ছোট বেলায় প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাসায় চায়ের আসর জমত।মহিউদ্দিন চাচা, হায়দার চাচা ,জলিল চাচা, রমেন চাচা এরা আমাদের বাসার নিয়মিত সান্ধ্যকালীন অতিথি ছিলেন। ওরা নিজেরাই পুড়ি, সিঙ্গারা,নিমকপারা আরও কত কি আনতেন। মা ভীষন বিরক্ত হতো।ওনার আসার আগেই মা বাবাকে ওয়ার্নিং দিতো যেন ওরা জোড়ে জোড়ে গল্প আর হাসাহাসি না করেন। সন্ধের সময় মা ভাইকে পড়াতে বসাতো, তখন বড় ভাই সবে স্কুলে যেত শুরু করেছে। মা ওদের উপর এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে শোকেসে তুলে রাখা ভাল কাপে করে কখনওই চা দেননি। অবশ্য ওরা এসব নিয়ে বোধহয় মাথা ঘামাতেন ও না।
ওনাদের সব গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটত যুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থনের ভেতর দিয়ে। কত লোমহর্ষক ঘটনার বর্ননাই না তারা দিতেন। ভয়ে আমি বাবার কোলে সিটিয়ে বসে থাকতাম।আর আল্লার কাছে শুকরিয়া জানাতাম যে ওরা আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়নি। ওনাদের কেউ কেউ আবার প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ওনারা এমন ভাবে ঘটনার বর্ননা করতেন যেন মনে হতো ওনারা তখনও যুদ্ধধক্ষেএে। আমার বাবাও গল্প বলতেন , তিনি কিভাবে বড় ফুপু আর ছোট ফুপু কে বিহারিদের বাসায় লুকিয়ে রেখছিলেন, কিভাবে একাওুর এর সেপ্টেম্বরে মাকে বিয়ে করলেন এসব। ঐ ছোট্ট বয়সে আমার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন আসত আমার বাবা কেন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, নাকি ওরা আমার বাবাকে ভর্তি নেয়নি যেমন করে বড় ভাই কে মোহাম্মদপুর বয়েজ স্কুলে ভর্তি নেয়নি সেভাবে । আমার বাবার গায়ে যেমন শক্তি,উনি ইজিলি চড় মেরেই দু চারটা পাক সেনা কে মেড়ে ফেলতে পারতেন। বাবার শক্তির নমুনা ঐ বয়সে আমরা দুই ভাই ই অবশ্য টের পেয়েছিলাম। আমরা একটা বিষয় ছোট বয়সেই পরিষ্কার বুঝেছিলাম যে বাবাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবেনা। প্রশ্ন যদি বাবার মনের মত না হয় তাহলে বাবা অগ্নমূর্তি ধারণ করবেন।আর তখনই উনি বড় ভাই কে টেন্স আর আমাকে নামতা পড়ানোর উছিলায় চড়ম বেত্রাঘাত করবেন। মার খেতে খেতে আমরা আমাদের অপরাধ আর এই মারের মাঝে যোগসূত্র খুজে পেয়ে যাব।
একবার বড় ভাই বাবাকে ভুল করে জিজ্ঞেস করেছিল বাবা তুমি যুদ্ধ করনি কেন ? বাবা কি উওর দিয়ছিলেন তা আমার মনে নেই তবে সেই দিন রাতে মেহমান দের চলে যাবার পর বাবা যেন হায়নার মত বড় ভাইয়ের উপর ঝাপিয়ে পরেছিলেন। শুরু করেছিলেন তার সেই ঐতিহাসিক কেইন থেরাপি।
তবুও আমি ও ভাই বাবাকে ভীষন ভালবাসতাম। কল্পনায় নিজেদেরকে যোদ্ধা মনে করতাম। ভাবতাম বাবাকে ওরা যুদ্ধ করতে নেয়নি বলেই বোধ হয় বাবা কথায় কথায় এত রাগ করতেন। আমরা দুই ভাই সে সময় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা ই বেশী পছন্দ করতাম।কল্পনায় আমরা বাবাকে আমাদের লিডার মনে করতাম, ভাবতাম আর একবার যুদ্ধ হলেই আমরা অবশ্যই বাবাকে নিয়ে যুদ্ধ করবো।
যখন আমি একটু একটু করে বড় হচ্ছিলাম তখন নিজের মনেই বাবার স্বপক্ষে যুক্তি দার করেছিলাম। ভাবতাম বাবা কেন এই সহজ উওর গুলো সহজ ভাবে দিতে পারেননি? যুদ্ধের সময় বাবা তার দুই যুবতি বোনকে রক্ষা করেছে ঔ সেই সাথে আর এক কন্যা দায় গ্রস্ত পিতার বোঝা লাঘব করেছে। এদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থাও করেছিলেন। সর্বক্ষণ এদের পাহাড়া দিয়েছিলেন। এটা কি যুদ্ধ নয় ? পরিবারকে রক্ষা করা কি দেশ রক্ষা করার চাইতে কম কিছু?
