দাদ ভাইয়া

ভাই/বোন (মে ২০১৪)

জাতিস্মর
  • ৪৫
ভাইয়া,

চমকে উঠলাম আমি। কে ডাকে? কার ডাক এটা? এইখানে এই জাহাঙ্গীর নগরেতো তার আসার কথা না। যে এভাবে ডাকতে পারে। তাই আপনমনে তাঁর সৃতিচরন করতে করতে হাঁটতে লাগলাম।

আবারো। ব্যাকুল গলায় অনিশ্চয়তার সুরে সেই পুরনো ডাকটা নতুন করে শুনতে পেলাম।

ভাইয়া।

আমি আবছা আলো আধারির মধ্যে হাঁটছিলাম। ভাবলাম, দূর থেকে বোধ হয় ভুল করে আমাকে অন্যকেউ ভেবে ডাকছে। বারবার মনে হচ্ছিলো যেন সেই আমাকে ডাকে। যার ডাক শোনার জন্য আমার সিক্ত হৃদয় ব্যাকুল। যার একটা কথা, একটা ডাক, শুধু “ভাইয়া” ডাকটা শোনার জন্য আমি করতে পারিনা এমন কোন কাজ নেই। কিন্তু আমি জানি, এ অসম্ভব। এখানে সে আসবে কি করে? সে তো তারা হয়ে গেছে। তারারা কি এভাবে আসতে পারে? তাই অসম্ভব কষ্টটা বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগলাম।

আবারো সেই ডাক।

ভাইয়া...

এবার আর আমার পক্ষে নিজেকে সামলানো সম্ভব হলোনা। থমকে দাঁড়ালাম। চমকে উঠে। পেছনে ছুটন্ত পদশব্দ। ঘুরতে আমার ভয় হচ্ছে। যদি সে না হয়? এরকম বহুবার আমার আশা ভঙ্গ হয়েছে। তাই আশা করতে আমি ভয় পাই। তবুও পেছনে ফিরলাম। হোক আশাভঙ্গ। যদি নেমে আসে তারা!

রাস্তার নিয়ন বাতির হলুদ আলো, চারিদিকে আরও বেশি অন্ধকার করে দিয়েছে। শুধু ল্যাম্পপোস্টের আশে পাশেই ধোঁয়াটে একটু আলো। একটা ল্যাম্পপোস্টের আলো আরেকটার কাছে এসে বোধহয় কারো ডাকে আমার মতোই থমকে গেছে। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, সেই কুয়াশাচ্ছন্ন আলোর ভেতর থেকে ছুটে আসছে সে। আমি তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছিনা। তবুও আমি জানি এ সেই। কিন্তু আমি যে কোন আশা করতে পারিনা। আশা ভঙ্গ হবে তাই। ঘুরে হাঁটতে চেষ্টা করলাম। পারলামনা। আবারো ঘুরে ঘোর লাগা চোখে তাকালাম ছুটন্ত মানুষটার দিকে।

যখন সে আমার বুকে “ভাইয়া” বলে আছড়ে পড়লো, তখন আমার সম্বিত ফিরে আসলো। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা। সবই স্বপ্ন? আগের মতো? আমার অবচেতন মনের আশা? যে মন সবসময় আশা করে আশাভঙ্গের জন্য। কিন্তু তা কি করে হয়? এই যে, আমার বুকের পরে সে। আঝর ধারায় কেঁদে চলছে। আরও জোরে আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। তবুও আমার বিশ্বাস হয়না।

আমি ধীরে ধীরে তাঁর মুখটা তুলে ধরি, আমার মুখের সামনে। হ্যা, এইতো সেই চেনা মুখ। সেই ছোট্ট বেলা থেকে যে মুখ আমার আনন্দ, হিংসা আর ভালোবাসা। ঠিক যেরকম দেখেছিলাম শেষবার। সেইরকমই আছে। চোখে চশমা। চশমার গ্লাসে চোখের নোনা জল। ঝাপসা হয়ে গেছে তাই দৃষ্টি। চোখের নিচে গালের দু-ধারে জলের ধারা। ফরশা মুখটায় কান্নার দমক, লালচে একটা আভার সৃষ্টি করেছে। কেঁপে উঠছে সে বারবার। আমি অপলক দৃষ্টিতে দেখছি তাঁর অপরুপ সোন্দয। আর মনের গভীরে, আরও গভীর ভাবে এঁকে রাখছি সেই ছবি। দ্রুত। যাতে সে, তাঁর এই অপরুপ সোন্দয কখনো আমার হৃদয়পট থেকে মুছে না যায়। যেভাবে সে হারিয়ে গিয়েছিলো সমুদ্রে। সমুদ্রের মেয়েকে সমুদ্র ফেরত দেয়নি। তবু মন বিশ্বাস করে হয়তো কোন দেশের সৈকতে সে আশ্রয় পেয়েছে।

