আমরা তখন চিটাগাং ছিলাম। হঠাৎ একদিন আমার আব্বু খাগড়াছড়িতে বদলির চিঠি পেলেন। প্রথম দিকে কিছুটা মন ক্ষুন্ন হলেও, পরবর্তিতে ঠিকই খুশিই হয়েছিলেন। এই ভেবে যে, নতুন জায়গায় যাবেন, নতুন কিছু দেখবেন, নতুন পরিবেশে মিশবেন, এই আর কি। তাছাড়া, আমার বড় কাকা থাকতেন খাগড়াছড়ির পাশেই মহালছড়িতে, আমাদেরও আগের থেকেই। উনার কাছ থেকেই ওখানকার অনেক গল্প শুনেছিলাম অনেক আগেই। আমরা খাগড়াছড়িতে যাচ্ছি শুনে আমার বড় কাকাও খুবই খুশি হয়েছিলেন, কারণ উনার অফিসের মিটিং-এ প্রায়ই আসতে হত খাগড়াছড়িতে। আমার আব্বু যখন থেকে জানতে পেরেছেন, খাগড়াছড়ি খুবই সুন্দর জায়গা, তখন থেকেই তিনি খুশিই হয়ে ছিলেন। আর আমার আব্বু যখন যেখানেই থাকতেন, আমাদেরও সাথে নিয়ে যেতেন। কারণ, উনি কখনই একা থাকতে পারতেন না তাই।
আমার আব্বু তাই, সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে তিনি একাই ওখানে যাবেন এবং সবকিছু দেখে শুনে ঠিকঠাক করে পরে এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। বিশেষ করে আমার স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে পরে যাবার দিনক্ষণ ঠিক করবেন। এরিমধ্যে আমার আব্বু কয়েকবার এসে ঘরের জিনিসপত্রও নিয়ে গিয়েছেন। তবে ফার্নিচার নেবেন না, কারণ ওখানে গিয়েই নতুন করে বানাবেন। তাই ওখানকার দোকানে কিছু ফার্নিচার বানানোর জন্য অর্ডারও দিয়ে এসেছেন। একসময় দিনক্ষণও ঠিক করা হলো। আমরা রাঙামাটি দিয়ে মহালছড়ি হয়ে খাগড়াছড়িতে যাবো। উদ্দেশ্য হলো, পাহাড়ের সৌন্দর্য্যটা দেখে দেখে যাবো এবং আমার বড় কাকার ওখানেও দেখা করে যাওয়া হবে। রাঙামাটিতে থাকব না, সোজা মহালছড়িতে যাবো। আর সেই উদ্দেশ্যে ভোর বেলায়ই বাসে করে আমরা রাঙামাটির দিকে রওয়ানা দিলাম।
বাংলার অপরূপ রূপের স্বর্গ যেন রাঙামাটি। ছবির মতই সবুজে ঘেরা পাহাড় আর কাপ্তাই লেকের বিশাল স্থির পানির রাশিই যেন রাঙামাটিকে সৌন্দর্য্যের স্বর্গে পরিণত করেছে। মনে হয় যেন পাহাড় ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে সেই বিশাল জলরাশি। রাঙামাটির দিকে যতই অগ্রসর হচ্ছিলাম ততই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল, কাপ্তাই লেকের পাশ ঘেঁষে থাকা পাহাড় আর সবুজের সমারোহে নিজস্ব স্বকীয়তায় গড়ে উঠা এই রাঙামাটি শহরটাকে দেখে। খুবই ছোট আর ছিমছাম এই শহরটি। দুপুরেই সেখানে পৌঁছে যাই এবং দুপুরের খাবার খেয়েই লঞ্চে গিয়ে উঠি মহালছড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। লঞ্চে চরে যখন যাচ্ছিলাম, লেকের দুই ধারে সবুজ গাছ গাছালিতে ভরা। যেন পানির রঙ্গে আঁকা জীবন্ত ছবি। সেই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে মহালছড়িতে গিয়ে পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে আসলো। সেখানে গিয়ে গোছল, খাওয়া-দাওয়া আর গল্পগুজব করেই রাতের আঁধার নেমে এলো। চাচাতো ভাই-বোনদের সাথে সেই অন্ধকারেই ছাদে গিয়ে গল্প করছিলাম। সেকি গা ছমছম করা রাত!! পাহাড়গুলো অন্ধকারে মনে হচ্ছিল ভুতুরে মত। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল আর বলছিল, আমি নাকি ভয় পাচ্ছি। পরের দিন সকালে নাস্তা শেষে, ঘুরে বেড়ানো হলো আমার বড় কাকার বাসার আসে-পাশে এবং গিয়েছিলাম বাসার পিছনে আঁকা-বাঁকা হয়ে একটি সরু পথ নিচে নেমে গিয়েছে পাহাড়ের গোড়ায়, সেখানেও একটি বিরাট লেইক আছে, তাই ওখানে একটা ঘাটও বাধা আছে সেখানেও। দেখা হলো ছোট্র মহালছড়ি শহরটাও। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা আবারও লঞ্চেই রওয়ানা দিলাম খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে।
