অসময়ের ইতিবৃত্ত

কষ্ট (জুলাই ২০২১)

ঐশিকা বসু
মোট ভোট ২১ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.০৯
  • 0
  • ৮১
আমাদের সামনে পড়ে আছে কতকগুলো হলুদ হয়ে যাওয়া ঘাস। সভ্যতার রোলার তাদের পিষে দিয়ে গেছে, ফেলে রেখে গেছে কেবল ধূসরতা।
জীবনও তেমনি বিবর্ণ হয়ে আসে। শতাব্দী পেরিয়ে এসে সভ্যতা বড়ো একটা ঝাঁকুনি খেল এবার, আর আমাদের স্বপ্নগুলো গেল ম’রে।

তুলকালাম বেঁধে যেত আরেকটু হলেই। সুচেতনার এমনিতেই দেরী হয়ে গেছিল বাড়ি থেকে বেরোতে। তার ওপর আবার তালপুকুরের মোড়ে ট্রাফিক জ্যাম। সব মিলিয়ে আধঘন্টার ওপর দেরী হয়েই গেল। রাজীব এতক্ষণে নিশ্চয়ই খুব রেগে গেছে। আজ একটা ঝামেলা না বেঁধে যাবে না।
যাই হোক, সুচেতনা যখন লাইব্রেরীতে পৌঁছোল, রাজীব ভারতীয় সংবিধানের বই পড়ছিল। সুচেতনা মুখ থেকে মাস্ক খুলে রাজীবের পাশে বসে বলল, ‘সরি, দেরী হয়ে গেল। তার ওপর রাস্তায় যা জ্যাম না, টোটো এগোতেই পারছিল না।’ রাজীব ওর কথার সরাসরি কোন উত্তর দিল না। সে বলল, ‘এবার কিন্তু ইকনমিক্সটা পড়তে হবে।’ এই বলে সে হঠাৎ থমকে গেল। সুচেতনাকে মাস্কটা ব্যাগের ভেতর ঢোকাতে দেখে রাজীব বলে ওঠে, ‘এখন আবার এসব নতুন ফ্যাশান শুরু হয়েছে।’
ফস করে জ্বলে ওঠে সুচেতনা, ‘ফ্যাশানের কি আছে? যেটা প্রয়োজন সেটাই ব্যবহার করছি। করোনা ভাইরাস তো ভারতেও ছড়াতে শুরু করেছে। কলকাতার একটা ছেলে তো আবার বিদেশ থেকে এসে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াল। এখন এর জন্য ভুগবো তো আমরা। এখন নিজে সচেতন হতে না পারলে ভুগতে হবে।’
রাজীব ফের তর্ক করে, ‘আচ্ছা সুচি, তুই এই মাস্কটা কত টাকা দিয়ে কিনেছিস?’
- তিরিশ টাকা। সুচেতনা জবাব দেয়।
- এবার বল তো, এই ভারতের কতগুলো লোক এই তিরিশ টাকা খরচ করে মাস্ক কিনবে? আমার তো মনে হয় না, সবাই এই করোনার জুজুতে ভয় পেয়ে মাস্ক পরে থাকবে।
সুচেতনা বলে, ‘যদি না থাকে, তবে রোগ আরো ছড়াবে। ইটালি, ব্রিটেনের যা অবস্থা। এইসব আম পাবলিকের অসচেতনতার জন্যই তো রোগ ছড়ায়, তাই না?
রাজীব বলে, ‘আচ্ছা? আম পাবলিকের জন্য রোগ ছড়ায়? আর সরকারের কোন দায় থাকে না?’
সুচেতনা বলে, ‘শোন, নিজের ভালোটা নিজেরা না বুঝলে, সরকারের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বুঝলি? এখন পড়।’
তর্ক বেশিদূর এগোল না। ওদের মধ্যে এমনটাই হয়। মাঝে মাঝে তুমুল তর্ক লাগে, যেন হাতাহাতি লাগবার জোগাড়, অথচ পরক্ষণেই ওরা এমন আচরণ করে যেন কিছুই হয় নি। এই যেমন এখন। দুজনে নিবিষ্ট মনে বসে পড়াশুনা করছে। দুজনেই সিভিল সার্ভিসে যেতে চায়। তার জন্য গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেই গ্রুপ স্টাডি করছে। এখন ডব্লুবিসিএসটাই ওদের মূল টার্গেট। কোচিং নেবার মত সামর্থ্য ওদের নেই। তাই কিছু বই কিনে আর এই লাইব্রেরীর বই নিয়ে পড়াশুনা চালাচ্ছে।
লাইব্রেরী সাড়ে সাতটার সময় বন্ধ হবে। ততক্ষণ চলবে ওদের এই চর্চা। তারপর ঘণ্টাখানেকের জন্য গঙ্গার ঘাটে হাল্কা অবসর। লিচুবাগান ঘাটটা বেশ একটু নির্জন। নদীর পাড়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা স্পষ্টতর হয়ে তাই কানে আসে। সেটা একটা ছন্দ হয়ে বাজে, যেন কোন এক দুর্বোধ্য কবিতার দুরূহ অনুরণন। শুনতে বেশ লাগে। টুকরো কথা, বিচ্ছিন্ন সংলাপ, নির্জনতা আর ছলাৎ ছলাৎ।


রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ রাজীব যখন বাড়ি ফিরল, বাড়িতে তার জন্য একটা একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল। বাবার বুকে হাল্কা একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। তার সাথে রয়েছে অত্যন্ত ক্লান্তিভাব। এমনিতে প্রিয়তোষের হার্টের একটা সমস্যা ছিলই। তার ওপরে ক’দিন ধরে খাওয়া-দাওয়ারও খুব অনিয়ম হচ্ছে। দোকানের মিহিরকাকু বেশ কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়েছে। তাই বাবাকেই এখন একা হাতে দোকানটা সামলাতে হচ্ছে। এর ফলে ঠিক সময়মতো খাওয়া হচ্ছে না। বাবা বলে, ‘চিন্তা করিস না, ও ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। তাহলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। গ্যাসের সমস্যায় মাঝে মাঝে এরকম হয়।’
তবে বাবার এই বুকের সমস্যাটা ইদানীং বেশ বেড়েছে। এই তো সেদিন হঠাৎ করে বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছিল। তবে সেদিন বাবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা জোর করেই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল রাজীব। পাড়ার ডাক্তার, অনির্বাণবাবু সব দেখেশুনে গম্ভীরমুখে একটা ইসিজি করতে দিলেন। কিন্তু ইসিজি রিপোর্ট ভালো এল না। ডাক্তার বললেন, ‘কোরোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করাতে হবে, যত দ্রুত সম্ভব।’
কিন্তু বাবা নিমরাজি। দোকান চালাবে কে? তাছাড়া সেটা নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর সময়। নতুন বছরের পাঠ্য বই কিনবে সকলে। লক্ষ্মীর ঝাঁপি খোলার এই তো সুবর্ণ সুযোগ। তাই তাকে হাতছাড়া করতে প্রিয়তোষ পারেনি। আর রাজীবও সেদিন তাকে বুঝিয়ে সফল হয়নি।
কিন্তু আজ এতো সহজে মুক্তি মিলল না প্রিয়তোষের। অনেক রাত্তিরে হঠাৎ মায়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় রাজীবের। ‘মনা, শিগগির ওঠ। দেখ তোর বাবা কেমন করছে।’ মায়ের ভয়ার্ত মুখটা দেখে বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো রাজীব। রাত পোশাকটা একটু সুস্থিত করে নিয়েই পাশের ঘরে দৌড়ল সে। বাবা বিছানায় শুয়েছিল। লোমশ খালি বুকটা তৈলাক্ত। একটা তেলের বাটি পাশে রাখা। মা বলল, ‘শুরু হয়েছে বুক ধড়ফড়ানি। কিছুতেই কমছে না। আমি তো বুকে গরম তেল মালিশ করলাম। কিন্তু…’ বাবা প্রায় গোঙাতে গোঙাতে বলে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে রে মনা। তুই একটু ডাক্তারবাবুকে ফোন কর।’
বাবার কথা বলা অব্দি আর অপেক্ষা করেনি রাজীব। সে ডাক্তারকে ফোন করতে থাকে। কিন্তু তার ফোন সুইচড অফ। ‘একটা আহাম্মক!’ ওষুধের ব্যাগটা থেকে দ্রুত সব ওষুধ বিছানায় ফেলে সে একটা ছোট্ট বড়ি বাবাকে দেয়। বলে, ‘এটা জিভের তলায় রাখো। গিলবে না।’ আধঘন্টা পর একটু সুস্থ লাগলো। রাজীব ভাবছিল, অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বেরোবে কিনা। কিন্তু বাবাই বারণ করলো।
সারাটা রাত কাটল একটা প্রবল দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে।
পরের দিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে প্রথমেই বেশ কিছুটা ধমক খেলো বাবা আর ছেলে । ডাক্তারবাবু বলেই দিলেন, ‘এরপর অ্যাঞ্জিও না করলে আমার আর কোন দায়িত্ব নেই।’ এই বলে তিনি একটা হাসপাতালের নাম করে প্রিয়তোষকে রেফার করে দিলেন অন্য এক ডাক্তারবাবুর কাছে। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার জন্য কার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করতে হবে তাও বলে দিলেন। ঠিক হল, একদিন পরেই হাসপাতালে যাওয়া হবে। এবার আর না করতে পারলো না প্রিয়তোষ নিজেও। কিছুটা হলেও তার মনে ভয় ধরেছে। বাবা রাজী হয়েছে দেখে রাজীবও খুশি। আর বাধা রইল না। সে ঠিক করে ফেললো, অ্যাম্বুলেন্সের সাথে আজ সন্ধেবেলাতেই কথা বলবে।
কিন্তু আর কিছুই করা হল না। দুম করে সরকার ঘোষণা করে বসলেন, কাল থেকে সারা দেশ লকডাউনে চলে যাচ্ছে।

জীবনের থেকে জীবনের দূরত্ব ছ’ফুট বজায় রাখলে, জীবনের থেকে জীবন মুখে মুখোশ পরে আলাদা হয়ে গেলে, জীবনকে আর আগের মতো করে চেনা যায় না। ঘরের মধ্যে থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাটাই যখন দস্তুর, তখন নিজেকেও বিচ্ছিন্ন মনে হয় নিজের থেকে। রাহুগ্রস্ত স্তব্ধ এক পৃথিবীকে বয়ে নিয়ে চলেছি।

