বাবা বিদেশে থাকতেন বলে খুব মিস করতাম বাবাকে তখন। মাঝে মাঝে খুব অপেক্ষায় থাকতাম বাবার একটা চিঠি পাওয়ার আশায়। আমি বড় ছেলে ছিলাম বলে হয়তোবা বাবা মনে করতেন আমাকে অনেক কিছু জানতে হবে। তাই বাবা নানান উপদেশ দিয়ে, পড়ালেখা কেমন করছি সেটা জানতে চেয়ে আমাকে চিঠি লিখতেন।আর মা যখন বাবাকে চিঠি লিখতেন তখন আমাকেও জিজ্ঞেস করতেন-
- কিরে তোর বাবার চিঠির উত্তর দিবি না ?
তখন খুব আনন্দই পেতাম বাবাকে চিঠি লিখতে। মনে হত বাহ্ আমারতো বেশ কদর সংসারে। তার পর বিদেশ থেকে যখন বাবা আসতেন, জামা কাপড় সহ নানান রকমের নতুন জিনিষ পাওয়ার যে কী আনন্দ সেটা বলে বোঝানে যাবে না। বাবা বিদেশ থেকে এটা এনেছে ওটা এনেছে বলে বন্ধুদের কাছে ফুটানি মারারও যে কেমন আনন্দ সেটা আরো বেশ মজার।
………
আমি চাকুরী নিয়ে বেশ ভালই আছি। বউ, বাচ্চা, সংসার, সুখে দুঃখে একসাথে থাকার কথা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনা। বউ একসময় বলে দিয়েছিল-
-তোমার বিদেশ যাবার দরকার নাই, যা করবা এখানেই কর।
ব্যস হয়ে গেল, কে আর চিন্তা করে এসব। বউ বাচ্চার প্রতি মনোযোগ রাখা বেশ সংসারী মানুষ আমি এখন।
‘বাচ্চাটাকে আজকে একটু স্কুলে দিয়ে আসনা অথবা আজকে একটু স্কুল থেকে তুমি গিয়ে নিয়ে আসো না’-
বউ এর মুখ থেকে ভালবাসা ভরা এসব কোমল আবাদার না শুনতে পেলে মনে হত জীবনই বৃথা। হায়রে না জানি কপালে কী আছে। হঠাৎ করে বসে ডেকে পাঠাল। সামনে গিয়ে হাজির হতেই-
-যান, ডিরেক্টর সাহেবের রুমে যান। উনি আপনার সাথে কথা বলবে। .. ভয়েতো আমার কলজে ঠান্ডা হয়ে গেল। থতমত খেয়ে বললাম-
-কেন ভাইয়া কোন সমস্যানাকি?
-আরে না এতো ভয় পাচ্ছেন কেন, মনে হয় আপনি বিদেশ যাচ্ছেন। ভিয়েতনামের নতুন ফ্যাক্টরীটাতে নতুন রিক্রুটদের ট্রেইনআপ করার জন্য আপনাকে সিলেক্ট করা হয়েছে।
- ভাইয়া আমাকে ত আগে কিছু বলেননি
এইমাত্র যেন ধপাস করে আকাশ থেকে পড়ে এই একটা কথাই বলতে পেরেছি শুধু বসকে। আর ডিরেক্টরের সামনে গিয়েত শুধু -হা, হু, ইয়েস , ইয়েস স্যার,ওকে স্যার। তারপর সোজা পাসপোর্ট অফিসের লাইনে দাড়ানো ১৫ দিনের মধ্যে কম্ম সাবাড় করতে হল ।
……..
