নতুন ঢাকার দক্ষিন ভাগের শেষ থেকে যেখানে পুরান ঢাকার শুরু এমন স্থানে আগামাসি লেনের অবস্থান।এই রাস্তায় বাংলাদেশের এক বিতর্কিত বিখ্যাত ব্যক্তিসাবেক রাষ্ট্রপতি মোস্তাক আহমেদের বাড়ি। বর্তমান বংগবাজার বলে যাকে আমরা চিনি, সেই ফুলবাড়িয়া নামক স্থানে তখন ঢাকার বাস স্ট্যান্ড ছিল ।বাসস্ট্যান্ড থেকে মিটফোর্ড মেডিক্যাল এ যেতে চাইলে রিক্সাওয়ালারা এই রাস্তাকে বেশি পছন্দ করত।
সাহেদ উত্তর বঙ্গের বগুড়া থেকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, মিটফোর্ডে পড়তে এসেছে সেই ১৯৮৪ সালে। বাড়ি থেকে রাগ করে বেড় হয়েছে আরও তিন বৎসর আগে। বাড়ি যায় না, বাড়ির কারো সাথে ও কোন সম্পর্ক রাখেনি। এখনো ওর মনে পরে যেদিন ওর বাবামা ওর সমস্ত বই পুস্তক আঙ্গিনায় ফেলে দিয়ে ওকে বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যেতে বলল; কিশোর সাহেদ শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আমি আজ থেকে এই বাড়িতে আসব না। শুধু এক মুঠো ভাত খাওয়ার জন্য এই বাড়িতে আসব না। যদি কোন দিন মানুষ হতে পারি, তবেই ফিরব, নইলে নয়।’
সে আজ অনেক পুরনো অতীত। জীবন যুদ্ধের চূড়ান্ত দেখার নিয়তে সাহেদ তাই অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছে প্রতিনিয়ত। লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য পুরান ঢাকায় ২ টি এবং নতুন ঢাকার দিলু রোডে একটি টিউশনি করে।এতে কিছুটা হলেও সাচ্ছন্দে সাহেদ ওর জীবনকে গতি দিতে পেড়েছে।
সাহেদের মেডিক্যালের পুরোসময় লেজেহোমোএরশাদ এরসামরিক শাসন ছিল বলা যায়। তবে শেষের দিকে কিছুদিন আধা খিচুরি মার্কা গণতন্ত্রও ছিল। এই সেনাপতি রক্তপাতহীন ক্যুএর মাধমে বিচারপতি সাত্তার এর কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়েছিলেন ২৪শে মার্চ, ১৯৮২ সালে। তার বছর দুই পর থেকেই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে ১৫ দল ও ৭ দল। এক দিকে শেখ হাসিনার দল,অন্য দিকে বেগম খালেদা জিয়ার দল নেত্রিত্বে। ১৯৮৭ সালে বিরোধী দল বেশ আন্দোলন জোরদার করতে সক্ষম হোল। লেজেহোমোএরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে, দেশ বেশ গর্জে উঠেছে। সাহেদের তখন ১ম প্রফেশনাল সাপ্লিমেন্টারী পরীক্ষা চলছে। ফিজিওলজি পরীক্ষার শর্ট ভাইভা হল, লং ভাইভা ২ দিন পর। শর্ট ভাইভা দিয়ে কলেজের তিন তালা থেকে নিচে নেমে সাহেদ শুনল যে, লেজেহোমো এরশাদ ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং বেলা ৫ টারমধ্যে হোস্টেল খালি করে দিতে হবে। মিটফোর্ড এলাকায় কেমন একটা থমথমে পরিবেশ।
সাহেদের মাথায় যেন বজ্রপাত পড়ল। ও এখন কি করবে? দুইদিন পর হলে কোন ক্ষতি ছিল না। পরীক্ষা শেষ করে যেতে পারত। এদিকে আবার নোটিশ হয়েছে যে, পরীক্ষা যথানিয়মে চলবে। কেমন যন্ত্রনায় পড়া গেল! বছরের শেষ দিক। টিউউশনিও চালাতে হবে, কারণ ছাত্রদের ফাইনাল পরীক্ষা ডিসেম্বরে।
কিছু ভেবে না পেয়ে প্রথমে সাহেদ গেল অধ্যক্ষ মহোদয়ের নিকট। স্যারকে সাহস করে বলল যে, ‘স্যার,আমার ঢাকায় থাকার কোন যায়গা নাই, পরীক্ষা পর্যন্ত দুইদিন হোস্টেলে থাকার জন্যআমাকে একটা স্পেসিয়াল কার্ড ইসু করে যদি দিতেন!’
