১৩ই ফেব্রুয়ারী,
পহেলা ফাল্গুন,
আজ সানজির জন্মদিন,
সকালে বসন্ত বরণের আমেজ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যাবে জন্মদিনের উৎসব । তার মা সাথী সানজিকে কিনে দিয়েছেন ফাগুণের বাসন্তী রঙা নতুন শাড়ী, বাবার আইনুদ্দিনের হাত দিয়ে আসবে জন্মদিনের প্রথম উপহার, প্রতিবছরই এমনই হয়, হয়ে আসছে । এই উপহার দুটোতে বাবা মা দুজনের ভালোবাসাই মিলেমিশে একাকার থাকে বলে এগুলো অন্যসব উপহারের থেকে আলাদা হয়ে বিশেষ হয়ে যায় ।
সানজির এবারের জন্মদিনে আলাদা একটি মাত্রা যোগ হয়েছে, এই জন্মদিনে আঠারোয় পা দিচ্ছে সে । তারও আজ অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছে । এর একমাত্র কারণ বয়সের ছাড়পত্রে স্বাধীনতা পাওয়া নয় । আগামীকাল ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ভালোবাসা দিবস । জন্মদিনের মত এবারের ভালোবাসা দিবসেও গতবারের সাথে একটি বড় পার্থক্য আছে, গত বছর বসন্ত ছিল তার জীবনে ক্যালেন্ডারের একটি হিসাব মাত্র, ভালোবাসা ছিল পরিবার ও বন্ধু মহলের ভেতর সীমাবদ্ধ, এবার আর তা নয়, এবার তার জীবনে সত্যি সত্যি ফাগুণের ছোঁয়া লেগেছে, উঠেছে ভালোবাসার ঢেউ, এবার তার হৃদয় ছুঁয়েছে কেউ । এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত সানজির ছোট জীবনের সব কিছু ছিল খোলামেলা, এখন সেখানে যোগ হয়েছে গোপনীয়তা, এই অনুভব কাউকে বোঝাবার নয়, এই গোপনীয়তার নাম মৃণাল, মৃণাল সচদেব । সানজি র এই গোপন নিবেদনের কথা কেউ জানে না, কেউ না, এমনকি যাকে ঘিরে এই স্বপ্ন বাতায়ন, সেই মৃণালও নয় ।
সানজি দেখতে ভালো, শুধু ভালো না, বেশ ভালো, কিছু মেয়ে আছে যাদের দেখলেই দেবী দেবী বলে মনে হয়, মনে হয় এরা কিভাবে যেন পথভুলে মর্ত্যলোকে চলে এসেছে, সানজি তাদেরই একজন, তরুণ থেকে বৃদ্ধ অনেকের চোখের আয়নায় তার এই মহীয়সী চেহারা দেখে দেখে সে নিজেও এটা জানে, সুন্দরী মেয়েরা জন্মগতভাবেই পুরুষের এই খাই খাই ব্যাপারগুলো বুঝতে পারে, পাত্তা না দিতেও শিখে যায় খুব সহজেই, খুব যারা সুন্দরী তারা মাঝে মাঝে অবশ্য ভুল করে সত্যিকার প্রেমিককেও সাধারণের ভীরে ফেলে দেয় । এতোদিন কাউকে সানজির মনে ধরেনি, কাউকে দেখে মনে হয়নি এই সেই বিশেষ মানুষটি, আর দশজন থেকে আলাদা, যাকে কিছুতেই ফেরানো যায় না, কোন কিছুর বিনিময়েই যাকে দুঃখ দেয়া যায় না, যার জন্য সবকিছু করা যায়, সবকিছু । নিজের পাশে সে নিষেধের একটি দেয়াল তৈরি করে নিয়েছিল, সত্যিকারের দেবী মেয়েরা এই দেয়াল দিয়ে নিজেকে চারপাশের অন্ধকার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে, ভালোবাসার হাতছানি পাবার আগ পর্যন্ত তারা সতীচ্ছদের মত এই দেয়ালটিও রক্ষা করে চলে। তার এই সুরক্ষা দেয়ালটি নিজের অজান্তে হঠাৎ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছে মৃণাল, অথচ তাকে বোঝা যায় না, সে ধরা দেয় না, কিছুতেই তাকে আর কারো সাথে মেলানো যায় না। মাঝে মাঝে মৃণালকে সানজি র খুব কাছের মানুষ মনে হয় আবার কখনো কখনো অনেক দুরের । এতো সুন্দর সানজি তবু মৃণাল কখনো সানজি র দিকে অন্য ভাবে তাকায় নি, কখনো রুচিতে বাধে এমন কোন কথা বা আচরণ করেনি, আবার কখনো জোর করে দূরে সরেও যায়নি । সে কাছে আসেনা, আবার দুরেও চলে যায় না, নিজের গণ্ডীতে সে জ্বলতে থাকে কালপুরুষের মত । মৃণাল যে ধনীর দুলাল, খুব বাকপটু, মেধাবী বা চটুল ধরণের ছেলে তাও না, চুপচাপ, একটু গম্ভীর, সুদর্শন তাকে বলা যায়, তবে নায়কমার্কা লেডি কিলার চেহারা তার নয়, মৃণালের চেয়ে অনেক সুন্দর ছেলেকে সানজি খুব সহজেই হেসেখেলা এড়িয়ে গেছে বেশ কয়েকবার, যারা ধরতে চেয়েছিল বা ধরা দিতে চেয়েছিল । মৃণালের সবচেয়ে সুন্দর যে জিনিসটি তা হল হাসি, সে খুব কম হাসে, তবে যখন হাসে বাদবাকি সব ঘাটতি পুষিয়ে যায়, সে হয়ে যায় গ্রীক দেবতা অ্যাপোলো । সামাজিক পরিচয়ে মৃণাল সানজির বড় ভাই রাকিবের বন্ধু, খুব কাছের নয়, আবার দুরেরও নয়, ধর্ম আলাদা, সমাজ আলাদা তবু সানজি মৃণালের কাছেই মনের অজান্তে খুলে দিলো তার নিজ ভুবনের নিভৃত দুয়ার । এরই নাম হয়তো অসম ভালোবাসা । তবুও সানজি মরে গেলেও কোনদিন মৃণালকে তার ভালোবাসার কথা বলতে পারবে না, পরিবার বা সমাজ তাদের ভালোবাসা মেনে নেবে না, সে জানে মৃণালও তাকে কোনদিন ভালোবাসার কথা বলবে না, সে যে সানজিকে কি চোখে দেখে সেটাও এক বিরাট হেঁয়ালি বলেই মনে হয় । সানজি জানে মৃণালকে সে কোনদিন নিজের করে পাবে না, তাই বলে তো মিথ্যে নয় এ ভালোবাসা । মৃণালকে সে দেখছে এক বছবের কিছু কম সময় ধরে, সময়ের দৈর্ঘ্যে তার এই অনুভবকে কখনো ধরা যাবে না, এই কষ্টের বিধিলিপি সে মেনে নিয়েছে, তাতে ভালোবাসা একটুও না কমে বরং বেড়েছে । সানজি জানে এ বয়সের বিভ্রম নয়, সময়ের মোহ নয়, এক জীবনে এই ভালোবাসা নিঃশেষিত হবার নয়, ধরা অধরার সীমান্তে অন্য এক মাত্রা পেয়েছে তার ভালোবাসা । সানজি অনেক ভেবেছে, সে বুঝেছে এই ভালোবাসা পাওয়া না পাওয়ার দেহজ সঙ্কীর্ণতা ছেড়ে অনেক উপরে । সে জানে তার এই ভালোবাসার মাত্রা সময়ের সাথে বাড়তেই থাকবে, মৃণালের কাছাকাছি থাকলে সে হয়তো একদিন দুর্বল হয়ে পড়বে, ভেঙে যাবে । তাই তাকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে, মৃণালের থেকে অনেক দূরে, চেনা পৃথিবী থেকে অন্যলোকে ।
সুন্দরী মেয়েরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বুদ্ধিমতী হয় না, যদিবা বুদ্ধি থাকে তবে পড়াশোনায় তেমন একটা ভালো হয় না, তাদের অনেকেরই জেনে যায় কোন এক সুদর্শন বোকা রাজপুত্র গলদঘর্ম পরিশ্রমে নিজেকে তৈরি করছে, একদিন পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় করে তাকে সে উড়িয়ে নিয়ে যাবে স্বপ্নলোকে, এই জানাটা অনেক ক্ষেত্রেই সত্যি, কাজেই তার খুব বেশী কষ্ট করার প্রয়োজন নেই । সানজি এই দলের কেউ নয়, সে পড়াশোনাও বরাবর ভালো, এই অল্প বয়সে সে অনেক কিছুই বোঝে । অনেক ভেবে সে সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজেকে পড়াশোনায় উজাড় করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলো, সময়ের সাথে সাথে ফল মিলল তার এই প্রয়াসের, তার এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল বেশ ভালো ছিল, স্থানীয় স্কুলে মেয়েদের ভেতর সে সবচেয়ে ভালো ফল করেছিল, বছর ঘুরতেই এইস সি তে মানবিক বিভাগ থেকে সে জাতীয় মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ফেললো । ভালোবাসে পাওয়া নীরব কষ্ট তার প্রেরনার উৎস হল, ভাঙনের হাতিয়ার নয় । আর মেঘ না চাইতেই জলের মত ভালো ফলাফলের জন্য সে মেয়েদের কমনওয়েলথ স্কলারশিপও পেয়ে গেলো কানাডায় পড়ার জন্য । সানজি জানে ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে এখন দূরে সরে যেতে হবে, মৃণালের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে । এতো কম বয়সে মেয়ে একা একা বিদেশ বিভুই চলে যাবে ভেবে মা বাবা প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ করল । পরে খুঁজে পেতে তার মায়ের এক দূর সম্পর্কের কানাডা প্রবাসী বোনের খোঁজ পাওয়া গেলো, তার জিম্মায় সানজিকে সপে দিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা নীরবে চোখের জল মুছলেন । বিদায়ের দিন ভাইয়ের সাথে কিভাবে যেন মৃণালও এসেছিল বিমান বন্দরে, সানজি তার দিকে একবারও চোখ তুলে তাকাতে পারেনি, বুক ভেঙে যাচ্ছিল নীরব কান্নায়, তবুও মৃণাল বরাবরের মত চুপচাপ, যেন সে চেনা ভুবনের কেউ নয়, কিছুতেই তার মন বোঝা যায় না । সবাই বিদায় জানিয়ে হাত নাড়ছিল, শুধু মৃণাল বাদ, সে সানজি নামের পরীর মত মেয়েটির স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝে নির্বিকার দাড়িয়ে ছিল হিমালয়ের মত, ঝাপসা চোখে এই প্রিয় মানুষদের ভীরের দিকে তাকিয়ে সানজি সেদিন শুধু মৃণালের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলেছিল, “তোমায় ভালোবেসে যাবো চিরদিন কিন্তু কোনদিন তোমার হব না” ।