কাল

শৈশব (সেপ্টেম্বর ২০১৩)

ইদরিস আলী মধু
  • 0
সহজ হয়ে তাদের সাথে কী ভাবে বাক্যালাপ করা যায়, সজিব সেভাবে তৈরী হচ্ছিল। মনের ভেতর সেরকম সহায়ক কথা বা বাক্য খুঁজছিল। জানার ইচ্ছে। কিছু একটা বলতে যায়। বলতেই একজন অভিমানের খেদ টেনে বলে, ‘ক্যান, আলাপের কাম কী? আমাগেরে লগে আবার কীয়ের আলাপ। আসল কতা কয়া ফ্যালান।’ এমন ঝাঁঝালো কথায় সজিবের চেতনায় চির ধরে। মনটা ধাক্কা খায়। ভেঙে যায়। লজ্জার সাথে ভয়ও লাগে। কী না কী ঘটে। কী না কী ওরা ঘটিয়ে ফেলে। পরিচিত কেউ দেখে ফেলে­ তো ছিঃ ছিঃ দেবে। ইতোমধ্যে ভোরের কুয়াশা কেটে যেতে যেতে সকালটা একদম নেংটো হয়ে উঠেছে। এখন যে-কেউ দূর থেকে দেখতে পাবে, চিনতেও পারবে। এত সব দিধাদ্ব›দ্ব। মাঝে কিছুটা সময় কেটে যায়। বিপদ আপদ হবে বলে মনে হয় না। এক ফাঁকে সজিব তাদের সম¯— দুনিয়াটা পরিমাপ করে ফেলে। সেই মেয়েটাকে জানবার কৌতুহলটাও বেড়ে যায়।
মেয়েটার সাথে ইচ্ছে করে হেঁটে এসেছে এতদূর। হাঁটতে হাঁটতে সে কী বলেছিল আর সেই বা কী বলেছিল, সেগুলো আর মনে পড়ছে না। কথায় কথায় তার আ¯—ানায় চলে আসে। নামটা পর্যšত জানা হয় না। যখন তাকে নিকটে পেয়ে অন্য একজন মেয়ে বলে ওঠে, ‘ওই যে লতিফা আইতাছে।’ তখন জানা হয় মেয়েটার নাম, লতিফা।
সজিব প্রাতঃভ্রমণ করছিলো। নির্মাধীন রেলের একটা অফিস বিল্ডিং এর সন্নিকটে ভোরের আধোআলোয় দেখা হয়েছিল। আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে, সম্মুখ বরাবর আড়াঅড়ি রেলপথের পশ্চিম পাশে নানান ময়লা আবর্জনার ভেতর খরকুটো, পলিথিন দিয়ে তৈরী করা খুপড়ি খুপড়ি ঘর ক’খানা। সেখানে ছেলে বুড়ো যুবক আর মেয়েরা মিলে বেশ কিছু মানুষের সমাগম। শীতের তীব্রতার জন্য আরাম-আয়েসে ঘুমোতে না পেরে পাখি ডাকার আগেই হয়ত জেগে উঠেছিল। কেউ কেউ পলিথিন জাতীয় কাগজটাগজ পুড়িয়ে শীতের তোর কাটাতে আগুন পোহাচ্ছিল। সেদিক থেকে ধেয়ে আসছিল ধূয়ার তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ। দম বন্ধ হবার উপক্রম। তারপরও নেশা কাটে না। লতার লতানো মায়ার টানে সজিব ছুটে যায় সেখানে।
লতিফার পরনে ছিল হলুদ রঙের লালপেড়ে শাড়ি। শাড়ির নিচ দিয়ে কালো রঙের পেটিকোটটা বৃত্তাকারে বেরিয়ে ছিল। হাঁটার সময় রা¯—ায় ছেঁচড়–তে ছেঁচড়–তে শাড়ি ও পেটিকোট শিশির ভিজা হয়। শীত ভিজা ঠান্ডা বুঝতে পেরে লতা পেটিকোটটা পেটের উপর টেনে তোলে কিছুটা। খুঁজে খুঁজে দেখে কতটুকু ভিজেছে। তখন সজিবের চোখে ধরা পড়ে, হালকা পাতলা শ্যামলা মতো লতিফার টানা টানা চোখ দুটোতে রাত জাগার এক ধরণের মাদকতা। টিকলো মতো নাকটার ডান পার্শ্বে মতির ফুলটাও বেমানান হয়ে অসহায় ভাবে হাসছিল যেন। লালÑনীল ফিতা দিয়ে চুল বেঁধেছে। পায়ে কমদামী প¬াস্টিকের সেন্ডেল, গায়ে ময়লাযুক্ত লেডিস চাদর, মুখে অযতেœ রাতে মাখা স¯—া মেকাপে চেহারাটা উসকো খুসকো ফ্যাকাশে দেখালেও বেশ চোখে লাগার মতো আরেকটা আবেগ তখনও তার দেহ থেকে ছুরিত হয়ে উঁকি মারছিল।
লতিফাকে উদ্দেশ্য করে কালো মতো লিকলিকে রোগাটে ধরণের সেই মেয়েটা আবার বলে, ‘কীলো মাগী! এত দেরি কীয়ের? আইতে বুজি মন চায় নাই?’
