তখনো ঘনকালো মেঘে আকাশ ছেঁয়ে আছে।বাতাসের একটানা শোঁ শোঁ শব্দ শষ্য ক্ষেতে পাখি তাড়ানোর পলিথিনের ফিতার মত শব্দ করে কানের পর্দায় আঘাত করছে।ঘের থেকে পানি ছেড়ে দেওয়া জাল বসানো নালীটার পাশে থির থির করে কাঁপছিল করিম। করিমের ডাক শুনে দৌড়ে আসে আবু, বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়
- কী হেইয়েরে করিম, কী হইয়ে কঅছে না !!(কী হয়েছে করিম, কী হয়েছে বল)
করিমের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছে না। কাঁপতে কাঁপতে সে ভাবছে শরীরের এত জোর দিয়ে সেআবু দা, আবু দা( আবু দাদা) বলে চিৎকার করল অথচ আবু দা একটুও শুনতে পেল না। কী অঘটনটাই আজ ঘটে যেতে বসেছিল।
….
দুদিন ধরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে তাই উপকুলবর্তী চিংড়ী ঘের মালিকেরা খুবই স্বন্ত্রস্ত সময় পার করছেন।অতিরিক্ত পানি বেড়ে গেলে অনেক কষ্টে আগলে রাখা মাছগুলো ঘের উপচে পড়া পানির তোড়ে ভেসে যাবে, তাতে বেশ ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে। গত মাসের প্রথম জো থেকেই জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেছে দেখে সবুর সাহেব বেশ চিন্তিত।তাই গত জো থেকেই সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করা ভা্ইপো টাকে অন্য দুজন কর্মচারীর সাথে হাত লাগাতে বললেন।
করিম ডিগ্রী শেষ করে চাকরির জন্য এখানে ওখানে চেষ্টা করে যাচ্ছিল।বেকারত্ব যেন তার মাথার উপরে অনেক বড় একটা ঘন কালো মেঘের মত চেপে থেকে হতাশার আঁধার ছড়িয়ে দিচ্ছে।এ অবস্থায় চাচা যখন ডাক দিয়ে বললেন হাত লাগাতে, এক কথাতেই করিম রাজী হয়ে গেল।কিছু খাওয়ার মাছ ত অন্তত পাওয়া যাবে।
-করিম তুত্তে কিন্তু খুব ভোরে ভোরে যঅন পরিবু( তোমাকে কিন্তুখুব ভোরে ভোরে যেতে হবে)।ফজরের আজানের পর পরই বাইর হই যঅন পরিবু( বেরিয়ে যেতে হবে )।আবু রাতিয়েত্তুন গোধা’র টং অত পাহারাত থাইবু (আবু ঘের এর ঝুপরিতে রাত থেকে পাহারায় থাকবে)।বেইন্নে পঅর হইবার আগে মাছ কিনইয়া অক্কল আইবু(সকলের আলো ফোটার আগেই মাছ ক্রেতারা আসবে),মাছ হুন ঠিকমত মাপি নের কিনা চাআবি(মাছগুলো ঠিকমত মেপে নিচ্ছ কিনা দেখবে)।দিন’র ন’টা পয্যন্ত গোধা’ত থঅন পরিবু(সকাল ন’টা পয্যন্ত ঘের’এ থাকতে হবে)।গাআকের মাছ বুঝাই দিয়েরে তোরাল্লাই কিছু রাই দিস, কাম শেষ গরি আইবের সমত ইউন লই আইছ(গ্রাহকদের মাছ বুঝিয়ে দিয়ে তোদের জন্য কিছু রেখে দিস, আর কাজ শেষ করে আসার সময় ওগুলো নিয়ে আসবি)।
এই ছিল সবুর সাহেবের শেষ কথা।তারপর থেকেই কাজে লেগে পড়েছে করম। খন্ডকালীন চাকুরির মত সকালটা বেশ কাজে লাগছে ভেবে করিম খুব আগ্রহ সহকারে দয়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।যদিও আমাবস্যা পূর্ণিমার জোয়ার-ভাটার জো হিসাবে মাসে ১৫ দিন কাজ থাকে বেচাকেনার আর বাকি দিনগুলো পাহারা দেওয়ার।করিম শুধু জো অনুয়ায়ী সহযোগীতা করবে।
…..
