এ ভরা বাদর মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর… আপন মনে গুনগুনায়। গুনগুনায় জয়গুন, বিরহের মিষ্টি সূর। ‘‘মিলনের আশু প্রত্যাশা থাকলে বিরহ এক প্রকার সুখানুভূতিই বটে’’- কোন মহাজনের কথা কিনা মনে করতে পারলো না। প্রত্যেকটি মানুষ নিজেই দার্শনিক, হয়তো এটি তার অন্তর্নিহিত দার্শনিক মনেরই উচ্চারিত বানী। তবে ওর মনে কেমন যেন একটি সুখ সুখ অনুভূতি ঘুরছে, সেটি কিন্তু সত্যি। হঠাৎ মনে অপ্রচলিত সূর বেজে ওঠা নিয়ে কিঞ্চিত ভাবনায় পড়ে সে। আজকাল ধ্রুপদী গানের জায়গা কোথায়? তাও এই গাও-গেরামে। যুগ তো এখন ‘ফাইট্যা’ যাওয়ার। বিরহ মানে কর্কশ স্বরে কলজে ফাটার বিলাপ, নয়তো কিম্ভূত সূরে ‘‘ধিকি ধিকি…’ আগুন জ্বলার প্রলাপ। অন্তর্বাসবিহীন আড়াই প্যাঁচের শাড়িপরা আর হাতে গোবর-ঘুটের গন্ধ লেগে থাকা জয়গুনের কণ্ঠে অবশ্যই বৈষ্ণব পদাবলী কিংবা বিদ্যাপতির গান মানায় না, নিদেনপক্ষে চলতে পারে কোন মেঠো পল্লী গীত।
জানালায় মাথা রেখে একটা দিক ব্যাথা হয়ে গেছে জয়গুনের। সেই বিকেল থেকে এক আসনে এক ধ্যানে বসে আছে সে। ছোটবেলায় খুব বেড়াতো ওরা। বাস কিংবা ট্রেনের জানালার পাশে বসে বাইরে দেখার সখ ছিল ওর। ট্রেনে লম্বা ভ্রমণে জানালার পাশের সিটে এক বিড়ম্বনা হয়- একপাশ ফিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড়ে আড়ষ্টতা আসে। এ থেকে মুক্তির পথও আছে, মুখোমুখি যাত্রীর সাথে আসন পাল্টে নেয়া। ঘরের কোণে প্রতীক্ষার এই বিকেল-সন্ধ্যা-রাতে তার কোন সহযাত্রী নেই। আর নজর রাখার দিকও একমুখী, পাল্টে নেয়ার সুযোগ কই!
বেশ অবাক হলো জয়গুন। বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু আকাশে ফকফকে জোছনা। রোদের মাঝে বৃষ্টি হয়, তার একটা মজার নামও আছে- খেঁক শিয়ালের বিয়ে। চাঁদনি রাতে বৃষ্টি হলে তার নাম কি, কে জানে? আচ্ছা, রোদের মাঝে বৃষ্টি হলে রংধনু দেখা যায়। চাঁদের আলোয় বৃষ্টি হলে তেমন কিছু দেখা যায় কি? শোনে নি কখনো। এমন আজগুবি ভাবনার লোকই বা আছে ক’জন? বাইরে বের হয়ে খোলা আকাশে তাকিয়ে দেখলে হতো।
জানালা থেকে পথের অনেকটা দেখা যায়। গ্রামবাংলার জনপ্রিয় কোন স্থির চিত্রের এক সাক্ষাত উদাহরণ হতে পারে জয়গুনের বর্তমান বাস্তু। হাট থেকে এখনও একজন দুজন ফিরছে। মাথায় ঝাঁকা, দড়ি ধরা ছাগল-গরু। এরা দেরী করে ফেরার দলের। টুপি-পাঞ্জাবী পরা দুয়েকজন মুসুল্লি দেখে মনে পড়লো কখন যেন এশার আজান হয়ে গেছে! এরা নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফিরছে। অজ্ঞাতে মাথায় আঁচল উঠে যায়। সহজাত বাঙালী মুসলিম সংস্কৃতি। স্মিত হেসে ফেলে জয়গুন। কত খুঁটিনাটি জিনিসও সে রপ্ত করে ফেলেছে। আগে ফেরার দল, পরে ফেরার দল- কোন দলেই নেই মেহের। টুপি পাঞ্জাবীর দলে তো সে থাকবেই না।
