ভূতপ্রেত বা অশরীরীর কিছু তে বিশ্বাস করি না কিন্তু প্রকৃতিকে করি। প্রকৃতি নিজেই এতটা অলৌকিক যে তার কাছে সমস্ত ম্যাজিক খুব সাধারণ মনে হয়। আজ এই জীবনের শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে এই বিশ্বাস আরও জোরালো হচ্ছে। তবে এই বিশ্বাসের জন্ম আজ থেকে নয়, সেই ১৫ বছর বয়স থেকে যখন সে বুঝে ছিল প্রকৃতি ও তার এই ক্ষমতা। তাই আজ সে জীবনের শেষ কটা দিন তাই সে এই প্রকৃতির মধ্যই কাটিয়ে দিতে চায়।
কালিকাগঞ্জ এখন একটা ছোট শহর তবে আজ থেকে ৬০ বছর আগে এটা একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম; চারপাশে নদী আর জঙ্গলে ঘেরা। হ্যাঁ ডাকাতের কিছু উপদ্রব ছিল বটে তা ছাড়া এই অঞ্চল ছিল খুব শান্তিপ্রিয়। সে প্রথম জীবনের ১৫/১৬ বছর সে এখানেই কাটিয়েছে তার পর বড় শহরে সেখান থেকে বিদেশ। সে তার বাবা, কাকা কাকিমা ও কাকাতো ভাই বোন দের নিয়ে তাদের বাড়ি। তার মা মারা গেছে সে যখন ছোট ছিল। সুধু মা এর একটা ছবিই তার সম্বল। আজ সে, সে এখন নাম করা চিত্রকর। আন্তর্জাতিক স্তরে তার নাম ও কাজ খুব জনপ্রিয়। জীবনের ৫০ বছর বিদেশে কাটিয়েছে। এবার সে ফিরবে
এখান থেকে চলে যাওয়ার পিছনে ছিল একটা ঘটনা, যেটা তার জীবনে একটা গভীর রেখাপাত করে গেছে ...
তার বাড়ির পিছন থেকে চলে গেছে এক খাল যেটা কাছেই মিশেছে সুবর্ণ নদীতে; মানুষজন, মালপত্র নিয়ে ছোট বড় নৌকা চলে নদীতে আর ছোট নৌকা গুলো ঢুকে পরত খাল গুলতে। এক দুপুরে একটা দুঃসাহসিক সাহসে ভর করে একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ভেসে পরেছিলাম। ছোটবেলা থেকে সাঁতার ও নৌকা চালানো এই অঞ্চলের সব ছেলেরাই শিখে থাকে কিন্তু বেশ বড় না হলে বাড়ি থেকে একা ছাড়ে না। কিন্তু সে বার আমি একাই এক দুপুরে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলাম, উদ্দেশ্য প্রচন্ডচণ্ডীর মাঠ। সুবর্ণ নদীতে উপরের দিকে ৫/৭ কিমি. উঠলে বা দিকে একটা ছোট নদী ভেঙ্গে যায় সেটা জঙ্গলের ভিতরে সেটা ধরে ২/৩ কিমি. গেলেই একটা পুরানো ভাঙ্গা মন্দির, প্রচণ্ডচণ্ডীর মন্দির। বছরে এক দিন পুজো ছাড়া সাধারণ মানুষ সেখানে যায় না, হ্যাঁ ডাকাতরা আমাবস্যার দিনে নাকি এখানে সারা রাত পুজো করে, আর নদীতে ডাকাতি করে।
সে বার কি হল, এক বন্ধুর সঙ্গে বাজী ধরে দুপুরেরই বেড়িয়ে পড়লাম। এবং খুব সহজেই বিকেল বিকেল পৌঁছে গেলাম মন্দিরে। আমি এখানে একা এসেছিলাম তার প্রমাণ হিসাবে নিজের গামছাটা মন্দিরের সামনের গাছের ডালে বেধে দিলাম, যেমন কথা ছিল। এর পর মন্দিরের ভিতরে ঢুকে প্রণাম সেরে নিয়ে বাইরে বার হয়ে তার মনে হল যেন সন্ধ্যে যেন একটু তাড়াতাড়ি নেমে গেলো, চারিদিকে অন্ধকার। কিছুক্ষণ বাদে বুঝল সন্ধ্যে নয় খুব মেঘ করেছে; তক্ষনি শুরু হল জোরে হাওয়া। ভয় পেলো, ছুটে গেলো নদীর পাড়ে। নৌকা হাওয়াতে খুব দুলছে ... বেশ ভয় পেল এবার। এই ঝড়ে নৌকা নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আবার এখুনি না গেলে আজ আর যাওয়া হবে না। তখন বাড়িতে সবাই বেশ দুশ্চিন্তায় পরে যাবে। চেষ্টা করল নৌকাটা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কিন্তু পারলো না; একে উত্তাল নদী সঙ্গে জোরে হাওয়া ও বৃষ্টি। প্রায় বাধ্য হয়েই ফিরে আসে ঘাটে। নৌকাটা একটা গাছের সাথে ভাল করে বেঁধে প্রায় দৌড় লাগাল মন্দিরের দিকে। বুঝতে পাড়লাম খুব বড় বিপদে মধ্যে পরেছি। অন্ধকার চারিদিকে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না, পথ পিছল, হাওয়াতে গাছ গুলো দুলছে, জোর বৃষ্টির তোড়ে সামনের মন্দিরটাও ভাল ভাবে দেখতে পাচ্ছে না। ভিজে একসা হয়ে ছুটে চলল মন্দিরের দিকে, কিন্তু মন্দিরে ওঠার মুখে পিছলে চাতালে পা পিছলে ... তার পর মাথায় জোরে আঘাত ... ব্যথায় ককিয়ে উঠল ... তার পর কিছু মনে নেই ...
