ছোট্ট একটি মেয়ে সাহারা সিদ্দিকা তাসনিম। আমরা তাকে তাসনিম বলেই ডাকি। স্বভাবে শান্ত, শিষ্ট। কিন্তু সে আমার সাথে অনেক রাত জেগে থাকে। আমি যতক্ষণ না ঘুমাই, সে ঘুমুবে না। তার বয়স মাত্র ৫ বছর। সবেমাত্র তার মায়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। আমি প্রায়ই লক্ষ্য করি সে তার সমবয়সী অন্য শিশুদের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রম। এই বয়সেই সে এমনসব কাজ- করে ফেলে যা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।
ওর মা ঘুমিয়ে পড়ে রাত এগারটার দিকে। আমি সারাদিন কর্মস্থলে খাটুনির পর রাত দশটায় বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে বসে পড়ি বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো দেখতে। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর ভালো শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, টক শো ইত্যাদি দেখে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করি। চ্যানেল ওয়ান, ইটিভি, চ্যানেল আই, এনটিভি ইত্যাদি একটার পর একটা দেখতে থাকি। তাসনিম কিন্তু ঘুমায় না।
আমি তাকে বলি, ‘তাসনিম তুমি ঘুমাও।’ সে বলে, ‘তুমি ঘুমালে আমি ঘুমাব।’
সেদিন আমি এমনই একটি টকশো মন দিয়ে দেখছিলাম। তাসনিম আমার পাশে বিছানায় উপুড় শুয়ে দুই গালে হাত দিয়ে নিরবে টকশোতে অংশগ্রহণকৃত অতিথিগণের কথাবার্তা শুনছে। এক সময় আমার আর উক্ত অনুষ্ঠানটি ভালো না লাগায় আমি চ্যানেল পাল্টালাম। কিন্তু তাসনিম বিরক্ত হলো। বললো, ‘আব্বু তুমি কিন্তু ভালো করছে না। আমি দেখছি।’
‘কী দেখছো বাবা।’
‘ওই যে লোকটা কী সুন্দরভাবে কথা বলছে।’
আমি অবাক হলাম। তাসনিম যে লোকটার কথা বলছে সে একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি। এ বয়সেই সে জ্ঞানী মানুষদের দেখা ও তাদের কথাবার্তা শোনার প্রতি আগ্রহবোধ করছে; এটা খুব ভালো লক্ষণ। আসলে দায়িত্বশীল বাবা-মায়ের কর্তব্য এই যে, শিশুদেরকে ছোটকাল থেকেই জ্ঞানী-গুণী ভালো মানুষ, সমাজ-পরিবেশ, ন্যায়-অন্যায় অর্থাৎ ভালো সবকিছুর প্রতি দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়া। ফলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই ভালো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং সমাজে সে ভালো কিছু সৃষ্টি করতে পারবে।
আমি তড়িৎগতিতে আবার চ্যানেল ওয়ানে ফিরে এলাম। কিন্তু ততক্ষণে উক্ত চ্যানেলের টকশোটি শেষ হয়ে গেছে। আমি চ্যানেল পাল্টিয়ে চলে এলাম স্টার মুভিজে। তাসনিমের এই চ্যানেলটি খুব প্রিয়। কারণ এই চ্যানেলটি সব বয়সীদের জন্যেই মুভি প্রদর্শন করে থাকে। বেশিরভাগ মুভিতেই থাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার। আজকে যে ছবিটি প্রদর্শন করেছে তার নাম, `The Mummy Returns '। ছবিটিতে অ্যাডভেঞ্চার রয়েছে, সেই সাথে আছে প্রাচীন ও ভবিষ্যতের নানা প্রযুক্তির ব্যবহার। তাসনিম এই ছবিটি খুব পছন্দ করে। কারণ, এই ছবিটিতে ১০/১১ বছর বয়েসী একটি কিশোর চরিত্র আছে; যে কি না বাবা-মায়ের জন্যে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। তাসনিম নিঃশব্দে গভীর আগ্রহভরে ছবিটি দেখছে।
এক পর্যায়ে সে উক্ত ছবিতে একটি দৈত্যমতো চরিত্র দেখে প্রশ্ন করলো, ‘বাবা এটা কী ভূত?’
আমি বললাম, ‘না বাবা। এটা রোবট।’
‘রোবট কী মানুষকে মেরে ফেলে?’
