(ক্রিসমাস ইভ -১৯৯৬)
সল্টলেক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের রিসেপশনে একটি সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে বসে আছে। ছেলেটার যে ব্যাপারটা সবার আগে চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে তার ফ্যাকাশে সাদা গায়ের রং। ছেলেটা শীর্ণকায়, মাথায় সোনালী ঝাঁকড়া চুল। সে মাথা নিচু করে বসে নিজের হাত দুইটা ঘষছে। তাকে যথেষ্ট বিক্ষিপ্ত মনে হচ্ছে।
ইন্সপেক্টর মাইক ব্রাউন মনোযোগ দিয়ে ছেলেটাকে খেয়াল করছেন। ছেলেটা একটা খুনের ব্যাপারে রিপোর্ট করতে এসেছে।
ক্রিসমাসের ছুটির জন্য ডিপার্টমেন্টে লোকজন খুব কম। মাইক ক্রিসমাসের সময় কাজ করতে মোটেই রাজি ছিলো না কিন্তু এবছর ডিউটি এড়ানো গেলোনা। এমনিতে ক্রিসমাসে খুব বেশি কাজ থাকে না ; দু-একটা ব্রেক-ইন, অতিরিক্ত স্পিডে গাড়ি চালানো, মাতাল হয়ে মারপিট- এধরনের কিছু ছোটোখাটো কেস থাকে। ক্রিসমাসে খুন-খারাবি এ পর্যন্ত পায়নি মাইক।
"কেভিন, যা বলবে নিশ্চিত হয়ে বলবে। আমি রেকর্ডারে তোমার কথাবার্তা রেকর্ড করবো যেটা পরবর্তীতে আইনী প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হবে। তুমি সব বুঝতে পারছো?"
"হ্যা, আমি জানি আমি কি বলতে এসেছি।"
"ওকে, তুমি নিশ্চিত তোমার মায়ের উপর রাগ করে মিথ্যা অভিযোগ করতে আসোনি?"
কেভিন মাথা তুলে মাইকের চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ভাবে বললো, "আমি নিশ্চিত অফিসার। আমার মা আমার ভাই জিমিকে খুন করেছে, ঠান্ডা মাথায়। তুমি কি খোঁজ নেবে আমার বাবা এখন কেমন আছে?"
"তোমার বাবা এখন কিছুটা ভালো আছে কেভিন। তাহলে শুরু করো। "
মাইক ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রেকর্ডার অন করলেন।
কেভিন একটা বিরতি নিয়ে শুরু করলো।
"আমাদের জন্ম ১৯৭৮ এ, আমরা মানে আমি আর জিমি, আমরা দুইজন একেবারে একরকম দেখতে যমজ ভাই।
আমাদের বাবা মায়ের বিবাহিত জীবন সুখের ছিলো না। আমার দাদা অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার অগাধ ধন সম্পদ বিলাসিতায় উড়িয়ে দিয়েছেন আমার বাবা। স্কুলের পর বাবা আর লেখাপড়া করেননি। তিনি মদ, জুয়া, মাদক, নারী সব কিছুতেই আসক্ত ছিলেন। এমন একজন মানুষকে আমার মা কেন বিয়ে করেছিলেন আমার ধারণা নেই। দাদার সব সম্পদ অনেক আগেই ধ্বংস করেছেন বাবা। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের বাড়িটা ছিল বলে আমাদের মাথার উপরে ছাদ ছিল। মা একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করতেন। তার আয়ে কোনোভাবে চলতো আমাদের সংসার।
আমার জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখছি বাবা মায়ের পরস্পরের প্রতি ভয়ানক হিং¯্র আচরণ। জন্ম থেকেই জিমি শারীরিক ভাবে দুর্বল ছিলো, সে খুব ধীর গতিতে বড় হচ্ছিলো। তাছাড়া তার নানা রকম অসুখ ছিলো। আমরা মনে আছে মা জিমিকে নিয়ে প্রায়ই হাসপাতালে ছুটতেন।
পারিবারিক অশান্তির মধ্যে জিমি আর আমি ছিলাম একজন আরেকজনের ভরসা। আমরা একসাথে খেলতাম, এক ঘরে ঘুমাতাম, ভয় পেলে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরতাম।
মাত্র ছয় বছর বয়সে জিমি মারা যায়, বুঝতেই পারছেন তার খুব বেশি স্মৃতি নেই। কিন্তু জিমির চেহারাটা আমার মনে আছে। একদিন বাবা ভয়ানক ক্রুদ্ধ ভাবে ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারছিলেন আর মায়ের কাছে টাকা চাইছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে জিমি আমার হাত ধরে দৌঁড়ে চিলেকোঠায় নিয়ে দরজা বন্ধ করে বলেছিলো, আমরা মরে যাচ্ছি কেভিন। কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবে না।
আমি যত সহজে সব মেনে নিতাম জিমি হয়তো পারতোনা। তার প্রভাব তার উপর পড়তো বলেই হয়তো জিমি অসুস্থ থাকতো।
আমি প্রায়ই দেখতাম মা চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন, আমি আর নিতে পারছি না, আর পারছি না।
সেবার খুব শীত পড়েছিল। জিমি খুব অসুস্থ ছিলো। মা আমাদের দুইজনকে নিয়ে উটাহ লেকের পাড়ে আমার দাদার বাংলোতে বেড়াতে নিয়ে গেলেন। আমি খুব খুশি ছিলাম।
বাংলোতে যাওয়ার দুদিন পরের ঘটনাটা। সেদিন দুপুরে খাবার পর আমি বসার ঘরে খেলছিলাম। আমার সামনেই জিমিকে রেডি করে মা বাইরে নিয়ে গেলেন। আমিও যেতে চাইলাম কিন্তু মা বললেন তারা একটু হাঁটতে যাচ্ছেন, একটু পরেই ফিরে আসবেন। মা আমাকে ভেতরের ঘরে যেতে বললেন। সেটাই ছিলো জিমির সাথে আমার শেষ দেখা।
আমি জানালার পাশে বসে দেখলাম জিমি মায়ের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। বাংলো থেকে উটাহ লেক দুই মিনিট হাঁটা পথ হবে। লেকের উপর কাঠের পাটাতনে হেঁটে হেঁটে একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলো ওরা। মা মাথা নিচু করে কিছু একটা বললেন জিমিকে তারপর ওর হালকা শরীরটা তুলে ছুঁড়ে মারলেন লেকের হিম শীতল পানিতে।"
কেভিন জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। ইন্সপেক্টর মাইক তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। কেভিন কাঁপা হাতে গ্লাসটা হাতে নিলো।
"তুমি ঠিক আছো কেভিন?"
"হুম, ঠিক আছি ,ধন্যবাদ। অফিসার , আপনি প্লিজ বারো বছর আগে জিমির মৃত্যুর তদন্তের রেকর্ড বের করে আমার তথ্যের সাথে মিলিয়ে দেখুন। "
মাইক রেকর্ড রুমে কিছুক্ষন ঘাঁটাঘাঁটি করে বারো বছর আগে জিমির মৃত্যু তদন্তের ফাইল বের করলেন। কম্পিউটারে এই তদন্তের সাথে জড়িত মামলার খুঁটিনাটি দেখলেন।
"কেভিন, এই তদন্তে আছে জিমি খেলতে গিয়ে পানিতে পিছলে পড়েছিল। তদন্তে হত্যার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।"
"কারণ আমার মা খুনকে দুর্ঘটনায় সাজিয়েছেন। মা যখন জিমিকে পানিতে ফেলে দিলেন, আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অফিসার সেই অনুভূতি আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। এখনো সেটা মনে হলে আমার ..........."
