তবুও বসন্ত এসেছিলো

ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারী ২০১৬)

Salma Siddika
মোট ভোট ২৯ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.২১
  • ২৪
দীপ্তিময় হলুদে ছাওয়া হিজল গাছটার দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মতি। গাছটার যেনো প্রাণ আছে, ফুলের সোন্দর্য দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে। মতি চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে গাছটার দিকেই তাকিয়ে থাকে। তার কোনো তাড়া নেই, অঢেল সময় নিয়ে চা খেতে পারে।
বাজারে ভিড় বাড়ছে। রহমতের চায়ের দোকানেও বেশ ভিড়। মতি চারপাশের মানুষগুলোকে দেখে, তাদের জীবনে কত রকম সমস্যা! সবচেয়ে বড় সমস্যা টাকার। বেশির ভাগ মানুষ অভাবী। তারা তাদের দৈনন্দিন ছোটখাট সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা করতে পারে। মতি মনে মনে খুব হাসে। তার মনের ভেতর একটা খোলা ময়দান, সেখানে টাকা লাগে না। মতি সেখানে মহারাজা।
রহমতের দোকনের সামনেই আলমের টিনের দোকান। দোকানের সামনে একটা ছোট ট্রাক দাড়িয়ে আছে। আলম দোকান থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছে। দোকানে আনিস কাজ করে, আজকে আসেনি, তার নাকি পেট খারাপ। ট্রাক থেকে টিন নামানো দরকার।
হঠাৎ মতিকে দেখে ডাকে আলম। মতি একচুমুকে চা শেষ করে পকেট থেকে ময়লা একটা দুই টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় রহমতের দিকে।
রহমত খেকিয়ে উঠে, ' দুইকাপ চা, ছয় ট্যাকা, দুই ট্যাকা দিয়া কই যাস?'
মতি গা করে না , আলমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
'মতি, আছস কেমন?'
মতি ঘাড় নেড়ে হাসে।
'মাথা ঠান্ডা আছে তো?'
'মাথা বরফ ঠান্ডা।'
আলম চোখ কুঁচকে তাকায়। মতি এমনিতে ভালই কাজ করে, গায়ে গতরে শক্ত আছে। কিন্তু মাথার সমস্যাটাই ভয়ের। হুটহাট তার মাথা গরম হয়ে যায়, তখন মতি কোনো কিছুর পরোয়া করে না। যাকে খুশি মারধর করে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে গালি দেয়, পাগলা ঘোড়ার মতো মাটিতে লাথি দিতে থাকে, যেন সব রাগ ক্ষোভ ওই মাটির প্রতি।
মতিকে বাজারে সব সময় দেখা যায় না, মাঝে মাঝে তার মর্জি হলে আসে। যখন আসে, আলম তখন মতিকে দিয়ে পঞ্চাশ টাকার কাজ দশ টাকায় করিয়ে নেয়।
আলমের কথা মত ট্রাক থেকে টিন নামিয়ে রাখে মতি। কাজ শেষে আলমের সামনে আবার এসে দাঁড়ায়।
আলম দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়। মতি কেমন চুপ করে থাকে, হাত বাড়িয়ে নোটটা নেয় না।
'কিরে, ট্যাকা নে।'
'ট্যাকা লাগত না, ভাত খামু।'
'আরে কয় কি? ভাত কই থেইকা দিমু?'
'চাইর দিন ধইরা খালি মুড়ি খাই, ভাত খাইতে মন চাইতেছে, কাঁচা মরিচ দিয়া গরম ভাত।'
আলম থম ধরে তাকিয়ে থাকে, মহা মুশকিল দেখি!এখন ভাত কোথায় পাবে? আবার ভাত না দিলে পাগলের মাথা গরম হতেও পারে।
একবার মতির পাগলামি দেখেছে আলম। সেই ভয়াবহ দৃশ্য আর দেখতে চায় না।
'আইচ্ছা, দুইফরে বাড়িত খাইতে যামু, তুই আমার লগে যাইস।'