অধ্যক্ষ স্যারের কর্কশ স্বরের কথা আজও ওর মনে বাজে এবং গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে।উনি সর্বোচ্চ রাগ দেখিয়ে বল্লেন,‘তুমি এবার পরীক্ষা না দিতে পারলে, ৪মাস পর আবার দিতে পারবে। কিন্তু পুলিশ যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যায়, তখন তো লেখাপড়াই বাদ হয়ে যাবে!বুঝেছ?’
অধ্যক্ষ স্যারের কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে একটু সাহসী হলে কি এমন ক্ষতি হত, বুঝতে পারল না। সাহেদ হতাশ হয়ে কি করবে বা করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। সারা বিকেল না খেয়ে পুরনো ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় ঘুরলো।
সন্ধ্যায় জিগাতলা ওর জ্যাঠার বাসায় গিয়ে ঘটনা বলে, থাকার আশা করল। জ্যাঠামশাই, জ্যাঠই এর সাথে আলাপ করলেন।
জ্যাঠই বল্লেন,‘বাবা, তুমি হোস্টেলে গিয়ে দেখ, যদি পুলিশ ধরেই নিয়ে যায়, তবে এখানে এসো।’সাহেদ বুঝতে পারল না, পুলিশ ধরে নিলে ও ক্যামনে এখানে আসবে?এদিকে রাত হয়ে গেছে, কালদিন পর ওর লং ভাইভা। দেরী নাকরে ও হোস্টেলের দিকেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিল।
রাত ১০ টা নাগাদ হোস্টেলে এসে দেখে সবাই চলে গেছে। দারোয়ান দুইজন গেটে তালা দিয়ে চুপচাপ বসে আছে, বারান্দার সিঁড়িতে। সাহেদ ওদের একজনকে ডাক দিল। ওরা দুইজনেই এলো এবং অধ্যক্ষের কঠিন নির্দেশের কথা শুনিয়ে বলল যে, ওরা কিছুতেই সাহেদকে ভিতর ঢুকতে দিতে পারবে না ।
সাহেদ বেশ অনুনয় করে বলল, ‘দেখরে ভাই, আমার ফাইনাল পরীক্ষা পরশু। কোথাও থাকার জায়গা বেড় করতে পারিনি,এদিকে জায়গা খুজতে গিয়া বই পত্র কিছুই নেয়া হয়নি। আমি একটু ভিতরে ঢুকে বইপত্র তো নিই, তার পর না হয় স্টুডেন্ট ক্যাবিনে গিয়ে রোগী হয়ে ভর্তি হব!’