কেভিন দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকে।
"মা পাটাতনে বসে পানির দিকে ঝুঁকে কি যেন বলে দৌড়ে ফিরে আসলেন বাংলোতে, তিনি কাঁদছিলেন। আমি তার দিকে দৌড়ে গিয়ে বললাম, জিমি পানিতে পড়ে গেছে মা। মা আমাকে ধরে খুব শান্ত ভাবে বললেন, কেভিন, জিমি চলে গেছে, আর কখনোই আসবে না। তুমি কি চাও আমিও চলে যাই? আমি চলে গেলে তোমার কেউ থাকবে না। তুমি যদি চাও আমি তোমার কাছে থাকি, তুমি যা দেখেছো তা কাউকে বলবে না।
এরপর মা নিজেই পুলিশকে ডাকেন।
সেই মুহূর্ত থেকে মাকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করলাম। না, আমি কাউকে বলিনি আমি কী দেখেছি। সত্যি মা ছাড়া আমার কেউ ছিল না। আমি বারো বছর ধরে এই সত্যিটা চেপে রেখেছি। তদন্তে কিছুই বের হয়নি। বাইশ দিন উটাহ লেকে অভিযান চালায় পুলিশ কিন্তু জিমির লাশ পাওয়া যায়নি।
আমার খুব কাছের একজন হটাৎ নাই হয়ে গেলো, ভাবতে পারেন আমার অবস্থা কেমন ছিল অফিসার? আমি মাকে প্রচন্ড ভয় পেতাম কিন্তু আমার কোনো যাওয়ার জায়গা ছিলোনা। বাবা মাঝে মাঝে এসে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন কিন্তু আমি তাকে কখনো বলতে পারিনি কী ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে কাটছে আমার দিন রাত। আমি জানতাম বাবা কিছুই করতে পারবেন না। যদিও বাবার নানা সমস্যা ছিলো, তারপরও বাবার সাথে কাটানো সামান্য সময়টুকুই আমার কাছে মহামূল্যবান ছিলো। জিমির মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই মা বাবা আলাদা থাকতেন। মিশেল নামে এক মহিলার সাথে বাবার সম্পর্ক ছিলো। আমার ইচ্ছা করতো বাবার সাথেই থাকতে কিন্তু মিশেল সেটা পছন্দ করতো না।
মা প্রায়ই উটাহ লেকের পাশে দাদার সেই বাংলোতে বেড়াতে যেতেন, আমাকেও সাথে নিতে চাইতেন কিন্তু আমি ভয়ানক স্মৃতিতে ঘেরা সেই জায়গায় আর ফিরে যেতে চাইনি। মা আমাকে এক চাচার বাসায় রেখে ওখানে একই চলে যেতেন। আমি ভাবতে পারিনা কী করে মা ওই বাংলোতে বারবার ফিরে যেতে পারেন।"
"তুমি এতদিন এই ব্যাপারে কিছু বলোনি কেনো?"
"অফিসার, আমি খুবই ছোট ছিলাম। মা ছাড়া আমার আর কেউ ছিলো না, আমি তো বললাম।"
"তাহলে এখন কেন বলছো কেভিন?"
"আমি এই সেপ্টেম্বর থেকে ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানে ক্লাস শুরু করেছি। জীবনে এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে আমি মুক্ত। মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো আগ্রহ আমার ছিলো না। অসুস্থ বাবার অনুরোধে আমি এই ক্রিসমাসে বাড়ি আসার প্ল্যান করি। তিনি চাইছিলেন এই ক্রিসমাস আমি বাবা মা দুইজনের সাথেই কাটাই।
বাড়িতে ফিরে মাকে এড়িয়ে চলছিলাম। কোনোভাবে ক্রিসমাস শেষ করে ডর্মে ফিরে যাবো-সেটাই ছিলো আমার ইচ্ছা। ক্রিসমাস ডিনারে শুরু হলো সমস্যা। হটাৎ পুরোনো বিষয় নিয়ে বাবা মায়ের ঝগড়া বেঁধে গেলো। এক পর্যায়ে বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করলেন, তুমি আমার ছেলেকে খুন করেছো। মা হটাৎ ভয়ঙ্কর রেগে টেবিল থেকে ওয়াইনের বোতল তুলে বাবার মাথায় আঘাত করলেন। লাল ওয়াইন আর বাবার রক্ত মিলে ভয়ংকর লাগছিলো! আমি সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হুঙ্কার দিয়ে মাকে বললাম, তুমি একটা রাক্ষুসী, একটা খুনি...........এরপর..........."