রাজীবের ডায়রি থেকে -
৩১শে মার্চ, ২০২০
২৫ তারিখ থেকে দেশজুড়ে লকডাউন চলছে। ২১ দিন টানা চলবে। বাড়ি থেকে বেরোনো মানা। বাস-ট্রেন, অটো-টোটো কিছুই চলবে না। শুধুমাত্র জরুরী কাজকর্ম ছাড়া অন্য কোন কাজ করবার ছাড় নেই। রোগের প্রকোপ এদিকে বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে মহামারী না বলে অতিমারী অভিধা দিয়েছে।
এই লকডাউন ব্যাপারটাকে নিয়ে আমি দু-ধরনের মানুষ দেখলাম। একধরনের মানুষ করোনা ভাইরাসের এই হারে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তারা অনেক আগে থেকেই সাবধান হয়ে চলছে। সরকারীভাবে লকডাউন ঘোষণা করবার আগে থেকেই নিজেরাই নিজেদের ওপর লকডাউন জারি করে ফেলেছে। আমাদের পাশের বাড়ির অনুপকাকু। নিজে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না। কাজের লোক আর রান্নার লোককে সবেতন ছুটি দিয়ে দিয়েছে। বাজার-ঘাট করতেও বাজারে যায় না। ভ্যানে করে যারা বাজারের জিনিস ফেরি করে, তাদের থেকেই কেনে। মুখে মাস্ক পরে। মাথায় রুমাল বাঁধে। হাতে গ্লাভস্ আঁটে। বাড়ির চৌহদ্দি থেকে এক পাও না বাড়িয়ে কোনোরকমে বাজার সারে। আর একটা দোষও আছে অনুপকাকুর। শুনছি বাড়িতে নাকি সে চার বস্তা চাল, দু-বস্তা আলু, গোটা দশেক সাবান, হ্যান্ড ওয়াশ, স্যানিটাইজার জমিয়ে রেখেছে। সরকারী কলেজের প্রফেসর হওয়ার দরুণ মাইনে তো আর কমছে না, তাই দেদার কিনে জমিয়ে রাখছে। তবে শুধু অনুপকাকুকেই বা দোষ দিই কেন? ওর মতো লোক এ পাড়ায় তো আর কম নেই। আর আমাদের হয়েছে জ্বালা। মুদিখানার দোকানে গেলে কিছুই পাই না। সত্যিই বিচিত্র লোক এরা!
আর কিছু ধরনের লোক দেখলাম, যারা ভাইরাস নিয়ে মোটেই তত চিন্তিত নয়, যতটা তাদের রুটিরুজি নিয়ে। আমাদের পাড়ার নিতাইদা। নিতাইদা ছিল রেলের হকার। এখন ট্রেন বন্ধ হবার পর, বলতে গেলে, কিছুই করে না। বৌ আর এক মেয়ে আছে। মেয়ে সামনের বছর স্কুল ফাইনাল দেবে। নিতাইদা বলে, ‘এসব বড়োলোকেদের অসুখ। আমাদের এসব রোগে কিস্যু হবে না। কোথাকার কোন এক ভাইরাসের জন্য লকডাউন করে দিলো, এবার তো আমরা না খেয়ে মরবো।’
বাবা মিহিরকাকুকে বলে দিয়েছে, ‘এ মাসটা মাইনে দিতে পারবো। কিন্তু সামনের মাস থেকে আর পারবো না।’ মিহিরকাকু আমাদের দোকানে কাজ করে। ওর দুটো ছেলে আছে। একজন ক্লাস এইটে পড়ে। অন্যজন ক্লাস ফাইভ। সেদিন বাড়ির ব্যালকনি থেকে দেখলাম মিহিরকাকু রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকে ডাকলাম, কিন্তু সে কোনো উত্তর করলো না। শুধু একবার ম্লান হেসে চলে গেলো।
বাবা আমাকে বলেছে, ‘রাজু, আপাতত তুমি নিশ্চিন্ত মনে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাও। বাইরের পরিস্থিতি নিয়ে তোমাকে এখন ভাবতে হবে না।’ এই কথা বলে বাবা আবার যোগ করে, ‘আমার খুব ইচ্ছা, তুমি এই পরীক্ষাটায় ভালোভাবে এবার পাশ কর।’ বাবার এই কথাগুলো আমাকে খুব উৎসাহ দেয়। যদিও লক্ষ্য করেছি, কথাগুলো বলবার সময়ে বাবার গলার স্বরটা বেশ ভারী হয়ে আসে; কোথাও যেন একটা চাপা কষ্ট কাজ করে বাবার ক্ষয়ে চলা বুকটার ভেতরে। বুঝতে দেয় না।
এ বছর চাকরিটা পাবার একটা জোর আশা আছে আমার। এর প্রথম কারণটা হল, গত বছরের থেকেও এ বছর আমার আরো ভালো প্রিপারেশন আছে। বাড়িতে মক টেস্ট দিয়ে নিজের দুর্বল জায়গাগুলোকে বুঝতে পারছি। গত বছর এতো সিরিয়াসলি সিলেবাসটাকে বুঝতেই পারিনি। আর তাতেই ইন্টারভিউয়ের ডাক পেয়েছিলাম। যে ক’টা টিউশানি করতাম, দুজনকে বাদে বাকী সব ছেড়ে দিয়েছি – শুধু পড়াশুনা করবার জন্য। তাই এবার আমার আশাটা বেয়ারা রকমের বেড়ে উঠেছে।

গৃহবন্দী জীবন কেবলই আবর্তের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ফেরে। পৃথিবীর অসুখের বিরুদ্ধে এক হওয়া আজ দুরাশা। আমরা আরো দূরে থাকার মন্ত্র শিখছি। মানুষকে মানুষ বলে চেনা যায় না। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে সম্মিলিত জীবন। সভ্যতার সংজ্ঞাটা এই লকডাউনে বদলে গেছে অনেকখানিই। বদলে গেছি আমরাও। নির্বোধ স্থবির জীবন আমাদের থেকে কী চায়? আমরা তাদের কী দিতে পারি?

