আজকের শিকার ধরতে পারলে এটা হবে আমার তেরোতম খুন। তেরো - প্রাইম নাম্বার , আনলাকি নাম্বার। মাথার ভেতরের মি. মুর বলছে, 'সাবধান! খুব সাবধান!'
প্রতি খুনের আগেই আমার প্রবল আনন্দ হয়। প্রতি রক্ত কনিকা যেন এই আনন্দের জন্য মুখিয়ে থাকে। আমার হাতের তালু শুধু ঘামতে থাকে। আমাকে দেখলে কি বোঝা যায় আমি কি করতে যাচ্ছি? নাহ , মোটেই না। আমার গায়ে ডিজাইনার শার্ট , দামী পারফিউম। লাল রঙের ফোর্ড এসকর্টে আমাকে দেখলে এই মুহুর্তে কেউ ভাবতেও পারবে না আমি আসলে কি করতে যাচ্ছি।
খুন করার পরিকল্পনা থেকেই আনন্দের শুরু। মি. মুর আমাকে সব বুঝিয়ে দেয়। প্রথমেই মাথার ভেতর একটা কথাই বলতে থাকে, 'এখন আরেকটা শিকার চাই।' তারপর প্রতিটা খুটিনাটি প্ল্যান। কিভাবে টার্গেট করতে হবে, কিভাবে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে গাড়িতে নিয়ে আসতে হবে, তারপর কিভাবে শেষ করতে হবে - সব মি. মুর দারুন গুছিয়ে বলে দেয়।
এখন রাত নয়টা পনের। অক্টোবর মাসের শেষ প্রায়, বেশ ঠান্ডা পরেছে। রাস্তায় হালকা কুয়াশা। আকাশের চাদটাও মেঘে ঢাকা। কেমন সুন্দর রাত! আমার খুব ভালো লাগতে থাকে। শীষ দিয়ে একটা গান তোলার চেষ্টা করি।
মেয়েটাকে কয়েকদিন থেকেই দেখছি। গতকাল ভালই খাতির হয়েছে। ডেসিল স্ট্রিটের শেষ মাথায় ক্লাব লুকাসের পেছনে মেয়ে গুলো সাড় বেধে দাড়িয়ে থাকে। মুখে উগ্র রঙিন সাজ , সস্তা পারফিউম মেখে ভাবে কত না সুন্দর লাগছে তাদের। গাড়ি নিয়ে কোনো খদ্দের আসলেই এগিয়ে যায়, মন ভোলানো কথা বলে। দরদাম মিলে গেলে গাড়িতে উঠে যায় ঝটপট। কুত্তার বাচ্চা একেকটা!
দেখলে আমার ঘেন্না হয়। ইচ্ছা করে ধরে সবগুলোর গলা চিপে ধরি। শুধু ওদের ঘেন্না লাগে, তা না। আমার ঘেন্না লাগে সব মেয়েমানুষকে। শয়তানের ছায়া একেকটা। যেমনটা ছিল আমার সৎ মা, জোয়েনা। মহিলা আমাকে সহ্য করতে পারত না। বাপটা তো নেশা করে কোথায় পড়ে থাকতো , ডাইনিটা সেই রাগই হয়ত ঝাড়তো আমার উপর । অকত্থ্য খিস্তি , চড় , লাথি সব চলত আমার উপর। কখনো কখনো আমাকে একা ঘরে ফেলে ক্লাবে মদ খেয়ে পরে থাকত। আবার মাঝে মাঝে শয়তানটা অন্য পুরুষ মানুষ নিয়ে আসত , ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখত কখনো, কখনো খোলাই থাকত, যেনো আমার উপস্থিতিতে কিছুই যায় আসেনা।
আমার দাদী আমাকে দশ বছর বয়সে তার কাছে নিয়ে গেলেন। আমার সারা গায়ে তখন কালসিটা , বয়সের তুলনায় শরীর বাড়েনি। প্রতি বুধবার বাবার কাছে আসতে হতো। আমার বয়স যখন ষোলো, এক বুধবার মি. মুর প্রথমবারের মত আমার ভেতর কথা বলে উঠলো।
বাবা বাসায় ছিলো না। জোয়েনা বরাবরের মতই চিত্কার করছিলো, বাগানের ঘাস বড় হয়ে গেছে, আমি কেন কেটে দিচ্ছি না। মি. মুর বলল, 'বন্ধ করে দে এই কুত্তির মুখ, শেষ করে দে'।
প্রথমে বুঝিনি কে কথা বলে। কিন্তু এত স্পষ্ট, এত প্রকট নির্দেশ, কেমন করে উপেক্ষা করব? যেন আমি না, আমার ভেতর আমাকে দিয়ে কেউ কিছু একটা করিয়ে নিতে চায়। আমি সেল্ফ থেকে ধারালো ছুরিটা তুলে নিলাম, শরীরের সব শক্তি এক করে পেছন থেকে বিধিয়ে দিলাম ওই ডাইনির পিঠে। কি দারুন উচ্ছাস তখন আমার আর মি. মুরের। আমি থামিনি, একেরপর এক আঘাত করেছি, তাজা রক্তের কি দারুন সুবাস!
