১৯৯৭ সালের ঘটনা। ঠাকুরগাও শহরের ঠিক বাহির পার্শ্বের মহাসড়কটি যেন শহর আর গ্রামের মধ্যে পার্থক্য একে দিয়েছে। এর একপার্শ্বে ঠাকুরগাও শহর আর অন্য পার্শ্বে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। এখানকার লোকজন দিনাজপুর বা রংপুর যেতে এই মহাসড়কে এসে অপেক্ষা করে। বেশীরভাগ যাত্রীর ভরসা পঞ্চগড় হতে ছেড়ে আসা বিআরটিসি বাস। বাসটি এলে সেখানে উঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে সকলে। মোটামুটি একটা খন্ডযুদ্ধ। আর কে কত দক্ষতার সাথে জানালা দিয়ে সীট দখল আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে তার একটা দেখার মতো প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়। ঈদ বা অন্য কোন উৎসব এলেতো কোন কথাই নেই। কাল ঈদ। জালাল বাড়ি যাচ্ছে ঈদ করার উদ্দেশ্যে। সে ঠাকুরগাও এ একটা ছোটখাট চাকুরী করে। তাই বাস ধরতে টিকিট কেটে অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন আসবে সেই বহুল কাঙ্খিত বিআরটিসি বাসটি। সেই সঙ্গে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। যেভাবেই হোক বাসে উঠতেই হবে। নইলে এখানেই বাবা-মা ছেড়ে একা একা ঈদ করতে হবে। তাই যুদ্ধের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে কিছুক্ষণ পরপর বাসের কাউন্টারে গিয়ে খোজ নিচ্ছে আর কতদূরে আছে বাসটি। সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে সৈয়দপুরের এক যাত্রী পাওয়া গিয়েছে। দুজনের মধ্যে আলাপ হয়ে আছে একজন কোনরকমে ঠেলে ঠুলে উঠতে পারলে আর এক জনের জন্য জায়গা রাখবে। এরপর অপেক্ষা চলমান। দূরে দৃষ্টি রাখতে রাখতে একজন বলে উঠল, ঐযে বাস মনে হয় চলে এসেছে। সাথে সাথে সকল যাত্রী যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। আমাদের জালাল তার সহযোদ্ধাকে নিয়ে পজিশন নিয়ে নিল । বাস এল। শুরু হয়ে গেল দৌড়াদৌড়ি। জানালা দখলের মহারণ। কেউ মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে। কেউ পা ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনেকে পুরোপুরি ঢুকাতে না পেরে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। যাক অনেক চেষ্টার পর জালাল বাসে উঠতে পারল। উঠেই তার সহযোদ্ধার রেখে দেয়া সীটে আসন গ্রহন করল। এত পরিশ্রমের পর ক্লান্তিতে কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে বাস চলে এল রংপুরে। সে ঘুমিয়েই আছে। হেল্পার এসে অনেক ডাকাডাকির পর তার ঘুম ভাংলো। এরপর শুরু হলো তার আর এক অভিযান। রিকশায় উঠে পীরগাছা বাসস্ট্যান্ড এ গেল সে। শেষ বাস সন্ধ্যা ৭.৩০ এ। যদিও এই রুটের বাস কবে সঠিক সময়ে ছেড়েছে তার কোন রেকর্ড কারো কাছেই নেই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ১ অথবা ১.