- এই প্রার্থী এলাকায় সবচাইতে জনপ্রিয়।….আরেক প্রধান দল ইনারে টিকেট দিবার জন্য লাইন ধরিয়া রহিযাছে।…না না না, খোঁজ লইয়া দেখিতে পারেন, ইঁহার নামে কোন মামলা অভিযোগ নাই।….দেশপ্রেমিক হিসাবেও খুব সুনাম।….প্রার্থী হিসাবে উহার ৯৯%ই ওকে….তয়….বিগত নির্বাচনে স্বতন্ত্র দাঁড়াইয়া পাশ করিতে করিতে…এট্টুর জন্য আটকাইয়া গেছেন.….(সাক্ষাৎকার বোর্ডের বিজ্ঞজনদের আচমকা পরিবর্তিত পাংশু মুখ দেখে বক্তা হোঁচট খায়)….মানে……
-মানে কী?
প্রশ্নকর্তার ধমকে আরো থতমত খাইয়া যান স্থানীয় শিকড়নেতা।
-….না মানে, একটু সৎ মানুষ তো….পয়সা খরচ করতে পারে নাই…..অসুবিধা?
স্থানীয় শিকড় নেতৃবৃন্দকে লইয়া নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে বসিয়াছেন কেন্দ্রবরদার নেতাগণ।
-অসুবিধা মানে? বুঝেন নাই? এই প্রার্থীর ৯৯% ওকে। হক কথা। কিন্তু বাকী ১ ভাগ? ঐ ভাগেই তো ‘টাকা পয়সা’ পড়িয়াছে। এইটা লইয়া কী আমার দল আপস করিতে পারে? অর্থ বিনা নির্বাচন অর্থহীন, ইহাও আপনাদের জ্ঞানের অতীত?
এই প্রার্থীকে নাকচ করিয়া পরবর্তী প্রার্থীকে ডাকেন বড় নেতা।
এইরূপ কিছু খণ্ডচিত্র নিয়া একটা রম্যরচনা দাঁড় করাইবেন মনস্থির করিয়া কী-বোর্ড লইয়া মনিটরের সামনে লেখক। হঠাৎ তাহারে আউলায় ধরিল। তাহার অতি জ্ঞানী মস্তিষ্কে ভাবনা প্যাঁচ খাইতে লাগিল- কেন এত বুদ্ধিচর্চা। কাহার জন্য করিতেছি? অনেকেই লিখিতেছে, কেহ কেহ পড়িতেছে। কিন্তু কাজের কাজটি কেহ শুরু করিতেছে না।
একদিকে চিন্তাবিদদের কলাম আর মতামতে পত্রিকা ভরা। অন্যদিকে ঘরের ছবিযন্ত্রটিতে আড্ডা, কথন, টক-শোর নামে আধুনিক ঝগড়া বাঙালীর রাত্রির ঘুম হারাম করিয়া ফেলিতেছে। লেখক আত্মতৃপ্তি পাইতেছে-জব্বর লিখিয়াছি। বক্তা তৃপ্তির ঢেকুর তুলিতেছে-আজ ফাটাইয়া বলিয়াছি, উহাদের চামড়া ছিলিয়া আয়োডিনযুক্ত লবন মাখাইয়া দিযাছি। এইবার যদি উহাদের কর্ণ/চক্ষুগোচর হয়, যদি বিবেক ইন্দ্রিয় জাগ্রত হয়! আয়োডিনে যদি উহাদের বুদ্ধি খুলে। না হইলে না হউক- এই রকম সামাজিক দায়িত্ববোধের কর্ম নিশ্চয়ই কোন না কোন বড় সোসাইটির নজরে পড়িবেই, এওয়ার্ড পাওয়া ঠেকাইবে কে?
