টপ টপ করে কয়েক ফোটা জল ঝরে পড়লো। অজান্তে চোখ মোছার জন্য হাত উঠে গেলো ভারিয়া’র।…ধুর…নিজের কাছেই লজ্জা পেল সে। দুটো কারণে- প্রথমত ছেলে-মানুষী(?)আবেগ….দ্বিতীয়ত ত্রিংশ শতাব্দীতে কান্নায় আবার জল ঝরে নাকি?
সুনসান রিডিং থিয়েটারে ভারিয়া আজ সকাল থেকেই পড়ছে। সারি সারি পেরামবুলেটরের মতো আসনে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ পড়াশুনা করছে। হাতের কাছে গোটা কয়েক বাটন, আর চোখের সামনে ছোট্ট রিডিং মনিটর। গত কয়েকদিন ধরে পুরনো সময়ের সাহিত্য পড়ছে সে। ভালবাসা, হাসি-কান্না….এগুলোই মূল উপজীব্য।
এই বইগুলো বুঝতে গেলে আবেগ সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান দরকার। বুড়ো লাইব্রেরিয়ানের পরামর্শে গতরাতে বেশ কিছু সময় ইমোশনপিডিয়া-তে কাটিয়েছে। প্রায় ৬০টির মতো আবেগ নিয়ে ঘাটাঘটি। ….আবেগ কর্মক্ষতা কমায়। ব্রহ্মান্ডের সামগ্রিক ক্ষতির কারণ তুচ্ছ মানবীয় আবেগ… আবেগ সম্বন্ধে এভাবেই ধারণা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পড়তে গিয়ে যে কেউ এখানেই থেমে যাবে। কিন্ত ভারিয়া গভীরে গেছে। ডিসপ্লে’র বেশীরভাগই নেগেটিভ আবেগ। এর মধ্যে ও চার পাঁচটা বুকমার্ক করেছে- মায়া মমতা ভালবাসা স্নেহ। ঘাটতে ঘাটতে এক জায়গায় একটা আবেগের ‘রিয়েল ফিলিংস প্রিভিউ’ পেয়ে গেল। অভাবনীয় ঘটনা! লাল কালিতে ‘হাইলি রেস্ট্রিকটেড’ লেখা। ¬¬¬¬¬¬ রিস্ক নিল ভারিয়া। নিজের ট্যাবলেটে নামিয়ে নিল। একটা কমিউনিটিতে নেশা করার কথা শুনেছে সে। নিষিদ্ধ সাইটগুলোতে এ রকম অনুভূতি কিনতে পাওয়া যায়। এটা সে রকম কিছু নয়তো? চান্স নিল তবু। নিজের ব্রেইন ইনলেটে লাগিয়ে ওকে করা মাত্র- এ কী…প্রত্যেকটা তন্ত্রে.. কোষে...ডিএনএ-তে অনুরণন! কিছু অদ্ভূত ভাবনা-দৃশ্য-অনুভূতি ছূঁয়ে গেল তাকে!