কেভিন ঢকঢক করে পানি খেলো। তার মনে হচ্ছে ভেতরটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।
মাইক কেভিনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, "কাম ডাউন, জিমি হত্যার কোল্ড কেসটা রিওপেন হবে। প্লিজ চিন্তা করবে না। "
(১০ জানুয়ারী,১৯৯৭)
ইন্সপেক্টর মাইক ব্রাউন এবং স্কট ওয়াকার আজ মিসেস সারাহ জোনসের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। স্কট উটাহ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান।
সারাহ টেবিলের ওপর প্রান্তে শান্ত ভাবে বসে আছেন। তার পোশাক পরিপাটি। মাথার চুল বেশিরভাগ পাকা এবং তার পুরো অবয়বে অযতœ অবহেলার ছাপ স্পষ্ট।
"মিসেস জোনস, আমরা আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো। আশা করছি আপনি সত্যি কথা বলবেন। "
সারাহ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন ।
"আপনার বিরুদ্ধে জিমি এডওয়ার্ড জোনসের হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আপনার এখনকার ভাষ্য আমরা এই কেসের জন্য ব্যবহার করবো তাই আশা করছি সত্য গোপন করবেন না। স্পষ্ট ভাবে বলুন আপনি সব বুঝতে পেরেছেন। আমি রেকর্ডার অন করছি।"
"আমি সত্য বলবো।"
"আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি সত্যি?"
"না, আমি জিমিকে খুন করিনি। "
"তাহলে চোদ্দই ডিসেম্বর ১৯৮৩ তে কী ঘটেছিলো?"
"সেদিন কী হয়েছে তা বলতে হলে আমাকে একটু আগে থেকে বলতে হবে। কেভিন আর জিমি আমার জীবনের চেয়েও প্রিয় ছিলো। তাদের দুইজনকেই আমি সমান ভাবে ভালোবাসতাম। কিন্তু জন্মের পর থেকেই জিমি অসুস্থ ছিলো। তার প্রবল শ্বাস কষ্ট হতো আর সে দিনের আলোতে বের হতে চাইতো না। ও যখন একেবারে ছোট তখন গরমের ছুটিতে একদিন সমুদ্রের পাড়ে বেড়াতে যাওয়ার পর জিমি এত বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লো যে আমি ভেবেছিলাম ও মরে গেছে! তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো আর সারা শরীরে ফোসকা পড়েছিলো। আমি তাকে হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাই। সেখানে ওকে চার দিন রাখা হয়। ডাক্তার জানায় জিমির তীব্র হাঁপানি আর সূর্যের আলোতে এলার্জি আছে। জিমির দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চলছিলো। আমি জিমিকে বাসার ভেতরেই রাখতাম।
এত চিকিৎসার পরেও জিমির অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছিলো না, আমি কিছুদিন পর পর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম আর ডাক্তাররা তাকে আরো কড়া ঔষধ দিতেন।এত ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় জিমি কী প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছিলো সেটা আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না।