কতক্ষণ এমন ভাবে পড়ে ছিলাম মনে নেই; এক সময় হুস ফিরল। হাত দিয়ে অনুভব করলাম মাথার পিছনটা ব্যথা করছে, ভিজে ভিজে লাগছে। শরীরটা ভারি হয়ে উঠছে, ভিজে শীত শীত করছে। কিন্তু এতো অন্ধকার কেন? চোখ টা বার কয়েক কচলে নিলো, না সব অন্ধকার। সে বুঝতে পারছে এই অন্ধকার রাতের অন্ধকার নয়, সে যেন চোখে কিছুই দেখতে পারছে না। সে জানে অন্ধকারে প্রথম প্রথম দেখতে অসুবিধা হয় কিন্তু তার পর আস্তে আস্তে সব দেখতে পায়। কিন্তু অনেকক্ষণ সে কিছুই দেখতে পারছে না, তার ভয় হল, সে বোধ হয় অন্ধ হয়ে গেছে। গা বেয়ে কিছু একটা চলে গেলো, তার ভয়টা আরও বেড়ে গেলো, সে চিৎকার করে উঠল প্রথম, তার পর জোরে জোরে কেঁদে উঠল ...
কান্না আস্তে আস্তে কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেলো, খিদেটা এবার টের পেলো ... কিন্তু ... সে কি করবে ... হাতরে হাতরে সে চারপাশটা বুঝে এগোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু বিফল হল। আরও এক বার বাবার নাম ধরে চিৎকার করে উঠল ... কিন্তু কিছুক্ষণ তার পর আবার গুটিসুটি মেরে পরে রইল। গায়ের জামা কাপড় গুলো প্রায় শুকিয়ে এসেছে, কিন্তু কতটা সময় সে এখানে তা বুঝতে পারল না। সে কি এখানেই মারা যাবে? তার বাড়িতে সবাই এখন কি করছে? সে আর ভাবতে পারল না ...
বুঝতে পারল তার ডান দিক থেকে সুন্দর হাওয়া এসেছে, আর ব্যাঙের কোলাহল; সে যে দিক থেকে হাওয়া আসছে সেই দিক হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো। এখানে বাতাস অনেক ঠাণ্ডা, সে আন্দাজে মাথা উপরের দিক তুলল, মনে হল তার চোখের সামনে যে অন্ধকার তার মধ্যে যেন কিছু আবছা মুখ; যেন অন্ধকারে কুয়াশায় কিছু মুখ কথা বলছে। সে একটা গন্ধ পাচ্ছে, সুন্দর গন্ধ; সে অনেক ফুলের গন্ধ চিনতে পারে কিন্তু এ গন্ধ তার চেনা গন্ধের মধ্যে পরে না। তার মনে হল তার সামনে অনেক আছে মানে অনেকে সামনে দাড়িয়ে থাকলে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমন। সে ঠিক বুঝতে না পেরে, আবার চিৎকার করে বলে উঠল- কেউ আছে এখানে?
নাহ, কোন উত্তর এলো না। তবে তার অনুভূতিটা নিমেষে উবে গেলো। আবার সেই অন্ধকার, সেই নিকষ কালো আঁধার। কিছুক্ষণ হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। তার পর অনুভব করল কেউ তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, পিছনে ঘুরল; একটা কিছু আছে মনে হল তার। ঠিক বোঝানো যাবে না, যেমন আগুনের সামনে চোখ বুঝে দাঁড়ালে কিছু দেখা যায় না কিন্তু সামনে উত্তাপ অনুভূত হয় ঠিক তেমন অন্ধকারে যেন এক উজ্জ্বল উষ্ণ স্পন্দন উপস্থিতি। কিন্তু তার কোন রূপ নেই, আকার নেই, রং নেই কিন্তু সে আছে। কিছু বুঝতে না পেরে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সেই উষ্ণ স্পন্দনের দিকে এগতে লাগলাম ... একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল সেই উষ্ণ স্পন্দনটা। বুঝল আর একা নেই ওই রকম অনেক গুলো উষ্ণ স্পন্দন তার চারপাশে তাকে ঘিরে আছে। সামনে হাত দিয়ে বুঝল সামনে একটা ছোট গর্তে কিছু জল জমে আছে, এবার তার তৃষ্ণা অনুভূত হল। দু হাত ভরে জল পান করল, কোথাকার সেই জল, কেমন জল তা আর বিচার্যে এলো না। এবার ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো চারপাশের এই উষ্ণ স্পন্দনগুলো তাকে সাহস দিচ্ছে। হটাত মনে হলে ফিসফিস করে কেউ যেন কথা বলছে, মানুষের ভাষায় কথা; কিন্তু খুব ধীরে; যেন দূরে কেউ কথা বলছে। মনে হল কোন মেয়ের গলা, বাচ্চা মেয়ে। তা হলে কেউ কি তাকে খুঁজতে এসেছে, খানিকটা উত্তেজিত হল, সে বলল, কে ... কে তুমি?