এবার দারোয়ানদের মন গললো। ওরা শুধুমাত্র বইপত্র নিতে সুযোগ দিতে ভিতরে ঢুকতে দিতে রাজী হল। সাহেদ হাফ ছেড়ে, পাশের হাসেম হোটেলে গিয়ে সারাদিনের অভুক্ত পেটে তিন টাকার ভাত আর সাত টাকার গরুর হাফ মাংস খেয়ে শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করল।
রাত প্রায় ১১ টায় সাহেদ হোস্টেলের ভিতর ঢুকল। ভীষণ নীরবতা। কেমন ভীতকর অবস্থা।দারোয়ান দুইজনই ওর পিছে পিছে ওর রুম পর্যন্ত এলো। ও চাবি দিয়ে রুম খুলে ভিতরে ঢুকল।সাহেদ খুব ছিমছাম করে বিছানা পেতে রাখত সবসময়। এটা শিখেছে ওর রুমমেট আলাউদ্দিন ভাইয়ের কাছ থেকে।বিছানায় বসতেই ওর মনে হল, ধুর, পুলিশ ধরলে ধরুক! এই পরিপাটি স্বর্গীয় বিছানায় না ঘুমিয়ে ও কিছুতেই কোথাও যাবে না! দারোয়ানরা প্রথমে রাজি না হলেও পরে সাহেদের নাছোড় ভাব দেখে ওর পরামর্শ মত বাহির থেকে দরোজায় তালা লাগিয়ে চলে গেল। ওদের সাথে কথা হলো - ২ ঘণ্টা পর পর ওরা এসে সঙ্কেত দিবে। কোন সমস্যা হলে বাহিরের গেট না খুলেই আগে ওকে পিছনের দেয়াল টপকানোর সুযোগ করে দিবে। সাহেদ সারাদিনের ক্লান্তিতে ডুবে গেল সহসাই এবং গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে গেল।
খুব ভোরে দারোয়ান শফিক এসে ওকে ডাক দিল। বলল,‘সাহেদ ভাই, এখন কোন সমস্যা নাই, আপনি বাথরুম করে এসে রুমে ঢুকুন। আমরা এখন ঘুমাব।’
সাহেদ এর খুব জোরে এতক্ষন পেশাব লেগেছিল, বাথরুমের কথা শুনতেই ওর তলপেট ফেটে যাওয়ার তীব্র ব্যাথা শুরু হোল। প্রায় দৌড়ে ও বাথরুমে গেল এবং কাজ সেরে এসে আর না শুয়ে, পড়তে বসল।দারোয়ান শফিক বাহিরে থেকে যথারীতি দরোজা লাগিয়ে চলে গেল।
বেলা ১০ টার দিকে দারোয়ান মফিজ এসে আস্তে আস্তে বলল, ‘সাহেদ ভাই, নাস্তা খাবেন না?’
সাহেদ বলল, ‘পেট তো ক্ষয় হয়ে গেছেরে ভাই, কেউ আসেন না, খাবার পাব কই?’
মফিজ ভাই হাশেমের হোটেল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে নাস্তা এনে দিল। এমনই করে ওরা সাহেদকে রুমে বন্ধ করে রেখে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দিল। সাহেদ পরের দিন পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে ঘরে ব্যাগ গুছায়েরেখে দিল।পরিক্ষা ভালই দিলো। মনে বেশ ফুর্তি নিয়ে হন হন করে সাহেদ যখন হোস্টেলে ঢুকলো তখন বেলা ৩ টা বেজে ১৫ মিনিট। দারোয়ান কাউকেই পেলনা।
সাহেদ চাবি দিয়ে রুম খুলে রুমের ভিতর ঢুকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরোজা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় দেখে, দুই জন পুলিশ ও একজন আর্মি ওর দরোজায় দাঁড়িয়ে। ও হতবম্ব হয়ে তাকায় তাদের দিকে। দেখে ওদের পিছনে মাথার উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দুই দারোয়ান শাফিক এবং মফিজ ভাই। সাহেদের মনখুব খারাপ হল।ও ভাবছিল শুধুমাত্র ওর উপকার করার জন্যই আজ ওদের এই শাস্তি।কোন এক পিপিলিকার বাচ্চা হোস্টেলে থাকার খবর ওদের দিয়েছে।
এক পুলিশ সাহেদকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুঁই হোস্টেলে ক্যান?’
ভাষা শুনে ওর ম্যাজাজ খারাপ হলেও ধীরে ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘ব্যাগ নিতে এসেছি। পরীক্ষা ছিল,হটাত হোস্টেল খালি করার জন্য ব্যাগ নিতে পারি নাই।’
এই কথা শুনে পুলিশ চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘চালাকি করস? তুঁই গতকাল রাতেও ছিলি,ঠিক না?’