আমাদের মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্সে যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা করিয়েছি, কিছুতেই কাজ হচ্ছিলো না। জিমির বয়স তখন খুব কম, অনেক কিছু বুঝিয়ে বলতে পারে না। যতটুকু বুঝিয়ে বলে তাকে বুঝি তার সারা গা জ্বালা পোড়া করে। সে মাথা উঁচু করে নিঃশ্বাস নেয় তবুও তার মনে হয় কোথাও কোনো বাতাস নেই।
এক বিকেলে কেভিন আর জিমিকে কমিউনিটি সুইমিং পুলে নিয়ে যাই। অবাক ব্যাপার ঘটলো সেদিন! পানিতে নেমে জিমি যেন পুরো সুস্থ হয়ে গেলো! সে দুই ঘন্টা পানিতে থাকলো। কেভিন ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসতে চাইছিলো কিন্তু জিমি কিছুতেই আসবে না। শেষে টানতে টানতে জিমিকে বাড়িতে নিয়ে আসলাম।
সেদিন রাতে ঘুমানোর সময় আমি যখন ওদের ঘরের বাতি নিভিয়ে দিচ্ছিলাম, জিমি বললো ও আমাকে কিছু বলতে চায়।
আমি ওর পাশে বসালাম। জিমি বললো তার পানিতে খুব ভালো লাগে। আমি যেনো প্রতিদিন তাকে পানিতে নিয়ে যাই। পানিতে গেলে নাকি তার কোনো কষ্ট থাকে না।
তখন ওদের বয়স চার।
আমি প্রতিদিন ওদের পুলে নিয়ে যেতাম। পুলে জিমি খুব ভালো থাকতো। কেভিন বিরক্ত হতো, সে এতক্ষন পুলে থাকতে চাইতো না। এদিকে কেভিন আর জিমির স্কুল শুরু হয়েছিল। কেভিন স্কুলে যেতে পছন্দ করতো কিন্তু জিমি স্কুলে যেতে পারতো না। একদিন স্কুলে গেলে চারদিন অসুস্থ থাকতো। জিমির শরীরে অদ্ভুত ছোপ ছোপ কালশিটে দাগ পড়েছিলো। ও বারবার বলতো তার ভেতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
ডাক্তাররা যখন দেখলো কোনো চিকিৎসাতেই কিছু হচ্ছে না তখন তারা জিমিকে নিউ ইয়র্ক চাইল্ড হসপিটালে পাঠানোর পরামর্শ দিলো।
অফিসার, আপনি হয়তো শুনেছেন, আমার বিবাহিত জীবন সুখের ছিলো না। আমার মনে হচ্ছিলো আমি একটা জেলখানায় আটকে গেছি। আমি একটা পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে যাই। যাবোই না কেন? আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসতো না, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু আমার ভাগ্য কেমন দেখুন- আমার প্রেমিক আমাকে ছেড়ে চলে যায়।
আমি মানসিক ভাবে এতটাই বিষন্ন হয়ে পারি যে আত্মহত্যার চিন্তা শুরু করি। তারপর ভেবে দেখলাম আমি মরে গেলে কেভিন আর জিমির স্থান হবে ফস্টার হোমে। তারা বড় হবে অবহেলায়।
আমি লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়ে জিমির সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করি। তখন তো আর গুগল ছিলো না, লাইব্রেরির বই ছিল ভরসা। আমি চিকিৎসা বিদ্যার বেশ কিছু বই পড়েছি।
