১)
এখন সকাল সাতটা; কিন্তু শীত তার উপর কুয়াশা। রাজেন সারারাত গাড়ি চালিয়ে ফিরছে আর মাত্র ১০০ কিমি তা হলেই পৌঁছে যাবে মাধবীর কাছে।
মাধবী কাল রাতে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। প্রথম বাচ্চা, সে একটু নার্ভাস। রাজেন কে সে বার বার বলেছিল যে এই সময় সে যেন বাইরে না যায়। কিন্তু সেটাই হল, গতকাল সকালেই এলো অফিস থেকে ফোন, সঙ্গে সঙ্গে ছুটল গাড়ি নিয়ে। আর সেই রাতেই ব্যথা শুরু। পাড়ার লোক আর রাজেনের বন্ধুরাই তাকে রাতে হাসপাতালে ভর্তি করে।
একটু আগেই রাজেন ফোন করেছিল, বলল কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আসছে।
২)
তিতান এর বয়স এখন ৬ বছর। সে চোখে দেখতে পায় না, মানে অন্ধ। আজ সে প্রথম স্কুলে যাবে। এই অঞ্চলে অন্ধদের কোন স্কুল নেই তাই সে বাড়ি দূরে শহরে যাবে, শহরের স্কুলে ভরিত হতে। মা তাকে রেডি করে দিয়েছে, বাবা ও রেডি।
এতো দিন তাকে তার মা ই তাকে পড়াত। তার মা সুন্দর গান করে, সে শুনতে শুনতে মা কে অনুভব করে। এর পর খুব দুঃখ হয়, সে কোন দিনই তার মাকে দেখতে পাবে না। সুধু মা না বাবাকে দেখার জন্যও তার মন কেমন কেমন করে। কিন্তু সে এ সব কথা আর মা বাবা কে বলে না। সে জানে মা বাবা এতে দুঃখ পায়। তবে আগ বলত, তখন মা বাবা সুধু কান্না করত আর ভগবানের নাম করত।
৩)
দীপ্তি আর প্রত্যুষ; ১০ বছর হল বিয়ে হয়েছে। খুব সুখী সংসার। ৪ বছর বাদে যখন তিতান এলো তাদের জীবনে, আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। কিন্তু তার পর যখন জানতে পারল তিতান দেখতে পায় না তখন ... তারা দুজনাই ভেঙে পরেছিল। কিন্তু তিতানের সেই ভুবন ভোলান হাসি তাদের সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল। ডাঃ বলেছেন যদি কেউ সহৃদয় ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে তার চোখে দান করে যায় তা হলে তাদের তিতান আবার দেখতে পাবে। তারা দুজনাই তাদের চক্ষু দান এর অঙ্গীকার করেছে কিন্তু তাদের মৃত্যু না হলে তাদের চোখ ও তাদের ছেলে কে দেওয়া যাবে না। তারা ডাক্তার ও হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।
৪)
রাজেন একটা বেসরকারি কোম্পানিতে গাড়ি চালায়, মাত্র দু'বছর হয়েছে বিয়ে করছে। তার পরিবারে আর কেউ নেই, বাবা মা অনেক ছোট বেলায় মারা গেছে। তবে মাধবীর বাবা মা ভাই আছে তারা গ্রামে থাকে। আজ সকালে তারাও মাধবীর কাছে পৌঁছে গেছে।
সে ও কোম্পানিকে বলে রেখেছিল ছুটি নেবে এই সময়। কিন্তু, হটাত তলব, সে সারাদিন গাড়ি চালিয়ে কাজ মিটিয়ে আবার সারারাত গাড়ি চালিয়ে ফিরছে।
হটাত তার একটু ঝিমানি এলো ...
৫)
তিতান তার বাবার হাত ধরে রাস্তায় চলছে; তার বাবা তার স্কুলের কথা বলছে। বলছে সেখানে গেলে কত আনন্দ হবে, কত বন্ধু হবে তার কথা। তার একটু একটু ঠাণ্ডা লাগছে, চোখ মুখ ভিজে যাচ্ছে ... হটাত ... জোরে একটা শব্দ ... বাবার চিৎকার ... সে ও ডেকে উঠল বাবা ...
৬)
জোরে চিৎকার এর শব্দ, জেগে উঠল রাজেন। আর সে ব্রেক চাপল। সে দৌড়ে নেমে গেল ...