ঘের এর মধ্যে পানির পরিমান অনেক বেড়ে গেছে, তাই সারারাত আবু পাহারা দিয়েছে। ভিতরের পানির চাপ কমাতে জোয়ার আসার আগ পয্যন্ত পানি ছেড়ে রাখতে হবে যতক্ষণ পারা যায়। আবার জোয়ার এসে গেলে ঘের এ পানি ঢোকনোও বন্ধ রাখতে হবে।না হলে অতিরিক্ত পানির চাপে ঘের এর বাঁধও ভেঙে যেতে পারে।তখনই ঘঠবে মহাবিপদ, সব মাছ ভেসে যাবে পানির তোড়ে।ভোর না হতেই আবু’র সাথে যুক্ত হয়েছে করিম, বয়সে বড় বলে আবু দা (আবু দাদা)বলেই ডাকে তাকে করিম।সকালে ধরা পড়া মাছের বেচাবিক্রি শেষ হলেও অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়ার তদারকি করছে দু’জনই ।পানি বের করে দেওয়ার দু’টো স্লুইস গেটেই জাল বসিয়ে দিয়েছে আবু অনেক আগে।করিম তাকে সহযোগীতা করার জন্য কখনো এগেট কখনো ওই গেইটে জাল পরখ করছিল।পানির অসম্ভব তোড় যাচ্ছে, ভাটায় খালের পানি একটু কমে আসায় ঘের থেকে বেরুতে থাকা পানির তোড় অনেক বেড়েছে।নালীর মুখে ফানেলের মত জালটা বেশ টান টান হয়ে আছে।ফানেলের শেষ প্রান্তটা খালের মাঝখনে ভেসে আছে, বেশ কিছু মাছও পড়েছে দেখা যাচ্ছে।দুপুর একটায় জোয়ার আসার আগ পয্যন্ত এভাবে পানি নামাতে হবে।
সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছিল আবু, করিম হঠাৎ দেখতে পেল আবু একটা বাঁশ নিয়ে স্রোতের মুখে কী যেন করছে।করিম চিৎকার করে জানতে চাইল কী হয়েছে।আবু জবাব দিল-
-জলইস্যে আর আগাছার বড় চাক্কা ওগ্গে ভাইআইয়ের ইক্কে, ইবে ঠেকাইত নপাইল্লে, জালত ঢুকিলে জাল ছিরি যাইত পারে(শেওলা আর জলজ আগাছার একটা বড় চাক ভেসে আসছে এদিকে। ওটা ঠেকাতে না পারলে, জালে ঢুকে পড়লে জাল ছিড়ে যেতে পারে)।
করিম দেখলো বাঁশ ফেলে আগাছার চাকটাকে অ্ন্যদিকে টেনে আনার চেষ্টা করছে আবু যাতে জালটাকে রক্ষা করা যায়।তাই সেও এগিয়ে গেল হাত লাগাতে।করিম দেখতে পেল ইতমধ্যেই কিছু ছোট ছোট আগাছা চাক জালে ঢুকে পড়েছে। আরো ভেসে আসা চাক স্রোতের টানে দুমড়ে মুচড়ে নালের মুখে হা করা জালর মুখে ঢুকে যাচ্ছে আর জালে আটকে গিয়ে শেষ মাথার থলেটা যেখান মাছ আটকাচ্ছে সেখানটা বেশ ভারী করে তুলছে,তাই জালের ঐ অংশটা স্রোতের সাথে জোরে জোরে উঠা নামা করে নালির মুখে বেশ শক্তি প্রয়োগ করছে য়েন এখনই ফ্রেম ছিড়ে জালটা বেরিয়ে যাবে।
হঠাৎ করে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, লক্ষণ বলছে ভারী বৃষ্টি নেমে আসবে অল্পক্ষনেই। সাথে সাথে বাড়ছে বাতাসের গতি। পরিস্থিতি দেখে করিম আরেকটা ছোট বাঁশ নিয়ে নালীর মুখ থেকে ছোট আগাছার চাক সরিয়ে নিতে যেইনা পা বাড়াল অমনি পিছলে গিয়ে ঝপাস করে স্রোতের মুখে পড়ে গেল।তখনো বুদ্ধি হারায়নি সে,পড়তে পড়তে নালার মুখে উচু করে তোলা পাকা দেয়ালের খাঁজটা খপ করে ধরে ঝুলে পড়ল। নিজের অজান্তেই বাঁচার তাগিদে তার গলা ফেটে চিৎকার বেরিয়ে এল-
আবু দা, আবু দা, আবু দা ( আবু দাদা)