একদিন হটাৎ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনের একটা ইস্যু পেয়ে যাই লাইব্রেরিতে। সেখানে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর অ্যালেন ম্যাকেঞ্জির একটা আর্টিক্যাল পড়ে আমি ধারণা করি আসলে জিমির কী হয়েছে।
সেই আর্টিক্যালে হিউমান ইভোলুশনের একটা হাইপোথিসিস ছিলো। সেখানে ডক্টর ম্যাকেঞ্জি বলেছেন ভবিষ্যতে মানুষের কয়েক ধরণের পরিবর্তন আসবে। টেকনোলজির উন্নতির জন্য মানুষ আর যন্ত্র মিলে তৈরী হবে হিউম্যানয়েড। অন্যদিকে দূষণ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য পৃথিবীর স্থলভাগ বসবাসের উপযোগী থাকবে না এবং বেশিরভাগ স্থল পানিতে ডুবে যাবে। তখন প্রকৃতি মানুষের মধ্যে একটা অংশকে এমন ভাবে পরিবর্তন করবে যে তারা পানিতে বাস করতে পারবে। এই আর্টিকেলে মানুষের সেইসব পরিবর্তনের বর্ণনা দেয়া হয়েছিল যেগুলো জিমির সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।
আমি আর্টিক্যালটা অনেকবার পড়েছি। আমি প্রফেসর ম্যাকেঞ্জির সাথে এই আর্টিক্যালটা নিয়ে সরাসরি কথাও বলেছি। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি মানুষের যে বিবর্তনের কথা বলেছেন সেরকম মানুষ এখনই আছে কিনা। তিনি হেসে বললেন সেরকম হওয়ার কথা না, ওনার হাইপোথিসিস আরো শত বছর পরের মানুষকে নিয়ে।
আমি দিন রাত অনেক ভাবলাম, একটা নোটবুকে জিমির সব সমস্যার ব্যাপারে লিখলাম। অফিসার, জিমির সেই যন্ত্রনা, সেই চিৎকার, নিদ্রাহীন রাত গুলো কিভাবে কেটেছে সেটা আমি জানি। একজন মায়ের জন্য সন্তানের অবর্ণনীয় যন্ত্রনা দেখার মতো কষ্টকর আর কিছুই হতে পারে না।
জিমি চিৎকার করে বলতো, মা আমাকে পানিতে নিয়ে যাও, পানিতে নিয়ে যাও। আমি বাথটাবে পানি ভর্তি করে তাকে ডুবিয়ে রাখতাম। জিমি সেখানে শুয়ে ঘুমাতো। আমি দেখেছি, পানির নিচে জিমি কী করে ঘন্টার পর ঘন্টা থাকতে পারে।
আমি জিমিকে পানি থেকে তুলে জড়িয়ে ধরতাম। জিমি আমার কোল ছেড়ে আবার পানিতে গিয়ে বসে থাকতো। আমি অনেক ভেবে দেখলাম, জিমিকে মুক্ত করে দেয়ার সময় হয়ে গেছে। সে আমাদের জগতের অংশ না। ডাক্তারদের এসব বললে বিশ্বাস করতো না, ওরা চিকিৎসার নামে ছেলেটাকে আরো কষ্ট দিতো। পানিতেই তার মুক্তি। আমি জিমিকে উটাহ লেকে মুক্ত করে দিয়েছি।"
"জিসাস ক্রাইস্ট ! আপনি নিজের ছেলেকে ডিসেম্বরের ঠান্ডা লেকের পানিতে ফেলে দিলেন?"
"জিমি এখানে বাঁচতো না অফিসার। আমি ওকে বাঁচিয়েছি। ক্রিসমাসের পরে ওকে নিউ ইয়র্ক চাইল্ড হসপিটালের স্পেশাল কেয়ারে রেখে আসতে হতো। প্রকৃতি ওকে জলজ হিসাবে সৃষ্টি করেছে, তার পক্ষে আমাদের মতো মাটিতে বসবাস করা সম্ভব ছিলো না। এসব শুনে আপনারা আমাকে বদ্ধ উন্মাদ ভাবতে পারেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না। "
"আপনি এতদিন এই ব্যাপারটা গোপন করেছেন কেন মিসেস জোনস?"