দেখল একটি আহত লোক পরে ছটফট করছে, বেশ আহত কিন্তু এখন বেঁচে। তার মনে হলে এখনি হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে যাবে। সে লোকটিকে তুলতে গেল, দেখল সে, হাত বাড়িয়ে একটি বাচ্চা ছেলের দিক ধরার চেষ্টা করছে।
ছেলে কাঁদছে, বাবা বাবা বলে ... , আর হাত মাটিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে ... সে বুঝল বাচ্চাটি অন্ধ। এই মাঝ রাস্তায় এই ভাবে পরে থাকলে ... আরও কিছু ঘটে যেতে পারে।
সে এদিক ও দিক তাকেয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগল।
লোক টি কে সে দু হাতে তুলে নিয়ে ... গাড়িতে চাপাতে যাবে ... এমন সময় কিছু লোকের শব্দ শোনা গেল ...
লোক গুলো এদিকে আসছে ভেবে ... সে ... তাদের কে সাহায্য করার কথা বলতে থাকে ...
কিন্তু লোকগুলো তার কথা শুনছে না, তাকে খুনি, বলে গলা ধাক্কা দিচ্ছে। সে লোকটিকে নিচে নামিয়ে বলল, অন্তত আপনারা এম্বুলেন্স এ খবর দিন। লোকটি এখন বেঁচে, ... তার কথা কেউ শুনল বলে মনে হল না।
লোক বাড়ছে, সবাই তাকে ঘিরে ধরছে। সে ভিড় কে বোঝাতে পারছে না। সে এবার ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল, আহত লোকটির দিকে।
হটাত, চড় ঘুসি কিল ... ছুটে এলো ... তার মাথা ঘুরছে ... প্রথমে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার পর ... যন্ত্রণা, অবসন্ন হয়ে আসছে তার দেহ... মাধবীর কথা মনে এলো, দেখল তার গাড়িটি আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে।
৭)
সকাল ১১ টাতে মাধবী ও রাজেনের সন্তান জন্মগ্রহন করে। টিভিতে তখন পুলিশ জনতার সংঘর্ষের ছবি ছড়িয়ে পরেছে।
দীপ্তি, কাঁদছে, সে প্রত্যষু আর তিতান কে খুঁজছে বার বার ফোন করে সে তাদের কোন খবর পাচ্ছে না। প্রতিটি পুলিশ আর আসে পাশে সবাই কে জিজ্ঞাস করছে। সে শুনেছে সকালেই এখানে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।
৮)
দুপুর দুটোর নাগাদ, পুলিশ দু জন গভীর আহত ব্যক্তি কে হসপিটালে ভর্তি করে। একটি অন্ধ বাচ্চা কে প্রাথমিক চিকিৎসার পর পুলিশ হেপাজতে রাখা হয়েছে।
ডাক্তার পরীক্ষার পর জানায় এক জন ব্যক্তি মৃত আর এক জনের আঘাত খুব গভীর, বাঁচবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
বিকেল পাঁচটা তে দীপ্তির কাছে ফোন এলো, পুলিশ।
রাত আটটা, দীপ্তি কাঁদছে। পাশে তিতান ও কাঁদছে। ডাঃ বলে যাচ্ছেন, আঘাত খুব বেশী না হলেও অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে এই মৃত্যু। এখন থেকে প্রায় ১০-১১ ঘণ্টা আগে তার মৃত্যু হয়। এখন যে হেতু এক্সিডেন্ট তাই দেহ প্রয়োজনীয় অনুসন্ধানের জন্য নিয়ে যাবে। তাকে কাগজে সই করে দিতে বলছে, সে হটাত বলে আমার স্বামীর চক্ষু দানের অঙ্গীকার করা আছে তাই তার স্বামীর চোখ যাতে তাদের সন্তান কে দেওয়া হয়। ডাঃ বললেন তিনি এখনি তাদের চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলছেন।
রাত ৯-৩০। ডাঃ, দুঃখিত, আপনার স্বামীর চোখ আমারা আর ব্যবহার করতে পারব না। এখন মৃত্যুর পর ১২ পার হয়ে গেছে, চোখে সাধারণত ৬ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হয়।
৯)
দুই দিন পর, প্রত্যষু এর দেহ, দাহ করে ফিরেছে সবে। বাড়ি জুড়ে হাহাকার, তার কান্না থম মেরে গেছে। তিতান যেন আরও ভয়ে কুঁকড়ে গেছে, সে আর কথা বলছে না।
খবরের কাগজে সুধু এই খবরটা, তার আর তিতানের ছবি ছাপা। কাল মর্গের সামনে কেউ তুলেছে। আর তার স্বামীর আততায়ীর খবর ...