৩০ ঘন্টার পর বাস ছেড়েছে সেটিও শর্ত সাপেক্ষে। বাসের কোন জায়গায় দাড়ানো বা বসার জায়গা না থাকলে তবেই সেটি ছেড়ে যাবে। অন্যথায় নয়। কাজেই মোটামুটি ৪-৫ ঘন্টা সময় হাতে পেয়েছে জালাল। তাই ভাবল একটু মার্কেট গুলোয় ঘোরাঘুরি করে দেখা যাক। টিকিট কেটে নিয়ে সে চলে গেল সুপার মার্কেট, রংপুরের সবচেয়ে বড় মার্কেটে। সেখানে বাবা মা আর দাদীর জন্য কেনাকাটা করে উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষন ঘুরে বেড়ালো। এরমধ্যে মার্কেটের ২য় তলায় উঠতে গিয়ে হঠাৎ করে কে একজন যেন তার হাত টেনে ধরল। পিছনে তাকিয়ে দেখে পাপিয়া। তার কলেজ জীবনের বান্ধবী। একসাথে কত স্মৃতি। কারমাইকেল কলেজের ফার্স্ট বিল্ডিং, ওসমানীর পুকুর পাড় আর জি এল হোস্টেলের ৩২ নম্বর রুম। কত আড্ডা, কত কথা, কত কিছু। আজ দীর্ঘ ১০ বছর পর তার সাথে দেখা। কিরে কেমন আছিস? বলল সে। আছি, চলে যাচ্ছে দিন। কোথায় আছিস? কি করছিস? ঠাকুরগায়ে একটা ছোটখাট কোম্পানীতে চাকুরী করছি। বিয়ে শাদী করেছিস? বাচ্চা কয়টা? বউ কি করে? শ্বশুরবাড়ি কোথায়? ব্রেক দে। এত প্রশ্ন একসাথে হজম করার মতো ক্ষমতা আমার থাকলে এগুলোর উত্তর তুই আগে জানতিস। নাকি মিথ্যা বললাম? আচ্ছা বুঝলাম।অনেক দিন পরে দেখা তোর হাতে কি সময় আছে? থাকলে চল কোথাও গিয়ে একটু বসি। সময় আছে কিছুক্ষন। আমার বাস ছাড়বে সন্ধ্যা ৭.০০টার পরে। চল কোথায় যাবি? সুরভি উদ্যানে। সেই শেষ করে বসেছিলাম মনে আছে? না মনে নেই। তোরতো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। যাক চল ওখানেই যাওয়া যাক। চল। এরপর রিকশা করে দুজনে সুরভি উদ্যানে গিয়ে বেঞ্চে বসে পড়ল। কত বদলে গিয়েছে জায়গাটা। তাই না। আমরা যখন আসতাম কত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ছিল। আর এখন গাছের তলায় জোড়ায় জোড়ায় বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বসে প্রেম করছে। কি দুনিয়া এল। আচ্ছা বাদ দে। আমি একাই বকবক করে যাচ্চি। এবার তাহলে আমার আগের প্রশ্নগুলোর এক এক করে জবাব দে। পারিবারিক জীবন নিয়ে বল। বলে থামল পাপিয়া। পরিবার মোট ৫জনের। এমা! এরই মধ্যে ৩টা বাচ্চা। তুই এখনও বদলাসনিরে। সবাই কি একক পরিবাবতন্ত্রে বিশ্বাসী? যৌথ পরিবারে থাকতে পারবিনা বলেইতো আজ আমার জীবনে তুই নেই। আমি, আমার বাবা,মা, দাদী আর ছোট চাচা এই আমার পরিবার। তার মানে কি? বলতে গিয়ে থেমে গেল পাপিয়ার কন্ঠ। একটুখানি আফশোস নিয়ে আবার বলল, আর খোচা দিসনা। জীবনে ঐ একবারই সুযোগ এসেছিল সুখী হবার। কিন্তু, নিজের হাতে গলা টিপে হত্যা করেছি সেই সুযোগ। সেই দিন যদি তোর প্রস্তাবে রাজী হয়ে যেতাম। তাহলে তাহলে কি হতো? কথা কেড়ে নেয় জালাল। তাহলে আজ আমার মতো একটা অভাবী লোকের সংসারে এসে মোটেই সুখে থাকতে পারতিনা। কেন? জীবনে কি টাকাটাই সব? এতদিনে বুঝেছি যে জীবনে ভালবাসা নেই। আদর সোহাগ স্নেহ নেই সেটা কোন জীবন নয়। টাকা দিয়ে সাময়িক সুখ পাওয়া যায় কিন্তু চিরস্থায়ী শান্তি পাওয়া যায়না। হুম। সবাই সেটা এত দেরীতে বুঝে যে আর কিছুই করার থাকেনা। আমার বউও বুঝলোনা। চলে গেল। তার মনের আব্দার পূরণ করতে পারছিলামনা। মানে। তুই বিয়ে করেছিলি? বিশেষ এক ঘটনা মনে করে অবাক হয় পাপিয়া। হ্যা। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারিনি। বাবা মা জেদ করে আমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তো বউ কি শুধু অভাবের কারণে চলে গিয়েছে নাকি অন্য কিছু? মানে যেটা বুঝাতে চাইছিস সেরকম কিছুনা। আচ্ছা থাকনা সেসব। অনেকদিন পরে দেখা তোর কথা কিছু বল। আমার আর কি। বুড়ো হাবড়া স্বামী । রোজগার করে দুহাতে টাকা এনে দিচ্ছে আর সমানতালে খরচ করে যাচ্ছি। কোন রাতে সে ফিরে কোন রাতে ফিরেনা। শুনেছি নতুন মালের সন্ধান পেয়েছে। সেখানে নিয়মিত সময় দিতে হয়। আমাতে আর পোষাচ্ছেনা। কি বলিস। ভয়ংকর সব কথাবার্তা। এসবও হয় নাকি? নিজের বউ থাকতে ? হু, তুই এখনও সেকেলে রয়ে গিয়েছিস। তথাকথিত অভিজাত ফ্যামিলিগুলোতে এর থেকেও বেশী কিছু হয়। ছেলেমেয়ে কয়জন? সেটা আর এক ইতিহাস। বিয়ের ৯ বছর হয়ে গেল ছেলেমেয়ের মুখ দেখতে পারলামনা। কত কিছু করলাম। আজমীর শরীফ থেকে শুরু করে শাহজালালের মাজার আর বৈদ্য কবিরাজতো আছেই। কেউ সমাধান দিতে পারলোনা। শেষে ডাক্তার এর শরনাপন্ন হয়ে জানা গেল আমার স্বামীধনের সে ক্ষমতাটুকুও নেই। পোড়া কপাল। কারো সর্বনাশ আর কারো পৌষমাস। সে এই আনন্দে মহাসুখে এর কাছে ওর কাছে যাচ্ছে। আর আমি সবসময় শুন্যতাকে লালন করে চলেছি। বুঝলি জালাল এই বুকটা চিরে যদি দেখাতে পারতাম তাহলে বুঝা যেত ভিতরে কত বড় মহাসমুদ্র বিরাজ করছে। সেখানে বড় বড় ঢেউ ছাড়া আর কিছু নেই। নেই কোন তীর, নেই কোন জনমানুষের ভীড়। এই সব কষ্টের কথা কারো সংগে শেয়ার করব সে উপায়টাও নেই। আজ তোকে পেয়ে পুরনো স্মৃতি জেগে উঠায় মনটা অনেক হালকা হয়ে গেল। হুম। রোজা আছিস? হ্যা, ঐ একটা কাজ নিয়মিত করে যাচ্ছি। ধর্মকর্ম। দেখি যদি আল্লাহপাক মুখ তুলে চান। তোর স্বামীরতো অনেক ইনকাম। এখন দেশের বাহিরে এ ব্যাপারে অনেক কিছুই হচ্ছে। তোরা চাইলে টেস্টটিউব বেবী নিতে পারিস। সেটা নিয়ে প্রায়ই তার সংগে ঝগড়াঝাটি লেগেই আছে। সে যে মজা পেয়েছে তাতে বাচ্চা কাচ্চার ঝামেলার জড়ানোর আর কোন ইচ্ছে নাকি তার নেই। জালাল তার হাত ঘড়িতে দেখলো ৫.০০টা বেজে গিয়েছে। জালালের ঘড়ি দেখা দেখে পাপিয়া মনে করল ওর মনে হয় অন্য কোন কাজ আছে। অথবা সে বিরক্ত হচ্ছে ওর কথায়। হায়রে সময়। মানুষকে কতটা বদলে দেয়। একসময় এমনও গিয়েছে ওর মুখের কথা শোনার জন্য জালাল ঘন্টার পর ঘন্টা লেডিস হলের সামনে দাড়িয়ে থাকত। তখন কত তাকে ঘুরিয়েছে। কত নতুন বাহানা বের করে ওকে নাকানি চুবানি খাইয়েছে। ছেলেটা একটু বেশীই সহজ সরল ছিল। সে নিজে ২টার সময় বের হওয়ার কথা বলে বের হয়েছে ৪টায়। তারপর একটু মিথ্যে অভিনয় করে উল্টো তার উপর রাগ ঝেড়েছে। নিরবে সব সয়েছে জালাল। পড়াশুনা আর ওর পিছনে সময় দেয়া ছাড়া আর কারো সংগে মিশতনা সে। এ কারণে ওর হোস্টেলের লোকজন প্রায়শঃই পাপিয়ার কাছে নালিশ জানাতো। আর বলতো ওকে মানুষ করে গড়ে তুলতে। সে চেষ্টা পাপিয়া ঠিকমতই করে যাচ্ছিল। সবই ঠিক ছিল । কিন্তু সমস্যাটা বাধল তখনি