রাজারাম জীবনে বহু ব্যবসা করেছে. কিন্তু কোনো ব্যবসাতেই থিতু হতে পারেনি.ইদানিং সে একটা নতুন ব্যবসা ফেন্দেছে.রাজারামের কথায় বলতে হয় 'মন্দ হছেনা'.ব্যবসাতা হলো কেনাবেচার ব্যবসা.সে বর্ধমান ,কলকাতা,প্রভৃতি শহর ও বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে পুরনো জিনিস কিনে আনে এবং ভালো খদ্দের দেখে বেচে দেয় ও লাভ করে.
তার নিজের পুরনো দিনের বিরাট বাড়ি ও উঠোন.তাই কোথাও পুরনো বাড়ি ভাঙা হলে তার কড়ি,বরগা,জানালা,দরজা কিনে এনে ওই উঠোনে রাখা যায়.আবার উপরে যে বড় হলঘর আছে,সেখানে পুরনো আলমারি,টেবিল,চেয়ার,খাট ইত্যাদি রেখে দেয়.
বর্ধমান রাজবাড়িতে পুরনো ঘর ভাঙা হলে বা পরে গেলে রাজারাম আগে ছুটে যায়.কর্মচারীদের সঙ্গে দোস্তি গড়ে ওঠায় সব জিনিস নিলামে ওঠার আগে কম দামেই পেয়ে যায়.এছাড়া বড় বড় মেহগিনি গাছের দল ভাঙলে,রাতারাতি রাজারাম ছুটে যায় ডাল সরিয়ে রাস্তার অবরোধ তুলতে.যেহেতু এইসব আপদে বিপদে রাজারাম ছুটে আসে,তাই কম দামে জিনিস পায়.আর সেই দামী দামী কাঠ জিনিসপত্র বেচে আয়ও অনেক ভালো.
গতবছরতো খন্নানের রাজবাড়ি থেকে একটা সেগুন কাঠের আলমারি আর একটা মেহগিনির খাট কিনে এনে খসবাগানের এক ডাক্তার গিন্নিকে বেচে সে নগদ কুড়ি হাজার টাকা লাভ করে ছিল.
রাজারাম কাল রাত থেকেই গিন্নিকে বলে রেখেছে যে,সকালে নাস্তা করেই সে কলকাতা বেরিয়ে যাবে.সেইমত সে ব্যাঙ্ক থেকে টাকাও তুলে রেখেছে.আজ রবিবার নিলাম হচ্ছে কলকাতার বড়বাজারের একটা বহু পুরনো বাড়িতে.বাড়িটি নাকি ইংরেজ আমলের দুঁদে অফিসার ডিউক সাহেবের বাড়ি.দশ কাঠা জমির ওপর বাড়ি.সেই বাড়ির কড়ি-বরগা-দরজা -জানালা শুধু নয়,ঘরের সব জিনিসই নিলাম হবে.তাই আজ তাড়াতারি রাজারামকে হাজির হতে হবে.
খুব ভোরে উঠে প্রাতকৃত্য সেরে,স্নান করে রাজারাম নাস্তা করে.বেরিয়ে যাবার সময় গিন্নি গীতাকে বলে,আজ কাজের লোক ভজাকে দিয়ে উঠোনে রাখা মালপত্রগুলো একটু সরিয়ে,নড়িয়ে যেন রাখা হয়.কারণ রাত্রে এখানে অনেক মাল ঢুকবে.
সকাল ছটার কড লাইন ধরে বর্ধমান থেকে হাওড়ার ট্রেনে চেপে বসলো রাজারাম.ট্রেন থেকে নেমেই বাস ধরে হন্তদন্ত হয়ে ডিউক সাহেবের বাড়িতে পৌঁছলো.সকাল দশটা থেকে নিলাম হাঁকা শুরু হবে.