কিন্তু আমার এই যুক্তিটা আমার নিজের কাছেই কখনও কখনও গ্রহণ যোগ্য হয়না। বোধহয় আমি নিজই একজন দ্বৈতসত্বার মানুষ। আমার এক সত্বা বাবাকে ভিষণ ভালবাসে আর এক সত্বা বাবাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে।
সময়টা ১৯৮১ সাল , আমি তখন পাঁচ বছরের শিশু । সেদিনের দৃশ্যটা আজও আমার কাছে স্পষ্ট। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি খাটে বসে বৃষ্টির পড়ে যাওয়া দেখছিলাম , খানিকক্ষন বাদেই বৃষ্টি থেমে গেল। বৃষ্টি থামায় আবার সব ফেরিওয়ালারা রাস্তায় নেমে আসল। একজন বুড়ো ফেরিওয়ালা গান গেয়ে গেয়ে মাটির হাড়ি পাতিল বিক্রি করছিল, আর আমি ক্লান্তিহীন ভাবে ওর মাইট্যা হাড়ি পাতিলের গানটা গেয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিন ছিল শব ই বরাত। চারিদিকে ঘি আর এলাচের গন্ধ। ।আমরা মোহাম্মদপুরে একটি এনিমি প্রপার্টির বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। আমাদের পাড়ায় অনেক বিহারিরা থাকত। ওরা গরীব হলেও এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজনে কৃপণতা করেনা। যতই বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল চারিদিকে পটকা, তারাবাতি , আগরবাতি ,সুজির বরফি আর ফিরনি র সুঘ্রান সব মিলিয়ে এক মোহনিয় পরিবেশ তৈরী হয়েছিল সেদিন। বলে রাখা ভাল সেদিন আমাদের বাসায় শব ই বরাতের স্পেশাল কোন আইটেম রান্না হয়নি। আমাদের সদ্য আমেরিকা ফেরৎ আব্বা এসবকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। আর আমরা দু ভাই ছটপট করছিলাম ঘর থেকে বেড়োবার জন্যে। এরই মধ্যে আমাদের বন্ধু যুম্মন, কইয়্যুম, গুড্ডু, ফরহাদ আমাদের ডাকতে এসেছে। কালবিলম্ব না করে আমরা দুজনে ছুটে বেড়িয়ে গেছি। কি যে খুশি হয়েছিলাম সেদিন! এ বাড়ি ও বাড়ি হালুয়া রুটি খেয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্ধ্যেটা বেশ ভালই কাটছিল। হঠাৎ আমাদের দেশপ্রেমিক বাবা বাড়ি ফিরে আমাদের দেখতে না পেয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেলাম গরম একট হাওয়া কানের পাশ দিয়ে বয়ে গেল। এর পর শুরু হলো প্রলয়ংকরী উওম মধ্যম। সেদিন আমার জ্বর এসে গিয়েছিল। ভয়ে আর আতঙ্কে আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ঐ বয়সে আমি ভেবে পাইনি আমার অপরাধ টা কোথায়। কেন এভাবে বাবা আমাদের কে মারেন?
বাবা সেদিন অকত্থ্য ভাষায় বিহারিদের গালিগালাজ করেছিলেন। ওরা শয়তান, ওরা ইবলিশ ওদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বেড় করে দেয়া উচিৎ। আরও অনেক কিছু যার কোন অর্থই তখন আমার বোধগম্য হয়নি। বাবা কেন এত ঘৃণা করেন বিহারিদের কে- এ প্রশ্ন আমাকে বার বার তাড়া করেছে সেই সময়ে।
একবার আমাদের বাসায় এক বিহারি আয়া কাজ নিয়েছিল । ওকে সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত কাজ করতে হতো । এক বেলা খাওয়া আর আশি টাকা বেতন ধার্য হয়েছিল। মা সবে আয়া নির্ভর জীবন শুরু করেছিলেন মনের খুশিতে মা গুনগুন করে অবিরত গেয়ে যেতেন ‘চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় ও প্রসারী ক্ষুদ্র দূঃখ সব তুচ্ছ মানি...... । মায়ের এই সুখ অবশ্য সপ্তাহও গড়াতে পারেনি । বিপওি ঘটল রোববার দিন। ছুটির দিনে (রোববার)সবে বাজার থেকে ফিরেছেন বাবা । রান্নাঘরে গিয়ে বিহারী আয়া কে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি । মাকে ঘরে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন এই আয়া কবে থেকে এ বাড়িতে কাজ নিয়েছে? মা বলেছিলেন পাঁচ দিন। বাবা ওকে পুরো মাসের বেতন দিয়ে কুকুরের মত তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।বাবার এই আচড়নের কোনো ব্যাখ্যা আমি তখন খুজে পাইনি।
আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে বিষয় গুলো স্পষ্ট হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার সাথে সাথে বাবার অগ্নিমূর্তির ইতিহাসটাও স্পষ্ট হচ্ছিল আমার কাছে। আমার দেশ প্রেমিক বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় পঁচিশ বছরের যুবক ছিলেন । উনসওর এর গনঅভ্যুত্থানের সময় বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন ।সেই গনঅভ্যুত্থানে বাবার কোনো ভূমিকা ছিলনা!একাওুরে উনি যুদ্ধে না গিয়ে ছাদনা তলায় কেন গিয়েছিলেন? কেনই বা তিনি যুদ্ধের সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি ঘরের দেয়ালে টানিয়ে রাখতেন? নিজের অক্ষমতার গ্লানি বাবাক কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল বোধহয় ।আমার কাছে বাবা একজন স্যাডিস্ট। তার হিংশ্রতা আর ক্ষোব নিবারনের একমাএ জায়গা আমরা দুই ভাই আর ঐ দরীদ্র বিহারী পরিবার গুলো। অপারগতার গ্লানি আর অপরাধ বোধ থেকে নিঃস্কৃতি পাবার জন্যই বাবা দূর্বলের উপর তীব্র ঘৃণা ও আক্ষেপ ঝাড়তেন। আসলেই কি অপারগতার গ্লানি নাকি বাবা একজন অতি সাধারন সুবিধাবাদি মানুষ? যার দেশপ্রেমের অন্তরালে আত্মপ্রেমই প্রকট! কারন মুক্তিযুদ্ধের পর আজ অব্ধি দেশ বারবার দেশিয় হায়নাপ্রেমিকদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে । দেশে মায়ের বুক চিড়ে সম্পদ লুট হয়েছে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর,আর আমার দেশপ্রেমিক বাবা সময়ের সাথে সাথে বারবার ভোল পাল্টেচ্ছেন। তিনি একজন গর্ভমেন্ট সার্ভেন্ট ছিলেন যে কারনে দেশের চরম সংকটে তাঁর দেশপ্রেম প্রকাশের অনেক সূযোগ পেয়েও তিনি মুখে কুলুপ এটেছিলেন।এই ডাবল স্টান্ডার্ড তাকে শুধু ঘৃণা করতেই শিখিয়েছে আমাকে।
রিটায়ারমেন্ট এর পর তিনি নিয়মিত টক শোতে কথা বেচতে শুরু করেছেন। প্রচুর বাহবা পেয়ে যাচ্ছেন তিনি । মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি কেন ঐ ফেরিওয়ালার সন্তান হলাম না। আমার ফেরিওয়ালা বাবা আর কত বড় হিপোক্রেট হতেন? যোড় বেশি পনের টাকার ঢাকনা বিশ টাকায় বিক্রি করতেন! নিশ্চয় তিনি দেশের চরম সংকট কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে নিস্ফল কথা বেচে ব্যাংকে রিজার্ভ একাউন্ট ভরাতেন না। পয়সার বিনিময়ে যদি আমার ফেরিওয়ালা বাবা ঐ কাজ গুলো করতেন তাহলেও আমি দূঃখ পেতাম না,কারণ নীতি এবং নৈতিকতা প্রদর্শনের জন্য তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা সামাজিক অবস্থান ছিলনা। আমার ঞ্জানপাপি বাবা সাধারন মানুষের ভাগ্য কে পুজি করে নিজের পকেট ভরার রাজনীতি করছে।
এখন আমি ছএিশ বছরের এক বলিষ্ঠ পুরুষ, দুটি পুত্র সন্তানের জনক। আমি যুদ্ধোওর অনেক গুলো ইতিহাসের সাক্ষি হয়েছি, স্বৈরশাষন দেখেছি, ক্ষমতা লিপ্সু দুটি রাজনৈতিক দলের মিথ্যাচার আর অরাজকতা দেখে চলেছি ।আমি দেশের কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ কে সমর্থন করিনা ।জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোন আদর্শবান রাজনীতিবিদ কে আমি দেখিনি! এই রাজনৈতিক নেতাদেরকে আমি আমার হিপোক্রেট বাবার মতই ঘৃনা করি। দেশ এখন চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে , এই শকুন চিলেরা আজ দেশের বুকে ক্ষত চিহ্ন একে দিচ্ছে, প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে আমাব চোখে। আমি ঘৃণা করতে শেখাচ্ছি আমার সন্তানদের এদের রক্তপাতের রাজনীতিকে । চিনিয়ে দিচ্ছি তাদেরকে যারা স্বামী ,পিতা আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ব্যবসা করছে । আমি তাই করছি যা আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি।আমি দেশ মাকে আমার মায়ের মতই ভালবাসি। এই সংকটটময় সময়ে আমি কিভাবে অফিস থেকে ফিরে স্ত্রীর আচলে মুখ মুছি? দেশ মাকে মুক্ত করার জন্য আর একটি মুক্তি যুদ্ধের নিরন্তর অপেক্ষায় আছি আমি ।
১৯ অক্টোবর - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