ছোটবেলায় ওরা কবুতর পুষতো। ওর সবচে প্রিয় ছিল নীল একটা গিরিবাজ। ওদের বাসার বারান্দা থেকে মুখোমুখি রাস্তার ওপারে লাল ইটের স্টেশন ভবনের ছাদে ছুটোছুটি করতে থাকা কবুতরগুলো দেখা যেতো। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলে একে একে সবগুলো পায়রা খোপে ফিরতো। দুষ্টু নীল গিরিবাজটি মনে হয় ছোট্ট মেয়েটির ভালবাসার প্রতীক্ষার কথা জানতো। নীল পাখা উড়িয়ে ও ফিরতো সবার পরে। অপার্থিব এক আনন্দের শিহরণ মনে নিয়ে বালিকাটিও বারান্দা থেকে ফিরে যেতো ঘরে। এখন বড় হয়ে বুঝছে- প্রতীক্ষায় রাখা এবং থাকা, দুটোতেই বুঝি আনন্দ আছে।
…… আকাশী নীল জামা পড়া মানুষ-পায়রা জয়গুনের যৌবন সখা মেহেরকে দেখা যাচ্ছে! মনে ছোট্ট একটি দোলা লাগে- গিরিবাজ ফিরছে! সন্ধ্যাদীপ জ্বলে নি। প্রদীপ জ্বলার উপলক্ষই ছিল না এতক্ষণ, মুরুব্বিও নেই কেউ বাড়িতে। কে তাড়া দেবে? এখন আর আলস্যের সময় নেই জয়গুনের। তাড়াতাড়ি উঠে কুপি জ্বাললো। হ্যারিকেনটাও তৈরি করে রাখতে হবে। রাতভর বাতি জ্বলবে আজ।
রাত করে ফেরার চেহারায় নেই আজ মেহের। মুখে কোন কটু গন্ধ নেই। চেহারায় নেই কোন আনন্দের ঝিলিক। কিংবা ফূর্তি ফেরত মানুষের কণ্ঠের গুনগুনানি। ওর অন্ধকার মুখটি রাতের কালোকে সহজেই হার মানিয়ে দিলো। পত্রিকায় মোড়ানো একটি মাঝারী ওজনের প্যাকেট জয়গুনের হাতে ধরিয়ে দিলো। সাবধানে রাখতে হবে- মনে করিয়ে দেবার দরকার নেই। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পদ আর আস্থার সাথে ভষ্যিতের স্বপ্ন বিনিময়ের মাধ্যম কতগুলো কাগুজে নোট। বিনিময় মূল্যটি কম নয়, জানে জয়গুন। বাইরে জোছনা অথচ ভেতরে জয়গুনের প্রাণপুরুষের মুখে ঘোর অমানিশা। আজীবন আনন্দে থাকা মানুষটিকে পিষে ফেলেছে আজ সিদ্ধান্ত নেয়ার চাপ।
কাপড় পাল্টে মেহের আবার অন্ধকারে মিশে গেলো। আকাশে মেঘ করেছে হয়তো। আঁধার করেছে আবার। রাতের নৈঃশব্দ্য কেড়ে নিলো টিউবওয়েলের ক্যাঁচ ক্যাঁচ, বালতি মগের নাড়ানাড়ি আর গায়ে পানি ঢালার ঝপাঝপ শব্দ। মন ও দেহের গ্লানি সবটাই ধুয়ে ফেলার সংগ্রামী স্নান।