বাড়িতে গিয়ে রাজারাম দেখল জন কুড়ি ক্রেতা সেখানে হাজির.যেহেতু বাড়িটা অনেক বড়,তাই ভাগে ভাগে জিনিস নিলাম করা হবে.প্রথমেই একতলা বাড়ির কড়ি-বরগা,দরজা-জানালার দর হাঁকা হলো.প্রথম থেকেই যে দর হাঁকা হলো,রাজারাম বুঝলো মুরদে কুলোবেনা,তাই সে চুপ করে রইলো.ক্রমে ক্রমে দোতলা ও তিনতলারও সব জিনিস বিক্রি হে গেল.রাজারাম এবারও চুপ করে রইলো.মনে মনে অবশ্য কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল. কারণ যেসব ক্রেতারা এসেছে তাদের অনেকের সঙ্গেই তার চেনা জানা আছে.কারণ এরা সবাই নিলাম পার্টি.
এবার ঠিক হলো প্রতিটি তলার আসবাব বিক্রি হবে.কিন্তু প্রতিটি তলায় প্রায় চল্লিশটি করে ঘর.আর সেইসব ঘরে প্রচুর জিনিস.একজনের পক্ষে এত টাকার জিনিস কেনা সম্ভব নয়.তাই ঠিক হলো এক একটি ঘরের জিনিস বিক্রি হবে.অফিসঘর,বৈঠকখানাঘর,নাচঘর,খেলারঘর প্রভৃতি ঘরের জিনিস প্রচুর টাকায় বিক্রি হয়ে গেল.অবশেষে চাকর-বাকরের সংগ্রহশালার এক লক্ষ টাকা দাম হাঁকা হলো.কেউ আর দাম বাড়ালোনা.রাজারাম দেখল সেখানেও যেসব আসবাব আছে,তার দাম ভালই হবে.সব চেয়ে বড় কথা হলো রাজারাম এখান থেকে খালি হাতে ফিরে গেলে বিরাট সম্মানহানি হবে.ভবিষ্যতে অন্যকোন নিলামে হাজির হলে এরা সবে রাজারামকে নেহাত খেলো বলে ভাববে.তাই আর কোনো খদ্দের না থাকায় রাজারাম ওই সংগ্রহশালার জিনিস ই কিনে ফেললো.
কেনার পর লরি বোঝাই করে রাজারাম সন্ধেবেলায় তার নবাবহাটের বাড়িতে এসে পৌঁছলো.খাট,আলমারি,তক্তপোশ,সোফা,পানের পিরিচ,পাথরেরগ্লাস,ঝাড়বাতি এমনকি অনেক পুরনো দিনের কাঁসা পেতলের বাসনও পেল রাজারাম.বাড়িতে এসে ভজাকে সঙ্গে নিয়ে সবজিনিস হলঘরে সাজিয়ে রাখল.ঐসব জিনিস সাজিয়ে রাখার পর তার চোখে কারুকার্য করা একটা পেতলের ড্রাম.রাজারাম দেখল তালালাগানো পেতলের ড্রামটা বেশ ভারী.রাজামের খুব কৌতুহল হলো.এর ভেতরে যদি সোনাদানা থেকে থাকে.ভজা ও খুব উত্সাহী ছিল.যদিও এসব গোছাতে রাত এগারোটা বেজে গেছিল.তবুও ভজা বলল বাবু চাবিটা ভেঙ্গে দেখুন ই না.কি আছে প ড্রামে.স্ক্রুড্রাইভার এনে রাজারাম চাবিটা খুলে ফেললো.ড্রামের ঢাকা খুলে রাজারাম হতবাক.পাঁচ পাঁচটা মাথার খুলি.দেখে বোঝা গেল এককালে ওই খুলি গুলিতে তেল সিন্দুর মাখানো হত.রাজারাম ভিতু নয়.কিন্তু এতগুলি মাথার খুলি তার ঘর থেকে পাওয়া গেলে হাজতবাসের ভয়তো আছে.রাজারামের মুখের কথায় তো কেউ বিশ্বাস করবেনা যে রাজারাম ঐ মরার খুলি নিলামের মালের সঙ্গে ফ্রি পেয়েছে.তাই রাজারাম সেই খুলিগুলো যেমন ছিল রেখে ড্রামের ঢাকা বন্ধ করে নতুন একটা তালা মেরে দিলে.সারাদিন খাটাখাটনি খুব হয়েছে.তাই রাজারাম খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল.