সাহেদ সত্য কথা বলতে যাবে, এমন সময় দারোয়ান শাফিক এর মাথা বাঁকানো ইশারায় অস্বীকার গিয়ে বলল, ‘নাতো, আমিতো দুইদিন আমার জ্যাঠার জিগাতলার বাসায় ছিলাম।আজ পরীক্ষা দিয়ে এইমাত্রই হলে ঢুকেছি।’ দারয়ান মফিজ বলে উঠল, ‘স্যার, আমরা বলেছি না রাতে কেউ ছিল না।’অমনি পাশের পুলিশ ধাম করে মফিজের ঘাড়ে এক রাইফেলের গুতা মেরে বলল, ‘চুপ, শালা!’
দারোয়ান দুই জনের জন্য সাহেদেরভীষণ কষ্ট হলো। ওদেরকে এই সমুহ বিপদে সেই ফেলেছে, এই ভেবে।
সাহেদ বলল, ‘ওকে মারছেন ক্যান?ও তো ঠিক বলেছে।’
তখন সামনে দাঁড়ানো পুলিশ বলল, ‘আমাদের কাছে খবর আছে,তুঁই কাল রাত ৯ টা থেকে হোস্টেলেই ছিলি। সারাদিন রুমে তালা দেয়া ছিল। ওরা তোকে খাবার এনে দিয়েছে, সব সহযোগিতা করেছে।’
সাহেদ তীব্রভাবে না বলে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, ‘প্রমান হাজির করেন!’
এমন সময় আরও একজন আর্মি এসে ওদের সামনে হাজির হোল। আগুন্তক বাহিনীর সবাই প্রায় একসাথে বলে উঠলো, ‘স্যার, খুব কঠিন মাল। মাইর না দিলে সোজা হবে না।’সাহেদ দ্রুত বুঝে ফেলল, উনিই টিম লিডার।
ও আরদেরি না করেআবার বলে উঠল, ‘স্যার, আমি আজ পরীক্ষা দিয়ে সোজা রুমে এসেছি আমার ব্যাগ নিতে। আমার পরীক্ষা ছিল বলে সেদিন ব্যাগ গুছাইলেও নিয়ে যাই নি, কারণ আমার থাকার কোন জায়গা ছিল না। পরে ঐ জিগাতলায় আমার জ্যাঠা থাকেন তার বাসায় ছিলাম। আজ ব্যাগ নিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য এসেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে না দিলে, গাড়ি মিস করব।’এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামতেই ঐ অফিসার আর্মি সাহেদ কে বললেন,‘আপনার বাড়ি কোথায়? কোথায় যাবেন গাড়ি ধরতে?’
সাহেদ দ্রুতই বলে উঠলো, ‘ফুলবাড়িয়া বাস স্ট্যান্ড, আমার বাড়ি বগুড়া।’
অফিসার হটাত করেই বলে উঠলো, ‘ওদের কে ছেড়ে দাও।লেখাপড়ার জন্য যদি ও এক রাত থেকেও থাকে এবং ওরা ওকে সাহায্য করে থাকে, তো এখানে এমন কোন অন্যায় হয় নি।চল সবাই। সাহেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কিন্তু আর দেরী করোনা, এবং আর হোস্টেলে থেকো না। এরপর ধরতে পারলে কিন্তু ছাড়ব না।’ সবাইকে ছেড়ে ওরা হন হন করে হোস্টেলের গেটের দিকে চলে গেল।
সাহেদ মফিজ ও শাফিককে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপনেরা আমার জন্য আজ মার খাইলেন, আমার আপন জ্যাঠা যে উপকার করেন নি, আপনেরা তার চেয়ে বহুগুন উপকার করলেন, এই ঋণ আমি জীবনেও ভুলব না।’সাহেদের চোখ জলে ভরে উঠলো।
মফিজ বলে উঠলো, ‘স্যার, আপনাদের উপকার করার জন্যই তো সরকার আমারে চাকুরি দিছে, সে জন্যই তো আমারে বেতন দেয়, যা দিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে বেঁচে আছি।’
সাহেদ আর দেরী না করে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত হোস্টেল থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এল।রিক্সায় উঠে ফুলবাড়িয়ার পথে যেতে যেতে ভাবছিল কর্মচারীদের কথা, যে ওরা কত সত্য কথাই না বলেছে!