বিদগ্ধ পাঠক পড়িয়া মন্তব্য করিতেছে-আহা হা…দারুন লেখা, জাতির এইবার যদি আক্কেল হয়! নিশি জাগিয়া টেলি-কথন শুনিয়া যাত্রাপালার মজা লয় কেহ কেহ। ঐখানে যেইরূপ নর্তন কুর্দন হয়, বিনোদন ভাবিলে অন্যায় কোথায়? বিবেকের ছিলিমে একটা টান দিয়া ঘুমাইতে যায়। রাত্রি পোহাইলে বুদ্ধি বাড়িবে, কাল একটা কিছু করিব-মনস্থির করিয়া কোল বালিশটি টানিয়া লয়।
দারুন সচেতক একটি আর্টিকেল লিখিলাম, এই তৃপ্তি লইয়া লেখক ঘর হইতে বাহির হইলেন। সড়কে আসিয়া দেখিলেন প্রচুর যানজট। হতাশা আসিল মনে, ‘নাহ, ট্রাফিক পুলিশ ইহা কমাইতে পারিল না।’ রাস্তা পার হইবেন, উপায় নাই। পাশেই ফুটওভারব্রিজ দেখিয়া ভাবুক হইলেন।….বড়সড় একটা সেতু নিয়া কর্তৃপক্ষের মাথা নষ্ট হইতেছে। ঐ সেতুটি কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া যদি হাজারখানিক এইরূপ ওভারপাস বানাইত, তাহা হইলে যান আর মানুষের সংঘর্ষ অনেক কমিত, তাহাদেরও দায়মুক্তি ঘটিত। যাহা হউক, উহারা কী আর এই ঢেঁকি হইতে বুদ্ধি ধার করিবে-মন খারাপ করিয়া ফুট ওভারব্রিজের পিলারের গোড়ায় ‘পিচিক’ করিয়া পানের পিক ফেলিলেন।
মনে পড়িল আজ তিনি অনেক ব্যস্ত! সিড়ি বাহিয়া উপর দিয়া যাওয়ার সময় নাই। ট্রাফিক পুলিশের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করিয়া চলমান যান ঠেলিয়া তড়িঘড়ি সড়ক পার হন। ধড়মড় করিয়া এইপারে আসিয়া ফলের টুকরিটা কোনক্রমে এড়াইতে পারিলেন। খিস্তি করিলেন, ‘নাহ…ডিসিসি আর ফুটপাতের হকার উঠাইতে পারিল না। টি-স্টলে চা পানরত ‘কর্মব্যস্ত’ লোকজনের মধ্যে তিনিও এক কাপ চা লইলেন। ফুটপাতের আশি ভাগ জুড়িয়া রাখা বেঞ্চিতে বসিয়া গলা খাকারি দিলেন। স্বভাববশতঃ মুখ চালাইলেন, ‘….আসলে আগে আমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব লইতে হইবে…. ’
এক বালক হাটিয়া যায়। চায়ের দোকানের কারণে বিঘ্ন পাইয়া, বেঞ্চির সহিত সংঘর্ষ এড়াইতে জনচলাচল পথ ছাড়িয়া যানচলাচল সড়কে নামিয়া যায়। আর বলে, ‘যেইভাবে মানুষ পরিবর্তনের কথা বলিতেছে, দেশটার একটা গতি নির্দিষ্ট হইয়াছে…..।’ আরও কিছু একটা বিড়বিড় করিয়া উচ্চারন করে।
লেখক ব্যাপারটি লক্ষ্য করেন। দ্রুত অপসৃয়মান ছেলেটির নিকটাগত হন। ত্বরিত ধাবনায় বেখেয়ালে একটি কলার খোসায় পা দিতে দিতে কোনক্রমে বাঁচিয়া্ যান।
বলেন- বাবাধন, কিছু একটা অস্ফূটে বলিয়াছিলেন মনে হয়। শুনিতে পারি তাহা?
বালকটি মুখ খোলে।
- বহুত বলিয়াছেন, বহুত শুনিয়াছেন, এইসব একটু বাদ দেওয়া যায় না? আমার বয়সের সহিত অমানানসই একটা গালি দিয়াছিলাম, শুনিবেন?
লেখক হা’ হইয়া আগাইয়া আসিতে থাকিলে সে আবার সরব হয়।
-ওহো হো…করিতেছেন কী? কলার খোসাটি হইতে বাঁচিলেন দারুন কায়দায়। অতি সচেতন পথচারী আপনি! এক কদম পিছনে যান, আপদটি অপসারণ করুন। নিজের পদযুগলের গোড়া হইতে শুরু করুন। নিজে নিরাপদ থাকিয়া অনুগামীদের চলন নিরাপদ রাখুন। তাহা না হইলে আছাড় খাওয়া চলিতেই থাকিবে।
-ধুর…দিনটাই মাটি। এইটি তো নিতান্তই ছোট চিন্তার বালক। ভাবিয়াছিলাম না জানি কী? দেশচিন্তককে কলার খোসা অপসারণের জ্ঞান দেয়!!! বালকটিকে দৃষ্টিতে ভস্ম করিয়া ফিরিয়া চলেন। খিস্তি করিতে থাকেন, নিজের উপরই বিরক্ত তিনি।