আমাকে কেউ সন্দেহ করেনি। মি. মুর বলে দিয়েছে কিভাবে বের হয়ে আসতে হবে ওই বাড়ি থেকে, কিভাবে মুছে ফেলতে হবে খুনের সব নিশান।
রক্তের নেশা আমার সেখান থেকেই। কালিফোর্নিয়া থেকে আমি ওয়াশিংটন চলে এসেছি, এই খেলা এক জায়গায় বেশিদিন খেলা বিপদজনক। আগের জায়গায় বারোটা মাগীকে শেষ করেছি, আজকে তের নাম্বার।
মেয়েটার নাম ম্যারি। বয়স আঠারো ঊনিশ হবে। মাত্র একমাস হয়েছে এই ধান্দায় এসেছে। তার বাড়ি মিনেসোটার ছোট এক গ্রামে। বড় শহরে বড় খদ্দের ধরতে এসেছে ওয়াশিংটনে। নরকের কিট কোথাকার। এই শহরে ম্যারিকে তেমন কেউ চেনে না, ওর তেমন কোনো বন্ধু নেই। হটাত একটা বেশ্যা মেয়ে হওয়া হয়ে গেলে কারো কিছু যায় আসে না। কেউ খুজতে আসবে না একটা জঘন্য মেয়েকে।
আমার প্রবল ঘৃনা উপচে উঠে। কিন্তু মুখ দেখে সেটা যেন বোঝা না যায়। নিজেকে সামলাই আমি।
গাড়ি নিয়ে ম্যারির পাশে যাই। সোনালী স্বচ্ছ টপ আর কালো লেদারের আটসাট স্কার্ট পরে আছে ম্যারি।
'কি ব্যপার মিস্টার? আমাকে ভুলতে পারছ না? আজকেও এসেছ?' তরল গলায় বলে ম্যারি।
'কি করব, তোমার মত সেক্সি মেয়ে আগে দেখিনি' পা থেকে মাথা পর্যন্ত ম্যারিকে দেখি।
মেয়েটা কোমর বাকিয়ে হাসে, চুল ঠিক করে। ম্যারির চুল বেশ লম্বা। এটা আমার জন্য ভালো, মেয়েদের লম্বা চুল পেচিয়ে ধরে খুন করতে দারুন সুবিধা।
'তোমাকেও আমি ভুলতে পারছি না হানী। আজকে কোথায় নেবে আমাকে?'
'আজকে আমার বাড়িতে চলো, তোমাকে আজকে বিশ ডলার বেশি দেব।'
ম্যারি আমার গাড়িতে উঠে পড়ে। গতকাল ওকে নিয়ে মোটেলে গিয়েছিলাম। সব কিছু মি. মুরের পরিকল্পনা। মেয়েটা নতুন এসেছে এই পেশায়, প্রথম দিকে মেয়েগুলো সাবধান থাকে খুব। তাই কোনো রিস্ক নেয়া যাবে না। প্রথমে তার বিশ্বাস পেতে হবে।
'কি? কেমন লাগছে? একশনের জন্য তৈরী তো?’ মি মুর ফিসফিস করে বলে আমার মাথার ভেতর।
আমি সীমাহীন আনন্দে মাতাল হতে থাকি।
'গ্যারি, এত চুপ করে আছো কেন? এত সুন্দর একটা মেয়ে তোমার পাশে বসে আছে আর তুমি তার সাথে কথাও বলছ না।'
'কথা বলব, অনেক কথা বলব তোমার সাথে।'
ম্যারি আমার কানের কাছে ঠোট এনে নিচু স্বরে কি যেন বলে, উত্তেজক কিছু হবে। আমার কানে ঢোকে না সেসব। আমার ভেতর মি. মুর শুধু বলে ' আর কিছুক্ষণ , আর মাত্র কিছুক্ষণ।'
ম্যারিকে নিয়ে আমার বেডরুমে যাচ্ছি। প্রথমে তাকে ভোগ করব, তারপর......