১৬ই এপ্রিল, ২০২০
বাবার শরীরটা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বুকের যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে থাকে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, দোকানটা বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকেই বাবা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। যখন দোকান খোলা থাকতো, তখন কাজের মানুষটাকে ঘরের মধ্যে পাওয়া যেত না। আর আজ বাড়ির মধ্যে এবং শুধুমাত্র বাড়ির মধ্যে থাকতে থাকতে তার জীবনটাই কেমন যেন শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। নিত্যনৈমিত্তিক কাজ যেমন স্নান করা, খাওয়াদাওয়া – সব কিছুতেই যেন তার একটা অনীহাবোধ কাজ করছে। কিছু জিগ্যেস করলেই বলে, ‘ভাল্লাগছে না। আর ক’টা দিনই বা বাঁচবো।’ কিন্তু তারও মধ্যে আমাকে মাঝে মাঝে ঠিক বলে দেয়, ‘পড়াশুনোটা ভালো করে চালিয়ে যাস রাজু। এবার তোকে ক্র্যাক করতেই হবে।’
অনেকদিন সুচির সাথে কথা হয়নি। আজ হল। তবে ওর সাথে কথা বলে মনে হলো, ও যেন আজ খুব ডিস্টার্বড অবস্থায় আছে। আমার সাথে কথা বলছিল। স্বাভাবিকভাবেই বলছিল। কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, এ ঠিক সেই সুচেতনা হয়, যাকে আমি বন্ধু হিসাবে এতদিন চিনে এসেছি। সেসময় সে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আজ মনে হচ্ছিল, ও যেন আমার সাথে কিছুটা দায়ে পড়ে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে পরস্পরের খবর নিলাম। ও বলল, ‘তোর পড়াশুনোর খবর কী?’ আমি বললাম, ‘চলছে। বাড়িতে বসেই করছি। যতটা পারছি সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছি। এদিকে বাবার শরীরটাও ভালো নয়।’ আমাকে কার্যত কথার মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘তুই চাকরির ব্যাপারে ভাবছিস না?’ আমি কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘তা আমি পড়াশুনোটা তো চাকরি পাওয়ার জন্যই করছি।’
ও কিছুটা থমকে গেল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘তা ঠিক। আমি ভাবছিলাম, এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এভাবে কতদিন চলবে? তুই তো অন্য চাকরির পরীক্ষাগুলোও দিতে পারতিস।’
হঠাৎ এই কথাগুলোর বলবার তাৎপর্য কী, সেটা আমি ঠিকমতো অনুধাবন করে উঠতে না পেরে বলে উঠলাম, ‘দেখ, বাবা আমাকে বলেছে পড়াশুনোটা মন দিয়ে চালিয়ে যেতে। এ বছরটা তাই আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জিং সময়। আর এটাকে আমি কাজে লাগাতে চাই।’ ফোনের ওপার থেকে কোন উত্তর এলো না। আমি বললাম, ‘তুইও তো প্রিপারেশন নিচ্ছিস। এক কাজ করলে হয় না? আমরা যে গ্রুপ স্টাডিটা লাইব্রেরীতে বসে করছিলাম, সেটা এবার থেকে তোদের বাড়িতে বা আমাদের বাড়িতে হোক। তাহলেই তো আবার সেই আগের মতো হতে পারে।’ কথাটা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা নিষ্ঠুর ‘না’ ভেসে এল আমার কানে। তারপরেই ও নিজেকে সংযত করে ফেললো, ‘আমি আর ঐ পরীক্ষা দেবো না রে রাজু।’ আমি বললাম, ‘কেন রে? অনেক দূর তো আমরা পড়াশুনো করেছিলাম।’ ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘যা করেছি, করেছি। আমার দ্বারা আর ওসব হবে না। অত ভালো মেয়ে আমি নই।’ ও কিছু না বললেও, আমি বুঝতে পারছিলাম, ওর এই কথাটার পেছনে খুব গভীর একটা বেদনা কাজ করছে।
এরপর কথা আর বিশেষ এগোয়নি। সাধারণ দু-চারটে কথাবার্তার পর আমি ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম।