পুরুষটির মুখে আজ নেশার নিঃশ্বাস নেই। তবে শরীরের নেশায় আচ্ছন্ন হয় যুগল মানব-মানবী। টিনের চালে বৃষ্টির ছাট বাড়তি আবেশ জাগায়। মনের কলকব্জা নাড়াচাড়ার সাথে সাথে বাহ্যিক কলগুলো সচল হয়। স্পর্শ… তাপ… চাপ… ক্রম রসায়নে অবধারিত নিয়তি মেনে নেয় শরীর। জোয়ান মর্দ পুরুষ নরম নারীর কোমল বুকে মুখ গোজে, বৃন্ত খোজে। কাম রিপু ভালবাসা মায়া- এক মালায় গাঁথা হয়ে যায়। হিসেবী নারী, মত্ত আবেগেও যুক্তি ভোলে না জয়গুন। সময়মতো ঠিকই নিয়ন্ত্রণের দেয়াল তুলে দেয়। নিকট সময়ে দুই থেকে তিন হওয়া- প্রস্তুতি নেই এখনও। আচ্ছাদনের ভেতর কল কল ঙ্খলন টের পায় শরীরের অন্দরে। নিস্তেজ হয়ে আছে মুহুর্ত আগের তেজস্বী শস্ত্র।
নির্ঘুম রাত জয়গুনের। গিরিবাজ ঘুমিয়ে গেছে। কঠিন সকাল সামনে। মুক্তির চ্যালেঞ্জও বটে। বুক ঢিপ ঢিপ অপেক্ষা। একটু পরে নিশিথের কোকিল ডেকে উঠলেই আজ রাতের দ্বিতীয় পর্যায়, জীবনের নতুন পর্ব শুরু হবে। তার আগের প্রস্ততিটুকু সেরে নেয় জয়গুন। এক কোনায় হ্যারিকেনটি টিমটিম জ্বলছে। আধো অন্ধকারে পা টিপ টিপ সতর্কতায় কাগজের প্যাকেটটি টিনের বাক্স থেকে বের করে আনে। অবশ্য এতোটা সতর্ক না হলেও চলে। মেহেরের ঘুম সহজে ভাঙার নয়। পানের খিলিতে বিশেষ কিছু মিশিয়ে দিতে ভোলে নি সে। খুব দরকারী জিনিসটি শাড়ির ভাঁজ থেকে বের করে হাতে নেয়। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢোকা চাঁদের আলোয় ঝিলিক দিয়ে ওঠে। নিজেই চমকে ওঠে জয়গুন- চকচকে দুধারী বিদেশী মাল! বসিয়ে দিতে খুব বেগ পেতে হবে না, আশ্বস্ত করেছে বসন্তের কোকিল। কুহু ডাক দিলেই কাজটুকু সেরে অন্ধকারে পথে নেমে পড়বে। সীমানা পাড়ি দিয়ে ওপারে নতুন জীবন গড়বে। প্রয়োজনীয় সম্পদ তো মেহেরই গছিয়ে দিয়েছে, ভিটেমাটি বিক্রি করে।
আস্তে আস্তে মেহেরের শিয়রের দিকে এগিয়ে যায় জয়গুন। ইচ্ছে হয় ডেকে তুলে চোখে চোখে রেখে কিছু প্রশ্ন করার। এক জীবন অবহেলা আর প্রতারনার জবাব নেবার, জয়গুন মেহতাব চৌধুরীকে ঘুঁটেঘাঁটা জয়গুন বানানোর জবাবদিহি করার। উত্তর দিতে পারে কিনা, কিংবা না দিতে পারলে কী রকম হয় চেহারাটি দেখতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয়, ওর পাশে বসে শেষবার দুদণ্ড কথা বলারও। দুয়েকটি উপভোগের মুহুর্ত যে সে উপহার দেয়নি, তাও তো নয়।
বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগে। আবারও জোছনা দেখা যাচ্ছে। নিশি নাগরের অস্পষ্ট ডাকটি শুনতে পেল। জয়গুনের জন্য সংকেত বেজে উঠেছে। শেষ মুহুর্তে মনে কেন যেন জোর পায় না জয়গুন। শরীর কেমন যেন ভারী হয়ে আসে। দ্বিধাযুক্ত পায়ে মেহেরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জয়গুন। এ সময় ‘ঝপাত’ শব্দ....কেউ কিংবা কিছু একটা কাদায় আছড়ে পড়ার আওয়াজ। আবারও ধড়াম…! এবার দরজার উপর পতনের শব্দ। ধড়মড় করে উঠে পড়ে মেহের। সামনে ছুরিধরা জয়গুনকে দেখতে পায়। বিন্দুমাত্র চমকায় না সে। জয়গুনের হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে দরজা খুলে ‘‘....