এঁকে-বেঁকে যাওয়া লেকের দুইধারে সবুজের সমারোহ দেখে দেখে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে বন্য পশু-পাখিগুলোকেও দেখছিলাম। বিকেল হয়ে সন্ধ্যাও গড়াচ্ছিল, তাই মন কাড়া সূর্যাস্তটাও দেখেছিলাম। ব্যস্ত শহরের প্রবেশ পথটির দু’পাশে সবুজের বাঁকে-বাঁকে উঁচু-নিঁচু, আঁকা-বাঁকা কি সুন্দর পথ। সেখান থেকে গাড়ি দিয়ে বাসায় এসে পৌঁছুলাম। উঁচু পাহাড়ের উপর অফিসের পাশে আমাদের বাসা। আগের থেকেই বলা ছিল বলে, অফিসের পিওন খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। খাবার খেয়ে বাসার বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখি, অন্ধকারে সমস্ত ছেঁয়ে গিয়েছে এবং শহরের সমস্ত লাইটগুলো জোনাকির মত যেন মিটমিট করে জ্বলছে। সাথে জোনাকি গুলোর আলো, এই সব মিলিয়ে কিযে অপূর্ব লাগছিল ঠিকই। কিন্তু বাসার সামনে-পিছনের গভীর জঙ্গল, তারউপর ঝিঝি পোকার শব্দ আর শিয়ালের ডাকে, সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকারে সত্যি ভীষণ ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন রাতের ঘন আঁধারের রাজ্য এটি। আমার আব্বু তখন আমাকে বলল, "ভয় পাসনে, সকালে উঠেই সামনের বড় বড় গাছ গুলো রেখে জঙ্গলটা কেঁটে দেবো, তাহলেই তোর আর ভয় লাগবে না এত।"
পিয়নটা তখন বলছিল, "এই জঙ্গলে নাকি হরিণও আছে, রাতের বেলায় ওরা বাসার আসে-পাশেই ঘুরা-ফেরা করে।"
সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতে বেশ রঙের মেলা চলতো। আর চাঁদনী রাত হলেই আমার আব্বু, বারান্দায় বসে গল্প করত বসে যেতেন। পাহাড় ঘেরা এ প্রকৃতিতে বসে চাঁদনী রাতের দৃশ্যপট সত্যিই ভিন্ন মাত্রা এনে দিত। এই পাহাড় চূঁড়ায় বসে দূর পাহাড়ের বুক চিরে সকালের মিষ্টি সূর্যোদয়, সন্ধ্যায় সব আলোকে ম্লান করে সূর্য্যাস্তের দৃশ্য সত্যি অপরূপ। একটা সময় দেখা গেল, ভয় সব কাঁটিয়ে খাগড়াছড়ির প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম আমি, যা নাকি আজও আমি ভুলতে পারি না।
একদিন হঠাৎ আমার আব্বু খুব খুশি হয়ে এসে বলল, "ডিসি অফিস থেকে আজ ফোন এসেছে, ওরা বলেছে আগামী সপ্তাহে, খাগড়াছড়িতে প্রতিটা ডিপার্টমেন্ট-এ বা অফিসেই আলাদা আলাদা করে নাকি আলোকসজ্জা হবে প্রতিযোগিতার মত। এবং যার আলোকসজ্জা সুন্দর হবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে। আর এটা এখন থেকে প্রতি বছরই একই সময়ে একবার করে হবে।"
তার কিছুক্ষণ পরই অফিসের সব স্টাফরা চলে আসে আমাদের বাসায়, আমার আব্বুর সাথে আলোচনা করার জন্য যে, কিভাবে এই অফিসটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে আলোকিত করা যায়। আমাদের বাসা এবং অফিসের মাঝে একটা বিরাট বড় টাওয়ার ছিল। তাই কেউ কেউ বলছে, সেই টাওয়ারটাকেই শুধু সাজালেই হবে। আবার কেউ কেউ বলছে, অফিস এবং টাওয়ার সবটাই সাজাবে। কেউ রঙিন লাইট কিনে নিয়ে আসলো, কেউ টাওয়ার সাজালো, কেউ অফিস সাজালো, এমন কি সমস্ত অফিসটাও সাজানো হলো। ঠিক এমনি করেই প্রতিটা অফিসেই প্রতিযোগিতামূলক সাজানো হলো। সন্ধ্যার পর সবাই আলো জ্বালিয়ে দিল, তখন কিযে অপূর্ব লাগছি, সমস্ত শহর শত রঙে রঞ্জিত হয়ে আলোকিত হয়ে উঠলো। রাতের ঘন অন্ধকারের গভীরতা তখন কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে দেখছিল তখন শহরের অপুরূপ ওই রূপটাকে।
পরের দিন সকালে অফিসের স্টাফদের সবার হইচই শুনে, আমি আর আমার আম্মু বাসার বারান্দায় দৌড়ে যাই। আমার আব্বু এসে তখন বললেন, "ডিসি অফিস থেকে ফোন করেছিল, ওরা বলেছে আমরাই প্রথম হয়েছি, ওরা কিছুক্ষণ পর প্রাইজটা নিয়ে আসবে।"
তারপর প্রাইজ পেলো, অফিসেও অনেক আনন্দ হলো। পড়ে আমার আব্বু প্রাইজ নিয়ে বাসায় এসে বললেন, "এই হলো আমাদের প্রথম প্রাইজ।"
আমি তখন বললাম, "আব্বু, এত্ত কিছু করে শুধু একটা টেবিল লেম্প, তাও আবার প্রথম প্রাইজ হলো এটা?!!"
আমার আব্বু তখন আমাকে বললেন, "বাবা, কিযে বলে না আমার মেয়েটা!! যেমনি হোক প্রাইজ তো প্রাইজই।"
তারপর থেকে প্রতি বছরই ওখানে আলোকসজ্জা হত এবং আমার আব্বুর অফিসই অর্থাৎ টিএনটি অফিসই সব সময় প্রথম হত। আমরা যতদিন ওখানে ছিলাম, ততদিনই ওই আলোকসজ্জাটা হয়েছিল, এখনো হয় কিনা জানিনা। তবে এখনো মনে পড়ে, এখনো ভুলি নাই, সেই আলোকসজ্জা কিংবা সেই ছমছম করা রাতের কথা। হয়তো কোনো দিন ভুলবোও না।