"আমাকে কেভিনের দরকার ছিলো। তবে আমার মনে হয় আমাকে এখন তার দরকার নেই। সেজন্যই সব বললাম। আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি অফিসার? আমার আর কিছু বলার নেই। "
(২৫ অগাস্ট, ১৯৯৭)
জিমি এডওয়ার্ড জোনস হত্যাকান্ড -১৪ ডিসেম্বর ,১৯৮৩
কেস নাম্বার-২৭৮৫৬
কেস রি ওপেন- ২ জানুয়ারী , ১৯৯৭
নতুন কেস নাম্বার-৯৮৬৪৭/বি
তদন্ত করেছেন- ইন্সপেক্টর মাইক ব্রাউন এবং ডিটেকটিভ স্কট ওয়াকার
তদন্ত রিপোর্ট:
মিস্টার কেভিন এডওয়ার্ড জোনসের অভিযোগের ভিত্তিতে ভিকটিমের মা মিসেস সারাহ এডওয়ার্ড জোনসকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মিসেস এডওয়ার্ড হত্যাকান্ডের স্বীকারোক্তি দেন। তিনি স্বীকার করেন চোদ্দই ডিসেম্বর ১৯৮৩ তে তিনি সজ্ঞানে ছয় বছর বয়সী জিমিকে উটাহ লেকে ছুুুুুঁড়ে ফেলেন।
প্রাথমিক তদন্তের সময় ভিকটিমের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। উটাহ লেক প্রায় দেড়শো মাইল জায়গা দখল করে আছে সেখানে ছোট শিশুর মৃতদেহ খুঁজে না পাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
মিসেস জোনসের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি ভয়াবহ বিষন্নতায় আক্রান্ত ও মদ্যপ । আগেও তার আক্রমনাত্মক এবং সহিংস আচরণের প্রমান পাওয়া গেছে। আমাদের মেডিক্যাল টিম মিসেস জোনসের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ পেয়েছে । এধরণের মানসিক রোগীর পক্ষে খুন করা অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। তাছাড়া পঁচিশে ডিসেম্বর ১৯৯৬ ক্রিসমাসের রাতে মিসেস জোনস অত্যন্ত হিং¯্রভাবে মিস্টার জোসেফ এডওয়ার্ড জোনসের মাথায় ওয়াইনের বোতল দিয়ে আঘাত করে মারাত্মক ভাবে আহত করেন।
অতএব মিসেস জোনসের স্বীকারোক্তি এবং তার মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করা যায় জিমি এডওয়ার্ড জোনসকে তার মা মিসেস সারাহ এডওয়ার্ড জোনস ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে।
(২৪ সেপ্টেম্বর ২০০২)
মাইক ব্রাউন সকালবেলা অদ্ভুত একটা ইমেইল পেলেন:
প্রিয় মিস্টার ব্রাউন,
আমি জানি না আমার ইমেইল পড়ে আপনি কী ভাববেন। এক ক্রিসমাসের রাতে যখন আমার মনে হচ্ছিলো আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না, আমাকে আপনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি সারাজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। আমার আত্মার সাথে জড়িয়ে ছিলো যে মানুষটা, তার হত্যার বিচার করতে আপনি যা করেছেন সেটা আমার জীবনে অবিস্মরণীয়। আমি কখনো ভাবিনি জিমির হত্যার কারণ জানতে পারবো। আমি যে ঘৃণার পৃথিবীতে বাস করতাম, আপনি সেখান থেকে আমাকে বের করেছেন।
আমি জিমি এডওয়ার্ড জোনসের হত্যার ব্যাপারে বলছি। আমি কেভিন, আশা করি আপনি আমাকে চিনেছেন।