নারে! ব্যাটাডা খুব ভালা ছিল। আদর কইরা ইজ্জত দিছে। টাহার সাথে খাওনও দিছে।
তোরে তো দিবোই। লওনের কপাল, তোর। আল­ায় তোর রূপ দিছে। দ্যাখ না আমারে কেউ লইতে চায় না। কেউ কদর করে না। কুন পাপেই যে দুনিয়াত আইছিলাম। কানাও পছন্দ করে না। দ্যাখ না, ওহনো আরেক ব্যাটা তোর পিছে লাইগাই আছে।
সজিব লজ্জায় নূয়ে যায়। মেয়েটাকে একেবারে বেহায়া-বেয়াদব বলে মনে হয়। সে নিজের জন্য কিছুটা সেল্টার পাবার আসায় লজ্জাবনত ভাবে লতিফার দিকে তাকায়। লতিফা যেন তাকে সেল্টার দেবে সে রকম একটা চোখের এশারা দিয়ে চাম্পার উদ্দেশ্যে অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলে, ‘না রে চাম্পা! হগোল মানুষই সমান না। গত কালক্যা যে ব্যাটা লইছিল। তার বাড়ির র“মগুলা কী সুন্দর মোজাইক করা! তার একেকটা হল ঘরের ল্যাহাল। কিন্তুক ব্যাট্যার মনডা খুবই কিপ্টা। আমার উপর রাত পার কইরা মাত্রর দুই শ টাহা দিয়া বিদায় করলো।’ কথার মাঝে মাঝে লতিফা বারবার করে সজিবের দিকে তাকাচ্ছিল। মিটমিট করে হাসছিলও। লতিফার এমন অচেনা ইশারাতে সজিব মনে মনে অনেকটা সাহসী হয়ে ওঠে। একাšত ভাবে প্রশ্নও করে, ‘আমি তোমার সাথে কেন এতদূর এলাম, তুমি জানতে চাইলে না তো?’ লতিফা আবার মৃদু হাসির ফুল ছড়িয়ে বলে, ‘হ , ক্যান অইলেন বুঝবার পারি নাই। প্রেমটেমের ফুন্দি নাকি?’
সজিবের কাছে লতিফার কণ্ঠটা বেশ মজাদার মনে হয়। না মেয়েলি না পুর“ষালি। কচি বয়স হলেও কণ্ঠটা কামাশক্তি ককিলার মতো যেন। শুনলে যে কারও আসক্তি বাড়বে। সজিব সেঘোর কেটে বলে, ‘না না। ওসব কিছু না। তোমাকে জানবার খুব ইচ্ছে করছে। তুমি কী আমার সাথে একটু মন খুলে কথা বলতে পারবে?’
পারবো। তয় এক’শ টাহা লাগবো। রাজি থাহেন তো কন, কী জানবার চান।
টাকাটাই বড়ো হলো?
কী কন না বোকা বাদরের মতো। টাহাই তো মাতাÑপিতা। টাহাই তো বগবান। টাহাই তো সব..
আচ্ছা! দিবো।
আগে দিতে ওইবো।
ঠিক আছে এই নাও।
লতিফা টাকাটা সজিবের হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে তারপর আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘কন কী হুনবার চান।’
এই যেমনÑতুমি কে, কোথা থেকে এ পথে এসেছ, এইসব আর কী।
সেগুলান জানে কী করবেন? হগোলেই তো জানবার চায়। কোনু কামে আহে না। এগুলান আপনাগেরে বিলিসিতা ওইচে। আজকাল হগলেই খালি জানবের চায়। কামে লাগাতে চায় না।
কেন অভিমান করছো? আমি তোমার কামে আসতেও তো পারি!