‘না, মেরে ফেলবে কেন? রোবট তো মানুষেরই সৃষ্টি। রোবট দিয়ে মানুষ নিজে যা করতে পারে না, সেসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করিয়ে নেয়। বড় হয়ে তুমি বইতে এগুলো পড়তে পারবে।’
‘বাবা, সেদিন তো মা বলেছিলো এগুলো ভূত। তুমি কেন বললে রোবট? প্রশ্ন করলো তাসনিম।
‘ভূত বলে পৃথিবীতে কোনো কিছু নেই। এগুলো আমাদের মনের কল্পনা। আর রোবট হচ্ছে মানুষের তৈরি, এগুলো বাস্তব। তোমার মা তোমাকে ভূতের ভয় দেখিয়ে বেশি বেশি খাওয়াতে চাচ্ছে। তাই রোবটকে ভূত বলেছে।’
‘সত্যি! বাবা জান, সেদিন না মা বলেছে আমি যদি বেশি করে না খাই তাহলে তেলাপোকা আমাকে কামড়িয়ে দেবে।’
আমি হাসলাম। তাসনিম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আমি উঠে একটি তেলাপোকা ধরে নিয়ে এলাম। তারপর তাকে বললাম, ‘তুমিও ধর।’ প্রথমে তাসনিম ধরতে অনীহা প্রকাশ করলো। কিন্তু পরে ভয় না পেয়ে তেলাপোকার একটি শুড় ধরলো। তেলাপোকাটি ভয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে পগার পার। তাসমিন উচ্চশ্বরে হেসে উঠে বললো, ‘তেলাপোকা আমাকে ভয় পেয়েছে।’
আমি বললাম, ‘দেখছো তেলাপোকা তোমাকে ভয় পায়। আজ থেকে তুমি তেলাপোকা, ভূত ইত্যাদিকে ভয় পাবে না, বুঝলে? এগুলোকে ভয় পাবার কিছুই নেই।’
‘বাবা তুমি কত ভালো। আম্মুটা ভালো না।’
‘তোমার আম্মুও ভালো। তোমাকে বেশি ভালোবাসে তো। তাই তোমাকে তেলাপোকা, ভূত এগুলোর ভয় দেখিয়ে বেশি বেশি খাওয়াতে চাচ্ছে। তুমি ভয় না পেয়ে যদি ঠিক মতো খানা খাও তাহলে আর বলবে না।’
তাসনিম বললো, বাবা জান, আজ না পাশের বাসার ছোটন সহ আমরা মাঠে গিয়ে ফড়িং ধরছিলাম। ছোটন কয়েকটি ফড়িং ধরে ওদের পাখাগুলো ভেঙ্গে দিয়েছে। ওরা আর উড়ে যেতে পারেনি।’
‘তোমরা একাই গিয়েছিলে?’
‘না, আম্মুসহ গিয়েছিলাম।’
‘তারপর’।
‘আমি ছোটনের সাথে রাগ করেছি।’
‘কেন?’
‘আমার না ফড়িংগুলোর জন্যে খুব মায়া হয়। কেউ যদি আমাদের হাতগুলো ভেঙ্গে দিতো তাহলে কেমন হতো? আমরা কিছুই খেতে পারতাম না। ছোটন ফড়িংগুলোর পাখা ভেঙ্গে দিয়েছে। ফড়িংগুলো আর উড়তে পারে না।’ তাসনিম কেঁদে ফেলল।
আমি তাসনিমকে বুকে টেনে নিলাম। বললাম, ‘আমি ছোটনকে বকে দেব। বলব যেন ও আর এমন না করে। কী হলো তো?’
তাসনিম উৎফুল্ল হলো। আমি তার চোখের অশ্রুকণাগুলো মুছে দিলাম। আমি ভাবতে লাগলাম। আমরা সমাজে বাস করি। কিন্তু সমাজের মানুষের একে অপরের মধ্যে ভালোবাসা খুব কমই বিদ্যমান থাকে। ফলে একজন অন্যজনের সাথে কলহ, বিবাদে জড়িয়ে পড়ে একে অপরের ক্ষতি করে থাকি। কিন্তু মানুষ যদি অপর মানুষের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হতো তাহলে কতই না ভালো হতো। যেমনটা তাসনিমের বেলায় ঘটেছে। তাসনিম শুধুমাত্র একটা ফড়িং এর কষ্ট-যাতনা সহ্য করতে পারে না। সে সামান্য একটা ফড়িং এর কষ্টের কথা বিবেচনা করে চোখের পানি ফেলেছে। অথচ আমরা মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে কতই না কষ্ট দেই।
শিক্ষণীয় ঃ ছোট হোক বা যে কোনো প্রাণীই হোক অনর্থক কাউকে কষ্ট দিতে নেই।
০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