কিছুক্ষণ সব চুপ। তার পর একটা ধীর কণ্ঠে একটা শব্দ ভেসে এলো ... আমি
আবার একটু জোরেই জানতে চাইলাম, তুমি, তুমি কে? কি নাম, তোমার সাথে কি কেউ আছে? আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে?
সুধু খিল খিল হাসি আর ... ছোট্ট উত্তর ... হ্যাঁ।
তারপর সব চুপ। আমি কান পেতে রইলাম। না কোন কিছু ভেসে এলো না। খানিক ঠাণ্ডা হাওয়া আবার আমাকে ছুঁয়ে গেলো। তা হলে কি আমি ভুল শুনছি। বুঝতে পাড়লাম না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম আবার ...
চুপ করতেই, আবার একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো মন হয়। কোন গানের সুর গুনগুন করে গাওয়া হচ্ছে। সে সুরটা জানে ... যেন খুব চেনা; কিন্তু সে মনে করতে পারছে না এখন। কিন্তু সুরটা তাকে টানছে, তার যন্ত্রণা গুলো যেন ধীরে ধীরে কেমন কমে আসছে সে বুঝতে পারছে সে যেন একটা আলো আঁধারের মায়াজালে আটকে যেন একটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একা সে হেটে যাচ্ছে; একা কিন্তু গাছ গুলো সব জীবন্ত তাকে সামনে এগোনোর পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। সে এগিয়ে যাচ্ছে, সামনে একটা মেয়ে বিনুনি দুলিয়ে সেই গুনগুন করেতে করেতে চলেছে, মনে হচ্ছে যেন এই মেয়ে কে সে অনেক দিন চেনে, অনেক পথ তারা এমন ভাবেই পথ চলেছে, আরও চলবে ...
তিন দিন পর আমার হুস ফেরে শহরের বড় হসপিটালে; তার পর পুরো সুস্থ হতে প্রায় এক মাস। পরে শুনেছিল ওই ঘটনার পরের দিন তাকে প্রচণ্ডচণ্ডীর মাঠ থেকে উদ্ধার করে তার বাড়ি ও গ্রামের লোকজন।
তার মাথায় আঘাত লাগে ও অজ্ঞান হয়ে পরেছিল এক রাত। মাথাতে আঘাত লাগার ফলে সাময়িক দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে; পাঁচ বছর লেগে ছিলে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেতে। আর সেই পাঁচ বছর সে অন্ধকারে বাঁচতে শিখে গিয়েছিল। বুঝে ছিল সেই অনন্য সুন্দর অন্ধকার জগত।
সে শুনেছিল অন্ধদের অনন্য অনুভূতি খুব প্রবল হয় আর সেই অনুভূতি গুলো দিয়েই তারা সাধারণ মানুষের মতন বেঁচে থাকে।
কিন্তু সে হটাত দৃষ্টি হারিয়ে প্রথম প্রথম অসুবিধেতে পরেছিল; কিন্তু একা থাকলেই সেই সুর আর উষ্ণ স্পন্দন গুলো তাকে ঘিরে থাকত, আসে পাশের সব জিনিস গুলো সে অনুভব করেতে পারত।
পাঁচ বছর পর সে ফিরে পায় তার দৃষ্টি কিন্তু হারিয়ে ফেলে সেই জগতটা। তার পর অনেক বার সে চোখ বুঝে চেষ্টা করেছে সেই সব অনুভূতি গুলো ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু, পারেনি, গত ৫০ বছর সে চেষ্টা করে গেছে; ভুলেও সে ভুলতে পারেনি।
এখন বয়সের ভারে কমছে দৃষ্টিশক্তি, সে বুঝতে পারছে এবার সে পাবে ... ফিরে পাবে সেই অন্ধকারের জগত ... সেই উষ্ণ স্পন্দন সেই সুর সেই মেয়েটা ... এবং তাই পেলো ... মাঝে এক দিন সে দেখতে পেল সেই মেয়েটার মুখ। এবার আর ভুল করল না; সে একে ফেলল সেই মেয়েটার মুখ, অপূর্ব সেই মায়া মাখানো মুখ ... যেন তার খুব চেনা ... খুব পরিচিত ...
এটা যেন তার মায়ের ছোট বেলার ছবি তার কাছে মায়ের যে ছবিটা ছিল সেই সাদা-কালো পুরানো ছবিটা মিলিয়ে দেখতে দেখতে তাই মনে হল ...
সে ফিরছে, ফিরছে মায়ের কোলে