২১ শে মার্চ,২০১০, রবিবার, বেলা ১০.৩০
শনিবার বেলা ২টোয় হাসপাতালে আমার কাজ শেষ হবার কথা হলে ও আমাকে ডা. বোস বলেই রেখেছিলেন-- “ ডা. রায়, শনিবারে আমার বিকালের ডিউটি টা যদি আপনি করে দেন, একটু বিশেষ অসুবিধার কারনে আমাকে বাইরে যেতে হবে।” না বলা চলে না, বলতে গেলে এখন উনি ই এই হাসপাতালের সব চেয়ে প্রবীণ এবং আমাকে বিশেষ স্নেহ ও ভরসা করেন, বহু জটিল-তর ক্ষেত্রেই ওনার থেকে বহু কিছু শিখেছি, কাজেই ফিরতে রাত ১০টা হল। তারপর রাতের খাবার পর দোতলায়।
সকালে, কয়েকটা পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার কাজে, পুরাতন কয়েকটা চিকিৎসা বিষয়ের কাগজ খুঁজতে গিয়ে বাবার একটা ডাইরি হাতে এল, ব্যক্তিগত জীবন এ অর্থাভাব, বাবার পড়া ফার্মাসি তেই ইতি টেনেছে, তবু বরাবর দারুণ পর্যবেক্ষণ ও মেধা র দরুন কলেজে, হাসপাতালে,সম্মান পেয়েছেন বিস্তর। কাজেই তাঁর ডাইরি! লেখা বেশ পরিষ্কার পড়া চলে, বাবার কলেজ জীবনের ব্যক্তিগত, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের কথা। বলাই বাহুল্য আমার এই ডাইরি লেখার অভ্যাস বাবার থেকে ই। এটা তখন বাবার বয়স ২৫-২৬। সামান্য কয়টা ব্যক্তিগত কথার পাশে গবেষণার কথা ই বেশী। আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগের একটা তারিখে লিখেছেন-
“ বাঁকুড়া, ফার্মাসি কলেজের আমরা চার বন্ধু বিবেক, বিতান, তন্ময়, আমি সুরজিৎ হস্টেলে একই ঘরে থাকি, চারজন বাংলার চার প্রান্ত থেকে এলেও এত সাবলীল ভাবে আমাদের বন্ধু হয়ে ওঠার কারণ বলা চলে রবীন্দ্রনাথ ও রসায়ন, যদিও অন্য ব্যাপারের সঙ্গে বিতানের গলা খুব ভালো, বিবেক দারুন আবৃত্তি করে, তন্ময়ের সুর ও শ্রুতির এবং আমার পদার্থবিদ্যা, যন্ত্র ও যন্ত্র সংগীত ভালো লাগে, অবসরে গীটার আমার সঙ্গী, গতবার উৎসবে আমাদের গান, কবিতা, ও গীটার রেকর্ড হয়েছে।
আজ এসব কথা লিখছি কারন কয় দিন পর আমাদের পড়ার জীবন ইতি, তবে একটা কাজ রয়ে গেল, প্রফেসর বাগচি ও আমি একটা নতুন ধরনের ওষুধ নিয়ে কাজ করছিলাম, মানুষের জীবনের মহা মূল্যবান সম্পদ মেধা নিয়ে। মস্তিষ্কের কোষের মধ্যে কতগুলি বিশেষ শ্রেণীর কোষ এক এক ধরনের বিন্যাস সৃষ্টি ক’রে বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ বিশেষ সংঘবদ্ধ বিভাগ করে রেখেছে। এই ঔষধ ‘স্মৃতি ও তার ধারাবাহিক এর বিন্যাসের জন্য’ এবং ‘নির্দিষ্ট ধাক্কায় সেই ধারার মিল খুঁজে বের করা ও যথাযথ প্রয়োগ’ এর জন্য যে যে বিভাগ গুলি দায়ী তাদের স্থিতি কাল, গ্রহন ও কাজ করার ক্ষমতা বাড়াবে, ফলেই মেধার অর্জনের এক সরল ও নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। তবে এই গবেষণার কাজে রসায়ন এর সাথে নির্দিষ্ট মাত্রার কম্পন এর আবশ্যকতা হচ্ছে, কারন কেবল কিছু জৈব পদার্থই জীবন নয়, জীবন এক বিশেষ স্পন্দনের ঢেউ, আর তাই ওষধটি তরল, কোনো কঠিন পদার্থ নয়। ”