যে হলঘরে নিলামের পুরনো জিনিস রাখত,তার পাশেই ছিল তার শোবার ঘর.মাঝরাতে হঠাত রাজারাম শুনতে পেল কারা যেন জোরে জোরে কথা বলছে.সে উঠে গেল কিন্তু টর্চটা কিছুতেই খুঁজে পেলনা.হাতড়ে হাতড়ে লাইট জালাতে গেল.কিন্তু সেই আগন্তুকরা তাকে বলল দাদা লাইট জ্বালাবার চেষ্টা করোনা.আমরা অন্ধকারের জীব.রাজারাম বলল তোমরা কারা?আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা.আগন্তুকরা বলল,তুমিতো খুব মজার লোক মাইরি.পয়সা দিয়ে আমাদের কিনে গাড়ি ভাড়া করে চাপিয়ে নিয়ে এসে তোমার হলঘরে তুললে.আর এখন জিগ্গেস করছ তোমরা কারা?
রাজারাম বুঝলো কেসটা গড়বর.কাজটা ঐ মড়ার খুলিগুলোর ই হতে পারে.তাই সে বলল,দেখো আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলো তোমরা কে?আমার কাছে কি চাও?
রাজারাম অন্ধকারে স্পষ্ট দেখল,সারা হলঘরময় সেই পাঁচটা মাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে.তাদের চোখ থেকে একটা আশ্চর্য রেখা বেরোচ্ছে.যেটা আলো নয়,কিন্তু তাদের উপস্থিতি স্পষ্ট করে দিচ্ছে.তাদের মধ্যে একজন খোনা খোনা গলায় বলল,আমরা সবাই ডিউক সাহেবের কর্মচারী ছিলাম.পান থেকে চুন খসলেই ডিউক সাহেব কর্মচারীদের গুলি করে মারতেন.আর সেইসব লাশ বাগান বাড়িতে কবর দিতেন.কিছুদিন পর কঙ্কালগুলো বেচে দিতেন.আর খুলিগুলো সাজিয়ে রাখতেন তার খাবার ঘরের প্রস্বস্ত টেবিলে.সেইখান থেকে আমাদের কর্মচারী বন্ধুরা আমাদের চুরি করে এনে রেখেছিল ওদের ঘরে.আসলে ওরা আমাদের খুব ভালো বন্ধু ছিল.আর আমাদের রাঁধুনি মাসি আমাদের নিজের ছেলের মত ভালবাসত বলে তেল সিন্দুর দিয়ে রোজ সকালে আমাদের সাজিয়ে দিত আর ঐ ড্রামে ভরে রেখে দিত.মাসির তো যথেষ্ট ভয় ছিল.যদি ডিউক সাহেব দেখতে পেত তাহলে মাসিরও ঐ দশা করত.তারপর ডিউক সাহেব চলে গেলেন বাড়ি বেচে.ঐ বাড়ি অনেকজন কিনেছে,কিন্তু কেউ বাঁচেনি.তাই আমরা ঐ ঘরেই বন্দী ছিলাম.আজকে তুমি ই আমাদের মুক্ত করলে.তাই আমরা তোমার ওপর খুব প্রীত হয়েছি.আমরা দুঁদে ইংরেজ সাহেবের কর্মচারী বলে আমাদের ক্ষমতাও অসীম.তাই আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই.
রাজরান বলল,বলো তোমরা আমাকে কি সাহায্য করতে পারো?আগন্তুকরা বলল আমরা প্রতিষ্ঠা চাই.রাজারাম বলল এটা কিভাবে সম্ভব?তারা বলল দিঘির পারে তোমার যে চাষের জমি আছে,ওখানে একটা চালা করে আমাদের প্রতিষ্ঠা কর.তুমি রোজ তেল সিন্দুর মাখিয়ে আমাদের জাগাবে.আর আমরা তোমাকে অলৌকিক ক্ষমতা দান করবো.তুমি ঐ আসনে বসে সবার ভবিষ্যত বলে দিতে পারবে.আর এর ফলে তোমার প্রচুর অর্থাগম হবে.
রাজারাম আগন্তুকদের কথামতো চালা বানিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠা করলো.প্রচুর ভক্ত সমাগমের ফলে বত্সরান্তে সেখানে বিরাট মন্দির তৈরী হলো.রাজারাম এখন মন্দিরের সেবক,জনগনের ভবিষ্যত বক্তা.নিলামের বেচাকেনার পথে রাজারামকে আর হাঁটতে হয়নি.
২৫ জানুয়ারী - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
১২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