দুইটা কুকুর সাদামতন কী একটা জিনিস নিয়ে টানাটানি করছে। জিনিসটা কী তা ঠাহর করা কষ্টকর নয় আবার কষ্টকরও বটে। রাতের আলো ক্ষীয়মাণ। সন্ধ্যে ও ঊষারের মধ্যস্থতায় সে হয়তো ক্লান্ত। কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারছে না। পেছনে গেলে হয়তো আর কখনো আলো ফুটবে না, সামনে গেলে হয়তো সে গর্বিত ভঙ্গিতে হেসে উঠবে। দু’চারটে ঝিঁঝিঁ পোকা মোমেনের উদোম শরীর থেকে বয়ে যাওয়া খুনের গন্ধ শুকতে শুকতে দূরে চলে যায়। মোমেনের নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস বেরুচ্ছে। শীতের শুরুর রাতগুলো হেমন্তকে ফেলে আসার শোক পালনে মগ্ন। মোমেন আস্তে আস্তে চোখ খোলে। তার শরীর বাবলা গাছের সাথে বাঁধা। গাছের উপর থেকে একটি জলপিপি উড়ে চলে যায়। দু’একটি পাতা খসে পড়ে নিচে। মোমেন তার নির্যাচিত মেধায় আবিষ্কার করে কুকুর দুইটি একটা রক্তাক্ত জলপিপিকে নিয়ে টানাটানি করছে। দু’একটি গাছের পরেই আরেকটি বাবলা গাছ। সে গাছের গোঁড়া থেকে কেমন যেন একটা গোঙানির শব্দ শুনতে পায় মোমেন। শব্দটি তার পরিচিত মনে হয়, আপন মনে হয়। সে ছুটে যেতে চায় কিন্তু তার সমস্ত শরীর বাঁধা বাবলা গাছের সাথে। তার শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ছে খুন। তার চোখদুটো দিয়ে সে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে কে সে? অতঃপর তার স্মৃতিতে ধরা পড়ে গত সন্ধ্যের কথা। মিয়াবাড়ির উঠোনে গ্রাম্য সালিশ কেন্দ্রের বৈঠকের ঘটনাগুলো তার ভ্রষ্টপ্রায় স্মৃতিকে খানিকটা চুলকোনি দিয়ে যায়। সমিরন মাথা নিচু করে থাকে। তার চুলগুলো এলোমেলো, চুচিযুগল ঢিলেঢালা। হয়তো কোনো সুনামি বয়ে গেছে তার ওপর। তার ঠোঁটের কোণায় খুন লেগে থাকে। এ খুন মুক্তি সন্তানের উপহার। তার লুটেরা দেহের প্রতি কোনো অনুশোচনা নেই যেন কারো। যেন এটাই তার প্রাপ্য। গ্রাম্য মাতবর মিয়া সাহেব পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলেনÑ তা কতা অইতাছে যে, এই কাম আমাগো পোলাপান করবার পারে না। এ অবশ্যই রাজাকারের পোলা মোমেনের মহাষড়যন্ত্র। আরেকবার তিনি পানের পিক ফেলেন। চারপাশে গম্ভীরতা। মুখ মুছে আবার কথা আরম্ভ করেনÑ তা কতা অইতাছে যে, মিয়া ভাইয়েরা আপনেরা তো দ্যাকছেন এই কুলটা মাইয়া মানুষের ঘর থিকা কে বাহির হইয়া আসছে, কে আসছে? কী কতা কন না কেন? গ্রাম্য এক বৃদ্ধ বলেÑ মোমেন মিয়া, ওই রাজাকারের ছাওডা। ওইডার লগে ভালাই পিরিত, কুলটা মাগির। সমিরন গর্জে ওঠেÑ খবরদার বুইড়া, ওনার কোনো দোষ নাই, উনি কোনো দোষ করে নাই, ওনারে মাখাইবা