সকাল থেকেই কেন যেন হোসনে আরা বেগমের ডান চোখটা কাঁপছে। ধীরে ধীরে নয়, রীতিমতো ধড়পড় করে। চক্ষু কম্পনের মেয়েলি থিউরি অনুযায়ী ডান চোখের কাঁপুনি সুসংবাদের পূর্বলক্ষণ- সে বিবেচনায় হোসনে আরা বেগমের জন্য নিশ্চয়ই দারুণ কোন শুভ সংবাদ অপেক্ষা করছে আসন্ন সময়ে। কিন্তু সেটা কী- তা নিয়েই এখন চলছে জল্পনা-কল্পনা।
দুইরাত আগে ছেলেকে স্বপ্নে দেখেছেন তিনি। ছেলে এসে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলছে, "মা, আমি এসে গেছি! তোমাকে সারপ্রাইস দেব বলে আগে থেকে জানাইনি।"
শুভ সংবাদ কি তাহলে এটাই? নিশ্চিত হবার জন্য হোসনে আরা বেগম লন্ডনে ফোন লাগালেন।
মধ্যরাতে মায়ের ফোন পেয়ে কিছুটা বিরক্তই হলো আবির। বড়দিন আর নববর্ষ উপলক্ষ্যে লন্ডনের সুপারমার্কেটগুলোতে এখন ক্রেতাদের বাড়তি চাপ, অনেক রাত অবধি এ্যাকাউন্টসে থাকতে হয় আবিরকে। গত কয়েকদিন ধরে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছে না ও। এর মাঝে মা ফোন করে দেশে ফেরার কথা জানতে চেয়ে কান্নাকাটি করলে কেমন লাগে! মা কেন যে বুঝতে চায় না- ও এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখানেই স্থায়ী হতে চায়। মাকেও নিয়ে আসতে চায় এখানে, কিন্তু মা দেশ ছেড়ে আসতে রাজী নয়।
আবির যা বলার বলে ফোনটা রেখে দিল।
হোসনে আরা বেগম আহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবলেন, ছোটবেলায় যদি ছেলেটাকে এতো প্রতিযোগিতাশীল হতে না শিখিয়ে একটু সহানুভূতিশীল হতে শেখাতেন, তাহলে আজ তার ছেলে তাকে বুঝতে পারত, তার অনুভূতিকে গুরুত্ত্ব দিত। তার বড় আফসোস, তিনি তার মুক্তিযোদ্ধা পিতার কাছ থেকে যে দেশপ্রেমের চেতনা পেয়েছিলেন তা তার সন্তানের মাঝে সঞ্চারিত করতে পারেননি। প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে গিয়ে তার বাবা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিজের একটি পা হারিয়েছিলেন, বাকী জীবন তাকে ক্রাচে ভর দিয়ে চলতে হয়েছে। কিন্তু যে দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে তার বাবার মতো অসংখ্য মানুষ নিজেদের জীবন বাজী রেখেছিলেন, সে দেশ কি তারা পেয়েছেন? যে তারুণ্য একটি রাষ্ট্রের প্রাণ, একটি রাষ্ট্রের শক্তি, সে তারুণ্যই কি না এখন দেশে থাকতে চায় না! হোসনে আরা বেগমের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
তার ছেলের যেহেতু দেশে ফেরার কোন সম্ভাবনা নেই, তবে কী সেই শুভ সংবাদ যার জন্য সকাল থেকে তার ডান চোখটা কাঁপছে?
হোসনে আরা বেগম পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেন, টেলিভিশন ছেড়ে সংবাদ দেখলেন। সংকট আর সমস্যা ছাড়া কোথাও কোন সম্ভাবনার খবর নজরে এলো না। হটাৎ তার মনে পড়ল, মালার মা অনেকদিন থেকেই বলে আসছে তাকে একটা ছুটা বুয়া এনে দিবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সে বুয়া নিয়ে উপস্থিত হয়নি। তবে কি আজ মালার মা বুয়া নিয়ে আসবে? এটাই কি সেই শুভ সংবাদ? ঢাকা শহরে আজকাল বুয়া পাওয়াও তো কোন অংশে শুভ সংবাদের কম নয়!