কী কামে আইবেন? বিয়া করবেন?
না। সেটা কী ভাবে সম্ভব! তুমি আমাকে কী কামে লাগাতে চাও বা আমার কাছে কী কাম চাও, সেইটা জানাতে পার।
লতিফা আর কিছু বলে না। নিরব হয়ে সজিবকে মনের মাঝে গেঁথে নিয়ে পরখ করতে থাকে। লোভে পড়ে ভাবে, ‘কী বলা যায়। লোকটার মনে হয় অনেক খ্যামতা আছে।’
‘কী ভাবছ?’ সজিব আবার প্রশ্ন করে।
তার আগে কন আপনে ক্যাডা? কী কাম করেন?
আমি ব্যাবসা করি। আমার কারখানা আছে।
আপনে তাইলে বড়লোক! কিন্তুক কুনু লাভ ওইবো না। আপনাগেরে মধ্যি ব্যাজাল বেশী। আপনাগেরে চোহে আমরা খানকি মাগী। ওসব ব্যাজালÑট্যাজাল বহুত দেহে আইচি। আমি যা আছি তাই থাহুম। আমার পরিচয় জানবার চান, জানেলন। কত মানষে জাইনে গ্যালো। আমি সবারেই কইয়া দেই। সত্য কতা কওনের আবার দোষ কী। তয় হোনেন, আমার বাড়ি ‘সাবারে’ আছিল। এহন আর হেহানে যাই না।
কেন যাও না?
আমারে মাতব্বর আর হুজুররা দোররা মারে তারাইছে। গিরামে যাবার দেয় না।
কেন? তোমাকে দোররা মারলো কেন?
হে অনেক কতা। কইলাম না আপনাগেরে বেতর ব্যাজাল আছে।
বলো না শুনি।
আমরা গরিব আছিলাম। পাঁচটা বোন আমরা। আমি সবার বড়ো। বাবায় বাড়ি বাড়ি কাম করতো। একবার আমাগো গেরামে এক বড়লোক ব্যাডার বাড়িত চুরি ওইলো। যে রাইতে হে ব্যাডার বাড়ি চুরি ওইলো আমার আব্বা তার আগের দিনত হে বাড়িতে কাম কইরা ছিল। তারপর তারা সন্দেহ কইরা আব্বার নামেত কেস দিল। সত্যি সত্যি ক’দিন পর পুলিশ আইসা আব্বারে দরে লইয়া গেল। হেই যে আব্বা গেল, আর ফিরে আইল না। ফিরে আইছিল লাশ অয়ে।
‘লাশ হয়ে মানে?’ সজিব প্রশ্ন করে।
‘আব্বাক জেলের মধ্যি কারা যেন মাইরে ফ্যালাই ছিল। পরে তারা কইলো, দম বন্দ অইয়া মরে গেছে। তার কুনু বিচার অইলো না।’ লতিফা এবার লম্বা করে একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে হালকা করে। তারপর আবার বলে, ‘তহন আমি গিরামের ইসকুলে পড়তে আছিলাম। কিলাস ফাইবত। আব্বা মইরে যাওয়ার পর হঠাৎ কইরা আমার এক গিরামের চাচা আমারে বুঝাইয়া ঢাকার আরেক বজ্জাত ব্যাডার লগে বিয়া দিয়া দিল। সাধীর পর অনেক সুখের ¯^পন দেহিছিলাম। হে ব্যাটারেও আমার পছন্দ অইছিলো। হুনছিলাম ঢাকাত কারখানায় চাকরি করে। অনেক টাহা বেতন পায়। গরিবের মাইয়া বইলা কত কীই যে বাবছিলাম গো বাইজান!
তারপর?
