"ধোঁয়া ওঠা কফি" কথাটা ভুল। ইউরোপের কোনো কফিশপের কফিতে ধোঁয়া ওঠে না, হালকা উষ্ণ গরম কফি হাতে নিয়ে চুকচুক করে খায় সবাই।
ফাহিমের কফি ভালো লাগে না। বাংলাদেশী বুড়ো মানুষদের মতো ঠোঁট জ্বলানো গরম চা খেতেই তার ভালো লাগে। মিলি বলে, "এতদিন আমেরিকা থেকেও কিচ্ছু শিখতে পারলে না। এখনো দুবেলা গামলা ভরা ভাত খেতেই হবে তোমার?"
রায়না কফির কাপ তুলে নাকের কাছে নিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস নেয়, কফির গন্ধ তার দারুন প্রিয়। ফাহিম রায়নাকে খুঁটিয়ে দেখে। এমন ভাবে দেখে যাতে রায়না টের না পায়।
"আমাকে দেখে অবাক হচ্ছিস?"
ফাহিম অপ্রস্তুত হয়ে হাসে।
"অবাক তো হবোই! এত বছর পরে............"
"বুড়ি হয়ে গেছি, না রে?"
"নাঃ , আগের মতোই আছিস।"
মুখ চাপা দিয়ে হাসে রায়না। মাথার সামনের দিকে কয়েকটা চুল রুপালি, চোখ কিছুটা বসে গিয়েছে, চোখের কোলে গাঢ় কালি -ব্যাস এইটুকু ছাড়া আর তেমন কিছু বদলায়নি রায়নার।
"তোর বৌ কি খুব ভালো রাঁধে ?"
"হটাৎ এটা মনে হলো কেন?"
"গোলগাল একটা ভুঁড়ি বানিয়েছিস, তাই মনে হলো।" হিহি করে হেসে ওঠে রায়না। এত বছর পরও মুগ্ধ হয় ফাহিম। খোঁচাটা গায়ে মাখে না।
"হুম, মিলি খুব ভালো রাঁধে। "
"তোর বাচ্চা কয়টা?"
"দুইটা মেয়ে।"
"বাঃ , খুব ভালো।"
রায়না মাথা নিচু করে কফি খেতে থাকে। ফাহিম আলাপ চালিয়ে যেতে পারে না। কথার পিঠে কথা বলে জমিয়ে আড্ডা দেয়ার গুণ ফাহিমের নেই, বরং কথা শুনতেই তার ভালো লাগে । অনেকবার এমন হয়েছে, রায়না বকবক করে ছে আর ফাহিম চুপ করে শুনেছে। ফাহিম জানে, শ্রোতা হওয়ার গুণ পৃথিবীতে খুব কম মানুষের আছে। ফাহিম ভালো শ্রোতা বলে তার বন্ধু বান্ধব নেহায়েত কম না।
রায়নার গায়ে ভারী জ্যাকেট, পায়ে কালো বুট। নভেম্বরের ধূসর ঠান্ডায় অবশ্য ভারী কাপড় না পড়লে মুশকিল। আরিজোনার গরম থেকে ইউরোপের ঠান্ডায় ফাহিম কিছুটা কাবু হয়েছে। ফ্রাংকফুর্ট একটা কনফারেন্সে এসেছে দিন চারেক আগে। আজকে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে মিউনিখ যাওয়ার কথা।
ফ্রাংকফুর্ট ট্রেন স্টেশনে ওদের দেখা, প্রায় বাইশ বছর পর।
রায়না মাথা থেকে উলের টুপি খুললো , গাঢ় বাদামি চুলগুলো ছড়িয়ে পড়লো কাঁধ পর্যন্ত। এত সুন্দর লম্বা চুলগুলো কেটে এত ছোট করেছে! এই চুলে মুখ গুঁজে একদিন গন্ধ নিয়েছিলো ফাহিম। কেমন মিহি চন্দন কাঠের মতো একটা দুর্বার গন্ধ। যেন অজানা গহীন বাদামী বনের আরো গভীরে টেনে নেয় সেই গন্ধ। বনের ভেতর বিপদ জেনেও দুরুদুরু বুকে এগিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।
"এত ছোট করে চুল কেটে ফেলেছো! কেন?"
" বয়স হয়েছে না ?আর ভালো লাগে না। তাই কেটে ফেললাম। ম্যানেজ করা সহজ। হটাৎ আমাকে তুমি করে বলছিস কেন?
