সাহিত্য ডট কমের জনপ্রিয় লেখক জনাব কুক্কুড়ু বেশ বিচলিত। এবারের বইমেলায় তার তিড়িং বিড়িং উপন্যাসটি প্রকাশিত হলেও এই পর্যন্ত তার একটি কপিও বিক্রি হয়নি, অথচ মেলার আজ পনেরোতম দিন! জনাব কুক্কুড়ু একবার ভেবেছিলেন ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে পাঠক জোগাড় করে উপন্যাসের বেশ কিছু কপি তাদের হাতে ধরিয়ে দিবেন, বাজারে স্বল্প অর্থে সহজলভ্য কোনো এক পত্রিকার পরিচিত সাংবাদিককে ধরে নিজের বড় একটা প্রতিবেদনও ছাপিয়ে দিবেন, প্রতিবেদনের শিরোনাম হবে 'সময়ের আলোচিত সাহিত্যিক: জনাব কুক্কুড়ু'। ব্যাস, এরপর আর কি লাগে! উপন্যাসের বিক্রি নিয়ে তখন আর তাকে মাথা ঘামাতে হবে না। পাঠক কৌতূহলী হয়েই হোক কিংবা হুজুগের বশবর্তী হয়েই হোক_ তার উপন্যাস কিনবেই কিনবে। কিন্তু সে উদ্দেশ্য আপাতত বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। কারণ আশেপাশে তার এখন শত্রুর অভাব নেই। অবস্থা অনেকটা এমন যে, তিনি যদি বাইরে কারো সাথে সামান্য রেগে কথা বলেন তাহলে তার প্রতিপক্ষের লোকেরা রটিয়ে দিবে তিনি ভীষণ বদরাগী_ মানুষকে অযথা মারধোর করেন, যদি কোনো সুন্দরী যুবতী মেয়ের সাথে তাকে দেখা যায় তাহলে পরদিন লোকমুখে শোনা যাবে জনাব কুক্কুড়ু তৃতীয়বারের মতো বিয়ের পিড়িতে বসতে যাচ্ছেন।
এমনই সব সমস্যার ভেতর দিয়ে এই লেখকের দিনকাল অতিবাহিত হচ্ছে। ভেতরের অস্থিরতা প্রশমনের জন্য তিনি একের পর এক সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছেন, কিন্তু তাতে অ্যাশট্রেতে ছাই আর ফিল্টার জমা ছাড়া তেমন কিছুই হচ্ছে না।
জনাব কুক্কুড়ুর বারবার মনে হচ্ছে বই প্রকাশ থেকে শুরু করে পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানার সমস্ত প্রক্রিয়াটুকু যদি সাহিত্য ডট কমের 'সেরা সাহিত্যিক' নির্বাচন প্রক্রিয়ার মতো অনলাইনে বসেই করা যেত তাহলে তাকে আর এতো চিন্তিত হতে হতো না, তিনি তার কলাকৌশল অবলম্বন করেই সব জয় করে ফেলতে পারতেন। এইসব কলাকৌশলের জোরেই তো আজ তিনি ওই সাইটের সেরা লেখক! প্রতিমাসের সেরা সাহিত্যিক নির্বাচিত হওয়ার জন্য তিনি এমন কোনো দুর্নীতি নেই যা করেননি। অনেকগুলো ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে নিজের লেখায় নিজেই ভোট দেওয়া, অন্য লেখক/ কবিদের মন গলানোর জন্য তাদের লেখার নিচে ধুমধাড়াক্কা প্রশংসাসূচক মন্তব্য করা (যাতে তারা তার কথায় দুর্বল হয়ে তার লেখায় ভোট দেয়), কিংবা সুন্দর মন্তব্য করেও অন্য প্রতিযোগীদের ভোট না দেওয়া, দিলেও নিম্নমানের ভোট দেওয়া যাতে তারা তার ধারের কাছেও না আসতে পারে, নতুন সদস্য সাইন আপ করা মাত্রই তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া, তার মন গলিয়ে কিংবা তাকে সুন্দর একখানা বার্তা পাঠিয়ে নিজ লেখায় ভোট দিতে বাধ্য করা, সর্বোপরি মনভোলানো স্ট্যাটাস দিয়ে সবার আইওয়াশ করা- কোনো কিছুই তিনি বাদ রাখেন নি। এরপরও যখন অন্য লেখাগুলোর ভিউ ও মন্তব্য পড়ে দেখতেন তার লেখা পিছিয়ে পড়ছে তখন দুনিয়াশুদ্ধ সব পরিচিত মানুষদের এটা-ওটার লোভ দেখিয়ে ওই সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে নিজের 'চেয়ার' ধরে রাখতেন তিনি। আহ! কতোই না সুখের ছিল সে দিনগুলি।
