১লা জানুয়ারী অথবা একটি সাধারন দিনের ঘটনা

নববর্ষ (ডিসেম্বর ২০১৩)

সাফাত সোয়েব বিস্ময়
  • ৫২
"মমি,মমি আমি এই জামাটা নেই?" আহ্লাদী গলায় মায়ের কাছে নিজের দাবি জানায় জুই। হাতে হলুদ রঙের একটি ফ্রক।
"দেখি,হা মা , নেও। প্রায় ১মাস ধরে তোমাকে কিছু কিনে দেই না। আজ যতগুলা ইচ্ছা ততগুলা জামা কিনো ।তাছাড়া কাল জানুয়ারী ১ তারিখ , তাই কাল আমি পার্টি রেখেছি। " স্নেহ মাখা গলায় মেয়েকে প্রশ্রয় দেন মিসেস মহুয়া।
"মমি, ১মাস না। ১মাস ১২ দিন। গত ঈদে শেষবার শপিং করেছিলাম । এরপর ৪২ দিন ধরে নতুন জামা কিনি নাই। আর সেবার মাত্র ৪টা জামা কিনেছিলাম। " চেহারা কুঞ্ছিত করে মাকে বলে জুই।
"আচ্ছা বাবা,আমি সরি। আমার মেয়েটা কি আমার সাথে রাগ করেছে? আজ আমি আর আমার মেয়ে ১০টা জামা কিনব।" আদরের একমাত্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে কথাগুল বিরতিহীনভাবে বোলে থামেন তিনি।

প্রায় ৩ঘণ্টার দীর্ঘ শপিং যুদ্ধ শেষ করে বাসায় আসেন দুই মা মেয়ে।কলিং বেল বাজান মহুয়া। একবার,দুইবার,তিনবার। তিনবার বেল বাজানোর পর গেট খুলল মহুয়ার বাড়ির গৃহকর্মী নাসিমা। গেট খুলে নাসিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই
খপ করে তার চুল মুঠি করে ধরেন মহুয়া। "ওই ধড়িবাজ মাইয়া,কই মরছিলি?? এতখন লাগল কেন দরজা খুলতে?"
নাসিমার চুল মহুয়া টানায় কষ্টে আর্তনাদ করে উঠে নাসিমা।" আমি একটু টয়লেটে গেসিলাম খালাম্মা। তাই, আইতে আইতে দেরি হইয়া গেসে । মাফ কইরা দেন।"
"যা দামড়ির বাচ্চা দামড়ি। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি খাওয়া । আর ভবিষ্যতে যদি এমন করিস তখন দেখবি তোর একদিন কি আমার একদিন!!' মহুয়া বললেন।
চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নাসিমা। ঠাণ্ডা পানি আনতে গিয়ে একটা দরজার একটা পিন আছে যেটায় টান লেগে জামার অনেকাংশ ছিঁড়ে যায় তার। ভয়ে হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে যায় তার। এবার কি হবে?
খালাম্মাকে জানালে তো উনি রেগে যাবেন ।না বলেও কিভাবে থাকবে, ওর তো একটাই জামা।
ভয়ে ভয়ে পানিটা এগিয়ে দিল মহুয়ার দিকে নাসিমা। ঢকঢক করে সবগুলা পানি খেয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিল মহুয়া। "খালাম্মা ,একটা কথা কইতাম ।"
"তাড়াতাড়ি বোলে বিদায় হ"
"খালাম্মা ,দরজায় ওই পিনে টান লেগে জামাটা ছিঁড়রা গেসে। "
"ওরে দামড়ি, নতুন জামাটা ছিঁড়া ফালাইসস। এত বড় সাহস তোর? গত ঈদেই মাত্র কিনা দিসিলাম।এখন থাক পুরান জামা পইরা। আগামি মাসে ঈদে নতুন জামা দিমু। এর আগে নতুন জামা পাবি না। "
"খালাম্মা,আমি কি এতদিন এই ছিঁড়রা জামা পইরা থাক্মু?"
"আমি জানি না, তুই যাইয়া মরতে পারস না!"
এরপর নিজের ডয়ার খুলে জুঁইয়ের একটা পুরান জামা মুখে ছুরে মারলেন তিনি । মাটি থেকে জামা তুলতে গিয়ে টপটপ করে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নাসিমার । আল্লাহ মানুষকে কি দেখে ভাগ্য ঠিক করে দেন জানতে পারলে কক্ষনো এই ভাগ্য নিয়ে
সে জন্মাত না!