২রা মে, ২০২০
গৃহবন্দী হয়ে আছি, একমাসের ওপর হয়ে গেল। আমাদের দোকানটা কিছুদিন হলো খুলেছে। কিন্তু কিনবে কে? বইপত্র আনবার জন্যে বাবা শ্যামলকাকুকে পাঠাতো কলকাতায়। এখন আনবে কে? ট্রেন বন্ধ, বাস বন্ধ। এভাবে বাঁচা যায়? বাবা বলছিল, বাচ্চুদা নাকি সাইকেল করে জিনিস আনতে কলকাতায় যায়। চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা সাইকেল চালিয়ে কলকাতা থেকে বই নিয়ে আসা, আর যাই হোক, বাবার পক্ষে সম্ভব নয়। আমিও পারবো না। তাই দোকানের বিক্রি কার্যত বন্ধ।
আমাদের এ অঞ্চলে বাজার বসছে একদিন অন্তর। বাজারে যেতে হলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। বাবা আমাকে মাথায় রুমাল জড়াতে বলে। সত্যি কথা বলতে কি, এসব আমার কাছে এখনও পর্যন্ত বাহুল্য বলেই মনে হচ্ছে। যদিও প্রতিদিনই কোভিড সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে, তবুও মানুষের রুটিরুজির তুলনায় এ যেন কিছুই নয়। তাছাড়া কোভিডে মৃত্যুর হার তো মোটেই বেশি নয়। তাহলে কেন এই বাড়াবাড়ি? কত মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। ভিন্রাজ্যে কত পরিযায়ী শ্রমিক আটকে পড়েছে, সেসব ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
আমি আজ রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। বিকেলবেলায় উদ্দেশ্যহীনভাবে মাঝেমাঝে ঘুরতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু এ দিন বড়ো রাস্তাটাকে ভর সন্ধেবেলায় যা দেখলাম তাতে ঠিক চিনতে পারলাম না। একটা ছুটে চলা শিশু যেন প্রাণহীন নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে জড় পদার্থের মতো। রাত বারোটার পরেও সে এতো জনশূন্য থাকে না। প্রতিদিন দেখে দেখে খুব বিরক্ত লাগতো। ভ্যান, টোটো থেকে শুরু করে বাস, লরি কিছুই বাদ ছিল না। রাস্তা দিয়ে নিশ্চিন্তমনে হাঁটা যেত না। সেই রাস্তাই আজ এমন মৃতবৎ!!! গোটা বিশ্বের সংকটের কাছে এই কলরবমুখর রাস্তাটা আজ বিস্ময়ে ত্রাসে বেবাক হয়ে গেছে। না দেখলে বিশ্বাস হয় না। পথের দুধারে বেশ কিছু ভিখারি আর পাগল – কেউ বসে রয়েছে, কেউ বা আনমনে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। এদের এ যাবৎ দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
হাঁটতে হাঁটতে আমি এগিয়ে চললাম। আঢাকা খাবারে বসা মাছির মতো চিন্তা উড়ে এসে বসলো মনে। এখন তো শুধু বাবার সঞ্চয়ের ওপরেই চলছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? গতকালই তো দেখলাম, আমাদের পাড়ায় একটা রাজনৈতিক সংগঠন থেকে খাবার বিতরণের আয়োজন করেছে। আর লাইন দিয়েছে মানুষ, যেন ভোগের খিচুড়ি নিতে এসেছে। চেনা অচেনা অনেক মুখ বেরিয়ে পড়লো ঐ লাইন থেকে। আমাদের বাড়িতে আগে ইলেকট্রিকের কাজ করতো বাবুদা। তাকেও দেখলাম সেই লাইনে। আমাকে দেখেই সে মুখ সরিয়ে নিল। বাবুদার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না, একেবারে অস্থিচর্মসার হয়ে গেছে। শিপ্রা বৌদিকেও দেখলাম। এই বৌদি তো একটা কারখানায় সেলাইয়ের কাজ করতো জানতাম। ওর একটা ন-দশ বছরের ছেলে রয়েছে; তাছাড়া বাড়ীতে শ্বশুর, শাশুড়ীও রয়েছে। সব মিলে একটা কম বড়ো সংসার নয়। ওর স্বামী গণেশদা। সে তো চেন্নাইয়ে মিস্ত্রীর কাজ করে। লকডাউনের পরে ফিরতেও পারেনি। আমাকে দেখে শিপ্রা বৌদি আঁচলটা মাথায় দিয়ে ঘোমটা টেনে নেয়।
এদের দেখে ভয় তো আমারও করে। আজ একটা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবার লক্ষ্যে আমি ছুটে চলেছি। তবু মনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারি না। বাবা আমার ওপরে এখনও কিছু চাপ সৃষ্টি করেনি। সে আমাকে আমার এই স্বপ্নপূরণের জন্য সবসময়ে সাহস দিয়ে যায়। কিন্তু আমার আশঙ্কা, আমি এখন থেকেই আয় না করতে পারলে আমাদের পরিবারটাও না একটা বিপদের সম্মুখীন হয়!
১৫ই মে, ২০২০
আজ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিলাম গঙ্গার ঘাটটায়। লকডাউনের পর থেকে এখানে আমি আসিনি। আগে যখনই আসতাম, সুচিকে না নিয়ে কখনো আসিনি। আর আজ, ওর সাথে আমার বিস্তর দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। অথচ এর যে কোনো প্রকৃষ্ট কারণ রয়েছে তাও নয়। নিজেকে খুব অযোগ্য বলে মনে হয় আমার। কী করতে পারলাম আমি? নিজেকে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারলাম না। নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াবার মতো আর্থিক জোর তৈরি করতে পারলাম না। কিভাবে বিশ্বাস করবে সুচি আমাকে?
গঙ্গার ঘাটে আসবার পথে খেয়াল করলাম রাজকেবিনের দরজাটা বন্ধ। সুচির সাথে এখানে এসে দুবার বিরিয়ানি খেয়েছি। সেটা অবশ্য নিজের রোজগার করা টাকায়। তখন টিউশানি করতাম। এখন তো সবই বন্ধ।
মনে পড়ে গেল, গতকাল রাতের কথা। বাবা আর আমি দুজনেই একসাথে খেতে বসেছি। খাবার বলতে ভাত, ডাল, শাক আর ডাটা চচ্চড়ি। রেশনের চাল থেকে ভাত আর সে ভাত ফুরিয়ে গেলে রেশনের গম থেকে আটার রুটি। বাবা আর আমার খাওয়া হয়ে গেলে মা খেতে বসে। মায়ের পাতে দেখলাম ডাটা চচ্চড়ি নেই। ‘তুমি চচ্চড়ি খাবে না?’ আমার প্রশ্নে মা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দেয়, ‘না। তুই রোজগার কর, তারপর খাবো।’ বাবা কথাটা শুনতে পেয়ে বলে, ‘রাজু, তোর স্বপ্নটা কিন্তু বাস্তবে করে দেখাতে হবে।’ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল বাবা। মা তাকে ধমকে থামিয়ে বলে, ‘তাহলে, ওর স্বপ্ন নিয়েই পড়ে থাকো, আর আমরা পেটে গামছা বেঁধে থাকি।’ মায়ের এই কথা শুনে বাবা বলে ওঠে, ‘না না, কাজের চেষ্টা করলেই ওর পড়ার ক্ষতি হবে। তুমি বুঝতে পারছো না।’ মা বাবার কথা শুনে মুখে কিছু প্রতিবাদ করে না। থালায় পড়ে থাকা সামান্য ক’টা ভাতের মধ্যে জল ঢেলে দেয়। তারপর উঠে যায়।
এই সমস্যা বাড়িতে রোজই লেগে আছে। আমি যে কাজের চেষ্টা করছি না, তা নয়। বাবা-মা জানে না। কিন্তু আমি টিউশানি খুঁজছি। অন্য যেকোনো কাজ হলেও আমার চলবে। কিন্তু মিলছে কোথায়? এই লকডাউনের সময় প্রত্যেকেরই একই খোঁজ – কাজ, কাজ আর কাজ। বাবা মায়ের ওপর দিয়ে কি ঝড়টা যাচ্ছে, তা বুঝছি। কিন্তু আমিও যে নিরুপায়।

