আপনার কি কখনো কখনো মনে হয়, 'জীবনে এত ঝামেলা কেন? কেন একটার পর একটা সমস্যা ? ধুর, আমি মনে হয় এই কাজটা করতে পারবা না, বাদ দেই।'
স্কুলে একবার টিচার জানতে চেয়েছিলেন, আমাদের চোখে আদর্শ মানুষ কে। কেউ বলল মহাত্মা গান্ধী, কেউ বললো আইনস্টাইন। আমি বললাম আমার আব্বু। কেন জানেন? আবার আব্বু কখনো বলেনি, ধুর বাদ দেই, আমি পারব না।
আব্বুর গল্পটা বলি ।
আব্বুর জন্ম গ্রামের এক অতি সাধারণ পরিবারে। অভাব অনটন ছিল সেই পরিবারের নিত্য সঙ্গী। আমার বাবার আগে আরো চার বোন্ আর এক ভাই ছিল, শুধু একটা বোন্ জীবত আছেন, বাকিরা সবাই নানান অসুখে মারা গেছেন, কারণ তাদের চিকিৎসা হয়নি, সেই সামর্থ ছিল না পরিবারে।
আমার দাদা একজন কৃষক ছিলেন, সামান্য লেখাপড়া জানতেন। দাদী লেখাপড়া জানতেন না। দাদা নানান রকম ব্যবসাও করতেন। রকমারি জিনিস হাটে নিয়ে বিক্রি করতেন, কখনো কাপড়, কখনো সবজি, যখন যা বিক্রি করা যেত; আমার বাবাও তার সাথে যেতো দাদাকে সাহায্য করতে। আমার দাদী ঝিনুক দিয়ে বোতাম বানাতেন। একদিন ঝিনুকের কনা তার চোখে ঢুকে যায়। সেটার চিকিত্সা হয়নি। আমার দাদির চোখটা নষ্ট হয়ে যায়।
বাবার বয়স যখন ছয়, দাদা গ্রামের এক প্রাইমারি স্কুলে তাকে ভর্তি করে দিলেন। অযত্ন অনাদরে সেখানে প্রাইমারি শেষ করলো বাবা। দাদাবাড়িতে লেখা পড়ার পরিবেশ ছিল না, প্রতি বছর সন্তান হয় দাদির। আবার নানা অসুখে মারা যায়। দাদির পনেরো জন সন্তান জন্ম নিলেও বেচে আছেন মাত্র ছয়জন। এর মধ্যে গুটি বসন্ত ধরল সবাইকে, বাবার ছোট দুই ভাই মারা গেলো । আমার বাবা বেচে গেলো। তার মুখে গুটি বসন্তেই কিছু দাগ এখনো আছে।
বাড়ির পরিবেশ এমন দেখে দাদা বাবাকে পাঠিয়ে দিলেন উনার মামার বাসায়। বাবা ওখান থেকে হাইস্কুলে পড়তে লাগলো।
সে বাড়ি ছিল অবস্থাপন্ন, কিন্তু অন্যে বাড়িতে থাকার নানা প্রতিকূলতা এড়ানো যায়নি। বাবার বয়সী ছেলেরা হাল ফ্যাশনের কাপড় পড়ে, ভালো ভালো খাবার খায়, কিন্তু বাবা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। সেসব কাপড় পরার কথা ভাবতেও পারে না ; ভালো ভালো খাবারের ভাগও পায় না। বেশি রাত করে পড়লে বাড়ির বয়স্ক মহিলা রাগ করে, হারিকেনের তেল বেশি খরচ হয় যে! বাবা বই দিয়ে হারিকেন ঢেকে লুকিয়ে পড়তো ।
ক্লাস টেনে সবাই স্কুল থেকে পিকনিকে যাবে, চাদা চার আনা। দাদার কাছে সেটা চাইতে গেলে দাদা বলে দিল উনার কাছে টাকা নেই। বাবা পিকনিকে যেতে পারেনি। মন খারাপ করে ধান খেতের পাশে গিয়ে বসে ছিল। সামনের বড় রাস্তা ধরে পিকনিকের গাড়ি গান বাজাতে বাজাতে চলে গেল। বাবা শুধু তাকিয়ে দেখল।
বাবার পরিশ্রমের ফল হলো দারুন। সেই স্কুলের ইতিহাসে প্রথম বারের মত আর্টস থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করলো ! তখন ১৯৬৮ সাল।
স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হলো, এলাকাবাসী ব্যান্ড পার্টি আনলো। বাবার গলায় টাকার মালা দিয়ে সারা গ্রামে ব্যান্ড পার্টি ঘুরে বেড়াল। কত বড় সম্মান! অভাব অনটনে অবহেলায় জর্জরিত একটা মানুষের জন্য কত বড় প্রাপ্তি!