হোসনে আরা বেগম মালার মাকে ফোন করার জন্য ড্রয়ার থেকে তার সাদা-কালো পর্দার নকিয়া সেটটা বের করলেন। সেটটিতে মাল্টিমিডিয়ার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না থাকলে কি হবে, মুরগীওয়ালা থেকে শুরু করে ময়লাওয়ালা পর্যন্ত সবার নাম্বারই সেভ করে রেখেছেন হোসনে আরা বেগম। তার এই সেটটিকে তাই অত্র এলাকার ফোন ডিরেক্টরিও বলা যেতে পারে।
মালার মাকে ফোন দিয়ে লাভ হলো না, ফোন বন্ধ। মালার মা নিশ্চয়ই কারও সাথে ঝগড়ায় ব্যস্ত, ঝগড়া শুরুর আগে সে সবসময় ফোন বন্ধ করে নেয়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, তারপর বিকেল। হোসনে আরা বেগমের ডান চোখের কাঁপুনি বন্ধ হলো না। এবার তিনি একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। শরীরে তার সমস্যার শেষ নেই। ডায়বেটিস, প্রেসার, কোমরে ব্যাথা- কোন কিছুই তো বাদ নেই! চোখে আবার নতুন করে কিছু দেখা দিলো না তো? হোসনে আরা বেগম ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন।
জাপানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহার দেখে যারা এদেশে বসে হা-হুতাশ করেন তারা একবার চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ নকীবের চেম্বারে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। ডাক্তার সাহেবকে যেন রোগী দেখে রোগ নির্ণয় নয়, বিভিন্ন টেস্টের প্রেসকিপশন ধরিয়ে দেয়ার জন্যই প্রোগ্রাম করা হয়েছে!
তার চেম্বার থেকে বের হয়ে হোসনে আরা বেগম কপাল চাপড়ালেন এবং জীবনে আর কখনও এমুখী হবেন না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলেন।
বাসায় ফেরার জন্য সিএনজি না পেয়ে তার মেজাজ আরও বিগড়ে গেল। ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলেন, সড়কে জ্যাম বাঁধতেই মোটরসাইকেল চালকগুলো যেন কোত্থেকে এসে ফুটপাথের উপর দিয়ে চলা শুরু করল। হোসনে আরা বেগম এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না, একজন মোটরসাইকেল চালককে থামিয়ে দিয়ে সমস্ত রাগ তার উপর ঢালা শুরু করলেন, "দেশটাকে কি তোমরা মগের মুল্লুক পেয়েছ যে যার যা ইচ্ছা তা-ই করবে? কী ভাবো তোমরা নিজেদের? বলি ফুটপাথ কি মোটরসাইকেল চলার জায়গা?
আগ্নেয়গিরি থেকে আকস্মিকভাবে বেরিয়ে আসা লাভা তার ভাইয়ের ছেলেকে তো বটেই, আশেপাশের মানুষজনকেও অবাক করল। বিভিন্ন যানবাহনে বসে থাকা যাত্রীরা তাকে সমর্থন দিতে লাগলেন। ট্রাফিক পুলিশের এবার টনক নড়ল, সে এসে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করল।
বাসায় ফিরে এসে হোসনে আরা বেগম অস্থিরতা অনুভব করলেন। একটা রিলাক্সেন ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন তিনি। তার আর ভালো লাগছিল না এসব।
অন্য সময় হলে সকালের আগে রিলাক্সেনের প্রভাব কাটত না। কিন্তু মহল্লায় তীব্র হৈ-হুল্লোড়ের শব্দে কিছুক্ষণের মাঝেই হোসনে আরা বেগমের চোখ খুলে গেল। তিনি ব্যালকোনীতে গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন কী হয়েছে। পাড়ার সব ছেলেরা একত্রে জড়ো হয়ে আনন্দে মেতেছে। কিন্তু কারণটা কী? হোসনে আরা বেগম বিল্ডিয়ের কাছে টিপুকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইলেন। টিপু উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, "খালাম্মা, বাংলাদেশ জিতা গেছে!" হোসনে আরা বেগম মনে করতে চেষ্টা করলেন সাম্প্রতিক সময়ে কোথাও ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল কি না যেখানে বাংলাদেশ দল অংশ নিয়েছিল, তার মনে পড়ল না। তিনি যেইনা আবার টিপুকে প্রশ্ন করতে যাবেন, ততক্ষণে ও অন্যদের সাথে হই-হই করায় মেতে গেছে। হোসনে আরা বেগম বিস্তারিত শোনার জন্য টিভি ছাড়লেন। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের অস্কার জয়- সংবাদটি শুনে তার চোখে পানি চলে এলো। এই শুভ সংবাদটি শোনার জন্যই কি সকাল থেকে তার ডান চোখটি কাঁপছিল?
হোসনে আরা বেগমের হটাৎ মনে হলো, তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? স্বপ্ন হলে স্বপ্নই, তিনি খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছেন। তিনি এ স্বপ্ন ভেঙ্গে জাগতে চান না। বাংলাদেশ পারে না এমন কিছু নেই। সে শত্রুর হাত থেকে নিজের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে, শত প্রতিকূলতার মাঝেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। শুধু প্রয়োজন এদেশের প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাওয়ার। কেননা এর মাঝেই যে দেশপ্রেম নিহিত।
০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