মানুষের জীবন অনেক অদ্ভুত। অনেক কিছুর ব্যাখ্যা মানুষের কাছে থাকে না। সেরকম একটা ঘটনার ব্যাখ্যাও আমি দিতে পারছি না।
আমার বাবা মারা গেছেন দুবছর হলো। মাকে জেলে নিয়ে যাওয়ার পরে আমি নতুন ভাবে জীবন শুরু করেছিলাম। অন্ধকার অতীতকে মাড়িয়ে আমি এগিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু জানেন, জিমি আর আমার মধ্যে কোনো একটা যোগসূত্র আছে, শত চেষ্টা করেও আমি জিমিকে ভুলতে পারিনি। অদ্ভুত ভাবে আপনিও আমাদের দুইজনের মাঝে যুক্ত হয়েছেন তাই আপনাকেই আজকে ইমেইল করছি।
গত মাসে আমার কনভোকেশন ছিল। অতীত অস্বাভাবকতার মধ্যেও আমি কেমন করে যেন আমি লেখাপড়ায় ভালো করেছি, এবছর ভ্যালেডিক্টোরিয়ান নির্বাচিত হয়েছি। ইউনিভার্সিটির এই সর্বোচ্চ সম্মান, যার জন্য অনেকে দিন রাত এক করে ফেলে, সেই সম্মান নিতে আমি একা গিয়েছি। আমার পরিবারের কেউ ছিল না। আমার তেমন কোনো বন্ধুও নেই। সেজন্যই হয়তো পুরো সময়টা লেখাপড়ার জন্য বিসর্জন দিয়েছি। হাহাহাহাহা
যা হোক, আমি পদক নিতে স্টেজে উঠেছি। সবাই দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে আর আমি মাইকের সামনে গিয়ে শতবার রিহার্সাল করা কৃত্রিম বক্তব্য দিচ্ছি। হটাৎ দেখলাম দর্শক সারিতে জিমি দাঁড়িয়ে আছে!
আপনি ভাবছেন, সেটা কি করে সম্ভব! আমিও থমকে গেছি। জিমি দেখতে ঠিক আমারই মতো! মাথায় বেসবল হ্যাট কিন্তু আমি ওর মুখটা স্পষ্ট দেখলাম। জিমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমি কয়েক সেকেন্ড হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম!
খুব অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? এত বছর আগে মৃত ছেলে কী করে ফিরে আসতে পারে? আর তাকে আমি চিনলামই বা কিভাবে? আমি সেটা বলতে পারবো না কিন্তু আমি নিশ্চিত আমি জিমিকে দেখেছি।
আমি গর্ব করছি না; আমি আমেরিকার একটা টপ ইউনিভার্সিটির টপ রেজাল্ট করা ছেলে, আমার শিক্ষকরা বলেন আমার ফটোগ্রাফিক মেমোরি। মাস্টার্স করার জন্য আমেরিকার টপ তিনটি ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে স্কলারশিপের অফার দেয়া হয়েছে। আমি সেদিন ভুল দেখিনি।
আমার বক্তব্য শেষে সবাই কখন দাঁড়িয়ে সংবর্ধনা দিচ্ছিলো আমি ছুঁটে দিয়ে জিমিকে খুঁজলাম, তাকে পাইনি।
তারপর আমি সারারাত অনেক ভেবেছি। গত তিন বছর মানুষের বিবর্তন নিয়ে অনেক পড়েছি। এমন কি হতে পারে না জিমি আসলেই বেঁচে আছে? আসলেই জিমির শরীর পানিতে বসবাসের জন্য উপযুক্ত ছিলো? প্রকৃতির নিয়ম কি কখনো ভাঙতে পারে না?
মিস্টার ব্রাউন, আগেই বলেছি -জিমি আর আমার মধ্যে যে সংযোগ সেখানে কোথাও আপনিও আছেন। তাই কেন যেন আপনাকে লিখতে ইচ্ছা করলো।
অর্থহীন কথাগুলো হয়তো আপনি অগ্রাহ্য করবেন, সেটাই ভালো।
আন্তরিক শুভেচ্ছা
কেভিন এডওয়ার্ড জোনস
ইমেইলটা পড়ে কপাল কুঁচকালো অফিসার ব্রাউনের। মায়ের সিজোফ্রেনিয়া ছেলেকেও ধরলো না তো? খুবই দূর্ভাগ্যজনক।