তিন হাজার টাকার পুরস্কার, সনদ, বই প্রকাশের সুযোগ আর জনপ্রিয়তা অর্জন তার কাছে এতোই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল যে সে তার ন্যুনতম বিবেক বোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলেন। নিজেকেই নিজে বলতেন- আমি তো কোনো দোষ করছি না। গলায় সুর না থেকেও শুধু স্বামীর জোরে যেহেতু দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হওয়া যায়, একঘেয়ে নাম দিয়ে একের পর এক সিডির অ্যালবাম বের করা যায়, সেখানে তিনি তো নিজের চেষ্টাতেই সব অর্জন করে নিচ্ছেন।
জনাব কুক্কুড়ু এসব করতে গিয়ে দু' একবার যে সাহিত্য ডট কমের অন্য লেখক/ কবিদের কাছে ধড়া পড়েননি, তা নয়। তবে যখনই ধরা খেয়েছেন তখনই হয় অর্থনৈতিক সংকটের মরা কান্না কেঁদে নয়তো সেখানকার অসাধু মানুষদের সায়েস্তা করার মহতী উদ্যোগের কথা বলে পার পেয়ে গেছেন। নিজেকে তখন তার মনে হয়েছে পুরস্কারপ্রাপ্ত দক্ষ অভিনেতা। লেখালেখির পাশাপাশি এখন তার অভিনয়েও নাম লেখানো উচিত। সুন্দর চেহারার শোপিছ টাইপ মডেলরা আজকাল যেহেতু নাচ, গান, এমনকি বড় পর্দায় মূল চরিত্রে অভিনয়ও করতে পারে, সেখানে তিনি তো লেখালেখির মারাত্মক প্রতিভা নিয়ে পার্টটাইম হিসেবে অভিনয় করবেন, এতে আর দোষ কি! পাঠকের জন্য নিম্নে সেই প্রতিভারই কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হলো:
১.প্রেমের কবিতা:
প্রিয়া যখন পান খেয়ে মুখ করে লাল,
আমি তখন তার প্রেমে হয়ে পড়ি মাতাল...
২. বর্ষার কবিতা:
বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর
খিচুড়ি খাব আজকে দুপুর...
৩.নববর্ষের কবিতা:
নতুন ভোরের সূর্য দেখে আমি জোরে মারলাম লাফ,
খাট ভেঙে পড়ে বউ বলল 'ওরে বাপরে বাপ!'...
কিন্তু এবার তিনি সত্যিই আসল পরীৰার সম্মুখীন হয়েছেন। এবার তিনি মুখোমুখি হয়েছেন প্রকৃত পাঠকদের। এর মাঝে একটু আগে আবার খবর এসেছে তার উপন্যাসের সাথে নাকি দেশের কোন এক প্রচার বিমুখ লেখকের পুরনো একটি উপন্যাসের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। যদি তা প্রমাণিত হয় তাহলে জনাব কুক্কুড়ুর বইটি তো বাজেয়াপ্ত করা হবেই, উল্টো তাকে আরো মাশুল গুনতে হবে। গল্পের সংকটে পড়ে জনাব কুক্কুড়ু না হয় ওই গর্ধব লেখকের (জনাব কুক্কুড়ুর মতে প্রচার বিমুখ মানুষেরা গর্ধব) অচল একটি উপন্যাসের (তার মতে যে বই দেদারসে বিক্রি হয় না তা অচল) কিছু অংশ কপি-পেস্ট করেছেন, এতে দোষের কি আছে? এর আগেও তো এ কাজ তিনি বহুবার করেছেন। তাছাড়া উপন্যাসের নামটি সম্পূর্ণ তার দেওয়া- সেটা কি কেউ দেখছে না? আসলে সময় যখন খারাপ যেতে থাকে তখন সব কিছুই খারাপ হয়! এর মাঝে বউটাও আবার তার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে।
জনাব কুক্কুড়ুর সব পানসে লাগছে। তিনি আর কিছুই না পেয়ে টিভির রিমোট নিয়ে বসলেন।