লোকটা এখনো বেঁচে আছে ... এই বলেই দাঁতে দাঁত চাপল দীপ্তি।
রাজেনের জ্ঞান ফিরেছে। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, দেহে ছুঁচ ফোটা আর মাথাটা ভারী। তার মাধবীর কথা মনে হল, সে বিড়বিড় করে বলার চেষ্টা ...
একটু পরে সে সামনে মাধবী কে দেখতে পেল, হাতে একটু পুটলি, তাতে কিছু একটা নড়ছে। সে একটু হাসল বোধ হয়, আবার চোখ বুঝল।
১০)
চার দিন কেটে গেছে, সরকার তাদের পরিবার কে ৫ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ দেবে বলেছে। আরও বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে এসেছে তিতানের দায়িত্ব নিতে। কিন্তু কিছুই তার ভালো লাগছে না দীপ্তির।
রাজেন আজ তার সন্তানের কান্না শুনেছে। সে এখন একটু উঠে বসতে পারে; ডাঃ খুব খুশি তার দ্রুত সুস্থতায়। তবে এখনো অনেক দিন এখানেই থাকতে হবে। একটু একটু সে জেনেছে সে দিনের ঘটনা; তার মন খারাপ হয় লোকটিকে বাঁচাতে না পারার জন্য। তার অফিসের লোক এসেছিল বলল, তার চিকিৎসার খরচা তারাই দেবে।
১১)
পঞ্চম দিন রাজনের অবস্থা হটাত খারাপ হতে শুরু করল। তার মাথার যন্ত্রণা বেড়েছে, মাধবী খুব কষ্টের মধ্যে আছে। এ ক দিন তার উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে, সুধু, তার বাড়ির লোক, পাড়া প্রতিবেশী আর রাজেনের অফিসের লোকেরা পাশে থাকায় সে কোন মতে সব দিন সামলাচ্ছে।
এখন সুধু ভগবানের কাছে প্রার্থনা রাজেন যেন তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠে।
১২)
সপ্তম দিন, রাজেন কে এমারজেন্সি অপারেট করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। অপারেশন থিয়েটার এর সামনে মাধবী তার সন্তান কে নিয়ে দাড়িয়ে, সঙ্গে আরও অনেক লোক। সে নিজের সন্তান কে এক বার আদর করল ... তার পর মাধবীকে কিছু বলল। মাধবীর চোখ দিয়ে জল নেমে এলো
বিকেলের দিকেই, ফোন এলো দীপ্তির কাছে, তিতান এর জন্য একটা চোখে পাওয়া গেছে। এখনি তাকে হসপিটালে যেতে হবে। ওই ঘটনার পর এখন সে একটু একটু করে নিজেকে সামলে নিয়েছে। তিতানও একটু শান্ত হয়েছে। তবু এক খবরটা তার মুখেও এক কণা হাসি নিয়ে এলো। সে প্রত্যষু এর ছবির সামনে দাঁড়াল; তার চোখ বেয়ে নেমে এলো জল।
সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে; হাসপাতালে, ডাঃ চেম্বার এ দীপ্তি তিতান কে নিয়ে বসে। ডাঃ বলছেন, যদিও আমরা ডোনারের নাম বলি না তবুও, ডোনার যখন নিজে বলে গেছেন যদি তিনি মারা যান তখন তার চোখ দুটো যেন তিতান কে দেওয়া হয়। তাই ...
দীপ্তি তিতানের হাত ধরে হেটে চলেছে করিডোর ধরে। বুক ফাটানো কান্নার শব্দ ভেসে আসছে তার কানে; তার চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রত্যষু এর দেহ ও সে দিনের ছবি। তার চোখ ও ভিজে এলো ...
মাধবী কাঁদছে, হাহাকার সে চিৎকার নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে আশেপাশে থাকা সবাই কে। দূরে দীপ্তি দাড়িয়ে, সে তো তার স্বামীর খুনির মৃত্যুই চেয়ে ছিল ... কিন্তু এখানে দাড়িয়ে তার কেন মনে হচ্ছে এমন না হলেই ভালো হত ... দীপ্তি যেন মিশে যাচ্ছে মাধবীর মাঝে ...
একটি বাচ্চার কান্নার শব্দে মাধবী কান্না একটু থামল, বুকে জড়িয়ে ধরল নবজাতকে। দীপ্তি ও চমকে উঠল যখন সে দেখল তিতান তার হাতটা জোরে চেপে ধরেছে