তিনটা বছর পেরিয়ে গেছে, প্রতি বছর একবার করে পরিবারকে দেখার সুযোগ পাই। এখন আর সেই চিঠির যুগ নেই বাবাকে একটা চিঠি লিখে ১৫দিন বসে থাকতে হতো চিঠিটা বাবার হাতে পৌছুতে, তারপর আরো ১৫দিন যেন বাবার উত্তরটা ফেরত আসতে। আর যদি কোন কারনে ডাকপিয়ন বেচারাটা উধাও হয়ে যায় তাহলে পোষ্ট অফিসে গিয়েও অনেক দেন দরবার করার কথাগুলো এখনো মাঝে মাঝে আমাকে নষ্টালজিক করে তুললেও ইন্টারনেটের কল্যানে আমার মেয়েগুলো প্রতিদিনিই আমার দেখাপায়, আমার সাথে কথা বলতে পারে। আর তাদের কোমল কোমল কচি কন্ঠের আবদারগুলোও সরাসরি বাবার কাছে ছুড়ে দিতে পারে।বছর শেষে বাড়ি যাওয়ার আগে আমার সেই যে কী ব্যস্ততা । এটা নেওয়া হয়েছে কিনা, ওটা নেওয়া হয়েছে কিনা, ব্যাগের মধ্যে জায়গা কুলাবে কিনা এসব বলে বলে তাদের যেমন তাগাদা, আমারও টেনশনে যেন নাওয়া খাওয়া বন্ধ হবার জোগাড় হয়ে যায়।
তবুও বুকের মধ্যে একরাশ আশা আর ভালবাসার পসরা নিয়ে মনে হয় আজই উড়াল মারি আমার ফেলে আসা সংসারের কাছে।মনটা খুবই ছঠফঠ করতে থাকে, সারাটা বছর আমি কি অনলাইনেই বাবা হয়ে থাকবো ?আমার আদরের সন্তান গুলোকে কি ছুঁতে পারবো না! বুকটা যেন ভারী হয়ে আসে, হাতগুলো কেমন যেন নিশপিশ করে উঠে। ছোট মেয়েটাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়ে রেখে এসেছিলাম। ওকে যদি একটু করে বুকের সাথে লাগিয়ে রাখতে পারতাম, যদি তার তুলতুলে কোমল কোমল হাতগুলো আমার মুখের কাছে এনে চুমু খেতে পারতাম মনে হয় সারাদিনে অফিসের কাজের ক্লান্তিটা মুছে যেতে আমার। বউটা যখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে থাকে –
- মেয়েটার জ্বর কিছুতেই কমছেনা, এই বলনা কী করব এখন ? সকাল থেকে ওকে কিচ্ছু খাওয়াতে পারি নাই। কিছু মুখে দিলেই বমি করে দেয়। বলনা কী করব ?
- ডাক্তার দেখিয়েছিলে না ?
- হেঁ দেখিয়েছিতো, ঔষধ খাওয়াচ্ছিতো…
- ঠিক আছেতো, সাথে সাথে কি কাজ হবে নাকি, এমন অধৈয্য হচ্ছ কেন? নামাজ পড়ো আল্লাহকে ডাকো ।
বউটাকে সান্তনা দিচ্ছি খুব শক্ত ভাব দেখিয়ে যেন আমার কোন কষ্টই হচ্ছে না । ভাবটা এমন যেন ওসব কোন ব্যাপারই না। বউটা খামাখা চিন্তার জট পাকাচ্ছে। মনে হয় কোন রকমে স্কাইপের লাইনটা কেটে দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছি। আর ধরে রাখতে পারছিনা। ওর সামনেনিজেকে খুব শক্ত করে ধরে রাখলেও লাইনটা কেটে দেওয়ার পর আর কিছুতেই ঘুমোতে পারি না। চোখের পানিগুলো মিছিলের পর মিছিলের মত চোখ থেকে গলা পয্যন্ত সচ্ছ ধারার প্রবাহে নিম্মগামী হতে থাকে শুধু। বুকটাকে তোষক চাপা দিয়ে পড়ে থাকলেও কোন কাজ হয়না, বালিশ যেন চিৎকরে বলতে পারেনা ‘আমি তো পুরোটাই ভিজে গেলাম বাপু’। পাছে অন্য সহকর্মীরা ছুটে আসে সে ভয়ে শক্ত হয়ে থেকে কান্নার শব্দটাকে অনেক কষ্টে বুকের খাঁচায় গুম করে রাখি। আর মনে মনে ভাবি
–‘আচ্ছা আমি কেমন বাবা হলাম, সন্তানের এমন প্রয়োজনের সময়ে তাদের কাছে যেতে পারিনা। বউটাকে মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দিতে পারি না ‘আমিত আছি’ বলে…
তারপর আর ভাবতে পারিনা, সইতেও পারি না এই বিচ্ছিন্নতা যেন, শুধুই ক্ষণ গুনে গুনে সময় পার করা ছাড়া আর কি কোন উপায় আছে?অতএব আবার সেই ১৫ দিন, জানিনা এই পনের দিনের ভুতটা আমাকে ছাড়বে কখন
……….
১৫ দিন কিন্তু কম সময় নয়।চাকুরীজিবীদের জন্য পনের দিন একটানা ছুটি পাওয়া মানে যে কী সেটা যারা চাকরী করে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পযন্ত অফিসের ঘানি টেনে টেনে সু্য্যটাকে দু’মিনিট যারা দেখার সময় পায়না তারাই বুঝতে পারে যে এই ছুটিটা নিশ্চয়ই আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত। যারা আমার জন্য ৩৬৫ দিন অপেক্ষা করে করে ক্ষণ গুনে গুনে চলে, হয়তো তাদের জন্য এটা খুবউ অল্প সময়। তবুও যারা এই দীর্ঘ প্রতিক্ষায় সময়ের স্রোত ভেঙে ভেঙে কাছে পাওয়ার সময়টাকে নিকটে টেনে আনে তাদের মধ্যে অবশ্যই অগ্রভাগে থাকে আমার দু’কন্যা।
আমিও যেন ৩৬৫দিন অপেক্ষা করে ১৫দিনের জন্যে স্কাইপে থেকে বেরিয়ে এসে আমার কন্যাদের সামনে স্বশরীরের বাবা হই তাদের কাছে।আমাকে কাছে পাওয়ার তাদের আনন্দ, তাদেরকে দীর্ঘ্য সময় পর ছুতে পাওয়ার আমার সুখবিলাস আর তাদের আকুতি ভরা কোমল কোমল সুরের আবদার শুনে আকু পাকু করা মন নিয়ে আবারো চিন্তায় মগ্ন হই। আবার কখনো আবাদার পুরন করতে পারান আনন্দেও যেন গদগদ হই।
তারপরও আরো সমস্যা নিয়ে কিছু পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক উঠকো ঝামেলা নিয়েও এদিক ওদিক দৌড়ুতে হয়। আত্মীয়তা রক্ষার দৌড়, বন্ধুত্ব রক্ষার দৌড়, সাক্ষাত দিয়ে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষার দৌড় ইত্যাদি করতে গিয়ে বউটার বকাত শুনেছিই, আর মনে হয় আমার কন্যাদ্বয়কেই শুধু বঞ্চিত করিনি, মনে হয় নিজেই বঞ্চিত হলাম পূর্ণ ১৫দিন বাবা হয়ে থাকতে আমার আদরের কন্যাদ্বয়ের কাছে। পতেঙ্গা সৈকতে বেড়াতে যাওয়ার শেষ আবদারটা আর রক্ষা করা হল না এবার, বাটারফ্লাই পার্কের প্রজাপতির সাথে দাড়িয়ে এবার আর ছবি তোলা হলনারে বাপ। অত্ঃপর ৩৬৫দিন পর আবার ১৫দিনের জন্য বাবা হওয়ার আশায় আবার তাদের ছেড়ে চলে আসতে হল কর্মস্থলে।
-এবারকার মতো আমাকে ক্ষমা করে দিস কন্যারা। যেটুকু পেরেছি তাই নিয়ে আরেকবার চড়ে বসিস ৩৬৫দিন পেরুবার ভেলায়। আর ছবি হয়ে হলেও জড়িয়ে থাকিস আমার বুকের মাঝখানটায়…।
২৪ আগষ্ট - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৪৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জানুয়ারী,২০২৫