ঘটনা ২ঃ
খবরের কাগজ পড়ছিলেন রহমান সাহেব। ছেলের ডাকে হঠাৎ খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। 'কি ব্যাপার সিজান?কি হয়েছে?'
'বাবা,আজ আমি আমার বন্ধুদের আমাদের বাসায় 31st উপলক্ষে দাওয়াত করেছি।তাই ওদের খাবার ও গানবাজনার জন্য কিছু টাকা দরকার।"
"ওহ , এই ঘটনা ! আমি ভাবলাম কিনা কি! কত টাকা দরকার? '
"বেশি না। দুই হাজার টাকা দিলেই হবে।"
"কি? মাত্র দুই হাজার? রাস্তার পাশের দোকানের খাবার কিনবি নাকি? এই নে ৩৫০০ টাকা । ভাল খাবার আনিস ।"
"আচ্ছা বাবা...আচ্ছা। ধন্যবাদ। তুমি দুনিয়ার সেরা বাবা ।"
ছেলের কথা শুনে মুচকি হাসেন রহমান সাহেব। সিজান যুদ্ধজয়ের হাসি দিয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়ানো বন্ধু শাওনকে বলল "দেখলি,আমি বলেছিলাম না? আমার বাবা অনেক বোকা । এবার বিশ্বাস হল তো? "
"হা রে, তোর বাবা আসলেই খুব সহজ সরল মানুষ । এখন বলত টাকাগুলা দিয়ে কি করবি?"
"কি আর করব! সবাই মিলে কা প্ল্যান করেছিলাম তাই করব। দামি দামি হুইস্কি ,ওয়াইন খাব আর আজ সারারাত আমাদের ছাদে নাচগান পার্টি করব ।"
"ওহ ইয়েস...... "

এই সময় ঘরে ঢুকল সিজানদের বাসার নতুন ড্রাইভার এবং মুখ কালো করে দাড়িয়ে রইল রহমান সাহেবের সামনে। রহমান সাহেব ব্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালেন যেন সে ঘরে আসায় রহমান সাহেব যারপরনাই বিরক্ত । "কি ব্যাপার? তুমি এখানে কেন?"
"স্যার, আপনার বাসা থেকে যেই খাবার দেন তা মুখেই দেওয়া যায় না। এই এত মোটা চালের ভাত, পানির মত পাতলা ডাল ও তরকারি তো এত ঝাল যে একটু খাইলেই খাওয়ার শখ মিটা যায়। তখন মনে হয়,না খায়া থাকা এর থেকে ঢের ভাল । "
"আরে বাবা! তোমাকে চাকুরীতে রাখার সময়ই তো বলা হয়েছে , তোমার খাবার খরচ বাবদ মাসে ২হাজার টাকা এর বেশি এক পয়সাও দিতে পারব না! থাকলে থাকবা নাইলে চলে যাবা। "
রহমান সাহেবের কথা শুনে ড্রাইভার মাটিতে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনি ঘরে সিজান ঢুকে । "বাবা, শরীরটা খারাপ লাগছে।"
"কি হয়েছে বাবা? বেশি খারাপ লাগছে?? ডাক্তার ডাকবো?"
" আরেহ না, তেমন কিছু না। কেনাকাটা করতে যাবো। কিন্তু গাড়ি নিব না ,গাড়িতে কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে। "
" আচ্ছা, এই নাও ৫০০ টাকা। এটা দিয়ে রিক্সায় করে যাবে আর আসবে। খুশী?"
ড্রাইভার বিস্মিত চোখে রহমান সাহেবকে টাকাটা দিতে দেখে । তার বিশ্বাস হতে চায় না শুধুমাত্র এই টাকার জন্য সে এমন অপমান অপদস্ত সহ্য করেও এই বাসায় থাকেন। এই টাকাই এই দুনিয়াকে ২ভাগে ভাগ করেছে! এই টাকার ক্ষমতা অসীম!!