না , মিয়া সাহেবের পোলা আমার সর্বনাশ করছে। মিয়া সাহেব আপনে না মুক্তিযোদ্ধা, তয় আপনের পোলা এতবড় ঘেন্নার কাম ক্যামনে করল? মিয়া সাহেব লুঙ্গি ঝাড়া দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেÑ তা কতা অইতাছে যে, এই বেগানা মাইয়া মাইনষের গলার আওয়াজ দ্যাখেন ভাইসাহেবেরা। চুরি-চুরি, শিনা-চুরি। পিরিত করবা, নষ্টামি করবা ওই রাজাকারের পোলা মোমেনের লগে আর ফাসাইয়া দিবা আমার পোলাপানগো। তয় শ্যাষম্যাষ কতা অইলো যে, এই কুলটা মাইয়ারে ১০১টা দোররার বাড়ি মাইরা গ্যারাম ছাড়া করা যায়, কী কন আপনেরা। সবাই সম¯^রে হ্ হ্ করে ওঠে। সমিরনের বৃদ্ধ নানি চেঁচিয়ে ওঠেÑ এইডা অবিচার, গরিবের বিচার নাই, ও আল্লা তুমি কই। মাতবর সাহেব ধমকে ওঠেন, ওই বুড়ি চুপ করো। তোমার সোয়ামিতো মুক্তিযুদ্ধে আমার পার্টনার আছিলো, বড় ভালা লোক ছিল সে, তোমার ছোট মাইয়া কুলসুম, তারে কত কোলে নিছি আমি। তার ঘরে এই আলবদর কইন্যা ক্যামনে জন্ম নিলো হিসাব মিলাইতে পারি না। বৃদ্ধা আহাজারি করে বলেÑ মাতবর সাব, আপনের পায়ে ধরি মাতবর সাব, ওরে ছাইড়া দেন, যুদ্ধে আমি তিন তিনডা জোয়ান পোলা হারাইছি, গেলো বছর মাইয়াডারেও হারাইলাম, এই নাতনি ছাড়া আমার তিন কুলে কেউ নাই, ওরে বুকে আগলাইয়া আমি বাঁইচা আছি, ওরে ছাইড়া দেন। মাতবর পা ঝাড়া দিয়ে বলেÑ পাও ছাড়ো বুড়ি, আমারে গুনাহগার কইরো না, সঠিক বিচার কইরা নেক কামাই করতে দেও। কইরে লোকমান দোররাডা আন, আর তোরা যা রাজাকারের ছাওডারে ধইরা আন। কিশোর, যুবা সবাই মোমেনের ঘরের দিকে স্লোগান দিতে দিতে ছুটে যায়Ñ রাজাকারের ছাও, ধইরা ধইরা খাও। সমস্ত গ্রামে যেন আবারো একাত্তর নেমে এসেছে, স্লোগান আরো ঘনীভূত হয়Ñ রাজাকারের ছাও, ধইরা ধইরা খাও। মাতবর দোররা মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে ওঠে।
সমিরনের গলার আওয়াজ কমে না। সে আরো প্রতিবাদী হয়ে ওঠেÑ কুত্তার বাচ্চা, গমচোর, টিনচোর, সুদখোর-দালাল, গেরামের পুলের ট্যাকা তুই মারছস, পাটের গুদামে তুই আগুন দিছস, অনেক মানুষরে ভিটাছাড়া করচস, তুই মুক্তিযোদ্ধা নামের কলঙ্ক, তুই রাজাকারের থিকাও খারাপ, তুই দ্যাশের শত্রু। মিয়া সাহেবের দোররা মারার জোর আরো বাড়তে থাকে। তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তার ছেলে মোক্তার তার হাত থেকে দোররাটি নিয়ে বলেÑ আব্বাজান আপনে বড় পেরেশান হইয়া পড়ছেন, একটু জিরাইয়া লন, এইবার আমি একটু নেক কাম করি। সমিরন মোক্তারের মুখে থুথু ছিটায়। মোক্তার তার গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে দোররা মারা আরম্ভ করে। সমিরনের চিৎকারে গাঁয়ের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভিড় থেকে একজন বৃদ্ধ বলে ওঠে, মিয়া সাব, ১০১টার বেশি হইয়া গ্যাছে এইবার থামতে কন। মিয়া সাহেব হাতের ইশারায় থামতে বলেন।