তারপর আমারে ঢাকা বাসায় লইয়া গেল। হেহানে যায়ে দেহি। ব্যাডার লগে অনেক ছোট-বড়ো মাইয়া মানুষ। আর রাইত ওইলে লগে কইরা পুর“ষ লইয়া আইত। সবাওে ডাইকা ডাইকা দেহাইত। হেরা আগে আমারে নজরে লইতো। এমন ব্যাগতিক অবস্থায় ফ্যালাইয়া আমার সব খাইয়া ফ্যালাইলো। পরে আরও ব্যাগতিক দেইখ্যা পালাইছিলাম। হে ব্যাডা আমারে আবার লইতে আইছিল। আমি আসল কতা গিরামেত সবারে কইলে ব্যাডারে ধুলাই দিয়া আমারে ছাড়াইয়া লইছিল। এরপর বাবার বাড়িতেই থাকলাম। আমি আরও খানিক ডাগর অইলে, আমাগো গিরামেরই সবুর নামের আরেক বিবাহিত ব্যাডা আমারে ভালোবাসলো। আমি তার ভালোবাসা অনেক বার ফিরাইয়া দিলাম। তার বউ, পুলাপানের কতা বুজাইলাম। কিন্তু হে কিছুতেই আমারে ছাড়লো না। বিয়ের কতা কইলো। জমি-জিরাত লেইহা দিবো কইলো। মুসমানের চারডা বিয়ে করা যায় বুঝাইলো। তারপরও আমি রাজি না অইলে, হে এক রাতে চুরি কইরা আমার ঘরেত আইলো। হে ভাবে আইতেই থাকলো। হেই থেইকা ঘটনাডা আ¯ে— অ¯ে— সকলে জাইনা গেল। তারপর তার বউ, পুলাপানরা টের পাইয়া আমার বিচার বসাইল। হে ব্যাডাকেও ক’ডা জুতা মারলো। আর আমারে ব্যাত মাইরা পাছা, ঠ্যাং ও শরীলডা ফুলাইয়া এক মাসের মতো গরে ফ্যালাইয়া দিল। আর আমার মারে কইলো, যদি তোমার ওই পাপী মাইয়া বাড়িতো রাহ তো, তোমরা কেউ বাড়ির বাহির হবার পারবা না। কল থেইক্যা পানি লিবার পারবা না, দোকান থেইক্যা সদায় লইতে পারবা না, কারও কাছে সাহয্য পাইবা না। কারও বাড়ি যাবার পারবা না। যে তোমাগো সাহায্য করবো তাদেরও বিচার করা ওইবো। এভাবে আমাগো ঠেকুনী দিল। আর তারা সবারে জানাইয়া দিয়া কইলো, যারা এই পাপিষ্টদেরক্যা গোপনে সাহয্য করবো তাদের আল­ায় গজব দিব।’ তারপর আমার মা আমারে কইলো, ‘তুই যেহানে পারিস চইলা যা। আমাগো বাঁচবার দে।’
লতিফার এরূপ বেদনাবহুল জীবনী শুনে সজিব অস¯ি—বোধ করে। দেশের গরিব মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হয়। ভাবে, ‘শুধু তো লতিফা নয়, এরূপ ল¶ ল¶ মেয়ে প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে এভাবে। বলি হচ্ছে বকাটেদের দ্বারা, প্রেমিকের দ্বারা, ¯^ামীর দ্বারা, বন্ধুর দ্বারা, মোল­াÑমাতব্বরদের ফতোয়ার দ্বারা। অথচ শেষ অপরাধী হয় শুধু মেয়েরা। গ্রাম-গঞ্জে শুধু মেয়েদেরকেই কঠোর বিচারের সম্মুখীন করা হয়। মেয়েরা সমাজে কখনও নিরাপদ ছিল না। আজও নেই। আর এজন্য কোনো পিতাÑমাতা তাদের কন্যা সš—ান নিয়ে সন্তুুষ্ট হতে পারে না। কোনো কালেও পারেনি কোনো পিতাÑমাতা। বর্বর যুগে তো সবলেরা অপে¶াকৃত দুর্বল শ্রেণীর পিতাÑমাতাদের নিকট থেকে তাদের মেয়েদেরকে জোর করে কেড়ে বিয়ে করতো। ধর্মের ভয় দেখিয়ে কিশোরীÑযুবতী কন্যা সš—ানদের দেবতার নামে রীতিমত ধর্ষণ করে হত্যা প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতো। সুন্দরী মেয়েদের মৃত দেহের উপরও ধর্ষণের অনুমতি দেয়া হতো সে সময়ে। এরকম ভীতি থেকে তৎসময়ে বুদ্ধিমান পিতাÑমাতারা তাদের কন্যা সš—ান জন্মালে বেশীরভাগ ¶েত্রে হত্যা করে ঝামেলা মুক্ত হতো। আজও বিজ্ঞানের বদৌলতে ভারত, চীন, মিয়ানমার, নেপাল সহ পশ্চিমার অনেক দেশে গর্ভে ভ্র“ণের খবর জেনে মেয়েভ্র“ণকে এ্যাবার্সন করা হচ্ছে।’
এভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়। সবার মাঝেই শুনশান নীরবতা। এরূপ অবস্থা থেকে বের“তে লতিফাই প্রশ্ন্ করে, ‘ভাইজান কিছু ভাবতেছেননি?’