ম্যারি ডলার গুলো গুনে নিচ্ছে । অনেকগুলো নোট, আজকের আয় বেশ ভালো। বেশ খুশি খুশি লাগছে ম্যারিকে।
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছি, আমার হাতে একটা দড়ি। নিঃশব্দ শিকারীর মত এগিয়ে যাই। মি. মুর ফিস ফিস করে বলে,' সাবধান, কোনো শব্দ না। পেছন থেকে গিয়ে দড়িটা গলায় পেচিয়ে ধরবে। তারপর শক্ত করে চাপ দিতে থাকবে । মেয়েটা হাত দিয়ে দড়ি ধরে টানতে থাকবে, পা দিয়ে লাথি মারতে থাকবে। কিন্তু তুমি পেছনে থাকবে, তাই তোমার কিছুই করতে পারবে না। মেয়েটার ক্ষীন অপুষ্ট শরীরে তেমন শক্তি নেই। মাত্র আঠারো বছর বয়স, কিচ্ছু করতে পারবে না। মারার পরে শরীরটা রেখে আসতে হবে গ্রীন নদীর পাশে জঙ্গলে। ওখানে কেউ যায় না, কেউ জানবে না। মেয়েটার হালকা শরীর তুলে নিতে মোটেই কষ্ট হবে না। এগিয়ে যাও। '
আমি এগুতে থাকি। তাজা রক্তের সুবাস পাই।
---------------------------------------------------------------------------
(দশ বছর পর)
আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা। অনেক মানুষ কথা বলে। আমি মি. মুরকে খুজি কিন্তু পাই না। আমি শুনতে চাইনা এত মানুষের এত কথা। তবুও ওরা কথা বলে যায়। কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট। আমি দেয়ালে মাথা কুটি। আমার কপালে সারা বছর ব্যান্ডেজ করাই থাকে।
জেলখানার ডাক্তার প্রতি সপ্তাহে একবার আমার সাথে কথা বলে। হাজারটা প্রশ্ন করে। আমি উত্তর দেই, কখনো আবার দেই না। তখন আবার লিখতে বলে।
আমি লিখি, লিখতে ভালো লাগে। কিভাবে কখন কোথায় খুন করেছি সব লেখার চেষ্টা করি। কখনো কখনো একটা ঘটনা আরেকটার সাথে গুলিয়ে যায়। সময়ের হিসাব মেলাতে পারি না। ওরা বলেছে আমি নাকি পঞ্চাশটা মেয়েকে খুন করেছি। আমার কিন্তু মনে হয় আরো বেশি হবে। মেয়ে মানুষ বেচে থাকবে কেন এই পৃথিবীতে? ওদের জন্ম হয়েছে ভোগের জন্য আর কষ্ট পাওয়ার জন্য।
ডাক্তার আমাকে জিগ্গেস করে, আমার কোনো অপরাধ বোধ আছে কিনা। আমার কোনো অপরাধ বোধ নেই। আমি ওই পশু গুলোকে শেষ করেছি। আমার খুব ভালো লেগেছে, অপরাধ বোধ কাজ করেনি।
রক্তের নেশা আমার এখনো তাড়া করে। কিন্তু এই নেশা থাকলে তো এখন হবে না, আমি তো বন্দী। মাঝে মাঝে মাথার যন্ত্রণা এত বেশি হয় কেন? এত কিসের কথা মাথার ভেতর? ইদানিং আর সহ্য হয় না ওসব।
প্রায়ই মেয়ে গুলো এগিয়ে আসে আমার দিকে, পায়ে হেটে না, পশুর মত হাত পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে। ওই মেয়েগুলোর মুখ আমি ভুলতে পারি না। ওরা ধীরে এসে ঠিক আমার বুকের উপর চেপে বসে, আমার মুখের কাছে মুখ এনে শুধু তাকিয়ে থাকে। আমার দম বন্ধ হতে থাকে, ঘামতে থাকি। চিত্কার করি, কেউ শোনে না। কি অসহ্য যন্ত্রণা, ভয়!
অনেকদিন পর মি মুর আবার কথা বলে আমার মধ্যে, 'রক্ত দেখবি না? ভেড়া হয়ে গেছিস? আয় , আজকে তোকে রক্ত দেখাবো। '
আমি অন্ধের মত এগিয়ে যাই, এইতো সামনে রক্তের নদী, গন্ধ পাই আমি। মন্ত্র মুগ্ধরের মত ডুব দেই রক্তের সাগরে, কি আনন্দ ভেসে থাকতে! মাথার ভেতর আর কোনো কথা নেই, শুধু নিস্তব্দতা। মেয়েগুলোর মুখ ভেসে যাচ্ছে দূরে।
-------------------------------------
গভীর রাতে জেলখানার ইমার্জেনছি বেল বেজে উঠে। জেল খানার সুইমিং পুলে গ্যারির লাশ ভেসে উঠেছে। কিভাবে এত রাতে সে তালা খুলে সুইমিং পুলে গেল, কেউ ভেবে পায় না!
( কুখ্যাত মার্কিন সিরিয়াল কিলার Gary Ridgway এর জীবনের ছায়া অবলম্বনে )