মতি দোকানের সামনে বেঞ্চে গিয়ে বসে। আবার আশেপাশের লোকগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়। আলম খেয়াল করে মতি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে আর মুখ টিপে হাসছে। তার চোখ উদ্ভ্রান্ত। মতির পরনে রং জ্বলা চেক লুঙ্গি আর ময়লা ধুসর রঙের শার্ট। কে যানে, শার্টটা হয়ত কোনদিন সাদা ছিল, এখন তার উপর ধূলোর আস্তরণ। মাথার চুলে নির্ঘাত জট পাকিয়ে আছে। রোদে ঝলসানো অকালে বলিরেখা পড়া রুক্ষ চামড়া। অথচ চোখ দুটো অম্লান উজ্জ্বল!

এই বাজারেই মতির মনোহারি দোকান ছিল। তেল,সাবান ,নারিকেলের বিস্কুট, আচার আরো কত কি পাওয়া যেতো। সব সময় ভীড় লেগেই থাকত। আলম নিজেই তো কতদিন মতির দোকান থেকে সদাই কিনেছে।

ভাতের অপেক্ষা করতে করতে মতি যখন প্রায় ঝিমিয়ে পরছিল তখন আলম তাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল।

বাজারের পেছনে ঢালু জমি পেরুলেই গ্রামের ভেতর যাওয়ার রাস্তা। মতি ভাবুক চোখে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। আগুন লাগা লাল ফুলে ছেয়ে আছে গাছটা। এই ফুলগুলো শাহিনার খুব পছন্দ ছিলো। একবার আবদার করলো ঠিক এই ফুলের মত লাল একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে তাকে। মতি গাছ থেকে ফুল ছিড়ে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল শাড়ির দোকানে। সাথে তার বন্ধু কামালও গিয়েছিলো, কত হাসলো তার কান্ড দেখে!

'কিরে, দাঁড়ায় গেলি ক্যান? তাড়াতাড়ি আয়।'
আলমের তাড়ায় মতি আবার হাঁটতে থাকে।
'মতি, তোর মাথা তো এখন ঠান্ডাই থাকে। দোকান আবার দিবি নাকি?'
আলমের উপহাস মতির গায়ে লাগে না। মতির দুঃসময়ে আলম কম দামে দোকানটা কিনে নিয়েছে। এখন দোকান চালায় তার ছোট ভাই। মতির ছোট দোকান এখন অনেক বড় হয়েছে। চারজন কাজ করে। মতি মাঝে মাঝে দূর থেকে দোকানটার দিকে তাকিয়ে দেখে, মাথার ভেতরটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়, কেমন যেন অস্থির লাগে।

আলমের বৈঠক খানায় খাবার দিয়েছে আলমের বউ। একটা ছোট কাজের মেয়ে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে।
আলমের বৌএর মাথায় লম্বা ঘোমটা, গাড়ো সবুজ শাড়ির ফাঁকে চিকন দুইটা সোনার চুড়ি ফর্সা হাতে কি সুন্দর দেখা যাচ্ছে, মতি আগ্রহ নিয়ে ফর্সা হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

