সময় ওদের সব ভুলিয়ে দেয় নি। খেলতে যেতে যেতে মনে ভাসছে, সেদিনের কথা। ব্যাট, স্ট্যাম্প নিয়ে স্কুল মাঠে ঢুকতে গিয়ে বাধা পাওয়ার ঘটনা। ফুটবল হাতে ফেরার পথ ধরা আরেকটি দলের আশাহত মুখ। মাঠের ভাঙাচোড়া প্রবেশপথে নতুন রঙচঙে গেট। ব্যানার- “বিশাল কারু ও শিল্প মেলা”। শক্ত চেহারার স্বেচ্ছাসেবীরা সেবা দিতে দাঁড়িয়ে। মাঠে খেলতে পারা তো দূরের কথা। টিকেট নিয়ে ঢুকতে হবে! ঐ অভিজ্ঞতা অবশ্য নতুন ছিল না ওদের। গরু-ছাগলের হাট, যাত্রা/সার্কাস/মেলা’র জন্য এই তল্লাটের সেরা ভেন্যু যেন ওদের স্কুল মাঠটিই।
মাঠ-বাণিজ্য শহর থেকে গ্রামে ভালই ছড়িয়েছে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে ক্লাস রুমে। মাঠ থেকে একটু আধটু আয় হলে কী আসবে যাবে- স্কুল কমিটির সভাপতির কথায় সায় দেয়া লোকের অভাব হয় না। তারা বোঝে আর্থিক আয়। মাঠ ইজারার টাকা থেকে প্রাপ্তি। মেলা-সার্কাসের খোঁড়াখুড়িতে, গরু-ছাগলের পায়ের গুতোয় নষ্ট মাঠ সংস্কারের কাজে অর্থ ব্যয়, সেখান থেকেও প্রাপ্তিযোগ। আয়-ব্যয, সঞ্চয়, পার্শ্ব লেন-দেন, বেশ একটা অর্থনীতি এখানে। খেলাধুলার মধ্য দিয়ে ছেলে-পুলেদের শারীরিক-মানসিক প্রবৃদ্ধি, এসব পণ্ডিতি কাগুজে কথায় কান দিয়ে ‘লোকাল’ সমাজ চলে না।
হট্টগোল কলরবে ছেলেরা পৌঁছে গেছে, গণি মিঞার মাঠে। এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা এটা। সময়ের প্রয়োজনে গ্রামের পুকুরগুলো যেখানে পরিকল্পিত মাছ-ক্ষেত, ক্ষেতগুলো তিন/সাড়ে তিন ফসলী জমি। নদী/খাল শুকিয়ে বৃদ্ধা শরীরে কচুরিপানার অভয়াশ্রম। ছেলে-ছোকড়া আর দুরন্ত কিশোরদের হাত-পা ছড়ানো, জলে হাওয়ায় দাঁপিয়ে বেড়ানোর জায়গা কই? গণি মিঞ্রা সেখানে যুগান্তকারী ঘটনা ঘটালেন। তাঁর বসবাসের বাড়ি থেকে একটু দূরে, দেয়াল ঘেরা বাগানবাড়ি আকারের জায়গাটি খুলে দিলেন। বলে দিলেন-যা বাচ্চারা, খেল্ খুশি মত!
গ্রামের তরুন-যুবা-বালক-কিশোরদের মিলন মেলা হয়ে উঠল গণি মিঞার মাঠ। ফুটবল ক্রিকেট নিয়ে মেতে যায় ছেলে-বুড়োর দল। কেউ কেউ করে শরীর চর্চা, সাথে মুখ চর্চা-আড্ডা, হাওয়া খাওয়া। খেলাধুলার প্রসারে গণি মিঞ্রা ওখানেই থামেন নি। জানালেন- ফুটবল, ক্রিকেটে প্রতি মাসে সেরা খেলোয়াড় ঘোষনা করা হবে। বছর শেষে উভয় বিভাগে সেরা খেলোযাড়দের নিয়ে দু’টি গ্রাম-টিম ঘোষনা করা হবে।
সাজ সাজ রব। কেরামত ফুটবল ভাল খেলে তো সয়ফু ক্রিকেটে সেরা। মিরাজের ফুটবল সেন্স ভাল, বারেক সেরা ফিল্ডার। সাদেকের কেতাবী ক্রিকেট ছোটরা অনুসরণ করে। কুতুবের পেশীবহুল শরীর দেখার মত। সফিজ মিয়া কোনকিছুতেই তেমন ভাল না, তবে সাঙ্গপাঙ্গ অনেক। সাংগঠনিক দক্ষতা ভাল আর কী! সর্ববিশারদ হিসেবে তারও গুণকীর্তন। নানা আওয়াজ, নানা কানাঘুষা। কিছু স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে ছড়িয়ে পড়া সুনাম। কিছু কৃত্রিমতায় তৈরী রব।