যখন সেই বোকা সোকা, সহজ সরল ছেলেটা একদিন ওকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলল। পড়াশোনা শেষ হয়নি। আয় রোজগার নেই। এই অবস্থায় কে ওকে বিয়ে করবে। তারপরেও ভেবেছিল পাপিয়া। ওকে সময় দিতে চেয়েছিল একটা চাকুরী বাকুরী হওয়া পযন্ত। কিন্তু ভ্যাজালটা লাগল যখন ও বলল বিয়ের পর ওর বাবা মায়ের সংগে থাকতে হবে। আর সে চাকুরী করতে পারবেনা। যৌথ পরিবার কখনই পছন্দ ছিলনা পাপিয়ার। কারণ সে ছোটবেলা থেকেই একক পরিবারে মানুষ। আর বাবা মা এত শখ করে পড়াশুনা করাচ্ছেন সে চাকুরী করে নিজের পায়ে দাড়াবেনা এটা মেনে নিতে পারেনি কোনমতেই। যেখানে তার নিজের বাবা-মা দুজনেই চাকুরী করে। আর সেই সাথে গ্রামে থাকতে হবে এই ভাবনাটাও তাকে সিন্ধান্তে আসতে বাধা দিয়েছে। আর জালাল মনে ভীষণ কষ্ট পেয়ে বলেছিল জীবনে আর কোনদিন সে বিয়ে করবেনা এবং কোন মেয়ের সংগে আর কখনই বন্ধুত্ব করবেনা। তাই পরদিন থেকে জালালকে এড়িয়ে চলতে থাকে সে। ফলাফল দুজনের বন্ধুত্ব শেষ। এরপর দুজনে পাশ করে বেরিয়ে সেই যে বিচ্ছিন্ন আর আজকে এই দেখা হওয়া। আচ্ছা জালাল আমরা কি পারিনা আবার নতুন করে শুরু করতে। এই কথা বলতে বলতে একদম আকস্মিকভাবে জালালের দুহাত চেপে ধরে সে। ছিঃ! কি বলিস। আতকে উঠে জালাল। তুইনা বিবাহিত। হাত সরিয়ে নিতে চায় জালাল। আরও জোরে চেপে ধরে পাপিয়া। হু, বিয়ে। একে কি বিয়ে বলে? তুই রাজী হলে আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। তারপর আমরা একটা সুখের সংসার গড়ব। ওকদম তুই যেমন চেয়েছিলি ঠিক সেইরকম। তুই চাকুরী করবি। আর আমি গ্রামে থেকে বাবা-মায়ের সেবা করে যাব। প্রতি বৃহষ্পতিবার তুই আসবি ভালবাসার ডালি নিয়ে। আর আদরে সোহাগে দুরাত কেটে যাবে। ঘরভর্তি ছেলে পুলে হবে আমাদের । সারাদিন বাড়িময় ছোটাছুটি করে বেরাবে। রাত হলে সবগুলোকে কোলে শুইয়ে ঘুমপাড়ানি গান শুনাব। আয় আয় চাদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাদের কপালে চাদ টিপ দিয়ে যা। পারবি? পারবিনা জালাল আমার পাশে এসে দাড়াতে? একটু খানি সুখ দিতে আমায়? আকুতি ঝরে পড়ে পাপিয়ার কন্ঠে। জালাল বিব্রত বোধ করে। দুলে উঠে তার পৃথিবী। সম্বিত ফিরে পেতেই হাত টেনে সরিয়ে নেয় তার একসময়ের প্রেয়সীর হাত থেকে। কোন বিবাহিত মহিলা এভাবে প্রস্তাব দিতে পারে তার ভাবনাতেই আসেনাই কখনো। সে কি বলবে ভেবে পায়না। তাই বলে আমাকে এবার উঠতে হবেরে। আরও কিছু কেনাকাটা আছে ।তারপর বাস ধরতে যেতে হবে। জানিসতো আমাদের রুটের বাসে বেশীরভাগ সময় টিকিট কেটেও দাড়িয়ে যেতে হয়। বলে কেটে পড়তে চায়। পাপিয়া হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে। তার হাসির শব্দে আশেপাশের কপোত কপোতিরা চমকে উঠে তাদের দিকে চায়। চোখে অগ্নিশূল। তাদের আনন্দময় মুহুতে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য বিরক্ত হয় তারা। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পাপিয়া হাসতে হাসতে বলে কি ভয় পেয়েছিস? পালাতে চাইছিস আমার কাছ থেকে। তাই না? ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই । এমনিতেই বললাম। আসলে কি জানিস আমার এই ব্যথ জীবনে আর কাউকে নতুন করে জড়ানোর ইচ্ছে আমার আদতে নেই। তোকে একটু বাজিয়ে দেখলাম। তুই এখনও আমার কথা ভাবিস কিনা। যাক মনের চেপে রাখা কষ্ট এতদিনে পাথর সরিয়ে বেরিয়ে গেল। এতদিন ভাবতাম তোর জীবনটাকে আমি নষ্ট করে দিয়েছিলাম কিনা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোর সেদিনের কথাগুলো ছিল উঠতি বয়সের উত্তেজনার ফল। আসলে মন থেকে তুই আমাকে কখনই ভালবাসতে পারিসনি। এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতেও পারব। তোর সাথে দেখা করার জন্য আমি প্রতিটা ছুটীর আগে বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে এসে ঘোরাঘুরি করি। যদি তোর দেখা পাই। না, খুব বেশীদিনের ঘটনা নয়। যখন দেখলাম জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর রুপ। অবর্ণনীয় কষ্ট। তখনি আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তোর মতো একটা ভাল ছেলেকে কষ্ট দিয়েছিলাম বলেই কি আমার জীবনটা এমন হয়ে গেল। সেই অনুশোচনা থেকেই তোকে খুজে বের করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। আরও আগেই খোজ পেয়েছিলাম তুই ঠাকুরগায়ে চাকুরী করছিস। তোর ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলেছিলাম। কিন্তু, বাংগালী নারীর মানসিকতা থেকে আর সাহস করে উঠতে পারিনি। তুই হয়তো ভাবছিস এতক্ষন যে নোংরা কথাগুলো তোকে বললাম তারপর আবার ভালমানুষি। আসলে বেশীরভাগ কথাই বানিয়ে বলা। তুই তো আমার অভিনয় দক্ষতা সম্মন্ধে ভালই জানিস। আমি ভাল অভিনয় করতে পারি। আমার স্বামী কুপথে যেতে যেতে একদিন তার প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়ে যায়। আর তারপর একে একে আমাদের সব বাড়ী, গাড়ী, জমি জমা সব বেদখল হয়ে যায়। আমি হয়ে পড়ি নিঃস্ব। স্বামীকে তার বাবা মা থেকে আলাদা করে ফেলেছিলাম বলে তারাও আমাকে জায়গা দেয়নি। আর আমার বিয়ের পর আমার বাবা মা একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান।তাই জীবন হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। এত দুঃসময়ে আমার স্বামীর এক বন্ধু অনেক কষ্টে একটা চাকুরী জোগাড় করে দেয় একটা কিন্ডারগাটেনে। সেখানে পড়িয়েই জীবন কোন রকমে পার করে দিচ্ছি। এজন্যই অনুশোচনা বড় বেশী করে আঘাত করছিল আমাকে। সেই কারণে আমি এসেছিলাম। বাসস্ট্যান্ড থেকে পিছু নিয়ে সুপার মার্কেটে এসে তোকে ধরে ফেললাম। যাক আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব। ও তোর দেরী হয়ে যাচ্ছে। চল উঠি। হয়তো আর কোন দিন আমাদের দেখা হবেনা। ভাল থাকিস দোস্ত। জালাল এতক্ষণ বাকহারা হয়ে কথাগুলো শুনছিল। কোন কথাই আর তার মাথায় আসছিল না। সে বিনা বাক্য ব্যয়ে পাপিয়ার সাথে উঠে পড়ল। পাপিয়ার কথাগুলো ওর কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। তাই কোনমতে মাথা ঝাকিয়ে বলল, আচ্ছা। ভাল থাকিস। আবার দুজনের ছাড়াছাড়ি। দুজন দুদিকের গন্তব্যের পানে ধাবমান।