শাহিনার খুব শখ ছিলো সোনার চুড়ি পরার কিন্তু মতির স্বাধ্য ছিল না। একবার হাটে এক ফেরিওয়ালা চুড়ি বিক্রি করতে আসলো। বাজারে সেই চুড়ি নাকি নতুন এসেছে, শুধু মাত্র ঢাকায় পাওয়া যায়। ফেরিওয়ালা ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছে। সেই চুরি দেখলে নাকি স্বর্ণকারও ধোঁকা খেয়ে যাবে।
ফেরিওয়ালা ইনিয়ে বিনিয়ে কত ভালো ভালো কথাই না বললো চুড়ি নিয়ে, 'এই চুড়ি নিয়া আপনার ইস্তিরির হাতে পরায় দিয়া বলবেন, স্বর্ণের চুড়ি। জীবনেও বুঝতো না এইটা ইমিটেশন। সারাজীবন চুড়ি পিন্দা গোসল করলেও চুরির রং যাইবো না। গেরান্টি দিতাছি, আমি কিন্তু মিছা কইয়া ব্যবসা করি না।'
মতি দুইটা চুড়ি কিনেই ফেললো।
রাতে ঘরে ফিরে হাতে পরিয়ে দিতেই ঝলমল করে উঠলো শাহিনা।
'ওমা, স্বর্ণের চুরি ক্যামনে পাইলেন ? কই থেইকা কিনলেন? অনেক ট্যাকা লাগছে না?'
আনন্দে চিকচিক করা শাহিনার চোখের দিকে তাকিয়ে মতি মিথ্যা বলতে পারে না। নিচু গলায় বলে 'স্বর্ণের চুড়ি না বউ, ইমিটেশন।'
'কি কন? আপনে না কইলে তো আমি বুঝতামই না।'
'তোমারে স্বর্ণের চুড়ি দিতে পারলাম না, দিলাম ইমিটেশন।'
মতির কথায় মুখ চেপে হেসে ফেলে শাহিনা। দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে মতিকে।
'স্বর্ণের চুড়ি না তো কি হইছে? এই চুড়ি দুইটা অনেক সুন্দর। আপনে মন খারাপ করেন কেন?'
সেই মুহুর্তের বিন্দু বিন্দু সুখ প্রবল শক্তিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মতিকে। শাহিনার চুলে তেলের গন্ধ, জংলা ছাপের শাড়ি, দুগছা চুড়ির টুংটাং শব্দ; এমন আরো কত কিছু যে ভুলতে চায় মতি কিন্তু ভুলতে পারে না।
আলমের ডাকে চমকে উঠে মতি। 'কি মিয়া, খাওয়া থুইয়া কি ভাবতাছো?'
'খাইতে মন চাইতেছে না, আইজকা যাইগা।'
'আরে মিয়া বসো, তোমার লগে কথা আছে। '
আলম মতির হাত টেনে বসিয়ে দেয়।
'মতি, তোমারে কিছু কথা কই, শুনো। মাথা গরম করবা না। তুমি যে এই রকম পাগল হইয়া ঘুরতেছ, কোনো লাভ হইতেছে? দোকানটা হাত ছাড়া করলা, ঘরে দানা পানি থাকে না, এইখনে যেইখানে ঘুইরা বেড়াও। মাইনষে তোমারে পাগল কয়। আর ওইদিকে শাহিনা আরেকজনরে বিয়া কইরা ভালোই আছে । এইতো কয়দিন আগে জামিনপুরের পীর সাহেবের ওরশে শাহিনা তার স্বামীকে নিয়া আসছিলো। তার স্বামীর সাথে কথা বইলা বুঝছি, ভালো টাকা পয়সাওলা। শাহিনার কাপড়-চোপড় গয়না দেইখা বুঝা গেল সে ভালই আছে। তোমার কথা একবারও জিগায় নাই। অবশ্য স্বামীর সামনে ক্যামনে জিগাইবো? তবে শাহিনা অনেক ভালো আছে। আর তুমি এইখনে কি করতেছ? যার জন্য পাগল হইয়া ঘুরতেছ, তারতো তোমার জন্য কোনো চিন্তা নাই।'
মতির ভেতর আগুন ফুসে উঠে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আলমের দিতে তাকিয়ে হাতের প্লেট ছুড়ে মারে। প্লেট ভাঙ্গার শব্দ শুনে আলমের স্ত্রী ভেতর থেকে ছুটে আসে।
'ভাত খাওয়াইতে নিয়া আইসা প্যাচাল পারস ক্যান?' মতি একগাদা গালিগালাজ করে হনহন করে বের হয়ে যায়।