দেশপ্রেম মানে একটি কলার খোসা….এইটি কিন্তু ভাঙা রেকর্ডের মত তাহার চিন্তায় ঢুকিয়া যায়, বারবার ঘুরিতে থাকে। চিন্তিত মনে শিক্ষালয়ে আসেন। বলা হয় নাই, উনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের একজন শিক্ষক।
ক্লাশে ধাড়ি ধাড়ি ছাত্রদের পড়াইতেছেন-‘অবক্ষয়, রাষ্ট্র ও সমাজ’। শিরোনামই বলিয়া দেয় কী পরিমান আকর্ষনীয় বিষয় হইতে পারে ছাত্রদের নিকট। সঙ্গীত যতই বেসূরো হউক, বক্তব্য যতই নিরস শুনা যাক, কেউ না কেউ আত্মস্থ করে। এইখানেও সবাই অমনোযোগী থাকিলেও একজন ছাত্র কিন্তু চিন্তাশীল মনে ঠিকঠিক হৃদয়ঙ্গম করে।
লেকচারের শেষে আসিয়া অধ্যাপক মহাশয় বলিতে থাকেন,…..বুঝিতেছ তোমরা, দেশপ্রেম প্রয়োজন। প্রয়োজন সবারই নিজ হইতে আগাইয়া আসা। দরকার স্বেচ্ছাসেবা। পথে চলিতে গেলে শুধু গন্তব্যের দিকে তাকাইয়া থাকিলেই চলিবে না। নিজের পদযুগলের গোড়ায়ও নজর রাখিতে হইবে। দেশপ্রেম শুরু হইবে সেইখান হইতেই। দেশপ্রেম মানে তাই একটি কলার খোসা….। বিদ্যূৎ চলিয়া গেল। শব্দযন্ত্র বন্ধ। বাকীটা শোনা গেল না। ক্লাসে বাধ্যতামূলক যবনিকা টানা হইল।
মনোযোগী ছাত্রটি বাড়ি ফিরার পথে ভাবিতে থাকে, তাহা হইলে দেশপ্রেম মানে স্বেচ্ছাসেবা। সেইক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক (লীগ, দল, পার্টি) ইহারা তো বিরাট দেশপ্রেমিক! খচখচানি সৃষ্টি হইতে থাকে মনে। তাহার এলাকার কালা মন্তাজ, ত্যাড়া মফিজ, গিরিঙ্গি লুতু (লুৎফর)-ইহারা সবাই স্বেচ্ছাসেবক। ব্রাকেটবদ্ধ পূর্বোক্ত দলগুলির শীর্ষে রহিয়াছে তাহারা। সে ভাবিয়া অবাক হয়, ইহারা তাহা হইলে আদর্শিক দল পার্টি করে! চলনে বলনে মনে হয় আয় রোজগার ভালই। পেশা উহাদের কী সুস্পষ্ট নয়। দেশ উদ্ধার করিয়াই হয়ত উহাদের চলে। তবে সবাই যেন উহাদের কেমন নজরে দেখে! আরো উসখুশ বাড়ে কলার খোসা লইয়া, মাস্টার বাবু কী বলিতে চাহিলেন বুঝা গেল না।
পরের দিন যথানিয়মে সে শ্রেনীকক্ষে আসে। পথে কুড়াইয়া পাওয়া একটি অর্ধগলিত কলার খোসা ঝোলায় পুড়িয়া আনে। শিক্ষক মহাশয় আসিলে সন্তর্পনে উহা বাহির করে। সকল দ্বিধা লজ্জা ত্যাগ করিয়া বলিয়া উঠে, মহাশয় এই যে একটি কদলীর চোকলা লইয়া আসিযাছি, দেশপ্রেমের সহিত ইহার যোগসূত্রটি হাতে-কলমে বুঝাইয়া দিন।
- ওরে করিয়াছিস কী, জলদি ছুড়িযা ফেল। ইহা যখনই দেখিবি, তখনই কুড়াইয়া লইয়া ছুড়িয়া ফেলিবি। ইহার মানে হইল গিয়া নিজ পদযুগলের গোড়া হইতে দেশসেবার শুরু।
ছাত্রটি তৎক্ষণাত জানালা দিয়া উহা ছুড়িয়া ফেলে। দেশসেবার প্রথম প্রায়োগিক শিক্ষা গ্রহণ করে।
নাগরিকবেশে এক সাধুদরবেশ ঐখান দিযা হাঁটিয়া যাইতেছিলেন। বাঙালী জাতির হাল হাকিকত তিনি সম্যক অবহিত। ভবিষ্যৎ নিয়া তাই গুরুতর ভাবিত। চিন্তিত মনে চলিবার পথে কলার খোসাটিতে পিছল খাইয়া ভূমি প্রপাত হইলেন।
গায়ের ধূলা ঝাড়িতে ঝাড়িতে বলিলেন।
- বাহ, এই দেশে তো দেশপ্রেম ভালই চর্চা হইতেছে! নতুন প্রজন্মও ভাল সবক লইতেছে। ভাবিবার বিষয়…..অতি ভাবিবার বিষয়…..