই , তাই তো চান তিনি । পাগলী মেয়ে !
রুমকি আবার নতুন করে পড়া লেখায় মন দিয়েছে । স্কুলের বান্ধবীরা তো এত দিন পর তাঁকে পেয়ে রীতিমত হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিয়েছে । টিফিনের পরের ক্লাসটা করবে না তারা । রুমকির অনারে । বড় আপাও তা অনুমোদন করেলেন । ক্লাসের সেরা মেয়ে বলে কথা ।
আর রুমকি ? সে আনন্দ উৎসবে যোগ দিয়েছে বটে কিন্তু তাঁর মন পরে আছে সেই রঙিন ঘুড়ী , নাটাই আর বুনো ফুলের পাশে হঠাৎ দেখা প্রিয় মুখটির কাছে । এত রুপময় !
আর ছেলেটি ? তাঁর মন ঘিরে আছে সেই জলের ধারে গানের পাখিটি ! এত রুপসী সে !