আবারো সন্দেহ হয়। এখনি বোধহয় ঘোর কেটে যাবে। নিজেকে আবিষ্কার করবো কোন নির্জন স্থানে। আবারো স্বপ্নভঙ্গ হবে। আবারো আশাভঙ্গ।

একি, আমার দু-চোখে পানি? জল? কোথায় ছিল এরা এতদিন? কত কান্নার চেষ্টা করেছি তাঁর জন্য। পারিনি। আমার শরীরে বোধ হয় মৃদু একটা কাঁপন হচ্ছে। অনুভূতি ভোঁতা, ভোঁতা লাগছে। এইতো সে আমার বুকে। কাঁদছে। আমি তাঁর চিবুকে হাত ছোঁয়ালাম। উঁচু করলাম তাঁর মুখটা। ছোট্ট করে চুমু দিলাম তাঁর কপালে। যেখানে মানুষ টিপ পরে। আমি জানি, এখনো সে হয়তো টিপ পরেনা, তারারাতো নিজেই টিপ। সে বলতো, “ভাইয়া যেখানে চুমু দেয়, সেখানে টিপের কোন দরকার হয়না। ভাইয়ার স্পর্শ, অনুভূতি আমাকে সুখ দেয়। সবসময়। যখন ভাইয়া থাকেনা, তখনও।” অনেকদিন আগে সে এই কথা বলেছিল, তার এক বন্ধুকে। আচ্ছা কতদিন আগে?

আমার বুকে সে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। অদম্য কান্না। সহস্র বছরের জমাট বাধা কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা আজ আমার উত্তাপে গলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে তাঁর জলের গতি। আমিও এককালে, অনেকদিন আগে কাঁদতাম। একা, একা। একা না, চোখের সামনে থাকতো তাঁর আবায়ব। দু-পাশে বেণী করা তাঁর লম্বা চুল, চোখে ব্রাউন কালারের কার্বন রীমের চশমা। মুখে অদ্ভুত মায়াময় হাসি। কষ্ট দিত তাঁর এই ছবি। কাঁদাতও আমাকে। সুখও কম দিত না। কাঁদার মধ্যেও খুঁজে পেতাম সুখের ঠিকানা। কষ্ট পেলেও তাই কাঁদতাম। এখন আর কাঁদিনা।

আবারো উঁচু করলাম তাঁর মুখটা। ধীরে ধীরে আমার অশ্রুসিক্ত মুখটা গভীর আবেগে ঘষতে থাকলাম তাঁর মুখে। একাকার করে দিলাম আমার জলে তাঁর জল, তাঁর জলে আমার জল। খুলে নিলাম তাঁর চশমা। কতদিন দেখিনা তাঁর আয়ত দুটো চোখ। অদ্ভুত সুন্দর চোখ। আমিকি আমার জীবনে এর চেয়ে সুন্দর চোখ আর দেখেছি? মনে পড়েছে। একবার গভীর বনে একটা হরিণ, একটা হরিণী আর তাদের একটা বাচ্চাকে দেখেছিলাম, নদীর জল খেতে। সেই হরিণ শাবকটির চোখ ছিল অবিকল তাঁর মতো। আমি তখন মনে মনে তাঁর নামে সেই হরিণ শাবকটির নাম রেখেছিলাম। শাবকটি যখন চলে যাচ্ছিলো তখন মনে মনে শাবকটিকে ডেকে বলেছিলাম, “প্লিজ তুমি যেওনা”। ঠিক যেভাবে তাঁকে বলেছিলাম, তারা হবার আগে। অদ্ভুত ব্যপার, শাবকটি ফিরে তাকিয়েছিল আমার দিকে। দুটো চোখ দিয়ে। তাঁর সেই দুই চোখের ভাষা আমি বুঝেছিলাম সেই দিন। শাবকটি বলেছিল, “আমিতো আবার আসবো। তখন তুমি আবার আমাকে দেখো। প্রানভরে দেখো। তবে আর হিংসা করোনা”। ঠিক যেভাবে বলতো সে। আমিতো কখনো হিংসা করিনি। খুনসুটি করেছি। আমার হিংসার কথাবার্তা তাঁকে আনন্দ দিতো। সে ভাবতো সবাই তাকেই সবচেয়ে ভালবাসে। সে কি জানত, “আমিই তাঁকে সবচেয়ে বাসি ভালোবাসি?”