বাবা ঢাকা কলেজ থেকে ভর্তি ফর্ম আনলেন কিন্তু ভর্তির টাকা নাই। অনেক সাধ ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার কিন্তু টাকার অভাবে সেটা সম্ভব হলোনা। নারায়নগঞ্জ তোলারাম কলেযে ফ্রি ভর্তি আর সব বই খাতা ফ্রি দেয়ায় বাবা শেষ পর্যন্ত তোলারাম কলেজে ভর্তি হয়ে গেলো।
এর মধ্যে একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোর চাকরি পেলো বাবা । বেতন তিরিশ টাকা। সেই টাকা দিয়ে কলেজে পরার খরচ চলতো । বেশ কয়েকমাস টাকা জমিয়ে দাদিকে একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো, তার চোখ ঠিক করতে। কারণ বাবা দাদিকে কথা দিয়েছিল, একদিন চাকরি করে দাদির চোখ ঠিক করিয়ে দেবে। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
উনিশ বাহাত্তর সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিল বাবা, আবারো ফার্স্ট ডিভিশন।
বাবা ভর্তি হয়ে গেলো ঢাকা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে। থাকতো সলিমুল্লা হলে। ইউনিভার্সিটিতে কত অভিজাত পরিবারের ছেলে মেয়ে, তাদের কত সাজ পোশাক, আর বাবার একটা মাত্র ট্রাউজার । সেটা পরেই প্রতি দিন ক্লাস করতে আসে। হোস্টেল ডাইনিং হলে পানির মত ডাল দিয়ে ভাত খায়। হাতিরপুলে দুইজন ছাত্রী পড়াতো , সেখানে বেতন দেড়শ টাকা। সেটা দিয়ে কোনো রকমে ইউনিভার্সিটির খরচ চলে।
অনার্স শেষে একবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখে ছোট দুই ভাই জমিতে চাষ করছে। সংসারে এত অভাব অনটন, আর কোনো উপায়ও নেই। বাবা ভাবলো, তাকেই কিছু করতে হবে। তাই ঢাকায় ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে দুই ভাইকে নিয়ে আসলো, তাদের লেখা পড়ার ব্যবস্থা করলো । সাথে সাথে ব্যবসা শুরু করলো ।
সলিমুল্লাহ হলে তার রুমমেট পরিচয় করিয়ে দিল বাটা সু কোম্পানিতে উনার চাচার সাথে। বাবা গেলো সেই চাচার সাথে দেখা করতে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ শুনে ভদ্রলোক উত্সাহ দিলেন ব্যবসা করতে। বললেন বাটা সু কোম্পানিতে অনেক ফ্যাব্রিক লাগে , বাবা চাইলে নারায়ানগঞ্জ থেকে সেটা সাপ্লাই দিতে পারে।
বাবা সেটা করলো, বাটা সু কোম্পানি তে কাপড় সাপ্লাই দিয়ে বাবার ব্যবসা শুরু। তখন উনিশত আটাত্তর সাল। বাবা অর্থনীতিতে অনার্স মাস্টার্স দুটি শেষ করলো ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। তার বন্ধুরা অনেক সাহায্য করেছেন, ব্যবসা আর লেখাপড়া একসাথে করা কত কষ্ট হতে পারে সেটা অনেকেই হয়ত ভাবতে পারবে না।
১৯৮০ সালে ছয়টা পাওয়ার লুম নিয়ে বাবা একটা ছোট টেক্সটাইল মিল করলো , নাম রাখলেন সালমা টেক্সটাইল মিল! তার সাথে সাথে নারায়ানগঞ্জ শহরে দুইটা দোকান ভাড়া নিয়ে দুই ভাইকে সেখানে কাজ দিয়ে দিল। একটা ছিল মৌচাক কনফেকশনারী (নারায়ানগঞ্জ শহরে সেই সময়ের অনেকেই দোকানটা চিনতে পারেন) আরেকটা কালির বাজারে ইলেকট্রনিক্স এর দোকান।
ধীরে দিরে প্রচন্ড পরিশ্রম, সততা আর একাগ্রতা নিয়ে আবার বাবা আজকে অনেক সফল একটা ব্যবসায়ী। নারায়ানগঞ্জ এ কম্পোজিট টেক্সটাইল আর গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান গড়েছে। সেখানে প্রায় দুই হাজার মানুষ কাজ করে। শুধু যে ব্যবসা করেছে তা না, আব্বু দাদার নামে এতিমদের জন্য একটা মাদ্রাসা করেছে, নিজের গ্রামে কলেজ তৈরিতে অনেক সাহায্য করেছে।নিজে অনেক কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছে বলে এখনো মেধাবী গরিব ছেলেমেয়েদের এক কথায় সহযোগিতা আর অনুপ্রেরণা দেয় আব্বু।