গণি মিঞা মাঠে আসেন না, দৈবাৎ কেউ ভাগ্যবান(!) তাঁকে দেখে থাকতে পারে, যোগাযোগ থাকাটাও অস্বাভাবিক না। প্রতিপত্তিশালী দু’য়েকজন ঠারে ঠারে বুঝানর চেষ্টাও করেন উদ্যোক্তার সাথে তাদের সখ্যতার কথা। একটু কলার উঁচু ভাব। তাঁর নিয়োজিত প্রতিনিধি ‘ভাই’রা মাঝে মাঝে আসেন, সরব হন। তবে নিয়মিত তেমন একটা চোখে পড়ে না। মাঠের এক কোণে তাঁর খোলা একটা চালাঘর আছে। রোদ-বৃষ্টিতে আশ্রয় চলে। বেঞ্চিতে বসে গল্প-গুজব, ঝাল মুড়ি বাদাম খাওয়া…বেশ জায়গা।
মাঠের সবকিছুতে গোদা টাইপ কিছু পোলাপান খুব সচেতন, কড়া নজর রাখে চারিদিকে। নিজেদের মাঝেও পারস্পরিক সন্দেহ অবিশ্বাস। মালেক ফুটবলে বেশী কারিকুরি দেখাতে গেলে হাশেম পিছন থেকে ল্যাং মারে। সাবেত বাউন্সার করলে আম্পায়ারকে ধরে ‘নো-বল’ ঘোষনা করায় দবির। তবে একটা সীমার মধ্যে আঁতাতটা ঠিকই ধরে রাখে। গোদাদের সামষ্টিক আধিপত্যে পুঁচকেদের বাহাদুরিপনা ভাল চোখে দেখে না তারা। পুঁচকে সয়ফু গোদা গ্রুপের সাবেতের বলে ছক্কা মেরে বল ‘গাতা’য় ফেলে দিল। যা হবার তাই। গোদাদের আইন জারী হল- বেয়াদবী শট মারা যাবে না। সুতরাং ওকে বেশী চান্স দেয়া চলবে না।
মাঝে মাঝে রাত-বিরাতে কাল কোট, কান টুপিতে মুখ আড়াল করা আর শীত চাঁদরে শরীর-চেহারা লুকোনো কিছু মানুষ আনাগোনা করে। কিছু অন্ধকার পরামর্শ চলে হয়ত, মাঝে মাঝে শোনা যায় উচ্চৈঃস্বরে গালাগাল বিষোদগার। কেউ ভয় পায়, কেউ নাক সিঁটকায় ভদ্রবেশে দিনের আলোতে চলা এসব মানুষের ছদ্মবেশী কার্যকলাপে।
পুঁচকেরা সন্দিহান হয়ে দেখে-ভিলেজ পলিটিক্স এখানেও। তবে বেশী ভাবাভাবি নেই। ওরা চায় খেলতে। দুর্লভ মাঠটা, খেলার সুযোগটা, হাতছাড়া হোক- এটা ভাবতেই ভয় পায়। যে কোন শোরগোলে মাঠ হারানোর অশনি সংকেতে কেঁপে ওঠে শিশুসরল অন্তর। তাই সকল গোদা-আইনে চুপচাপ থেকে খেলে যেতে চায় ‘ওরা’। নীরবে আবার কেউ কেউ ভাগ হয়ে যায় গোদা গ্রুপে, টিকে থাকার স্বার্থে।
গণি মিঞাও কম বিপদে নেই। সকাল-বিকাল দাবী-দাওয়া, ফাঁপর আর ফাঁপর। মাঠে গর্ত- ঠিক কর। কাঁদা-পানি জমে আছে- বালি ফেলো। মাঠ থেকে সড়ক পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে দাও। দেখাশুনার জন্য রেফারী/আম্পায়ার আনো। ….নামে বেনামে অভিযোগ- অমুক গোদা বেশী সুবিধা পাচ্ছে, তমুক গোদা নিজের পক্ষে হাততালি দেয়ার জন্য লোক ভাড়া করছে। চালাঘরে বসে সারা দিন বকবকানী, গ্রুপিং। শেষ-মেষ গণিমিঞ্রা ‘এলান’ পাঠাতে বাধ্য হলেন- মাঠে শুধু খেলা, কোন আড্ডা খোশগল্প চলবে না। যার যার বাড়ি অথবা মাঠের বাইরে গিয়ে এগুলো কর। এটা নিয়েও গোস্যার শেষ নেই একটি বিদগ্ধ মহলে। শেষে আলাপ-মিটিং করার জন্য আলাদা ছাউনি করে দিতে বাধ্য হলেন গণিমিঞ্রা।
তিতি-বিরক্ত হয়ে একদিন তিনি জানিয়েও দিলেন। এই মাঠে খেলাধুলা করতে দেয়াটা তাঁর পুরোপুরি দাতব্য কাজ নয়। ছোটখাট একটা ব্যবসার নিয়ত আছে এখানে। এটা একটা প্রাইভেট স্টেডিয়াম হবে, পরিচিতি পাওয়ার পর গ্যালারী হবে, দর্শনীর বিনিময়ে খেলা দেখার ব্যবস্থা হবে, অনেক বিজ্ঞাপন আসবে। আপাততঃ বেশ কিছুদিন কোন প্রাপ্তি ছাড়াই চলবে। তবে খেলোয়াড়রা সারা জীবন বিনে পয়সায়ই খেলতে পারবে-এটাও নিশ্চিত করলেন। খোলামেলা বলা ব্যাপারটা কেউ কেউ বাঁকা নজরে দেখার চেষ্টা করলেও, গনি মিঞ্রার এই কাজটি যে বিরাট ইতিবাচক উদ্যোগ সেটা প্রায় সর্বমহলই বুঝতে পেরেছে। একরত্তি জায়গা কেউ ফেলে না রেখে ফ্ল্যাট এপার্টমেন্ট করে। গ্রামে সেটা না চললেও নিদেনপক্ষে কয়েকটা দোকান করে ভাড়া দেয়। বেশী জায়গা যাদের, তারা প্লট বানিয়ে হাউজিং ব্যবসার ফিকির খোঁজে। সেখানে গণি মিঞা যা করছেন, তাকে সমাজসেবা না বললে অন্যায়ই হয়।