"ও সরি, ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি করে বললে তোর খুব রাগ হয়। "
"এখনো তুমি করে বলতে তোর ভালো লাগে?" গলাটা কিছুটা কি কেঁপে ওঠে রায়নার? নাকি ফাহিমের শোনার ভুল?
দুজনের আলাপের খানিক বিরতি। ফাহিমের বুকের ভেতর হাজার অভিমান, প্রশ্ন, রাগ পায়চারি করে মরছে কিন্তু মাথার ভেতরের জ্ঞানী অভিজ্ঞ লোকটা বলছে সব চেপে রাখতে।
একসাথেই বেড়ে উঠেছিল ফাহিম আর রায়না। ফাহিমের চেনা জানা চারপাশের সবকিছুর মধ্যে মিশে থাকা মানুষ রায়না। খুব ছোট বেলায় রায়নার বাবা মা আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। লোকে বলতো রায়নার মা কার সাথে যেন পালিয়ে গিয়েছিলো। রায়না বড় হয়েছিল ওর চাচার বাসায়, ফাহিমদের বাড়ির দু বাড়ি পরেই।
রায়নাকে আকাশে ওড়া দুরন্ত ঘুড়ি মনে হয় ফাহিমের অথবা বাঁধ না মানা বন্যা। সবাই তাকে বাঁধতে চায়, দমাতে চায় কিন্তু রায়না তার গাঢ় বাদামী ঢেউ খেলানো উদ্দাম চুলের মতো স্বাধীন। ক্লাস এইটে পাড়ার এক উঠতি মাস্তানের সাথে প্রেম করে এলাকায় শোরগোল পাকিয়ে দিলো। লোকে বলতো , "যেমন ভাগুনি মা, তেমন তার উড়নচন্ডী মেয়ে!"
ফাহিমের কেমন জানি জ্বলতো ভেতরটা। বিকালে খেলার মাঠে রায়না আর আসে না।ছুটির দিনে ছাদে বসে লুডুও খেলে না কিংবা নন্দী স্যারের কাছে পড়তে গিয়ে পাশে বসে ঝিমায় না। এখন কেমন উজ্জ্বল রঙের কাপড় পরে বুকে ওড়না দিয়ে জংলী চুলগুলো বেঁধে ছাদে গিয়ে প্রেমিকের সাথে কথা বলে, রাস্তায় দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। ভালো লাগে না এসব ফাহিমের।
যেদিন প্রেমিকের হাতে মার খেয়ে হাত মুখ ফুলিয়ে কঙ্কালের মতো খাটে শুয়ে ছিল রায়না, মায়ের সাথে ওকে দেখতে গিয়েছিলো ফাহিম।
অন্ধকার ঘরে পরে ছিল রায়না। তার চাচী অকথ্য গালি দিচ্ছিলো অবিরাম। এমনকি ফাহিমের মাকে দেখেও থামেনি।রায়নার চাচা চুপটি করে বসে ছিলেন । চাচীর চিৎকার শুনতে শুনতে হটাৎ নিয়ন্ত্রণ হারালেন । গলা সপ্তমে চড়িয়ে বললেন, "একবার উঠুক বিছনা থেকে, এই মেয়েকে আমি পিটিয়ে বিদায় করবো। সারাজীবন আমারটা খেয়ে, আমারটা পরে আমার মুখে চুনকালি মাখতে আসছে?" তারপর রায়নার মাকে তুলে আবার সেই যা তা।
ফাহিম আর ফাহিমের মা ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলো। সেদিন রাতে ফাহিমের খুব কান্না পেয়েছিলো। তার খুব ইচ্ছা করছিলো রায়নার পাশে গিয়ে বসে থাকতে। যে মেয়েটা খেলার মাঠে দু তিনজনকে মেরে কেটে বেরিয়ে আসতে পারতো আজকে কেন সে এভাবে ঘায়েল হলো -সেই হিসাব মেলাতে পারলোনা ফাহিম।
"তোর ট্রেন কখন ফাহিম ?"
"এইতো, সাড়ে চারটায়।"
ঘড়ি দেখে রায়না। আর বেশিক্ষন নেই।
"তুই কি আমাকে কিছু বলবি?"
ফাহিম প্রশ্নটার উত্তর কি দেবে ভাবতে থাকে। খানিক্ষন তাকিয়ে থাকে রায়নার চোখে।
"তুই লোকটাকে বিয়ে করেছিলি কেন? "
"তোর থেকে পালানোর জন্য।"
"ফালতু কথা রাখ। সত্যি কথা বল। তোকে আমি কতদিন খুঁজেছি জানিস? ইন্টারনেটে, তোর বন্ধুদের কাছে, তোদের বাসায়, সবখানে খোঁজ নিয়েছি। তোকে কোথাও খুঁজে পাইনি "
ফাহিমের মাথার জ্ঞানী লোকটা চুকচুক করে শান্তনা দিয়ে বললো, "পারলে নাতো ফাহিম? আজকেও পারলে না?"