বগুড়া যাওয়ায় সাহেদের হাত শূন্য হলো। হটাৎ চলে আসতে বাধ্য হওয়ায় টিউশনির বাড়িতেও যেতে পারেনি। যেতে পারলে হয়ত কিছু টাকা নিতে পারত। বগুড়া যাওয়ার ৩৭ দিনের মাথায় কলেজ খুলে দিল। সাহেদ ঢাকায় ফেরার পথ ধরল। এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩০ টাকা এবং ওর পেয়িংগেস্ট থাকার সেই বাড়ির জমির ভাই থেকে নেয়া ৫০ টাকা নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা দিল। পথে ১০ টাকা খরচ হয়ে গেল। ঢাকার টিকেট কাটল ৫৫ টাকায়। রাস্তায় মাত্র ৫ টাকার হাল্কা নাস্তা খেল নগরবাড়ি ঘাটে।ঢাকায় যখন পৌঁছল তখন ৪টা বাজে। ফুলবাড়িয়ানেমে ও ৪ টাকায় রিক্সা ভাড়া করল মিটফোর্ড এর উদ্দেশ্যে।রিক্সাওয়ালা আগামাসি লেনে ঢুকে মোস্তাকের বাড়ি বামে ফেলে ডানে মোড় নিতেই ওর পেটটা এমন মোচর দিয়ে বড়টা লেগে গেল যে, সাহেদ কাতর কণ্ঠে রিক্সাওয়ালাকে থামাতে বাধ্য করল।
মোড়েই একটা মসজিদ দেখে ও সেখানের বাথরুম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল। সাহেদ কষ্টে অস্থির হয়ে বাথরুম খুঁজে যাচ্ছিল, কিন্তু পাচ্ছিল না।কারণ মসজিদের সাথেই যে বাড়ি, ওর সামনে একটা টয়লেট দেখলেও ও মনে করেছিল যে, ওটা ঐ বাড়ির নিজস্ব।তাই ও এদিক ওদিক খুঁজে হয়রান হচ্ছিল। অবশেষে কোন পথ না পেয়ে এবং নিজের জরুরী অবস্থার কথা ভেবে ঐ টয়লেটএ ঢুকে পড়ল।একজন মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমনপ্রমান সাইজের টয়লেট। কিন্তু ভিতরে কোন ফাঁকা যায়গা নেই যে, ও ওর কাধের ব্যাগ রাখবে। বাইরে রেখে টয়লেট করাও সমুহ ঝুঁকি। একবার বাইরে রাখে, কিন্তু দরোজা বন্ধ করতেই আবার খুলে ভিতরে নিতে চায়, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। এদিকে এমন চাপ, কাপড় মাখামাখি হওয়ার উপক্রম!
এমন সময় এক বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর শুনে ও গলির ভিতর বাসার দিকে তাকাল। এক সাদা শাড়ি হাঁটুর কাছাকাছি পরে থাকা বৃদ্ধা বলছেন, ‘বাবা, তুমি ব্যাগ এখানে দাও, কোন ভয় নাই। বাথরুমের কাজ হলে নিয়ে যেও। স্নেহা,যাতো তোর ভাইয়ের ব্যাগটা নিয়ে আয়। বিপদে পড়েছে মনে হয়।’
শেষের কথায় হাল্কা রসবোধেরপরিচয় ফুটে উঠল।১৫/১৬ বছরের এক কিশোরী এসে সাহেদের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে মোহনীয় স্বরে বলল, ‘ভাইয়া, ব্যাগ দিন।’
এমন ধনুকের মত লাবন্যদ্যুতি ছড়ানো পটলচেড়া চাহুনির কোন মেয়েকে সাহেদ এই প্রথম দেখল। এমন কিন্নোর কণ্ঠের আওয়াজ শুনে কিছু ভাবার আগেই স্নেহা নামীয় সেই মেয়েটির হাতে সাহেদ ব্যাগ তুলে দিল এবং স্নেহার হাতে ওর হাত সামান্য স্পর্শ করায় ওর মন এমন পরিবর্তন হয়ে গেল যে, তলপেটের কঠিন চাপ ভুলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকল ভ্যাবলার মতো।
বৃদ্ধা আবার বলে উঠলেন,‘যাও বাবা, কাম সারো। ও তোমার এক ছোট বোন, পরে দেখো।’
টয়লেটের দরোজা বন্ধ করার সময় বৃদ্ধার মুচকিহাসি সাহেদের চোখ ফাঁকি দিতে পারল না। সাহেদ এবার সত্যি লজ্জা পেয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল এবং সেই সময় নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বোকা বলে মনে হলোতার। প্রাকৃতিক কর্ম সফলভাবে সারার পর এক স্বর্গীয় সুখ সাহেদকে আচ্ছাদিত করল। অধীর পায়ে ব্যাগ নিতে বাড়ির ভিতর এগিয়ে গেল।
এবার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্য হওয়ার পালা অপেক্ষা করছিল, ওর জন্য।
ব্যাগে হাত দিতেই বৃদ্ধা বলে উঠলেন, ‘বাবা, কই থেকে এলে?’