নাহ্, প্রিভিউতে চলবে না। পুরোটাই চাই তার। মেডিক্যাল সাইন্স কর্মী সে। থার্ড লেভেল ল্যাবে তার যাতায়াত পাশ আছে। প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। নিজের ব্রেইনের ‘লিম্বিক সিস্টেমে’র নিউরাল ম্যাপিংটা সহজেই বের করতে পারলো। ‘পেলিও সার্কিট’ সম্বন্ধে আগেই কিছু ধারণা ছিল। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজ্যান্স নিয়ে সে কিছু কাজ করেছে। প্রি-কনফিগারড পথটা পাওয়া একটু কঠিন হলো। এখন কিছু নিউরো-কেমিক্যাল জোগাড় করতে পারলেই চলবে। এই কেমিক্যালগুলো নিষ্ক্রিয় (ডিজ-অ্যাবল্ড) আবেগগুলোকে উদ্দীপ্ত (ইনেবল) করবে। ……………………………….. নতুন এক ভারিয়া আজ সাহিত্য রস নিচ্ছে! আজকের সিটিংয়ে সবচে’ বেশী পঠিত বিষয় হলো হলোগ্রাফিক ভার্চুয়াল প্রেজেন্স, লাইব্রেরী স্ট্যাটস চেক করলো। এটা ওরও প্রিয় বিষয়। হাজার বছর আগের ভিডিও চ্যাটের আজকালকার রূপ। সাহিত্য পড়ছে মাত্র ১৩ জন! বিষয়গুলোও খটমটে-বিবর্তনে সাহিত্যের ভূমিকা, আধুনিক সাহিত্যে রোবোটিক্স- এ জাতীয়। একমাত্র সে ই পূরনো দিনের সাহিত্য পড়ছে। নিজের স্টাডিতে ‘প্রাইভেসি’ দিয়ে রাখলো। ও চায় না ওর পাঠ্য বিষয় অন্য কেউ জানুক।
বিংশ শতাব্দীর কোন এক লেখকের সাধারণ একটি উপন্যাস তার সামনে। কালজয়ী লেখকদের লেখা, বিশেষ করে সাহিত্য, সাধারণ মানুষের কাছে আজকাল সহজলভ্য নয়। মা-মেয়ের গল্প। ভারিয়ার প্রজন্মে এগুলো বোঝা সহজ কাজ নয়। আসলেই তাই, সি-১ শ্রেনীর নাগরিক ভারিয়া ‘মা’ ‘মাতৃত্ব’ ‘সন্তান’ এসব বুঝবে কী করে? ইতিহাস ও আদি সমাজ-ব্যবস্থা সম্বন্ধে সে কিছুটা পড়েছে বলেই রক্ষা।
‘এ’ শ্রেণীর মানুষই শুধুমাত্র আজকাল জন্ম দেয়ার ক্ষমতা ও অধিকার রাখে। একটি কঠিন বিধি ও মনিটরিংয়ের আওতায় এরা তথাকথিত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয় এবং বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। ¬¬¬¬ ‘বি’ শ্রেণী আন-আইডেন্টিক্যাল ক্লোন। সুনির্দিষ্ট ‘এ’ শ্রেণীর কারো একক ক্লোন বা প্রতিরূপ। ‘সি’ শ্রেণী আইডেন্টিক্যাল ক্লোন। বিশেষ ক্ষমতা বা গুণবিশিষ্ট এক জাতীয় মাল্টিপল ক্লোন। প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে আরো ভাগ আছে। ‘সি’ শ্রেণীকে মানবিক আবেগ-অনুভূতি দেয়া হয় না। ভারিয়া এ পর্যন্ত যেটুকু করেছে তা এক পর্যায়ের সীমা লংঘন বলা যায়।
ল্যাবরেটরীতে প্রতিরূপ হিসেবে সৃষ্ট ভারিয়ার মা-বাবা নেই। তার চারিত্রিক, শারীরিক বৈশিষ্ট্, অবয়ব সবই পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রামড। তার শিক্ষা কার্যক্রমও আধা যান্ত্রিক আধা মানবিক।