এর মাঝে প্রতি মাসে গণি মিঞা’র দহলিজে ডাক পড়ে ‘সেরা খেলোযাড়’দের। কারো আনন্দ, কারো হতাশা- সব সিলিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ। চলতে থাকে গণি মিঞার মাঠ।
এদিকে গোদা-গিরি, মাঠ রাজনীতি, রাজনীতির ভেতর পলিটিক্স নিত্যকার ব্যাপার হলেও, কাজের কাজটির গতি কিন্তু ঈর্ষনীয়। মাঠ থেকে দারুন দারুন খেলোয়াড় বেরুতে থাকল। কিছু বুড়োরা তাদের সুপ্ত প্রতিভা দেখাতে থাকল। তাদের অনুসরণ করে তরুনরা এগুতে থাকল। আয়োজকরাও নড়েচড়ে বসে খেলোয়াড় নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করলেন। বিদেশী কোচ আনলেন, প্রতিভা যাচাইয়ে। কাল ছায়া হয়ে ঘোরা কিছু আত্মা আগ্রহ হারিয়ে কোথায় যেন চলে গেল, কেউ কেউ চিন্তায় মননে আত্মশুদ্ধি এনে বিশুদ্ধ ধারায় যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল।
পুঁচকেগুলো আর বিশুদ্ধ চিন্তার মানুষগুলো কীভাবে যেন এক প্ল্যাটফরমের দিকে যেতে থাকল। তারাও আস্তে আস্তে গণি মিঞ্রার বাড়ির দরজা খুঁজে পেল। সেদিনই তো নতুন একজন ডাক পেল। তার পিছু পিছু গণি মিঞার বাড়ি দেখে আসবে বলে আরও কিছু পুঁচকে জড়ো হল। হাসি-আনন্দ উৎসাহে তারা গণি মিঞার বাড়ি পৌঁছুলো। এবার আবার নতুন অভিজ্ঞতা! গণি মিঞা নেই। তার সহচর এত লোক দেখে বিরক্তি লুকাতে পারলেন না, বলেই বসলেন- সবাইকে একসাথে ডেকেছে নাকি? যাই হোক, এতদিনের প্রাপ্তি আনন্দে তারা এটা গায়ে মাখল না। খালি হাতেও ফিরতে হয় নি। গণি মিঞার জ্যেষ্ঠ সহচর এসে পুরস্কার টুরস্কার দিয়ে দিলেন। তবে চোখে লাগল, বুকেও কিঞ্চিত বাজল অতিথি দলনেতার- বাঙালীর চিরায়ত সৌজন্যের অভাবটি।
স্কুল মাঠের সেই চেহারা মনে করে ফেরার পথে তারা মাত্র পাওয়া অভিজ্ঞতা ভুলে কৃতজ্ঞতার নজরেই বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখল বাড়িটি। আশে-পাশের গ্রামের মানুষের চেয়ে ওরা ভাগ্যবান-এই গণিমিঞার কল্যাণে।
বিকেলে বটতলায় বসে খেলোয়াড় মেলা। প্রাণবন্ত দুয়েকটা পিচ্চি তাদের গড়ে ওঠা পেশী দেখায়। বিভিন্ন ক্লাবে/দলে ডাক পাওয়ার খবর শোনায়। মেদওয়ালা আধ বুড়োরা দু’ইঞ্চি ভুড়ি কমার গল্প করে। ডায়াবেটিস ব্লাড প্রেসার গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। নেশা, বাজে আড্ডা, ইভ টিজিং এই গ্রামের পথ খুঁজে পায় না। …পাশাপাশি কিছু কিছু ছায়া শরীর মূর্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেখালেও পুঁচকেরা এখন আর ভয়ে কেঁপে ওঠে না।
বছর শেষে দারুন দু’টো অজেয় টিম গড়ে উঠবে তাদের, এই স্বপ্নের অংশী হয় সকলে। যারাই খেলবে, খেলবে সকলের পক্ষে, খেলবে গ্রামের নামে- প্রত্যয় ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে…অন্তরে অন্তরে!
জয়তু শরীর-মন-চর্চা, জয়তু গণি মিঞার মাঠ!