প্রথম প্রেসে যে চ্যানেল আসল তাতে 'জনপ্রিয়' সব শিল্পীদের 'জনপ্রিয়' সব কর্মকাণ্ড নিয়ে 'জনপ্রিয়' আড্ডায় বসেছেন বিশ্বের এক নম্বর 'জনপ্রিয়' বাংলা চ্যানেলের 'জনপ্রিয়' উপস্থাপিকা ...(নাম না হয় না-ই বললাম)। উপস্থাপিকা গত এক মিনিটের মধ্যে যতবার 'জনপ্রিয়' শব্দটি ব্যবহার করেছেন, ততবার মনে হয় না শিল্পীদের নামগুলোও উচ্চারণ করেছেন। জনপ্রিয়তা বিচারের দায়ভার যেনো সম্পূর্ণই তাদের, দর্শক যেনো কিছুই না! জনাব কুক্কুড়ু মূলত এসব অনুষ্ঠান দেখেন না। অতএব পরের চ্যানেল। এই চ্যানেলে রগরগে পোশাক পড়ে উদ্দাম নৃত্যে মত্ত হালের কোনো এক আইটেম গার্ল। বউ বাড়িতে না থাকলে জনান কুক্কুড়ু এসব আইটেম গার্লদের আপাদমস্তক উপভোগ করেন, কিন্তু আজ কেনো যেনো তা-ও ভালো লাগছে না। সুতরাং আবার রিমোটে চাপ।
পরের চ্যানেলে কি হচ্ছে প্রথম দর্শনে জনাব কুক্কুড়ু ধরতে পারেননি। কিছুক্ষণ দেখার পর বুঝতে পারলেন_ বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান, উপস্থাপক আজ একজন নবীন লেখকের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিবেন যার বই এবারের মেলায় বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে, লেখক কায়সার হোসেন, যাকে দেখে জনাব কুক্কুড়ু রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লেন। এই সেই কায়সার হোসেন সাহিত্য ডট কমে যার লেখায় সে ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে ইচ্ছেমত নেতিবাচক মন্তব্য করতেন। কায়সার হোসেন প্রথম থেকেই অসাধারণ সব লেখা লিখতেন, কিন্তু নেটে খুব একটা হাজিরা দিতে পারতেন না। কারণ পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় তার বাসায় কম্পিউটার ছিলো না, নেটের সংযোগ তো পরের কথা। লেখা জমা দিতেন সাইবার ক্যাফে থেকে। কে কি মন্তব্য করছে তা দেখার জন্য সাইবার ক্যাফে থেকেই মাঝে মধ্যে নিজের অ্যাকাউন্ট চেক করতেন। কিন্তু লেখার নিচে নেতিবাচক মন্তব্য পড়তে পড়তে একসময় উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। অর্থ সংকট থাকলেও কায়সার যথেষ্ট সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তাই তিনি আর নিজেকে সেরা বানানোর জন্য কোনো দুই নম্বরির আশ্রয় নেননি, অগোচরেই সরে পড়েছিলেন। সেই ব্যাটাই কি না এখন সময়ের আলোচিত সাহিত্যিক!
জনাব কুক্কুড়ু হঠাৎ বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন। তার কপাল ঘামাতে লাগল। এইবার তিনি সত্যিই হেরে গেলেন। হেরে গেলেন সততার কাছে, হেরে গেলেন বাস্তবতার কাছে, হেরে গেলেন প্রকৃত প্রতিভার কাছে। গত কয়েক বছরে তার মাথায় যা কখনোই আসেনি আজ তা তিনি উপলব্ধি করলেন_ এই দীর্ঘ সময় এতো কপটতার আশ্রয় না নিয়ে তিনি যদি সাধনা করতেন তাহলে আজ নিজের যোগ্যতা দিয়েই সাহিত্যজগতে নিজের একটা অবস্থান গড়ে নিতে পারতেন।
পাদটীকা: মশারা পনপন করে উড়ে যায়, হয়তো কিছু রক্তও শুষে নিয়ে যায়, তারপরেও টিকে থাকে রক্ত-মাংসে তৈরি খাঁটি মানুষেরা।
০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