সাহেদ আস্তে উত্তর দিল, ‘বগুড়া থেকে?’
‘তোমার বাড়ি কি বগুড়ায়?’ বৃদ্ধা আবার প্রশ্ন করলেন।
এবার সাহেদ ব্যাগ নিয়ে সোজা হতে হতে বলল, ‘জি!’
বৃদ্ধা বললেন, ‘অনেক দিন আগে তোমার বগুড়া গিয়েছি,কলোনিতে। তুমি চেনো?’
সাহেদ বলল,‘চিনি। আপনি কি কলোনিতে গেছেন? কে থাকে সেখানে?’
বৃদ্ধা বললেন,‘মুক্তিযুদ্ধের আগে আমি ওখানেই ছিলাম। আমাদের ওখানে বাড়ি ছিল। যুদ্ধের সময় আমার বিয়ে হয়ে যায়, ঢাকায় এই ক্যাম্পে আমাদের ঠাই হয়। আমরা বিহারি, বাবা।’
সাহেদ এতক্ষনে বুঝতে পারে, ওনার কথায় কেমন যেন একটা আলাদা সুর।ভারতের মিষ্টি মিষ্টি কেমন এক সুরের টানে কথা বলছেন এতক্ষন!
সাহেদ এর দম বন্ধ হয়ে আসছিল ছাগলের মুতের ও গায়ের গন্ধে। কিন্তু সামনে বা আশে পাশে কোন ছাগল দেখছিল না। ও ভাবছিল মানুষের গায়ে কি এত বিশ্রি গন্ধ হতে পারে, ওর গা গুলিয়ে আসছিল। বৃদ্ধা ওর মনের কথা বুঝতে পেরেছিল মনে হয়।
বললেন,‘কি বাবা, ছাগলের গায়ের গন্ধ পাচ্ছ? কি করব বাবা, আমরা অনেক কষ্ট করে এই খুপড়ি বাড়িতে থাকি, গরীব মানুষ তাই ছাগল পুষি। ঘরের নিচে ছাগল থাকে, আমরা উপরে ঘুমাই। তোমার কষ্ট হচ্ছে, আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমি কি করো বাবা?’
সাহেদ এবার ভালো করে বাড়ির দিকে তাকায়। দেখে বাঁশের চটা দিয়ে মাচা করে দোতলার মত করাহয়েছে, নিচে নাদুস নুদুস বেশ কয়টি ছাগল শুয়ে আছে।সাহেদ আস্তে উত্তর দিল, ‘মেডিক্যালে পড়ি।’
স্নেহা নামীয় মেয়েটি হটাৎ করে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘আপনে ডাক্তার?’
সাহেদ এর কোন উত্তর খুঁজে পেল না। শুধু মেয়েটির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ওর ফিনফিনে পাতলা পোশাকের ভিতরের রূপসুধা উপভোগ করতে থাকল।
বৃদ্ধা মায়াবী স্বরে এবার জিজ্ঞাস করলেন,‘বাবা, তোমার মুখ এত শুকনো কেন? দুপুরে খাওনি?’