সেদিন ঠিক এভাবে হেরে গিয়েছিলো ফাহিম। রায়না ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো সিঁড়ি কোঠায়। ফিসফিস করে বলেছিলো, "তুই সবসময় থাকবি আমার সাথে?"
ফাহিম একসাথে থাকা মানে কি বোঝেনি। খালি বুঝেছিলো ও সারাজীবন রায়নাকে শক্ত করে ধরে রাখবে। আর কেউ কখনো রায়নাকে কষ্ট দিতে পারবে না। অথচ ঢাকায় ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় হটাৎ রায়নার চিঠি, "ফাহিম শোন, তুই আমার মধ্যে যাকে খুঁজিস, আমার মধ্যে সেই মানুষটা আসলে তুই কোনোদিন পাবি না। তুই আমাকে খুঁজতে আসবি না। যেখানেই থাকবি, ভালো থাকবি।"
চিঠি পরে সব ছেড়ে ছুড়ে বাড়ী ফিরে এসেছিলো। রায়নাদের বাড়িতে গিয়ে শুনেছিলো রায়নার বিয়ে হয়েছে সপ্তাখানেক আগে। ছেলে জার্মানিতে চাকরি করে।
রায়নার চাচী মহা খুশি হয়ে বলেছিলো , "এমন জংলী মেয়ের এমন ভালো বিয়ে হবে আমি জন্মেও ভাবি নাই।"
সেই দিনটা ঠিক কেমন ছিল ফাহিম মনে করতে পারে না। মাথার ভেতরের জ্ঞানী ব্যক্তি সেই দিনটাকে একটা কালো বাক্সে পুরে কোনো এক গভীর পুকুরের অতলে গেঁথে দিয়েছিলো। সেই ভালো ছিল। আজ এতদিন পরে জ্ঞানী লোকটার পাহারা ভেঙে বাক্সটা হাতে নিয়ে ফাহিম বোকার মতো তাকিয়ে আছে রায়নার দিকে।
"ফাহিম, তুই ভালোবাসার মানুষের সাথে সংসার করতে চেয়েছিলি । এখন যেমন আছে ঠিক এমন জীবন চেয়েছিলি। কিন্তু আমি এমন সংসার জীবন তোকে দিতে পারতাম না। আমি ছকে বাঁধা জীবন চাইনি। আমি আমার মতো থাকতে চেয়েছিলাম। তোকে ঠকাতে চাইনি। তুই দেখ, তোর জীবনটা মিলির সাথে কত সুন্দর।"
"হিপোক্রেসির একটা সীমা আছে! বিয়ে করতে চাসনি তো জার্মানির লোকের সাথে তো ঠিকই বিয়ে করে আরামে আছিস!"
"আনিসকে বিয়ে করেছিলাম ওই বাড়ি থেকে, ওই দেশ থেকে পালানোর জন্য। আমাদের বহু বছর আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এরপর কত কাজ করলাম! এখন একটা থিয়েটার গ্রূপের সাথে কাজ করি। ওদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। জানিনা কতদিন এই কাজটা ভালো লাগবে। যতদিন লাগবে করবো, তারপর ছেড়ে দেবো।আমার এমন থাকতেই ভালো লাগে। সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো উড়তেই আমার ভালো লাগে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো তোর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছি। ব্যাপারটা একই সাথে তীব্র ভালো লাগার আবার খুব কষ্টেরও। আমি মনে হয় তোকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। "
আলতো করে চোখ মোছে রায়না। তারপর মাথায় উলের টুপি পরে, পাশে রাখা বড়োসড়ো ব্যাগটা তুলে নেয়।
"কফির জন্য থ্যাংকস। আজকে যাই রে। "
"তোর ঠিকানা ফোন নাম্বার দে। "
"না। আমি চাইনা তোর সাথে আমার আর কোনোদিন যোগাযোগ হোক। "
ফাহিম কিছু বলে না। কি এক পাগলামিতে ওর মনে হয় রায়নার হাতটা শক্ত করে ধরতে। কিন্তু ততক্ষনে ফাহিম আর রায়নার গন্তব্য আলাদা হয়ে গেছে।
২২ জানুয়ারী - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
২৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