চেতনার ঝড় বাইরের ঝড়ের সাথে মিলে গেলে জন্ম নেয় যে বিধ্বংসী সাইক্লোন, তাকে প্রতিহত করতে হবে আমাদের

২১শে মে, ২০২০
আজ আর গঙ্গার ধারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। গিয়েছিলাম আমাদের দোকানে। জায়গাটার নাম জোড়া বটতলা। ওখানে একটা বটগাছ ছিল। লোকে বলে, ওটা একশো বছরের পুরনো। বটতলায় গিয়ে দেখলাম, সেই প্রাচীন বট গাছটা শুয়ে পড়েছে। তার গুঁড়ি কিছুটা মাটি তুলে নিয়েছে। তার একটা মোটা ডাল গিয়ে পড়েছে আমাদের দোকানটার ওপর। দোকানের ছাদের একটা কোণ তাতে ভেঙে পড়েছে। পাশের একটা বাড়ির টালির চালেও পড়েছে একটা ডাল। টালি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। একটা লাইটপোস্টও ভেঙে পড়েছে এই সুপ্রাচীন মহীরুহের পতনের সাথে সাথে। সারাটা রাস্তায় হাঁটু জল। দোকানের ভেতরটা পর্যন্ত জলে থৈ থৈ করছে।
আজ এই দৃশ্য খুব একটা আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রায় গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়েই কমবেশি একই ছবি। গতকাল যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেখলাম, এমনটা সারাজীবনে দেখিনি। সে কি শব্দ আর তার কি উচ্ছৃঙ্খল রূপ! এর জন্য কত মানুষের যে মৃত্যু হল আর কত যে ক্ষয়ক্ষতি হল, তার ইয়ত্তা নেই। মনে হয়, প্রকৃতি আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে, আমরা বেঁচে থাকতে জানি কিনা?
বিদ্যাসাগর মাঠের ধারে ছিলো অন্তত দশ বারোখানা গাছ। আজ তার দু-একটা মাত্র অবশিষ্ট আছে। এ শহরের বিভিন্ন রাস্তা আজ অবরুদ্ধ। বিদ্যুৎ কর্মীরা এই দুদিন ধরে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। কাঠ চেরাইয়ের শব্দে আসছে মাঝেমাঝেই। বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। পানীয় জলও নেই। পৌরসভা থেকে পাড়ায় পাড়ায় জলের গাড়ি পাঠিয়েছে। আমাদের পাড়াতেও এসেছে একটা। সেখান থেকে আমি দুটো বালতি জল নিয়ে এসেছি। এগুলো গৃহস্থালির কাজে লাগবে। পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়ে জলের একটা বড়ো ড্রাম আনা হয়েছে। বিসলেরির কুড়ি লিটারের বোতল। আশা করি খাওয়ার জল এ দিয়েই মিটবে।
আজ সকাল থেকে দোকানে অনেক কাজ ছিল। দোকানঘরে জল ঢুকে থৈ থৈ করছিল। বেশ কিছু বই তাতে নষ্ট হয়েছে। সব জল ছেঁচে পরিষ্কার করেছি। যেক’টা বই ভালো আছে সেগুলোকে আলাদা করে রেখে বাকীগুলোকে বাড়িতে আনলাম। বাবা সকাল থেকেই শুয়ে রয়েছে। শরীরটা যে খারাপ তাও নয়। তবু খুব গম্ভীর। কারুর সাথে কোনো কথা বলছে না। আমি দু-একটা দরকারি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেও বাবা তাতে যতটা সম্ভব কম কথায় উত্তর দিয়েছে। তাই এসব কাজ আমাকে একাই করতে হল।
ঘটনাটা ঘটল সন্ধেবেলায়। আমি ঘরে পড়াশুনো করছিলাম, বাবা হঠাৎ কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে আমার ঘরে এলো। বুঝতেই পারছিলাম বাবা কিছু বলতেই এখানে এসেছে। তবে বাবাকে সেদিন দেখে কেমন যেন বিমর্ষ লাগছিল। খুব হতাশা আর ক্লান্তি তার সারাটা মুখে।
প্রথমে দোকানের কী কী বই নষ্ট হয়েছে ইত্যাদি দু-একটা ছোটখাটো প্রশ্ন করে বাবা আসল কথা পাড়ল। বলতে শুরু করলো, ‘দেখ, এতদিন তোকে কিছু বলিনি। কিন্তু এবার বলছি। আমার ইচ্ছা, এবার থেকে তুই একটা কাজের চেষ্টা কর। আসলে পরিস্থিতি তো ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দোকানের যেটুকু আয় ছিল, সেটাও গেল। পড়াশুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিস নে। কিন্তু তার পাশে একটা…’
কথাটা বলতে বলতে বাবা থেমে গেল। আমার মনে হল, বাবার গলাটা হঠাৎ বুজে এলো। তারপর বলল, ‘দেখ ভেবে।’ ছোট্ট কথাটা বলেই সে চলে গেল।
বাবা যখন আমাকে বলছে, কোনো কাজের খোঁজ করতে, তখন সেটা আমি করবোই। এটা আমার শুধু রুটিরুজির প্রশ্ন নয়, এর সাথে আমার সম্মানও জড়িয়ে রয়েছে। আজ বাবার মুখে ঐ কথা শোনার পর থেকে এটুকু বুঝতে পারছি, ডব্লুবিসিএস দেওয়ার যে স্বপ্ন আমি দেখছিলাম, সেটা আজকের এই ঝড়ের দিনটাতে এসেই শেষ হয়ে গেছে। সে যাক, আমার মত একটা সাধারণ ছেলের স্বপ্নের কি-ই বা মূল্য আছে? তা হারিয়ে গেলেও কারুর কিছুমাত্র যায় আসবে না।