মতি বাড়িতে ফিরে দরজা বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে পরে। কে যেনো তাকে পরামর্শ দিয়েছিল বেশি রাগ উঠলে চুপচাপ সোজা হয়ে শুয়ে পড়তে।
মতি একদৃষ্টিতে ঘরের চালের দিয়ে তাকিয়ে থাকে। মতি এমনিতে ঘরের দরজা জানলা সবসময় বন্ধ রাখে তাই ঘরে কেমন একটা বদ্ধ গুমোট ভাব। এর মাঝে চালে কয়েকটা ফুটো গলে তীক্ষ্ণ আলোর রেখা ঘরে ঢুকে কেমন যেন রহস্য তৈরী করেছে।

মতির মাথায় আগুনের ফুলকিগুলো শান্ত হয়েছে। যে তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল সটান শুয়ে পড়লে রাগ কমে যায়, বুদ্ধিটা ভালই দিয়েছে।

মতির এক দুসম্পর্কের মামা শাহিনার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলেন। মতির বাবা মা কেউ নেই। নানা সংকট ঘিরে থাকলেও মতি পরিশ্রম করতে পারতো। বাজারে দোকানটাও ভালই চলছিল। শাহিনার বাবা মা এতিম ছেলের সাথে বিয়ে নিয়ে নিম রাজি ছিলো, তারপর কিভাবে জানি বিয়ে হয়ে গেল মতিউর আর শাহিনার।

বিয়ের দিনটার কথা খুব মনে পরে মতির। কেমন যেন ভয় আনন্দ মেশানো অনুভুতি। নিজের মায়ের মুখটা আবছা আবছা মনে পরলেও বাবার কথা কিছুই মনে নেই মতির। অন্যমানুষের ভরা সংসার দেখলে নিজের বুকটা এমন খাখা করত, শাহিনাকে দেখে মনে হলো সব শুন্যতা পূরণ হয়ে গেছে। খালি মনে হলো এই মেয়েটাকে সে কোনদিন কোনো কষ্ট দেবে না।

মতি চোখ বন্ধ করলে এখনো সব দেখতে পায়। তাদের সংসারে ভালবাসার কোনো শেষ ছিল না। দিনশেষে বাড়ি ফেরার তাড়া আর অপেক্ষায় বসে থাকা শাহিনার মুখটা মতিকে উজ্জীবিত করতো । মাঝেমাঝেই এটা সেটা নিয়ে যেত শাহিনার জন্য, একটু কদমা, চুলের ক্লিপ কিংবা সাবান। শাহিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত আর তারপর হেসে লাজুক গলায় বলতো 'কি সব ছাতা মাথা কিন্না পয়শা নষ্ট করেন?'

আচ্ছা, শাহিনার কি সেসব কিছুই মনে পরে না? সব ভুলে গেছে? যেদিন তাদের ছেলে বাবলু জন্মালো, মতি পাগলের মত কেঁদেছিল। আশেপাশের বাড়ির লোকজন তার কান্ড দেখে হেসে বাঁচে না ! বাবলুকে কোলে নিয়ে মতির মনে হয়েছিলো পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাওয়ার নেই তার। যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল তারচেয়ে অনেক বেশি সুখ তার কোল জুড়ে ঝলমল করছে।

আবছা অন্ধকার ঘরে আলোর রেখাগুলো কেমন যেন এক বিচিত্র নকশা তৈরী করেছে। বাবলু কি পানিতে ডোবার সময় আলো দেখেছিল? ওইতো সেদিন মতি দোকানে কাজ করছিল, কে যেনো দৌড়ে এসে জানালো বাবলু পুকুরে পরেছে। ছুটে এসে বাড়ির উঠানে বাবলুর লাশ দেখে মতির মনে হয়েছিল পুরো ব্যাপারটাই বানানো -মিথ্যা। সে অবাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে ছিল। শাহীনা আছড়ে পরে কাঁদছিল , তাতে যেন মতির কিছু যায় আসে না। তার শুধু মনে হয় বাবলু কিছুতেই পানিতে নামতে পারে না। কতবার বাবলুকে গল্প শুনিয়েছে,' ওই পুষ্কুনির তলে কিন্তু রাক্ষস আছে , তুমি কিন্তু কোনদিন ওই পানিতে যাইবা না। ঠিক আছে বাপ ?' বাবলু কি সুন্দর ঘাড় কাত করে সায় দিত, সে কখনো যাবে না। তাহলে কিভাবে গেলো ? বাবলুর লাশটা দেখে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি উঠে বসবে। মতি কত ডাকলো, বাবলু উঠেনি।