আজ কি বার? বুধবার আমার শুভ বার। কিন্তু এই বারিই আমার সবচেয়ে কষ্টের। আজকে বোধ হয় বুধবার। রাশিফল তাই বলে। আচ্ছা ওর কি মনে আছে, আমি ওকে গান শোনাতাম,

মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে
বন্দি হইয়ারে,
কান্দে হাসন রাজার
মন মুনিয়ায়রে।

কত গান! কত সুখ! চকলেটের লোভে আমার বেসুরা গলার গান খুব বিজ্ঞ মানুষের ভাব করে সে শুনত। তারপর আমার কাছ থেকে চকলেট নিয়ে বলতো, “দাদা, পিঞ্জিরা কি?” আর মানে বোঝার পরে বলতো, “দাদা, পিঞ্জিরা পচা।” তখন সে এতটুকুন ছিল। যখন একটু বড় হোল, একদিন এসে আমায় বলল, “দাদা, আজ থেকে তুই ভাইয়া। দাদা, বললে তোকে বুড়ো মনে হয়”।

গাবো নাকি সেই গানটা?

সে এখনো আমার বুকে। আমি ধীরে, ধীরে গাওয়া শুরু করলাম সেই গানটা...

আকাশ মেঘে ঢাকা
শাওন ধারা ঝরে,
যেদিন পাশে ছিলে
সেদিন মনে পড়ে।

এই গানটা অজস্রবার শুনেছি তাঁর মুখে। ভাইয়ার নাম আছে গানে, তাই শুধুমাত্র এই গানটাই সে শিখেছিল। প্রথম অন্তরাটুকুই মাত্র পারতো আর কাঁপা কাঁপা গলায় নিজে নিজে গাইত। আমার সামনে পড়লেই ঘুরে দিতো দৌড়। হয়তোবা লজ্জায়। পরে আমি সম্পূর্ণ গানটা শুনেছি। মুখস্ত করেছি। কিন্তু তাঁকে পাইনি শোনাবার জন্য। শেখাবার জন্য।

এখনো সেই সৃতি
বুকেতেই বয়ে চলি,
নিজেরও সাথে আমি
নিজেই কথা বলি।
সৃতিরও মনি মালা
সবার চেয়ে দামি,
আজও তা পরে আছি,
ভুলিনিতো কিছু আমি।

ভুলি কি করে? এতো ভালোবাসা কি ভুলে থাকা যায়? এতো কষ্ট কি সহ্য করা যায়?

হঠাৎ মনে হল, চারপাশে কারা যেন আমাদের দেখছে। গভীর আগ্রহ, কৌতূহল আর করুনার চোখে। একি, সে কোথায়? আমিতো তাঁকে একটু আগেও জড়িয়ে ধরে ছিলাম। চোখ মেলে তাকাই। কোথায় সে? নেই। বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আমি একটা চীজ, পাগল। তাকাক ওরা। যেমন ইচ্ছে তেমন করে তাকাক। ওদের তাকানোতে আমার কোন দুঃখ নেই। দুঃখতো আমার আশা ভঙ্গে। আবারো আমার আশা ভঙ্গ হলো। স্বপ্নভঙ্গও।

হাঁটতে শুরু করলাম। গন্তব্যের দিকে। পেছনে রেখে আসলাম তাঁর জন্য আমার কান্না, গান আর নতুন আরও একটা আশা, স্বপ্ন। যার ভাঙাতেই আমার সুখ।

সুখে থাক বোন।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু হৃদয় ছুঁয়ে গেল। দুঃখ বোধ হলো অনেক। শ্রদ্ধা জানবেন।
নাজমুছ - ছায়াদাত ( সবুজ ) ভুলি কি করে? এতো ভালোবাসা কি ভুলে থাকা যায়? এতো কষ্ট কি সহ্য করা যায়? --------------সুখে থাক বোন। । মনটা বেজায় খারাপ হল ।

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