হ্যাঁ লতা!
লতা না লতিফা।
ও আচ্ছা।
কী ভাবতাছেন?
তোমার ভাগ্যের কথা।
ভাগ্যেটাগ্যে ভলো কিছু থাহিলে তা মানষেই কাড়ে লইছে। তাছাড়া আমার এমন ওইবো ক্যা। আমার তো চেহারাÑছুরত কম আছিল না। হগলেই তো বিয়া করবার চাইতো। ওই বজ্জাইতের খপ্পরে না পড়লেই তো ভালা বিয়ে ওইতো। কন, ওইতো না ভাইজান? এসব বাইবে বাইবে কত কাদিছি। এ্যাহন আর কাদন আহে না।
হ্যাঁ! অবশ্যই হতো। তুমি এখনও তো ফিরে যেতে পার। আর কেঁদে তো কোনো লাভ নেই।
‘হ’ বাইজান! দ্যাশের বাড়িতো? হে আর যাইতে দিব না। আর যাইতে ভয়ও লাগে। কেউ বাইচে আছে কী-না। যায়েই বা খামু কী। প্যাট চলবো কেমনে?
দেশের বাড়ি না যাও। আমি যদি তোমার কাজের ব্যাবস্থা করে দেই?
ভাইজান কী যে কইতাছে। যেডা করি হেডাও তো কাম। দেহডারে তো খাটাইতে ওয়।
কিন্তুু একাম তো সমাজ ¯^ীকৃত নয়।
আমি আর সমাজ মানি না ভাইজান। পাপের কামও আমার কাছে কাম। তয় পরকালের কতা বাইবা মনডা খারাপ অয়। কী যে বিচার অইবো। অইলে অইবে, কী আর কর“ম!
কিšু‘ একাম করতেও তো শারিরীক সামর্থ লাগে। সে জন্য তো নিয়ম মতো খাওয়াÑদাওয়া, গোসল, ঘুমানোর মতো পরিবেশ লাগে। তোমার তো সেটা নেই।
এহন আমার এমনই ভালা লাগে। আগে ময়লাÑঅবর্জনায় শরীলডা ঘিনঘিন করতো। এহন সব সয়ে গেছে। গোসল না করলেও অসুবিদা লাগে না। যেহানে-হেহানে ঘুম আহে।
আচ্ছা! ঢাকাতে তুমি কতজনকে পার করে ছিলে ?
বাইজান যে কী কইতাছে। যে বিয়া কইরা ছিল হে আমার কাছেই আহে নাই। হে আমারে তো জোর কইরা ও পথে নামাইছিল। একজনের কাছেই রক্ত বের হয়। অনেক রক্ত। সহজে বন্দ অয় না। আমি দুর্বল অয়ে পড়ে থাহি। অনেক কদিন অষুদ খাইতে অয়। তারপর তো ভালা হইলে আরেকটা মাইয়া আমারে পালাইতে সাহয্য করে বাইর করে দেয়।
ঈশ্বরদী এসেছো কবে?