বেশিরভাগ সময় মতি পুকুরের পাড়ে বসে থাকতো। তার মনে হত যেকোনো সময় বাবলুকে দেখা যাবে। হঠাৎ হঠাৎ পানিতে নেমে পাগলের মত আঘাত করত পানিতে, যেন অদৃশ্য রাক্ষসটাকে মারছে। কত কষ্ট হয়েছে বাবলুর! হাত পা ছুড়ে চিৎকার করে বাবাকে ডেকেছে, মতি শুনতে পায়নি। তিন বছরের বাবলুর ছোট্ট বুকে পানি ঢুকেছে, বাবলু নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, বাঁচার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছটফট করেছে কিন্তু মতি কিছুই করতে পারেনি। সেই হতাশা আগুনের মত পোঁড়ায় মতিকে।

শাহিনার মনে হয় মতিউর থেকে ধীরে ধীরে মতি পাগলা হয়ে যাওয়া মানুষটার সাথে তার যোজন দুরত্ব। হাত বাড়ালেই মানুষটাকে আর পাওয়া যায়না। মতির নিচ্ছিদ্র বলয়ে শাহিনার কোনো স্থান নেই। প্রায় বছর ঘুরে গেলেও মতি শাহিনার সাথে ঠিক মতো কথাও বলে না। মাঝে মাঝে মতিকে ভয় হয় , লোকটা কেমন বদলে গেছে, শত চেষ্টা করেও লোকটাকে কাছে আনতে পারে না।

মতির মনে আছে সে রাতের কথা। শাহিনা তার পাশে শুয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, আদর সোহাগ চায়। মতির হঠাৎ কি যেনো হয়, এক ঝটকায় শাহিনাকে বিছানা থেকে ফেলে দেয়। তারপর হিসহিস করে বলে, 'কেমন মা তুমি? তোমার পোলা মইরা গেছে, আর তুমি আমার সাথে সোহাগ করতে আসছো ? তুমি মা, নাকি রাক্ষসী?'
শাহিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিচু গলায় বলে, 'আমার কি দোষ?'
মতি চিৎকার করে উঠে, 'সব দোষ তোর। একটা মাত্র পোলা তুই দেইখা রাখতে পারলি না? তুই মারছোস আমার পোলারে.................’
হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারতে থাকে শাহিনার দিকে। আতঙ্কে কাঁদতে থাকে শাহিনা। তারপর চুলের মুঠি ধরে এলোপাথারি মারতে মারতে ঘরে থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে । তাদের চিৎকারে আশেপাশের বাড়ির মানুষজন চলে আসল। সবার সামনেই মতি বললো ,' তোর চেহারা আমি দেখতে চাইনা আর। চইলা যা তুই, এক্ষণ চইলা যা। '

শাহিনা সে রাতেই চলে গেলো। আর ফিরে আসল না। মতির অনেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হয়েছে দরজা খুললেই দেখবে শাহিনা উঠানে মুরগিগুলোকে ধান ছিটিয়ে দিচ্ছে। কখনো নির্ঘুম রাত শাহিনার সাথে একা একা গল্প করেছে , ফিস ফিস করে বলেছে, 'আমার ভুল হইছে, তুমি চইলা আসো।' শাহিনা আসেনি।
বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য লাগে মতির। ছোট বেলায় তার মাকে একদিন করা যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো। মায়ের সেই মুখটা কেমন আলো ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মত। মাঝে মাঝে মনে হয় মায়ের আবছা মুখের মত শাহিনার মুখটাও আবছা হয়ে যাবে। কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও শাহিনার মুখটা কেন ভুলতে পারে না?