৩রা জুন, ২০২০
তিনদিন আগে রাত্তিরবেলায় বাবার হার্টের কলকব্জা হঠাৎই আবার নড়ে গেলো। তবে এবার একটু বেশি রকমেরই নড়েছিল। আমরা তখন ঘুমোচ্ছি। কেউ কোনো সাড়াশব্দও পেলাম না। বাবাকে সকালে চা খাবার সময়ে ডাকলাম। বাবা সাড়া দিলো না। বিছানার ওপর উপুড় হয়ে, পাশবালিশটাকে কোলের কাছে টেনে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু এমন গভীর ঘুম তো বাবা ঘুমোয় না। তাহলে?
পালস ধরলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। অবশেষে ডাক্তারবাবুকে ডাকতে বাধ্য হলাম। উনি বাবাকে পরীক্ষা করলেন। ভিজিট নিলেন আর একটা ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে চলে গেলেন।

বাবাকে বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেছিল আমার। আরো আগে বুঝলে আজকের এই দিনটা হয়তো এড়ানো যেত। এখানেই আমার মনে সংশয় দানা বেঁধেছে। বাবার এই মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোথাও আমার ‘সফল হয়ে না উঠতে পারা’ও দায়ী নয় তো? এই প্রশ্নটার উত্তরই খুঁজে চলেছি নিরন্তর।
বাবার মারা যাওয়ার পর বাড়িতে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছে। সেখানে বড্ড শব্দ। তাই পরিচিতজনের থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। সেই গঙ্গার ঘাট। সুচির সাথে যেখানে আমি আগে আসতাম। নদীর জল যেখানে ঘাটের সাথে মিশছে, তার থেকে ঠিক দুটো ধাপ ওপরে বসে রয়েছি। নদীতে এখন ভাঁটা। গতদিনের ঘূর্ণিঝড়ে বেশ কিছু কচুরিপানা ভেসে এসেছে ঘাটের কাছে। নদীর স্রোত ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন পর দেখবো ঘাটটা থেকে সমস্ত কচুরিপানা সরে গেছে। সবটাই ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো। সবই এভাবে ঠিক হয়ে যায়। তবু কেন একটা ‘কিন্তু’ কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে?
বাবা মারা যাবার খবর পেয়ে সুচি এর মধ্যে একদিন ফোন করেছিল। এটা ওটা সেটা বলতে বলতে একসময় ও বলেই ফেলে, ‘বাবার চাকরিটা তো আর একবছর আছে। তাই বাবা চাইছে, সামনের বছরের মধ্যেই আমার বিয়েটা দিতে। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে হয়তো অনুষ্ঠানটা এখনই হবে না। বাবা চায়, রেজিস্ট্রিটা অন্তত হয়ে যাক।’ এই বলে সুচি থামে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বলি, ‘বাঃ ভালো তো। ভালো করে সংসার কর। আর বিয়েতে আমাকে নেমন্তন্ন করবি তো?’
ও হেসে বলে, ‘কেন করবো না রে? নিশ্চয়ই করবো।’
আমি বলি, ‘সবকিছুই খুব দ্রুত পাল্টে যায় রে। তাই একটা ভয় হয়।’ কিছুক্ষণ থেমে আবার বলি, ‘সুচি, তুই আমার সাথে এরপর আর যোগাযোগ রাখবি তো?’
- কেন রাখবো না রে পাগল?
- জানি, রাখবি না। এতগুলো দিন গেল। একবারও ফোন করেছিস?
- সে না হয় সময় পাইনি।
- সেটাই। এরপরেও পাবি না। আমার কথা মিলিয়ে নিস।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর আমি বলেই ফেললাম, ‘তুই আমাকে বুঝলি না সুচি। বুঝতে পারলে… না থাক।’
সুচেতনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুইও কি পেরেছিস?’