চোর.....’’ বলে চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে পড়ে। দুদ্দাড় করে চোর(!) বাঁশঝাড়ের আড়ালে চলে যায়। গৃহস্থের ভয়ে তস্করের অবধারিত পলায়ন। কাদার মধ্য দিয়ে অনেকটা দূর তাড়া করে মেহের শব্দ আন্দাজ করে। পায়ের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে গেলে পিছপা হয়। কাদামাখা শরীর নিয়ে ঘরে ফেরে, চোর-ডাকাত তাড়ানো সাহসী বীরের চেহারা নিয়ে।
দুহাত মুখে চেপে ঝরঝর করে কাঁদছে জয়গুন। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে! ‘‘....দেখ, কিচ্ছু নিয়ে যেতে পারে নি, হারামজাদা!’’ টাকার পুটলিটি দেখিয়ে বলে মেহের। জয়গুনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বুকের চাপ আর তাপ দিয়ে আশ্বস্ত করার চিরায়ত চেষ্টা। মৃদু বকা দেয় জয়গুনকে- ওকে না ডেকে ছুরি নিয়ে চোরের মোকাবেলা করার সাহস দেখানোর জন্য। ডুকরে কাঁদতে থাকে জয়গুন। ‘‘কিচ্ছু নিতে পারে নি,.....সব ঠিক আছে! সব ঠিক আছে!’’- জয়গুনও বিড়বিড় করে। মেহেরের ভেজা কিলবিলে পেশীবহুল বুকে মাথা এলিয়ে দেয় জয়গুন। তার শরীরও আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে আসে।
সচরাচর রজনী মানেই অন্ধকার কাটার প্রতীক্ষা। আঁধার কাটলেও আবার অনেকের সকাল হয় না। আবার মনের কালি সরে গেলে রাত থাকতেই অনেকের ভোর হয়। প্রকৃতি কিংবা ক্রীড়নকদের নিয়তি অনেক পরিকল্পনায় সাজানো একটি চিত্রনাট্য বদলে দিয়েছে। মেহেরকে বুঝিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল জয়গুন- প্রবাসে নতুনভাবে জীবন গড়ার। শুধু নিজের পরিকল্পনায় মেহেরকে বাদ দিয়ে এক খলনায়ককে নায়কের আসনে বসিয়ে দিয়েছিল সে। এই অসামঞ্জস্য বিধাতার সয় নি। ছোট্ট এক খেলায় বিকৃত চিত্রনাট্যটি ঠিকঠাক হয়ে যায়। পরিকল্পনা ঠিকঠাকই বাস্তবায়িত হয়, তবে সঠিক পাত্র-পাত্রী নিয়ে।
দিন যায়। আহ্নিক গতিতে সৌর আলো কমে বাড়ে। ভিন্ন মণ্ডলে আটপৌরে জীবন। সাদাকালো সেই জীবনেও মাঝে সাঝে বর্ণ রচে।
… … মেহেরের মুখে রোদ পড়েছে। রাতে ভার্টিকেল ব্লাইন্ড সরিয়ে রেখেছিলো বিছানায় শুয়ে চাঁদ দেখার জন্য। সময়ের ফেরে এখন সেপথে রোদ ঢুকছে। কয়েক ফোঁটা জল এসে পড়ে তার মুখে। আয়নার সামনে ভেজা চুল ঝারছে জয়গুন। এবার রোদ-বৃষ্টির খেলা, নর-নারীর নাখরামির খেঁকশিয়ালী বৃষ্টি। মেহেরের পূর্ণ দৃষ্টির সামনে শুভ্রবসনা জয়গুনের মুখে রংধনু ফোটে।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