খাটের তলায় রাখা ধুলো জমা ট্রাঙ্কটা খুলে হাতড়ে কাপড় খোঁজে। অনেকদিন পর একধরনের নিঃশব্দ উচ্ছাস টের পায় নিজের মাঝে। আজকে শাহিনাকে দেখতে যাবে।
সবচেয়ে ভালো শার্ট আর পান্ট পরে নেয় মতি। বহুদিন বাক্সবন্দী থাকার কারণে কাপড়ে কেমন একটা গুমোট গন্ধ। মতি হাত চালিয়ে শার্টটাকে নিপাট করার চেষ্টা করে। ভাঙ্গা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অগোছালো ময়লা চুলে হাত বুলিয়ে গোছানোর ব্যর্থ চেষ্টা। শাহিনার এক শিশি সুগন্ধি তেল ছিলো, সেটা পাওয়া গেলে চুলে মাখা যেতো।
শাহিনার স্বামীর নাম ঠিকানা বলেছিল আলম। বেশি দূরে না, হেঁটে গেলে হয়ত তিন ঘন্টা লাগবে। অনেকদিন পরে একটা গন্তব্য পাওয়া গেছে।বারবার মতির মনে হয় এই পথের শেষে আনন্দময় কিছু আছে।

দুপুর মাত্র পার হয়েছে, গ্রামের এই ছায়া মাখা রাস্তাটা নিরিবিলি থাকে এই সময়। মতি মাথা নিচু করে অকারণেই হাসে। আবার একটু গম্ভীর হয়ে যায়, শাহিনা যদি তাকে দেখে রেগে যায়? যদি ঠিক আগের মতই মুখ ফুলিয়ে বলে,' কিছু খান নাই, ঠিক না? মুখটা কেমন শুকায় গেছে ।'

দূরে কথাও অজানা কোনো পাখি ডাকছে। কোকিল নাকি? মতি থমকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে। ঠিক পলাশরাঙা শাড়িটা পরে থাকবে নাকি শাহিনা ? অজানা কৌতহলে মতির ভেতরটা তোলপাড় করে।