ঘটনা ৩ঃ
'এই ছেলে , এই। এখানে আয় ।" বাড়ির মেইন গেটের রাস্তার সামনে দাড়িয়ে আছেন আবির । বিরাট বড় অভিনেতা তিনি। দেশের সবার ভালবাসার পাত্র তিনি। সবাই তাকে খুব আপন মনে করেন ।টিভিতে ভালোমানুষের চরিত্র করায় সবাই তাকে ভাল মানুষ হিসেবেই জানে।
টোকাই ছেলেটা বস্তাটা নিচে রেখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রস্ন করল " জি স্যার ,আমারে কইলেন?'
"হা, এইযে । তুমি কই থাক?নাম কি তোমার? "
" আজ্ঞে জি...... আমার নাম মনসুর। আমি ঐযে পাশে যে বস্তিটা আসে ...ওইখানে আমার মায়ের সাথে থাকি ।"
"তো, তোমার মা কি করে?"
"জি , আমার মায় আগে মাইনসের বাইতে কাম করত। কিন্তু এহন তো অসুখ ...তাই কামে যাইবার পারে না ।"
"ওহ, আচ্ছা ঠিক আছে। আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে??"
" আজ্ঞে কি কাম?"
" আমার বাসার ছাদে কালকে একটু নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠান ছিল । তাই সারা ছাদ নোংরা হয়ে আছে। তার মাঝে আজ আমাদের কাজের ছেলেটা আসেনি। ছাদটা পরিস্কার করে দিতে পারবে? এরবদলে অবশ্য ৫০০ টাকা দিব।"
"জি স্যার, পারমু। চলেন যাই। "
আবির সাহেবের বাড়ি বিশাল বড়। তাই ছাদটাও বিরাট। তাছাড়া কাল মনে হয় অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল। অনেক নোংরা হয়ে আছে ছাদটা। তাই দেরি না করে কাজে লেগে পড়ল মনসুর। প্রথমে সে ছাদের চারিদিকে একটা চক্কর দিল। মজার ব্যাপার হল, ছাদ থেকে ওর টিনের ঘরটা
দেখা যায়। মনসুর এসব দেখে কাজ করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সে দেখল তার ঘরের সামনে বেশ কিছু বস্তিবাসীর ভিড়।মার কিছু হল না তো? তার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়। শুধুমাত্র ময়লাগুলি নিচে নিয়ে ফেলে দেয়া বাকি। সে ভাবল ,ময়লাগুলি এক কিনারে রেখে একবার কি দেখে আসবে
বাসায় কি হল? পরে এসে আবার ময়লাগুলি নিচে ফেলে দিয়ে সাহেবের থেকে টাকা নিয়ে যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঘরে গিয়ে সে দেখে তার মার অবস্থার অবনতি হয়েছে ।তাই দেখে বস্তিবাসীরা ডাক্তার ডাকে ।ডাক্তার জানায় তেমন মারাত্মক কিছু না। এই ওষুধগুলা খেলেই ঠিক হয়ে
যাবেন, কিন্তু ওষুধ না খেলে বাড়তে পারে। মনসুর টাকা যা ছিল,রাস্তায় কাগজ কুড়িয়ে পাওয়া। তাই ডাক্তারকে তার ভিজিট দিয়ে বিদায় করল এবং আবির সাহেবের বাসায় গেলেন তার কাজ শেষ করতে এবং টাকা নিয়ে আসতে । আবির সাহেব মনসুরকে দেখে বিরক্ত হয়ে প্রস্ন "আজব ছেলেত
বাবা তুমি!কাজ ফেলে কই গিয়েছিলে? "
"স্যার ,আমার মায়ের অসুখ। তাই তাকে দেখতে গিয়েছিলাম যে সে ঠিক আছে কিনা!"
" বেশ করেছ গিয়েছ । এখন আবার ফিরে এসেছ কেন?"
"স্যার, আমিতো কাম মোটামুটি শেষ কইরাই গেসিলাম।"
"ছেলের সাহস কত দেখ! কাজ ফেলে গিয়েছে।আবার বলতেছ কাজ শেষ করে গেছ? বুয়াই তো দেখলাম সব ময়লা নিচে ফেলে দিয়ে আসলো। শুনো ছেলে,আমার সাথে মামদোবাজি করবা না। এইসব আধামাধা কাজের জন্য কোন টাকা পাবা না।"
"স্যার,আমার মায়ের ওষুধ কিনমু। টাকাটা দেন, খুব লাগত।"
"আমি এসব জানিনা। তুমি কোন টাকা পাবা না। এবার তুমি আসতে পার ।"
হতাশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মনসুর। কি করবে সে বুঝতে পারছেনা আজ!! চেনা এই পৃথিবীটা আজ তার কাছে বড্ড অচেনা লাগছে তার!!

নতুন বছর আসছে। সবার জীবনেই নতুন একটা বছর শুরু হবে। কিন্তু আদৌ কি সব পরিবর্তন হবে!! আশায় বুক বাধি যেন এই নতুন বছরে নতুন করে সবাই সব ভেদ বৈষম্য ভুলে নতুন এক পৃথিবী সাজাই। যেই পৃথিবী সুখ ও শান্তির পৃথিবী। শুভ নববর্ষ সবাইকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Rumana Sobhan Porag আমিও আপনার সাথে একই প্রার্থনা করি যেন আমাদের চারপাশের অসহায় মানুষ গুলোকে যেন একটু সহায়তা দিতে পারি. আপনি তো পাঠকের বিবেক কে ধাক্কা দিয়েছেন ভাই , খুব সুন্দর লিখেছেন.
ভালো লাগেনি ৯ জানুয়ারী, ২০১৪
ধন্যবাদ আপু! আল্লাহ এসব মানুষের সহায় হন! ভাল থাকবেন!
ভালো লাগেনি ১৭ জানুয়ারী, ২০১৪

১১ অক্টোবর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