দিন দশেক ওইবো।
আমাদের এরকম আলাপচারিতার মাঝে সেই লিকলিকে রাগী মেয়েটা আবার চেঁচিয়ে উঠে বলে, ‘অইচে অইচে, অত কতার কাম নাইক্যা। ভদ্দর লোকের মতো চইলা যান। এ্যাহন বিহান ওইচে। ফষ্টিÑনষ্টি করার সময় নাই।’ মেয়েটার এর“প কথায় লতিফাও বিরক্ত হয়। সে তাকে ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করলে পাশের আরেকটা মেয়ে ভেংচি কেটে বলে, ‘ওরে আমার পিরিতির নাচুনীরে! কিছু কওনের জো নাই। রাত ভরে ঠাপ খায়েও সখ মেটে নাই।’ লতিফা এবার রেগে আরও কঠিন করে ধমক দিয়ে বলে, ‘দ্যাখ! ভালা অইতেছে না কইতাছি। সকলকেই এক পাল¬ায় ওজন করা ঠিক ওইবো না। দুনিয়াডায় ভালা মানুষ অহনও আছে।’
এবার তারা শাš— হয়। লতিফাও কিছু সময় চুপ থেকে লজ্জা মাখা চোখে আবার সজিবের দিকে তাকায়। সজিবের চোখÑমুখেও লজ্জাটে ভাব কাতুকুতু খেলতে থাকে। মাথাটাও হেট হয়ে আসে। সজিব আর দেরি করতে চায় না। সে চলে যেতে পা বাড়ায়। কিন্তু লতিফা তাকে ডাক দিয়ে থামিয়ে দেয়। সজিব ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, লতিফা দার“ণ উচ্ছ¡ল হয়ে হাসতে হাসতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নিকটে এসেই প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা! আপনি আমার লগে আইলেন খালি এই জন্যি? আমাগো এ্যাত জানার কাম কী। আমরা তো ভালা না। আমাগো তো কেউ দেকবার পারে না। পথের বেশ্যা কয়ে ছিঃ ছিঃ দেয়।
‘জানি। এ জন্যই তোমাদের জন্য আমার খারাপ লাগে।’ সজিব বলে।
ক্যান খারাপ লাগে বাইজান!
তোমাদের কোনো দোষ নেই জন্য।
‘কী কইতাছেন!। হাচা কইতাছেন?’ লতিফা সন্দেহের চোখে তাকায়।
লতিফা! আমি বোধহয় ঠিকই বলছি। তুমি বা তোমরা একটু ভেবে দেখ, তোমরা একদিন বিধাতার আর্শিবাদ হয়ে পৃথিবীতে মাÑবাবার কোলে এসেছিলে। সেদিন কী তোমাদের মাÑবাবা ভাবতে পেরেছিল যেÑআকাশের দিকে হাতÑপা ছুঁড়তে থাকা পুতুলের মতো আমাদের আদরের মেয়েটা বড়ো হয়ে একদিন দেশের কোনো শহর বা নগরে দেহ বিক্রি করে পেট চালাবে? নিশ্চয় কেউ ভাবে না সেটা। তাহলে তোমরা কেন এ পাপের পথে আসবে ?
লতিফাকে এবার পাথরের মূর্তির মতো মনে হয়। সে ওভাবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বেশ কিছু¶ণ পরে কিছু এটা ভেবে বলে, ‘ভাইজান! আমার মনে হয় আপনে ম্যালাকিছু জানেন। আপনি কনতো তাহলে সত্যি কী আমাগো কুনু দোষ নাই? একামে আমাগো কী কুনু পাপ ওইবো না?’
সজিব এবার শক্ত ভাবে ভাবনায় পড়ে। ভাবে, লতিফার এ প্রশ্নের কী জবাব দেবে সে। তবে কী সজিব বলতে পারে, ‘না লতাÑনা! তোমাদের কোনো পাপ হবে না। সমাজের কিছু মানুষ পাপী, তোমরা নও। তোমরা পাপী হলে তো পাপীর আর জায়গা থাকে না।’ বলতে বলতে সজিব মানি ব্যাগ থেকে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলে, ‘তোমাকে ভালোলেগেছে। কাজ করলে আসতে পার। আমার একটা কাপড় তৈরীর কারখানা আছে। অনেক মেয়ে কাজ করে।’
লতিফা কার্ডটায় চোখ বুলাতেই সজিব তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেতে থাকে। লতিফাও তার চলার পথের দিকটায় আরও কিছু¶ণ তাকিয়ে থাকে।
ক’দিন থেকে লতিফা ভাবনায় পড়ে। ভাবে, ‘লোকটা বালো হবে। দিলে দয়ামায়া আছে। তার ওহানে গেলে মনেঅয় বাঁইচে থাহনের মতো কাম পাওয়া যাইবো। এই পাপের পথ থেইকা বাঁচনও যাইবো।’