শেষ পর্ব
পড়ন্ত বিকেলে রাজীব এসে দাঁড়াল সেই জোড়া বটতলার সামনে। বটগাছটা নেই, তার জায়গায় একটা শূন্যস্থান বড্ড চোখে লাগছে। যে বাড়ির চালাটা ভেঙে পড়েছিল, সেটা আবার ঠিক হয়ে গেছে। ওদের দোকানটাও মেরামত করা হয়েছে। পড়ে যাওয়া ল্যাম্পপোস্ট, বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি সব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। রাস্তা থেকে জল নেমে গেছে। বিদ্যুতের সংযোগ এসেছে। পরিবেশটা আবার আগের মতো হয়েছে। শুধু নেই একশো বছরের পুরনো বটগাছটা। রোদে ক্লান্ত পথিককে যেটা ছায়া দিত। তার গুঁড়ির একাংশ শুধু এখন বর্তমান রয়েছে, তার মৃত্যুচিহ্নস্বরূপ।
দোকানের সামনে রাজীব এসে মুখের মাস্কটা নামিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। পথে নানা লোকের আনাগোনা, তাদের টুকরো সংলাপ আর সন্ধের এই প্রাক্কালের একটা মায়াময় মাদকতা রাজীবকে যেন একটা অন্য জগতে নিয়ে যেতে লাগল। বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে অস্তমিত সূর্যের রক্তিমাভ আভার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাজীবের একটা ঘোর এল। সে দেখতে লাগল তার চারিদিকটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। আর ধীরে ধীরে অন্ধকারটা যেন তাকে ঘিরে ধরতে লাগল। তারপর সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বুক চিরে একটা আলোর জ্যোতি প্রকাশ পেল – তার বাবা!
বাবা দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গায় যেখানে আগে সেই বটগাছটা ছিল। দেহটা ঈষৎ দীর্ঘ, মুখখানা প্রশান্ত, গাম্ভীর্যে ভরাট। তবু যেন অনেকগুলো প্রশ্নচিহ্ন রাজীব দেখতে পেল তার ঐ দীপ্তিমান চোখদুটোতে। কী প্রশ্ন করতে চাইছে সে রাজীবের দিকে তাকিয়ে? রাজীব বলতে চাইল, ‘বাবা তুমি আমাকে কাজের খোঁজ করতে বলেছ, আমি তা করেছি।’ কিন্তু তার গলা থেকে আওয়াজ বেরোল না। পরক্ষণেই সিগারেটের ছ্যাঁকায় সম্বিত ফিরে আসে রাজীবের।
লোকজনের আনাগোনা আগের মতোই। সন্ধের অন্ধকারটা এখন ভালোই নেমেছে, তাই রাস্তার আলোগুলো জ্বালানো হয়েছে। নিজের মনের ভুলে লজ্জা পেয়ে রাজীব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর তার নজর পড়ে ঘড়ির দিকে। ছ’টা বাজতে চলল, আর সময় নেই। এখনই তাকে পড়াতে যেতে হবে। এখন ক্লাস এইটের দুটো মেয়েকে পড়াবে, তারপরেও টিউশানি আছে। ডব্লুবিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে চায় বলে দুটো ছেলে আজই যোগাযোগ করেছে তার সাথে। তাদেরকেও পড়াতে হবে। সাইকেলে ওঠবার আগে একবার চোখ পড়ে গেল দোকানঘরটার সামনের দিকে। পিচবোর্ডের একটা কাগজ সেখানে ঝুলছে, তাতে লেখা – এই দোকানঘর ভাড়া দেওয়া হবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dipok Kumar Bhadra অভিনন্দন।
ফারহানা সিকদার বহ্নি শিখা এক কথায়, অসাধারণ। ভালো থাকবেন।
ফয়জুল মহী গভীর উপলব্ধির অতুলনীয় অসাধারণ প্রকাশ।খুব ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ স্যার। আপনাদের ভাল লাগলেই আমার শ্রম সার্থক।
Dipok Kumar Bhadra খুব সুন্দর লিখেছেন। ভোট দিলাম।এগিয়ে যান। সামনে আপনার জন্য ...................অপেক্ষা করছে। শুভ কামনা রইল।
ধন্যবাদ দীপকবাবু। আপনাদের শুভকামনাই আমার পাথেয়।
সজল কুমার মাইতি অতিমারি, লকডাউন ও আম্ফানের ত্রিফলা আক্রমণে সাধারণ মানুষের জীবনের এক সফল ও সাবলীল চিত্র নির্মিত হয়েছে আপনার লেখনীর জাদুতে। ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ। আপনিও ভালো থাকবেন।
hrchowdhury অসাধারণ লিখেছেন। যেমন বাস্তব পটভুমি তেমনি নান্দনিক উপস্থাপনা।
ধন্যবাদ ভাই। আপনাদের ভালো লাগলেই আমার শ্রম সার্থক।

০৫ সেপ্টেম্বর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৮ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.০৯

বিচারক স্কোরঃ ২.৫৭ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৫২ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