সাহেদ সত্য উত্তর দিল, ‘এখনো দুপুরের খাবার খাইনি, মিটফোর্ড হোস্টেলে গিয়ে খাব।’বলেই পকেটের অবস্থা ভেবে ভিতরে ভিতরেআরও জরসর হয়ে গেল । ভাবনায় এলো মনে যে, ওর হাতে আছে মোটে ৬ টাকা, আবার রিক্সা নিতে হলে চলে যাবে ৪ টাকা, খাবে কি?
মহিলা খুব জোরে বলে উঠলেন, ‘স্নেহা, তুঁই এটা কি করলি? তোর ভাইকে খাইতে বলসিছ না কেন? ওমা, কত বেলা হইসে, ও এখনো খায় নি! বসো তো বাবা, উপস্থিত খেয়ে যাও।’
স্নেহা কম্পিত স্বরে বলল, ‘ভাইয়া, বসুন বসুন!ভাত না খেয়ে যেতে পারবেন না।’বলেই কাধের ব্যাগ একটানে কেড়ে নিল।
সাহেদ স্নেহার এই আদর-সম্মানকে উপেক্ষা করার সাহস করে উঠতে পারল না। বৃদ্ধার আহ্বান উপেক্ষা করার বয়স হয়ত সে অতিক্রম করেছে, কিন্তু স্নেহা নাম্নীয় রূপবতী কিশোরীর মধুর ডাক ও মিষ্টি ভালোবাসাকেউপেক্ষা করার সাহস সে কিভাবে করে? সাহেদস্নেহার বিছানো স্নেহের মাদুরে দ্রুত বসে পড়ল।
কাজরি মাছের চর্চরী ও পাটশাক ভাজি দিয়ে সাদা ভাত। স্নেহার ও বৃদ্ধার মায়াবি আদরে ক্ষুধার পেটে সাহেদ এর চোখে পানি চলে এলো।ভাবছিল, মহান আল্লাহ্পাক কার রেজেক কোথায়, কিভাবে ব্যবস্থা করে রাখেন, কে জানে?
৩ বছরের অধিক কাল মা-বাবা-ভাই-বোনহীন সাহেদের হটাৎ করেই বাড়ির ভালোবাসার কথা মনে পড়ে গেল। মনেহলো স্নেহা যেন ওর আপন ছোট বোন, আদর করে ওকে খাবার তুলে দিচ্ছে, পাতে। সাহেদের আটকানোর চেষ্টা বিফল করে দিয়ে ক্রমাগত চোখের জলে খাবার থালা ভরে যেতে লাগলো। স্নেহা ও বৃদ্ধা হচকচিত হয়ে কেউই কোন প্রশ্ন করার সাহস দেখাল না।
সাহেদ মাথা নিচু করে গোগ্রাসে খাবার শেষ করল। উনারা আর কোন কথা বললেন না। কথা বলল না সাহেদও।হটাৎ এক নীরব নিথর অবস্থার মাঝে সাহেদ তার ব্যাগ কাধে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘আজ আসি!’ বলেই দ্রুত পায়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে চলল।
পিছন থেকে স্নেহা বলল, ‘ভাইয়া, আবার আসবে,আমি তোমার হাসপাতালে বেড়াতে যাব।’
বৃদ্ধাও বলে উঠলেন, ‘বাবা, শরমিন্দা না যাও, তুমি যখন মন চাবে এসো। মনে করো এটা তোমার নিজের বাড়ি।’
সাহেদ মাথা দুলিয়ে বাড়ি থেকে বেড় হয়ে এলো। যেন নিজের বাড়ির আঙ্গিনা পেড়িয়ে ও আবার রাস্তায় পা রাখলো। সন্ধ্যা হতে বেশী দেরী নাই। মিটফোর্ডে যেতে হবে। আগামাসি লেনের মুখের দিকে রিক্সার জন্য হাঁটছি আর ভাবছি আমি কিসুন্দর ভাবে সাহেদের সাথে নিজের জীবনকে মিশিয়ে দিয়েছি, কত্ত সাবলীল ও সহজে !