বইয়ে মন ফেরালো সে। গল্পের মেয়েটা এক কঠিন সমস্যায় পড়েছে…১৫/১৬ বছরের মেয়েরা যে ধরণের সমস্যায় পড়ে। মাকে তার খুব প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় তার মা? পারিবারিক টানা-পড়েনে সে আজ অনেক দূরে….! পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়টাই দূর্বোধ্য ভারিয়ার কাছে। তাও যেন গল্পের মেয়েটার কষ্ট ওকে স্পর্শ করলো। কেমন একটা বুক হুহু করা অনুভূতি ওকে ছূঁয়ে গেল। মনুষ্যসৃষ্ট হাজার বছরের কৃত্রিম বিবর্তন একটা মেয়ের ডিএনএ’র সুপ্ত অনুভূতিকে পুরোপুরি গায়েব করে দিতে পারে নি। স্বভাবসূলভ নারীত্বের টান অনুভব করলো ভারিয়া। আদি মানব সভ্যতার একটা নির্মূলপ্রায় মনো-জৈবিক ধারা নিয়তির মতো ভারিয়া-কে বেঁধে ফেললো। এর পরের কয়েকটা দিন এটা নিয়েই ভাবলো। ‘মা’ পাবে না সে, যা তার ছিলই না কখনো।। তবে? বিদ্যূৎ চমকের মতো আইডিয়াটা মাথায় খেললো! -আরে...আমি তো ‘মা’ হতে পারি!!! বিষয়টা এক কথায় অসম্ভব। তার একার প্রচেষ্টায় সফলতার সম্ভাবনা মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। এর পরের এক সপ্তাহে কয়েক টেরাবাইট তথ্য খোঁজাখুঁজি আর ভার্চুয়াল দেন-দরবার সম্ভাবনাটাকে হাজার ভাগের এক ভাগে উঠিয়ে নিয়ে আসলো।
এ পাশ ওপাশ মাথা নাড়লেন ‘ন্যাচারাল ইভোলুশনারী কাউন্সিল’ ল্যাবরেটরী চিফ মিঃ তাবালুকি। সি-১ শ্রেনীর কাউকে এ ধরণের এক্সপেরিমেন্টে দেয়া যায় না। সি-৩ কিংবা তার পরের সিরিজের ক্লোনরাই এ কাজের জন্য নির্ধারিত। এই ভদ্রলোক সম্বন্ধে জানে ভারিয়া। তার মুখ থেকে ‘না’ বেরুলে সেটাকে ‘হ্যা’ করার ক্ষমতা কারো নেই।
মুখটা বিবর্ণ হলো ভারিয়ার। অভিব্যাক্তি লুকাতে পারলো না সে। দৃষ্টি এড়ায়নি মিঃ তাবালুকির। চিন্তিতভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন ভারিয়ার দিকে। মেযেটার চোখে জল! হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিল তার মনে। এটা কী করে সম্ভব- সি১ শ্রেণীর একজন কাঁদবে! তারচেয়েও অবাক ব্যাপার হলো এমন মানবিক দাবী নিয়ে আসাটা। - তুমি এই পরীক্ষার সম্ভাব্য ফলগুলো জান ? গুরুগম্ভীর কন্ঠে তাবালুকির প্রশ্ন। - না। তবে যে কোন পরিণতি আমি মেনে নিতে রাজী। দৃঢ় কন্ঠে ভারিয়ার উত্তর। সে জানে তাদের মতো নাগরিকদের জন্ম মৃত্যু জীবনকাল দেশ-চিন্তকদের পরিকল্পণা অনুযায়ী ঘটে। - যদি কাউন্সিলকে রাজী করাতে পারি, সেক্ষেত্রে….থেমে গেলেন তাবালুকি। তিনি সর্বোচ্চ শ্রেণীর মানুষ। আবেগীয় প্রকাশ ভঙ্গির কারণে ভারিয়াকেও পুরোদস্তুর মানুষ না ভেবে পারলেন না। ১৮ বছরের একটা মিষ্টি মেয়েকে এরকম পরিণতির দিকে কীভাবে ঠেলে দেবেন তিনি! মাথা ঝাকিয়ে সরাসরি বলে ফেললেন : - প্রক্রিয়াটি শেষ হবার পর, ফল যাই হোক, তোমার পুরো দেহ প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে সংরক্ষণ করা হবে। প্রতিটা অঙ্গ, গ্রন্থি আলাদাভাবে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হবে। ভয় দেখিয়ে ফেরাতে চাইলেন। - ওটা নিয়ে ভাবছি না। আমার প্রজন্মের কী হবে? সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার পাবে তো? আকুল জিজ্ঞাসা ভারিয়ার। - নিশ্চিতভাবেই। যদি প্রক্রিয়াটি সফল হয়। সে ‘বি’ শ্রেণীর মর্যাদা পাবে। - প্লিজ আমাকে সুযোগটি দিন। আর যদি আমার ছেলে বা মেয়ে পৃথিবীতে আসে, দয়া করে যতো নীচের গ্রুপেই হোক ‘এ’ শ্রেণীর মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করবেন। ঝরঝর করে কেদে ফেললো ভারিয়া।