বেশ কিছু ব্যবসায়িক সংঘটন যেমন বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স ,BGMEA , BKMEA এর ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করছে। রোটারি ইন্টারন্যাশলানের সাথে ১৯৮৫ থেকে যুক্ত আছে। যেখান থেকে অনেক রকম সমাজ সেবার কাজ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোলিও নির্মূল অভিযান, লো কোস্ট হাউসিং (অল্প খরচে গৃহহীন দের জন্য পূর্ণাঙ্গ ঘর), বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান। বাংলাদেশ রোটারি এর গভর্নর হিসাবে ১৯৯৭-৯৮ সালে অনেক রকম জনসেবা করেছে, বাংলাদেশ রোটারিকে বিশ্বে পরিচয় করেছে। রোটারি আর ব্যবসার স্বার্থে পৃথিবীর সব গুলো মহাদেশে গেছে, অনেক দেশ থেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। রোটারির জন্য বিশ্বের অনেক দেশ থেকে সম্মান পেয়েছে, বিভিন্ন সম্মেলনে যোগ দিতে আর সেখানে বক্তব্য দেয়ার জন্য দেশে বিদেশে গিয়েছে বাবা। ইদানিং মনে হয় ব্যবসার চেয়ে এই সেবা মূলক কাজ গুলোতেই বেশি আগ্রহ আব্বুর।
আমার দুই চাচা যারা হয়ত গ্রামে হাল চাষ করত, তারা এখন প্রতিষ্ঠিত। এখনো আব্বু প্রতি শুক্রবার নিজের গ্রামে যায়। সবার খোজ খবর নেয় , সবার বিপদে সাহায্য করে। আমি যখন ছোট ছিলাম প্রতি সকালে প্রায় দশ পনেরো জন মানুষ গ্রাম থেকে আসত আমাদের বাসায়, সাহায্যের জন্য। আম্মু প্রতি সকালে এক গাদা নাশতা বানাত সবার জন্য।আব্বু কাউকেই নিরাশ করত না। সবার সাথে কথা বলে যথা সম্ভব চেচ্টা করত সাহায্য করতে।আরেকটা ব্যপার এই খুবই শ্রদ্ধা করি সেটা হচ্ছে আব্বুর কৃতজ্ঞতাবোধ। তার জীবনের খারাপ সময়ে যারাই এগিয়ে এসেছে তাদের সবাইকে আব্বু এখনো এত বেশি সম্মান আর গুরুত্ব দেয়া যেটা না দেখলে বোঝা যাবে না। অনেকেই সাফল্যের শিখরে উঠলে পেছনের মানুষ গুলোকে ভুলে যায়, আব্বু কখনই সেটা করে না।
আব্বু আমাদের কখনো অভাব কি, তা বুঝতে দেয়নি।আমাদের সব রকম আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করেছে। সত্যিকারের প্রিন্সেসের মতই বড় হয়েছি । নিজের জীবনে কত কষ্ট করেছে, তা কখনো আমাদের বুঝতে দেয়নি।
আমার আম্মুর সাথে আব্বুর যখন বিয়ে হয়, আম্মুর বয়স পনেরো , ক্লাস নাইনের ছাত্রী। বিয়ের পর আমরা তিন বোন জন্ম নিলাম খুব কাছাকাছি সময়ে। তারপর আব্বু উত্সাহ দিল আম্মুকে আবার পড়ালেখা করার জন্য। বাসায় টিচারও আসত আম্মুকে পড়াতে। আমাদের তখন একান্নবর্তী পরিবার। দাদা দাদী , দুই চাচা আমাদের সাথেই থাকত, তার উপর আমরা তিনটা ছোট ছোট বোন। বুঝতেই পারছেন, এই পরিবেশে আম্মুর জন্য কত কঠিন হতে পারে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া। শুধুমাত্র আব্বুর উত্সাহ আর সাহায্য নিয়ে আম্মু মেট্রিক, ইন্টার, বি.এ, মাস্টার্স সব করলো একটা একটা করে। অনেক কষ্টে পারিবারিক সব দ্বায়িত্বের পাশাপাশি পড়তে পারলো আম্মু, আব্বু যদি পাশে না থাকতো, আম্মুর জন্য সেটা অনেক বেশি কঠিন হতো।
বাবা সব সময় আমাকে বলে কিছু পেতে হলে তা অর্জন করতে হয়। সততা, কঠোর পরিশ্রম আর কাজের প্রতি ভালবাসা থাকলে যেকোনো কাজে সাফল্য আসে। কথা গুলো একশ ভাগ সত্যি।
অনেকে অনেক সময় দাদার পেশা নিয়ে কটুক্তি করেছে, আমি নিজেও অনেকবার শুনেছি। কিন্তু খুব কম মানুষ আছে যারা সব বৈরিতাকে পেছনে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারে । আমার দাদা কৃষক ছিলেন তাতে সমস্যা হবে কেন? এটাতো আরো বেশি গর্বের কথা , আরো বড় অর্জন!
আব্বু কখনো হাল ছাড়েনি। তাই আমার আব্বু আমার সুপার হিরো।