এর পর বাবা ওই পদার্থটির রাসায়নিক সংকেত টি লিখেছেন, যা আমি আমার গবেষণার কাগজে লিখেছি, কারন বাবার ডাইরির এর পরের পাতায় লিখছেন--
“ ঔষধ টা কে নিয়ে আবার গবেষণা করতে হবে। কারন, উপাদানের বিশেষ একটা তে কিছু এ্যামাইন ও কম্পনের তারতম্য এর সম্বন্ধ আছে,(কাজ শেষ না করে বলা আমার অপছন্দ তাই বলছি না।) ”
এর দীর্ঘ দিন পর পর্যন্ত ডাইরি তে কোনো লেখা নেই।
প্রায় আড়াই বছর পর থেকে সময় সময়ে বাবা লিখেছেন তার হাসপাতালে চাকরিতে যোগ দেবার, বিয়ের ও আমার জন্মের তারিখটুকুই । এর প্রায় বছর পাঁচেক পরের তারিখে লিখেছেন--
“হাসপাতাল থেকে ফেরার গাড়িতেই ডাইরিটা লিখছি, আজ এত দিন পর আমাদের (যদিও প্রফেসর বাগচি এবার আমার সাথে নেই) গবেষণা সার্থক ও সফল, আজ হাসপাতালের গবেষণাগারে ঔষধটা তৈরি করা গেছে কিন্তু আমার বিশ্বাস ডা.ঘোষ আমার কোনো ক্ষতি করতে পিছপা হবেন না। এখানে গোড়া থেকেই যেভাবে তিনি আমার কাজের উপর... ”
এরপর আর লেখা নেই, মাস ৬ পর মার হাতের লেখায় পাওয়া যাচ্ছে---
“ হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় উনি মাথায় আঘাত পান, ৬ মাস পর বাড়ি তে ফিরেও কিছুই মনে পড়ছিলনা, একদিন রাতে ওঁর রেকর্ড করা গীটারটা যখন বাজিয়েছিলাম, হঠাৎ আমার নাম ধরে ডেকে ওঠেন, সেই প্রথম ওই দূর্ঘটনার পর, তার পর বলে ওঠেন ডাইরিটা। এর পর তার স্মৃতি ক্রমে সামান্যই ফিরে আসে, যদিও কাজ বিশেষ কিছুই করতে পারতেন না, তবে আমাকে ওনার ঐই ডাইরি টা খুঁজতে বলেন, দূর্ঘটনার স্থল থেকে পুলিশ ওটা উদ্ধার করেছিল। আমাকে মাঝে মাঝে লিখতে বলতেন, কিন্তু ওই ‘আ্যমিনো না আ্যামাইনো-থ্রিও...’ বলেই মাথায় দুহাত চেপে বসে থাকতেন, মুখে ফুটে উঠত ভীষণ বেদনা, তাই পরের দিকে আমি আর লিখতে চাইতাম না। তবে শেষের দিকে উনার কাছে ওনার গীটারে বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘দুরে কোথাও দুরে দুরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে’ বাজালে স্থির হয়ে যেতেন। ”
বাংলার বাইরে থেকে ডাক্তারি পাশ করে আসার পর বাবা চলে যান, জানিনা বাবার কতটা আমি হতে পারব, করতে পারব তার কাজটা! তাঁর সুর আমায় সুরলোকে নিয়ে চলুক।