আবু কিছু শুনতে পেল কিনা কে জানে। দেয়ালের খাঁজ ধরে ঝুলে থাকা করিম শরীরটাকে টেনে তুলতে পারছেনা কোন রকমেই।তার পুরো শরীরটাকে স্রোতে টেনে যেন এখনই জালের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলবে।এক মুহুর্তেই মরণ চিন্তায় করিমের দুনিয়াটা যেন আঁধার থেকে আঁধারে তলিয়ে যেতে লাগল।নাক মুখ দিয়ে অনেক গুলো পানি ঢুকে গেল তার, একটা পা টেনে এনে কোন ভাবে দেয়ালের খাঁজে চাপ দিয়ে একটু শক্তি সঞ্চয় করতে চাইল সে, শুরুতে ২/৩বার আবু দা আবু দা করে ডাক দিলেও এখন তার মুখ দিয়ে আর কোন শব্দই বেরুচ্ছে না। জীবনটাকে মাছের জালে আটকে পড়া মৃতদেহ হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য কারোমুখাপেক্ষি না হয়ে যেন নিজের যুদ্ধ নিজেই করে যাচ্ছে সে।আবু তখন অন্য যুদ্ধে ব্যস্ত। শেওলা আগাছার বড় দঙ্গলটা সরাতে সরাতে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজটা আবু’র কানে যে প্রতিবন্ধকতা দাড় করিয়ে দিয়েছে তাতে করিমের সংকটাপন্ন জীবনটা তছনছ হওয়ার পথে ধাবিত হতে যাচ্ছে। আবু যখন সেই দঙ্গলটা সরাতে সক্ষম হবে ততক্ষনে হয়তো করিমের প্রাণহীন দেহটা জালের শেষপ্রান্তের থলেতে মরা মাছেদের সঙ্গি হয়ে যাবে। জালটা না তোলা পয্যন্ত করিমকে আর কউ খুজে পাবে না।আবু দা’ও হয়তো করিম করিম করে কতক্ষণ চিৎকার করবে ছেলেটা হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল ভেবে ভেবে। জোয়ারের মুখে পানির স্রোত যখন দুর্বল হয়ে পড়বে তখন হয়তো মাছেদের সাথে ভেসে উঠবে জালের খোপে আটকে পড়া করিমের মরাদেহটা।
…..
বৃষ্টি নেমেছে এমন ভাবে যেন আজকে পড়ে এমন বৃষ্টি আর নামবে না। চারিদিকের এতো শব্দে শুনে করিম বুঝতে পারছে তার কান এখনো সতেজ আছে। বাতাসের শব্দ, স্রোতের গর্জন,বৃষ্টির ফোঁটা পানিতে আছড়ে পড়ার শব্দ সবই করিম স্পষ্ট বুঝতে পারছে, নাকে মুখে পানি ঢুকে পড়ার প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে করিম।এমনিতে ঘনকালো মেঘে আঁধার আকাশ, তার উপর প্রচন্ড বৃষ্টি করিমকে যেন আরো আঁধার কোন জগতে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।সৃষ্টিকর্তার কাছে বাঁচার ফরিয়াদটা নিজের অজান্তেই জপতে শুরু করেছে সে। স্রোতের মুখে ভেসে থাকা শরীরের একটা পা সমস্ত শক্তি দিয়ে হঠাৎ করিম কেমন করে যেন দেয়ালের খাঁজে নিয়ে আসতে সক্ষম হল। দুহাতে দেয়ালের খাঁজ জড়িয়ে থাকায় বগলের অংশটা বেশ খানিক চিড়ে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে গেছে। পা টা দেয়ালের খাঁজে আসতেই শরিরটাকে যেন একটা অলৌকিক শক্তিতে পল্টি মেরে করিম দেয়ালের উপর উঠে গেল।সাথে সাথে আরেকটা গড়ান দিয়ে পড়ে গেল দেয়াল থেকে পাড়ের মাটিতে, চিৎ হয়ে পড়েছে সে আকাশের দিকে মুখ করে।দেয়ালের উপর উঠার পর গড়ান দেয়ার আগে একবার চোখ খুলে দেখেনিয়েছিল কোন দিকে গড়ান দিতে হবে তা দেখে নেয়ার জন্য।এখন যেন তার চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। যদিও এযাত্রা সে বেঁচে গেছে।তবুও যুদ্ধ শেষের ক্লান্তিতে কতক্ষণ চোখ বুজে পড়েছিল সে।শরীরটা তখনও থির থির করে কাঁপছিল তার। ভয়াল আঁধার এক জগতের হাতছানি থেকে ফিরে এলেও সেই আতংকে সে একেবারেই কুকড়ে গেছে।বেশ কিছুক্ষন পর যখন একটু শক্তি সঞ্চয় করে উঠে বসল তখনই সে শুনতে পেল আবু দা তার শরীরকে নাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলো
-কী হইয়েরে করিম, কী হইয়ে, কী হইয়ে কঅছেনা…
করিম নির্বাক আর ক্ষোভ ভরা চোখে শুধু আবু দা’র দিকে তাকিয়ে রইল, উত্তরহীন।
২৪ আগষ্ট - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৪৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