পৃথিবীর যেকোন মানুষকেই যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে – ‘আপনি কি আবার আপনার শৈশবে ফিরে যেতে চান’? আমার ধারণা, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই এক বাক্যে বলবে ‘হ্যাঁ’। আর আমি হচ্ছি সেই হাতে গোনা কয়েকজনের দলে। সাধারণত শৈশব বলতেই যে খন্ড খন্ড আনন্দঘন মুহূর্তের ঊজ্জ্বল ঝলক হৃদয়ের মাঝে উকি দেয়, আমার ক্ষেত্রে তা হয় না। শৈশব বলতে আমি একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে বুঝি; যে সময়টাতে আমি আমার মা-বাবা ও ভাই এই তিনজন মানুষ ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব খুঁজে পাই না। শৈশব বলতেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একরাশ নিকশ কালো অন্ধকার, আর সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মাঝে একটি ছোট্ট বালিকার বিষণ্ন মনে ঘোরাঘুরি করার দৃশ্য, যাকে চরম একাকীত্ব প্রতিনিয়ত গ্রাস করে চলছে। সেই ছোট্ট বালিকাটি আমি। আমার শৈশবের আমি। আমার এই একাকীত্বের কারণ ছিল প্রবাসে জীবন-যাপন। আমার জন্মের প্রায় বছরখানেক আগে আম্মা আমার বড় ভাই ত্বোহাকে নিয়ে লিবিয়ায় আসেন। আব্বার চাকরির সুবাদেই এই স্থানান্তর। আর এখানেই আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। এটি লিবিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর ‘মিসরাতা’। তখনও সেখানে বাংলাদেশীদের সংখ্যা খুবই কম। হাতে গোনা যে কয়জন ছিল, তারাও এতো দূরে দূরে থাকতো যে বছরে দুই-একবারের বেশি দেখা করা সম্ভব হতো না। আশেপাশে লিবিয়ান – ফিলিস্তিনি – সুদানীসহ বিভিন্ন এ্যারাবিয়ান প্রতিবেশী থাকলেও ভাষা না জানার কারণে তাদের সাথে সেরকম পারিবারিক সখ্যতা গড়ে ওঠতে পারেনি। তবুও দেখা যেত আম্মু প্রায় বিকেলেই সময় কাটানোর জন্য আমাকে আর ভাইয়াকে নিয়ে তাদের বাসায় যেত এবং বোবার মতো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে চলে আসতো। এটাও সব সময় সম্ভব হয়ে উঠতো না। চারদিক এতোই নীরব-নির্জন ছিল যে দরজা খোলার সাহস পর্যন্ত হত না আমাদের। তাছাড়া ঘরের ভেতরেও ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতাম আমরা। এতো বিশাল বাড়িতে আমরা মোটে চারটি মানুষ। তার ওপর আব্বু তাঁর নিজের কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সারাদিন। সেই সকাল বেলায় যে বেরিয়ে যেতো, ফিরতে ফিরতে রাত কখনো এগারোটা কখনো বা বারোটা হতো। সময় কাটানো-টা আমাদের জন্য একটা মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছিল। কিছুই করার ছিল না আমাদের। একেবারে কিছুই না। টিভিতে শুধুমাত্র একটা চ্যানেলই ছিল তখন; সরকারি চ্যানেল ‘আল-জামাহেরিয়া’। সেখানে সারাদিন একটানা টক-শো চলতো, আর তার ফাকে ফাকে সংবাদ। সংবাদের তো প্রতিদিনই এক বিষয় – তাদের মহান নেতা গাদ্দাফী কোথায় গিয়েছে, কী করেছে, কী বলেছে ইত্যাদি ইত্যাদি.....। একারণেই বোধহয় টিভি দেখতে ভীষণ অনীহা ছিল। খেলাধুলার মধ্যে একটা খেলাই খেলতাম আমি আর ভাইয়া। দুই খাটের উপর দুইটি মশারি টানিয়ে দুইটি বাড়ি বানাতাম আমরা। আমি হতাম বুচির মা আর ভাইয়া হতো কুচির মা। আমরা একজন আরেকজনের বাসায় যেতাম, মিছে-মিছি খাবার দাবার খেতাম। সেটাতেই প্রচুর আনন্দ ছিল। আমাদের তো এভাবে করেও কিছুটা সময় কাটতো। আম্মুর সে উপায়ও ছিল না। কোনরকমে রান্নার কাজটা সেরে এসেই বসে বসে কাঁদতো। আলাদা আলাদা ভাবে কখনো নানাভাইয়ের জন্যে, কখনো নানুর জন্যে, কখনো মামা, কখনো খালা আবার কখনো মামাতো ভাই-বোনদের জন্যে কাঁদতো। দিনের বেশির ভাগ সময়ই আম্মু এদের কথা মনে করে কেঁদে কেঁদে কাটাতো। আমরাও কিছু না বুঝেই সাথে সাথে কাঁদতাম। এতো কিছুর পরেও আম্মু আমাদেরকে খুশি রাখার জন্য – ব্যস্ত রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যেতো। কিন্তু শৈশবের মতো উচ্ছ্বাসময় রঙিন দিনগুলোর একাকীত্ব কি কোন কিছু দিয়েই পূরণ করা যায়! শৈশবের দিনগুলো পেরিয়ে যাওয়ার পর অবশ্য ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ করি। ততোদিনে আমরা মোটামুটি আরবী শিখে ফেলেছি। এর ফলে প্রতিবেশীদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। বিভিন্ন কোম্পানীতে কর্মরত ব্যাচেলররা তাদের ফ্যামিলি আনা শুরু করে। পরিবেশটা জমজমাট হয়ে উঠে। আব্বুও চাকরি পরিবর্তন করে বাসায় আরেকটু সময় দেয়ার সুযোগ পায়। এক কথায় আমাদের অন্ধকারময় জীবনে আলো ফুটতে শুরু করে। সেই থেকে শুরু। আজও চারপাশে আলোর তীব্র ঝলক ঊপলব্ধি করি। কিন্তু বাস্তবের এ আলো আমায় মোটেও টানে না। বুঝতে পারি শৈশবের সেই করুণ একাকীত্ব আমাকে ভীষণভাবে কল্পনাপ্রবণ করে তুলেছে। তাই আজও আমি আলোর হাতছানিকে খুব সহজেই উপেক্ষা করে কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াই। বেড়াতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। এতো কিছুর মাঝেও আজও আমি আমার একাকীত্ব অনুভব করি। আর ভাবি, যে শৈশব আমার মাঝে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে এই একাকীত্বের বীজ বুনে দিয়েছে, সেই নিকষ কালো অন্ধকারময় গ্লানিমাখা শৈশবে আর কখনোই ফিরে যাব না। যেতে চাইবো না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক
খেলাধুলার মধ্যে একটা খেলাই খেলতাম আমি আর ভাইয়া। দুই খাটের উপর দুইটি মশারি টানিয়ে দুইটি বাড়ি বানাতাম আমরা। আমি হতাম বুচির মা আর ভাইয়া হতো কুচির মা। আমরা একজন আরেকজনের বাসায় যেতাম, মিছে-মিছি খাবার দাবার খেতাম। সেটাতেই প্রচুর আনন্দ ছিল। - শৈশবের ভিন্ন রকম অনুভুতি...সুন্দর গল্প...ভালো লাগলো....
জায়েদ রশীদ
জানি না, প্রবাসে রাজনৈতিক উষ্ণতা আপনার শৈশবের বেদনাকে ম্লান করতে পেরেছে কিনা; হয়তো সেই উষ্ণ বর্ণনা থাকবে পরবর্তী কোন সংখ্যায়... অপেক্ষায় রইলাম।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন
মাতৃভুমি হচ্ছে আরেক মা- সে কাউকেই আবহেলা করেনা। আর তাইতো বিদেশ সবার জন্যই কষ্টকর। আমাদের শিশুরা যেন আপনারমত এমন কষ্টের মাঝে না পড়ে। লেখা ভাল লাগল। শুভেচ্ছা রইল।
মোঃ সাইফুল্লাহ
খুবই সুন্দর। আমার মা গলব্লাডারে ক্যান্সারে আক্রান্ত। আল্লাহর কাছে আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন ও আমার মায়ের শাররিক অসুস্থতার বিষটি মানবিক দিক দিয়ে বিচার করে যে যতটুকু পারেন আর্থিক সাহায্য করবেন । সাহায্য পাঠানোর ঠিকানা : মোঃ সায়ফুল্লাহ ,সঞ্চয়ী হিসাব নং -১০১৭৪০৪, সোনালী ব্যাংক,মাগুরা শাখা মাগুরা।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।