¯^প্ন আর ভাবনা থেকে নিজের ভেতরে পরিবর্তন ঘটে। গতর খাটাতে আর ভালোলাগে না। কেউ ডাকলেও যেতে মন চায় না। ব¯ি—র দালাল খয়বর চাচার কন্ট্রাকও সে একের পর এক না করে দিচ্ছে। গালকাটা কালুও দু’দিনের খুপড়ি ভাড়া না পেয়ে চুলের ঝুটি ধরে ঝাঁকিয়ে গেছে। খয়বর চাচা দেখেও কিছু বলে নি। অথচ আগে সবসময়ই খেয়াল করতো। কেউ কিছু বললে, তেড়ে আসত। প্রতিবাদ জানাত। আজকাল খয়বর চাচার মতো ব¯ি—র অনেকেই অচেনা হয়ে গেছে। কেউ আর মন খুলে কথাও বলতে চায় না। কালুকে তার ভয়। কালু রাজনীতি করে। সাক্সঘাতিক রকমের ক্যাডার। এব¯ি—র সবাইকে প্রতিটা খুপড়ির জন্য দিনপ্রতি কুড়ি টাকা করে ভাড়া দিতে হয় তাকে। কাউকে খাতির করে না। তারপরও সিদ্ধাšত নেয়, যাই ঘটুক। যে যা বলুক। মার“ক। সে আর খারাপ কাম করবে না। কারখানার কামেই যাবে। রাত পোহালেই যাবে।
লতিফা চাকুরিতে জয়েন করেছে। কারখানার মালিক সেই ভাইটা বিশেষ ভাবে নজরদারী করছে তাকে। ভালোভাবে কাপড় বুননো মেশিন চালানো শিখিয়ে দিয়েছে। মাইনেও দিচ্ছে। মাস শেষে বেতনও তুলছে। কেউ আর তাকে খারাপ কাজে ঈঙ্গিত করছে না। দাদাল খদ্দের এনে ডাকছেও না। চাকরির পরিবেশে থেকে আর দশজন মেয়ের মতো রঙচেহারায় সুন্দর হয়ে উঠেছে। কারখানার একটা ছেলেকে দেখে বিয়েও করেছে। একটি ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। ¯^ামী আদর করে। সুখের সংসার গড়ে তুলেছে। ফুটটে ফুটটে একটি কন্যা সšতানের জননীও হযেছে। কচিমুখে মা মা বলে ডাকছে মেয়েটা। মেয়েটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড়ো করে তুলবে সে ¯^প্নও দেখছে। ¯^ামীর সাথে দেশের বাড়ি সাভার গিয়ে বেড়িয়ে মা-বোনদের খোঁজ-খবর নিয়েও এসেছে। তার পিঠে জন্ম নেয়া বোনটা সšতান হতে মারা গিয়েছে জেনে কষ্ট পেয়েছে। তার জন্য কেঁদেও-ছে অনেক। মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়েছে আনন্দিত হয়েছে। আরও বলেছে, ‘মা! তুমি চিšতা করও না। আমি মাসে মাসে কিছু কিছু টাকা পাঠাব। আরও শাšিত পেয়েছে গ্রামে বুক ফুলিয়ে সবার কাছে ¯^ামীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে। গ্রামের চেনা-জানা অনেকে তাদেরকে আদর-সম্মানর করেছে।’
হঠাৎ গভীর রাতে কার যেন হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায়। লতিফা বুঝতে পারে, তার দেহের উপর একজন মানুষের হাত হলেও সংখ্যায় কয়েকজন। তারা সবাই খুপড়ির মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পেরে তাকে ঘিরে মাথা নূয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন তার দেহ মর্দন করছে। লতা শুয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে যায়। কিন্তু তাকে জোর করে শুয়ে দেওয়া হয়। ধ¯তাধ¯িত শুর“ হয়। অনেক চেষ্টা করেও সে আর উঠতে পারে না। ছাড়াতেও পারে না তাদের। চিৎকার দিতে গেলেও তার মুখ চেপে ধরা হয়। তারপর এক এক করে তার দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে তারা। একজন মুখ ধরেই থাকে। সর্বশেষ জন ঝাঁপিয়ে পড়ে দেখে লতিফার দেহটা শক্ত আর কঠিন শীতল হয়ে উঠেছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন কবে এই স্মাজের পরিবর্তন আসবে কে জানে। ভাল লিখেছেন। শুভেচ্ছা রইল।
ভালো লাগেনি ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
মিলন বনিক sundor golpo...anek boro...tobe golper kahini bastobota chuye gelo...valo laglo.....
ভালো লাগেনি ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ইব্রাহীম রাসেল -ভালো লাগলো বাস্তবতার গল্প-

১৯ আগষ্ট - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