সহসা গ্রামের কিশোররা স্লোগান দিতে দিতে বৈঠকখানায় ঢুকে পড়েÑ রাজাকারের ছাও, ধইরা ধইরা খাও। মোক্তারের বন্ধু সগীর বন্দি মোমেনকে সামনে এনে বলেÑ মাতবর সাব এই লন হালারে দিছি আচ্ছামতোন। শালিসের আগে ইট্টু ওয়ার্ম আপ কইরা লইলাম, মাইর হজম করবার পারবো কিনা একটু টেস্ট করলাম। মিয়া সাহেব হো হো করে হেসে ওঠেন। তার পান খাওয়া দাঁতের হাসি মোমেনের কাছে দৈত্যের হাসি বলে মনে হয়। এরকম বিভৎস হাসি সে আগে কখনো দেখেনি। মোমেনের নাক দিয়ে অনবরত গরম হাওয়া বেরুতে থাকে। তার সমস্ত শরীরে খুন এঁকে দেয় মুক্তিসন্তানেরা। মোমেনের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই শৈশবের বাংলা শিক্ষক নিখিল মাস্টারের ভয়ঙ্কর রক্তচক্ষু। স্কুলে কারণে অকারণে নিখিল মাস্টার তাকে রাজাকারের ছাও বলে গর্বিত চিত্তে বেত্রাঘাত করতেন, আর উল্লাসে উল্লাসে ছড়া কাটতেনÑ রাজাকারের ছাও, ধইরা ধইরা খাও। সমস্ত ক্লাসে যেন তখন একাত্তর নেমে আসতো। হয়তো তার বেত্রাঘাতে জাতীয় পতাকাটা গর্বে একটু নড়েচড়ে উঠতো। সেই থেকে স্কুলের সব ছেলেরা তাকে রাজাকারের ছাও, ধইরা ধইরা খাও এই স্লোগান দিতে দিতে খেপাতে থাকতো। রাজাকার কী তখন ভালভাবে বুঝতো না মোমেন। তবে এটা বুঝতো যে, এটা খারাপ মানুষের উপাধি। মায়ের কাছে বাড়িতে এসে যখন জিজ্ঞেস করতোÑ মা, রাজাকার কারা? তখন মা ঘৃণামিশ্রিত এক অজানা লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকতো। আজ এই মুহূর্তে সে মিয়া সাহেব ও তার ছেলেপেলের চোখেমুখে রাজাকারের প্রতিমূর্তি দেখে ঘৃণামিশ্রিত এক অজানা লজ্জায়, খানিকটা ভয়ে শিহরিত হয়ে ওঠে।
ঠান্ডা বাতাস বইছে সমিরনের হাতের দড়ি আলগা মনে হচ্ছে। তাকে মুখ চেপে আবারো নিয়ে যাওয়া হয় গঞ্জিকা সেবকদের কক্ষে। তাকে আবারও স্বর্গসুখ দেয়া হবে, সে স্বর্গে যাওয়ার জন্য ভীত, ঘৃণিত হয়ে উঠবে, হয়তো খুব ভোরে তার চোখদু’টো নীলাভ হয়ে উঠবে। হয়তো এ রাত কখনো শেষ হবেনা, কখনো আলো ফুটবেনা। মোমেন ছুটে যাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়। তার অবসন্ন চোখদুটো জলপিপিদের ছটফটানি দেখে। এখনো কুকুরদুটো জলপিপিটাকে নিয়ে টানাটানি করছে। আবারও একটা জলপিপি বাবলা গাছের ডগা থেকে দূরে উড়ে চলে যাচ্ছে শরীরে খুনের সন্ত্রস্ততা নিয়ে।