কুমারডাঙ্গা পৌঁছতে প্রায় শেষ বিকাল হয়ে গেল। গ্রামে ঢোকার মুখে কিছু জটলা দোকানপাট , ছোট খাটো হাটের মতো। মতি একটা দোকানে শাহিনার স্বামীর পরিচয় দিয়ে ঠিকানা নিয়ে নিলো।
শাহিনার বাড়ির সামনে এসে মতি থমকে গেলো, কি সুন্দর বাড়ি! ঝকঝকে টিনের চালে সূর্যাস্তের শেষ আলো উজ্জল । পাকা বাড়ির সামনে থেকে ভেতরে ঢোকার লোহার গেট। সব ছবির মত সাজানো।
মতি কি করবে বুঝতে পারে না। একবার ভাবে, ফিরে যাবে। তারপর আবার মনে হয় একবার শাহিনাকে দূর থেকে দেখে যাবে।
মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। মাথায় টুপী পরে অল্প বয়সী একটা ছেলে বের হয়ে আসে।
'আপনে ক্যাডা ? কারে খুঁজেন?
মতির গলা ধরে আসে। উত্কন্ঠা, উত্তেজনা আর কৌতহলে মতির মাথা এলোমেলো লাগছে।
'এই বাড়িতে কি শাহিনা নামে কেউ থাকে?'
'হ, থাকে। আপনে তার কাছে কি চান?'
'একটু দরকার ছিলো, অনেক দূর থেইকা আসছি।'
ছেলেটা মতির পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে। মতি আরো আড়ষ্ট হয়ে যায়।
কি ভেবে ছেলেটা গেটের ভেতরে ঢুকে যায়।
মতির হাত পা কেমন যেন কাঁপছে। খুকখুক কাশি আসছে। এতক্ষণ তো কাশি ছিলো না, এখন কেনো এত কাশি আসছে কে জানে।
মাথায় বড় ঘোমটা দিয়ে একজন বের হয়ে আসে। হলুদ রঙের শাড়ি সন্ধ্যার আলোতে ফুটে উঠেছে। মহিলা ঘোমটা একটু সরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
'আমার কাছে আসছেন? কি বিষয়?'
মতি খুকখুক কাশতে থাকে।
মহিলা ভালো করে ঘোমটা সরিয়ে মতিকে দেখে। মতিও বোকার মত হা করে শাহিনাকে দেখে। এ কয় বছরে আরো সুশ্রী হয়েছে। হাতে সোনার চুড়ি । এমন চুড়ি মতি কোনদিন কিনে দিতে পারেনি।
মতিকে চিনতে শাহিনার কিছুটা সময় লাগলো। চিনতে পেরে চমকে দু পা পিছিয়ে গেলো।
'কেমন আছ শাহিনা?'
'এইখানে ক্যান আসছেন?'
মতি লজ্জার মাথা খেয়ে বলে, 'তোমারে দেখতে আসছি, দেখতে মন চাইতেছিলো। '
'এতদিন পরে মনে খায়েশ উঠছে? এতদিন উঠে নাই?'
'আগে আসলে আমার লগে যাইতা ?'
'না , যাইতাম না, আপনের মাথা নষ্ট হইয়া গ্যাছে। আপনের লগে কেউ থাকতে পারে না। '
কথাটা বলে শাহিনার ভয় লাগে। হঠাৎ মতি রেগে যায় যদি? বাড়ির লোকজন জানলে সর্বনাশ হবে।
'আপনে এইখান থেইকা যান। এক্ষনি চইলা যান, আর কোনদিন এইখানে আইবেন না। এইটা আমার স্বামীর বাড়ী। উনি জানতে পারলে আপনেরে খুন কইরা ফেলবে।'
শাহিনা মুখে কাপড় চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।
'আইচ্ছা , তোমার কি কোনদিন আমার কথা মনে হয় নাই? মনে হয় নাই আমি বাইচা আছি না মইরা গেছি? একবার আমার খবর নিতে ইচ্ছা করে নাই?তোমরা সবাই আমারে ফালাইয়া চইলা গেলা?' অভিমানে মতির কথা জড়িয়ে যায় ।
ঠিক তখন গেটের ভেতর থেকে একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে আসে, তিন চার বছর বয়স।
ছেলেটা শাহিনার আঁচল ধরে অবাক হয়ে মতির দিকে তাকিয়ে থাকে, 'এইটা কে , মা?'
মতি চমকে দেখে তার বাবলু সামনে দাঁড়িয়ে আছে! ঠিক একই রকম মায়া কাড়া চেহারা, গায়ের রং।
মতি হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে ডাকে।শাহিনাকে অবাক করে দিয়ে অচেনা লোকটার দিকে তার ছেলে এগিয়ে যায়।
মতি দুহাতে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কাঁদতে থাকে।
শাহিনার উত্তর দেয়ার আর প্রয়োজন নেই, মতি সব জবাব পেয়ে গেছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া পুরোনো গল্পটি নূতন করে ভালো লাগল। ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১৯ জানুয়ারী, ২০১৮
ইমরানুল হক বেলাল "তবুও বসন্ত এসেছিল" নামেৱ সাথে লেখাটিও সত্যিই অসাধাৱণ হয়েছিল। তৃতীয় হওয়াৱ জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন।
আতিক সিদ্দিকী অভিনন্দন জানাই সালমা সিদ্দিকা আপনাকে.
জয় শর্মা (আকিঞ্চন) অভিনন্দন রইল...
অনেক ধন্যবাদ
শামীম খান অনেক অভিনন্দন আপুকে ............।
অনেক ধন্যবাদ
এশরার লতিফ অনেক অভিনন্দন।

২২ জানুয়ারী - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ২৫ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.২১

বিচারক স্কোরঃ ৩.০৩ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.১৮ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী