পতেঙ্গা সুজনেষূ পরিবারের সাহিত্য সভা। আয়োজনটা ভালই চলছিল, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই বৈশাখি আড্ডায় সবাই মশগুল হবো, পতেঙ্গার সুজনদের সাথে আজ যোগদেবে শহরের অন্যান্য এলাকার সুজনরাও। শিমুল এসেই আমাকে বললো আজ বায়েজীদ থেকে একজন নতুন সুজন আমাদের সাথে যোগ দেবে। সব আয়োজন শেষ, একে একে সুজনরা এসে জড়ো হতে লাগলো।
-সোহলে ভাই, আমি রাস্তার ওপাশে দাড়াই, শ্রাবণ আসছে - বলে শিমুল চলে গেল।
মিজান, বাপ্পু বড়দা’কে নিয়ে আমি স্বভাব সুলভ প্রাথমিক গল্পে মশগুল হলাম। একটু পরেই আড্ডা শুরু হবে, বারান্দাতে দাড়িয়ে দেখলাম শিমুল এগিয়ে আসছে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধি মেয়েকে নিয়ে, জানিনা সেই ই শ্রাবণ কিনা।
আমাদের সৌভাগ্য যে শিমুলের মত একজন শারীরিক প্রতিবন্ধি আমাদের পতেঙ্গা সুজনেষূ পরিবারের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তার মেধা ও সাহিত্যানুরাগ আমাদের মুগ্ধ করেছে। শিমুলের ডান পাশের একটা হাত এবং পা দুটোতেই বৈকল্য আছে, যার কারনে সে সুস্থ মানুষের মতো হাটতে পারে না খুড়িয়ে হাঁটে। কিন্তু তার সাথে শ্রাবণ নামের যে মেয়েটি আজ আমাদের সাহিত্য আড্ডায় এসেছে সুদুর বায়েজীদ থেকে তা দেখে সত্যি আমি বাকশুন্য হয়ে গেছি। চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ প্রান্তে পতেঙ্গা আর উত্তর প্রান্তে বায়েজীদ, এলাকা প্রায় উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর মত। তাহলে কতটুকু উদ্যোম থাকলে ্একজন প্রতিবন্ধি মেয়ে একটু পরে সন্ধ্যা হবে জেনেও আমাদের সাহিত্য আড্ডায় যোগ দিতে এসেছে সেটা ভেবে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না।
শ্রাবণের দুটি পায়েই বৈকল্য আছে। ৫০-১০০ গজের রাস্তা পেরিয়ে আড্ডাস্থলে আসতে সে যতটুকু সময় নিল ততক্ষণে উপস্থিত সব সুজনই কক্ষ ছেড়ে বারান্দায় এসে দাড়িয়ে গেছে শ্রাবণকে দেখার জন্যে। সে শুধু শারীরিক প্রতিবন্দিই নয় একটু কাছে আসতেই দেখলাম তার চোখে মোটা লেন্সের চশমা। নিজেকে খুবই দুঃখবোধে জর্জরিত হতে হলো আমার, সাহিত্য কক্ষটা দোতলায় বলে। কেননা রাস্তা পেরিয়ে আসতে শ্রাবণের যে শারীরিক কসরৎ বা কষ্ট আমি দেখলাম তাতে এখন সিড়ি বেয়ে দোতলার সভাকক্ষে আসার কথা ভেবে আমি যেনো কুকড়ে যেতে লাগলাম। তবুও শিমুল তাকে নিয়ে সভা কক্ষে হাজির হলো।
আমাদের বৈশাখি সাহিত্য আড্ডা শুরু হলো, সাহিত্য আলোচনা হলো, সুজনরা নিজেদের লেখাও পাঠ করল কয়েকজন। কিন্তু আমার মনে কি যেন হয়ে গেল, আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না আর। সভা শেষে এবার সব সুজনই শ্রাবণকে গাড়িতে তুলে দেবার জন্য উদগস্খীব হলো। এত দুরের পথে এই সন্ধ্যেবেলা মেয়েটা কিভাবে পৌছাবে সেই চিন্তায় সুজনদের কপালে উদ্বিগ্নতার রেখা ফুটলেও শ্রাবণ খুব সুন্দর করে বললো
---- না ভাইয়া, কোন সমস্যা হবে না,আমি ঠিকই পৌছে যাবো, আপনারা ি চন্তা করবেন না।
শ্রাবণ সেদিন বিদায় নিলো আমাদের সামনে থেকে, কিন্তু তার আগ্রহ, তার উদ্দীপনা, এই কষ্টকর যাতায়াতের ভয়কে জয় করে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় আমরা যারা সুস্থ আছি তাদের মনের অন্তপুরে সত্যিকারের শ্রাবন ধারার মত যেনো একটা ক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়েছিলো সেদিন থেকে। শ্রাবনের ভঙ্গিমাগুলো আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। এভাবে ভাবতে ভাবতে মনে হয় অনেক দিন গড়িয়ে গেছে। শ্রাবণ ফোনে ফোনে অনেক কুশল বিনিময় করে আমাদের সাথে। আমরা যেনো সকলেই সত্যিকারের সুজন হয়ে আর্বিভুত হয়েছি শ্রাবণের জীবনে। মিজান , শিমুল সহ আমাদের পুরো পতেঙ্গা পরিবার শ্রাবনের এত কাছাকাছি চলে গেলাম মনে হলো সব দুরত্ব ঘুচিয়ে আমরা যেনো এক্ই এলাকায় একই পরিবারের সদস্য হয়ে গেলাম। তাই শ্রাবনের অনুরোধ আর ফেলতে পারলাম না, একদিন আমি স্বস্ত্রিক হাজির হলাম বায়েজীদ এর সেই ছোট্ট বাসাটাতে। আমি তখনো জানতাম না সে কী চাকরি করে, কোন রকমের জীবন যাপন করে। সেটা আসলে যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তা হলেও কিছু কিছু লোকজন থাকেন আমাদের চারপাশে তাদের সংখ্যাও হয়তো বেশী নয় কিন্তু বেচে থাকার জন্য তাদের সংগ্রাম যেনো অন্যদের চেয়েও একটু আলাদা। যার কারনে সাধারণের চোখে তারা কখনো কখনো অসাধারণ হয়ে উঠেন। শ্রাবনের বাসায় এসে বুঝলাম শ্রাবনও অসাধারণ মনোবল সম্পন্ন একজন অসাধারণ মহিলা।
সন্তান ছিনিয়ে নিয়ে স্বামী ি নরুদ্দেশ হয়ে গেছে, এখন সে একজন অসহায় স্বামী পরিতক্ত্যা প্রতিবন্ধি নারী ছাড়া আর কউে না। শরীরের সাথে অসম্ভব রকম অসহযোগী পা জোড়া অনেক কষ্টে এগিয়ে নেয় তাকে হাটার সময়, দিনকে দিন চোখের আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে চলেছে, তার পরও সে বেচেঁ আছে। অনেক দুঃসাহস নিয়ে দাপটের সাথে বায়েজীদের এক জীর্ণ কুটিরে বেঁেচে আছে সামান গার্মেন্টস এর এক নারী শ্রমিক, দৃঢ় মনোবলের সাহিত্যমোদী একজন সুজন সীমা চৌধুরী শ্রাবণ । সুজনদের সাথে থিতু হওয়া এই সুজনের সেই কুঠিরে অবশেষে বেড়ার ফাঁক গলে ভোরের আলো ঢুকে পড়ার মতো একটু করে আলো খেলে উঠলো। ক্ষীণ হওয়া দৃষ্টিতে অল্পখানেক দম দিতে পাহাড়তলীর চক্ষু হাসপাতাল থেকে ঘুওে এলো শ্রাবণ সহযোগীতার ক্র্যাচে রূপান্তর ঘটা সুজনদের কাধে ভর করে, চোখের ছোট্ট একটা অপারেশনটর পর শ্রাবণের সাথে আমরাও উৎফুল্ল হলাম এই ভেবে যে শ্রাবণের চোখের আলোতে আমরা সুজনরা আরোও একট ু স্পস্ট হলাম । শ্রাবণ ধারায় ঝরে যাওয়ার মতো কিছু কিছু আঁধার কনিকা থেকে আমরাও যেন ভার মুক্ত হলাম শ্রাবণের সাথে সাথে। আমাদের শ্রাবন আবারো ফিরে পাবে তার কর্মস্থল, আবারো বুক ফুলিয়ে এগিয়ে যাবে জালালাবাদ পাহারের ঢালু বেয়ে উঠে যাওয়া সেই রাস্তায় একজন কর্মজীবি পোষাক কর্মী হিসাবে।
স্বপ্নে স্বপ্নে আমার মনটা বিভোর হতে হতে একদিন শ্রাবণের কাছ থেকে ইথার বেয়ে আমার সেলফোনটা খুব যেনো গর্জে গর্জে উঠলো। একজন মহামানবের আগমন বার্তা পৌছে দিল আমার মস্তিষ্কের আলোড়ন চেম্বারে, যে কিনা শ্রাবণের সবকিছু মেনে নিয়ে তাকে জীবন সঙ্গী করে নিয়ে যাবে। মুহুর্তেই আনন্দাতিশায্যে আমি যেন বিভোরে অবশ হয়ে গেলাম। শ্রাবন তোমার ঝর ঝর বারি ধারার ঝরা কাব্যে ঐ মধুকর তোমার অন্তর কলিকে আবার পরিপূর্ণ ফুলে ফুটিয়ে তুলুক। আমাদের শ্রাবণ ঐ দেবদুতের হাত ধরে যাত্রা করল স্বর্গলোকের দুয়ারে উপনীত হতে। এক দুঃসহ একাকীত্বের বেড়াজাল ছিন্ন করে জীবন সঙ্গীতের সুরে আপন করে নিতে নতুন এক পরিবেশ , যেখানে থরে থরে সাজানো থাকবে ভালবাসার পরশসিক্ত ফুল মঞ্জরী, সাজানো থাকবে দুঃখ ভাগাভাগী করে জীবন পাড়ি দেওয়ার ভালবাসার কার্পেট পথ, সাজানো থাকবে যা কিছু অর্জন অধিকারের সম আকাঙ্খায় পরিব্যপ্ত ভালবাসার মকমল অনুভুতি। তাই ই হলো। আবারো শিহরিত হলাম, সবুজ আমাকে ফোন করে বললো
---ভাইয়া শ্রাবণ মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে’। আমারতো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা হলো, শেষ পর্যন্ত মেয়েটার কপালে বুঝি আর সুখ সইল না।
--- কেন ? শ্রাবণের কী হয়েছে সবুজ?
----ওর বাচ্চা হবে ভাইয়া, পেটে বাচ্চার পজিশন ঠিক নেই, মনে হচ্ছে সিজারিয়ান করাতে হবে। তাই ওর জন্য রক্তের প্রয়োজেন।
-----ওর রক্তের গ্রুপ কী ?
---- এ বি পজেটিভ , আমি কয়েক জনকে বলেছি এখনো পাইনি। আগামীকাল দুপুর দু’টার দিকে রক্ত দিতে হতে পারে, আপনিও একটু দেখবেন ভাই।
কী বললো সবুজ ! শ্রাবনের রক্তের গ্রুপ এ বি পজেটিভ ? প্রথমে বিশ্বাস হতে চাইল না মন, তারপর মনে মনে আল্লাহর কাছে একবার শুকরিয়া আদায় করলাম। শ্রাবণ আমার ছোট বোন, ওর এই বিপদে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে সৃষ্টিকর্তায় যেনো আমার নিয়তি সাজিয়েছে। শ্রাবণের চোখ থেকে শ্রাবনি তো দুরে থাক একফোটাও অশ্রুপাত হতে দেব না। তাই দৃঢ় কন্ঠে সবুজকে বললাম
---সবুজ তুমি চিন্তা করো না, শ্রাবণকে বলো আমি তার ব্যবস্থা করবো।
সবুজের সাথে কথা শেষ করেই আমি শ্রাবণকে ফোন দিলাম।
----- শ্রাবণ কেমন আছো ?
---- জ্বী ভাইয়া ভালো, ডাক্তার বলেছে কাল দুপুর নাগাদ অপারেশন হবে। রক্ত. . . .
শ্রাবণের কথা শেষ হতে না দিয়ে বললাম
---শ্রাবণ তুমি চিন্তা করো না, তুমি আমার ছোট বোনের মত, আমিই তোমাকে রক্ত দেব, আমার রক্তের গ্রুপ এ বি পজেটিভ।
----ভাইয়া. . . ্ওপাশে শ্রাবণের কন্ঠ একটু ভারী শোনাল।
অফিস থেকে দুঘন্টা ছুটি নিয়ে রক্তটা দিয়ে আবারো অফিসে ফিরে এলাম, লেবার রুমে থাকার কারনে শ্রাবণের সাথে আর দেখা করা হলো না। শ্রাবণের ফুটফুটে বাচ্চাটা হামগুড়ি ছেড়ে এখন হাঁটি হাঁটি পা পা করছে।
----কখন আসবেন আপনি?
এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না আর। নিশ্চিত যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও চাকরি নামের যান্ত্রিকতার শহরের শেকল ছেড়ে সবুজ গ্রামের শ্রাবণ নীড়ে একবারও যেতে পারিনি।
তবুও বার বার ওকে বুঝাই ---
‘এই তো আমি আসছি, সত্যি দেখবে কদিন পর হঠাৎ তোমার উঠোনে হাজির হবো।’
গত বছর বৈশাখের আগে চৈত্র সংক্রান্তিতে ফোন করেছিলো সে, আবদার করেছিলো না পারলে বৈশাখের দুদিন পরে পুজোর শেষে গিয়ে তার ছেলেটাকে যেনো দেখে আসি। এই সেই বলে মনটাকে বোঝাই ক্ষনিকের জন্য, কিন্ত শ্রাবণের আকুতি ধারন করতে না পারার দুঃখবোধে অন্তরের ক্ষরণ বেড়েই চলে। পাশা পাশি নানান রকম ভাবনাতেও মনটা বিষন্ন হয়ে যায়, এই বিষয়টা আসলেই একটা পার্থিব বা এককথায় বললে ইহজাগতিক লোকদেখানে বলে মনে হয় আমার। তাকে রক্ত দিয়েছি বলে জানিনা সে আমাকে কোন জায়গায় রেখেছে ভাবনায়, কিন্তু ফোনে তার কথা বা তার আকুতি বলে দিচ্ছে সে গরীব বলে তাকে আমি এড়াতে চাইছি বা যে ছেলের জন্মের সময় আমি তাকে রক্ত দিয়েছিলাম সে ছেলে এখন হাটতে শিখে গেছে অথচ আমি তাকে দেখে আসতে বা আশির্বাদ করতে এখনো গেলাম না এরকম কিছু । কিন্তু আমার মন বলছে এমেয়ে আমার জন্য অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়বে, ওর স্বামী একজন সামান্য বেতনের কাটমিস্ত্রী, আমি শহর থেকে যাব হয়তো সেও মেহমানের জন্য তার আয়ের বাইরে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে বউএর মন রক্ষার জন্য, বিষয়গুলো আমাকে একবারেই এলোমেলো করে দিচ্ছে বারবার। আমি চিন্তার কোন কুল কিনারাই পাচ্ছিনা যাব কি যাব না।
আবারো বৈশাখ চলে এলো, মানে আরো একটা বছর পেরিয়েছে। এবার কি পারব শ্রাবনের উঠোনে দাড়িয়ে বলতে - ‘দেখো শ্রাবন আমি তোমার উঠোনে দাড়িয়ে’?