অবাক হওয়ার অভ্যাসটাই ভূলে গিয়েছিলেন তাবালুকি। আজ চরমভাবে হলেন। তিনিও স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করে বসলেন। উঠে গিয়ে ভারিয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, মা যাও। আমি তোমাকে ডাকবো। ……………………………………………………………… দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়া…কখনো ঘুম কখনো আধো-জাগরণ। উদ্ভিদের কাটিং বা কলম পদ্ধতির মতো আধুনিক বোটা-ফিজিউলজিক্যাল অযৌন প্রক্রিয়ায় দেহের মধ্যে তার আত্বজ সৃষ্টি হচ্ছে। ভারিয়া জানে বেশ কিছু জটিল শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। কয়েক ঘন্টাও হতে পারে কয়েক বছরও হতে পারে। সময় তার কাছে মূল্যহীন। - ভারিয়া !!!! কয়েক সহস্র আলোকবর্ষ দূর থেকে যেন কেউ তাকে ডাকছে। অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাবালুকির পিতৃসূলভ চেহারা দেখলো সে। নরম তুলতুলে কিছু একটা নড়ছে তার গা ঘেষে। তার সন্তান! জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা, ছুঁয়ে দেখারও ক্ষমতা নেই তার। কেউ একজন শিশুটাকে তার বুকের সাথে কয়েক সেকেন্ড মিশিয়ে রাখলো। মাতৃত্বের এক মধুর অনুভূতি তার পাংশু ঠোটে স্মিত হাসির আকারে ফুটলো। হাজার বছর ধরে প্রকৃতি সযত্নে এই অনুভূতিকে অবিকৃত রেখেছে। প্রজন্মান্তরে থাকবে। আবার চোখ বন্ধ হয়ে এলো ভারিয়ার।
শেকড়ে ফিরে যাওয়ার যুদ্ধ শুরু হলো….প্রথম যোদ্ধাটি প্রাণ দিল- বিড়বিড় করলেন তাবালুকি।
চিকিৎসক দলের প্রধান কন্যা শিশুটির মস্তিস্কে একটি ন্যানো চিপ বসিয়ে দিল। চিন্তাশক্তি পাওয়ার সাথে সাথে তার মায়ের পূর্ণ স্মৃতি তাকে দেবে চিপটি। একদিন পূর্ণ বয়স্ক হলে সে পূরো ইতিহাস জানবে। হয়তো ‘ইভোলুশনারী কাউন্সিল’ প্যাথ ল্যাবে সে তার মাকে খুঁজে নেবে। গভীর মমতায় তার মায়ের মস্তিষ্ক, হৃদপিন্ড সুরক্ষাকারী স্বচ্ছ ক্যাপসুল ছুঁয়ে দেখবে!
সময়ের প্রেক্ষাপটে এক বীর মায়ের ভাগ্যবতী সন্তান সে!!!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
logno
পড়তে গিয়ে প্রথমে হোচঁট খেয়েছিলুম । কিন্তু মাঝপথ থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মত পুরোটা পড়লাম । চমত্কার একটা ফিকশন :-)্তু মাঝপথ থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মত পুরোটা পড়লাম । চমত্কার একটা ফিকশন :-)
খন্দকার নাহিদ হোসেন
লেখাটি আমার কাছে খুব ভাল লাগলো। আপনার মত আমিও মাকে নিয়ে লেখা প্রথম লেখাটা এখানে দিয়েছিলাম। আর আপনাকে ৫ দিলাম কারণ আমরাতো এ যুগের তাই ভালোবাসার আবেগটুকু আমাদের সবসময়-ই ছুয়ে যায়; কে জানে সামনে কি হবে?!
বিন আরফান.
সায়েন্স ফিকশন , আমার একসময়ের প্রিয় পছন্দ ছিল. নিজে চর্চা করতে গিয়ে পা পিছলে পড়েছিলাম. আজ মাথা ঘুরছে এত চমত্কার একটি লেখায় মতামত কম দেখে. আসুন সকলে একবার সত্যতা যাচাই করে দেখি বিন আরফান মিথ্যাবাদী কিনা. আমার বিশ্বাস তা আমাকে শুনতে হবে না. লেখককে অনুরোধ করব এরকম গল্প আমাদের জন্য বার বার লিখতে .
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।