সারারাত পাপিয়ার কথাগুলো নিয়ে ভেবেছে সে। আর কোন ফলাফল বের করতে পারেনি। ওর কি পাপিয়ার পাশে গিয়ে দাড়ানো উচিত ছিল। পাপিয়া যে কথাগুলো অভিনয় বলে চালিয়ে দিল আসলেই কি অভিনয়? নাকি বেশীর ভাগ আকুতিই ছিল সত্যের প্রকাশ? এসব ভাবতে ভাবতে সে শেষ পযন্ত ভোর রাতে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। বাবা- মা আর চোট চাচার সংগে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। আজ ঈদ। সকালে উঠতে একটু দেরীই হয়ে গিয়েছে জালালের। গত রাতের ঘুমগুলো সকালে যেন জাকিয়ে বসেছিল তার চোখে। তাই সকালে মা ডাকা ডাকি না করলে হয়তো আজকের ঈদের জামাত ধরতে বেশ কষ্টই হতো। নামাজ পড়ে আসতে আসতে ছোট চাচাকে সে আগের দিনের সব কথা বললো। ছোটবেলা থেকেই সে কোন সমস্যায় পড়লে চোট চাচার সংগে শেয়ার করতো। আজ এত বড় হয়ে যাওয়ার পড়েও চোট চাচার সংগে আলোচনা ছাড়া সে কোন কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। সবশুনে ছোট চাচা বলল বাবা তুমিতো এখন বড় হয়েছো। আর নিজের ভালমন্দ তুমি ছাড়া অন্য কেউ সেভাবে বুঝবেনা। তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাকেই। তবে যেহেতু তুমি এখনও ব্যাচেলর। আর যতটুকু শুনলাম তাতে মেয়েটা সত্যিই তোমাকে ভালবাসে। হয়তো প্রথম জীবনে সে একটু উচ্চাকাঙ্খী ছিল। এ কারণে তোমার ডাকে সাড়া দেয়নাই। অথবা সে তোমাকে যাচাই করে নিতে চেয়েছিল। তবে সে আসলে তখনও তোমাকে ভালবাসতো। মানুষ যখন প্রচন্ড সমস্যার মধ্যে কালাতিপাত করে তখণ তার ভালবাসার মানুষের কথাই প্রথম মনে পড়ে। এজন্যই তার কাছে আশ্রয় খুজতে চায়। জালাল যেন এই কথাগুলো শোনার অপেক্ষায় ছিল। তাই চাচার কথা শুনে আনন্দে সে চাচাকে জড়িয়ে ধরে বলে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ চাচা। তুমি বাবা-মাকে একটু বিষয়টা জানাও আমি পাপিয়াকে তার হারিয়ে যাওয়া আশ্রয় ফিরিয়ে দিতে চাই। আচ্ছা আমি বলব। বলে ছোট চাচা তাকে আশ্বস্ত করে। সব শুনে বাবা মাও আর আপত্তি করেনা। তারা জালালকে বলে মেয়েকে একদিন আমাদের কাছে নিয়ে আস। তা ও থাকে কোথায়? অকস্মাৎ জালাল আকাশ থেকে পড়ে। যেন প্রকান্ড এক বজ্র তার মাথায় এসে আঘাত করে। পাপিয়া কোথায় থাকে? ঠিকানাটা তো তার নেয়া হয়নি। কেমন করে খুজে বের করবে তাকে?
ঈদ শেষে অফিস করতে আসে জালাল। সকালে অফিসে এসেই পত্রিকা পড়ার অভ্যাস তার বহুদিনের। পত্রিকা পড়তে গিয়ে গ্রাম গঞ্জের খবর এর পাতায় আটকে যায় চোখ। একটা ছবি তার সমস্ত দুনিয়াকে উলট পালট করে দিতে থাকে। আর তার পাশের খবরটা পুরোপুরি পাঠ করার মতো শক্তি তার আর থাকেনা। স্তম্ভিত হয়ে খবরের কাগজ ধরে বসে থাকে সে। খবরটা ছিল রংপুর রেলস্টেশনে ঈদের আগের রাতে পাপিয়া নামের এক মহিলা শিক্ষয়ত্রীর রেলে কাটা লাশ উদ্ধার
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।