আজ ১৪ আষাঢ় ১৪২০।
তারিখটা বাংলায় মনে রেখেছি, কারন বাবা বাংলা সালে হিসাব রাখতেন !
আজ আমার মনটা ভালো নাই। আজ আমার বাবার মৃত্যুদিবস। ২ বৎসর আগে এই দিনে আমার বাবা আমাদের ছেড়ে গেলেন, কিছুটা অভিমানকরেই। আমার বাবা ৪০ এর দশকে জম্ম নেয়া গোড়া মুসলমান বাঙালি ছিলেন। আমারদাদার বাড়ি রাজবাড়ি শহরের প্রান্তিকে। শহর না গ্রাম তখন টের পাওয়া যেত না।বাবা ব্যবসায়ী মানুষ ছিলেন। মুলতঃ চালের মিলের মালিক। চালের মিলপৈত্রিকসুত্রে পেয়েছিলেন। মিলের নাম ছিল ‘ইসাহাক রাইচ এন্ড ফ্লাওয়ার মিল’।বাবার নামেই দাদা এই মিল চালু করেছিলেন। আমার বাবা ননমেট্রিক ছিলেন। অবশ্যএতে আমরা তার ভিতর তেমন কোন ভাবান্তর দেখিনাই। একবার আমরা ৪ ভাইবোন সবাই একসাথে বাবাকে তার এই লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম। উনি হাসতে হাসতেবললেন, ‘আমাদের জাতীর পিতা কিন্তু ননমেট্রিক ব্যারিস্টার ছিলেন, বুঝলি !’ আমার বাবা কিন্তু মোহাম্মদ আলীকে জাতীর পিতা ভাবতেন। আমরা বাবার এই আচরণেকিছুতা খুব্ধ ছিলাম। কিন্তু বাবা বলে কথা, কি আর করা !
গতকাল আমি বাবার মৃত্যু দিবসে গ্রামে মিলাদ করার জন্য গিয়েছিলাম। সাথে একজন ডাঃবন্ধু আর আমার গিন্নী। ডাঃ বন্ধু আমার বাবার মৃত্যুতে অনেক করেছিলেন। আমরাতার কাছে ঋণী। কিন্তু উনার অনেক মুল্যবান সময় নষ্ট করেই নিয়ে গিয়েছিলামরাজবাড়ী শহরে। আমাদের বাড়ি এখন পুরোই শহর। সেই মিলের স্থানে আব্বা একটি ৪তলা দালান তুলেছেন। চালের ব্যবসা করেন না। আমার দাদার সম্পত্তি বেঁচে ঢাকায়একটা ৫ তালা বাড়ি করেছিলেন, আজ থেকে ১০ বৎসর আগে। সেই বাড়ি থেকেই মুলতআমার বাবার সকল খরচ মেটাতেন। শেষ বয়েসে গ্রামের লোকেদের কথায় উনি রাজবাড়ীশহরে একটি বাড়ি করেছিলেন। আমি কিছুটা বাঁধা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অন্যভাইবোনদের জন্য আর কিছু বলিনি। আমার এই বাঁধা দেওয়ার কথা জেনে বাবা আমাকেফোন করে বলেছিলেন, ‘ইসমাইল, তুই গাধাই রয়ে গেলিরে। তোর ছেলে মেয়ে ঢাকাথেকে আমার বাড়িতে বেড়াতে এসে কোন কষ্ট পেয়ে চলে যাবে, তা আমি চাইনা, বুঝলি ?’ এখন বুঝি কেন আমার পিতা আমার সন্তানদের কাছে এত প্রিয় ছিলেন ! আসলেমানুষ বাঁচে তার কর্মে !
আজ বাবার মৃত্যুর পর বুঝলাম, আসলেই আমি গাধা ছিলাম। বাবার তুলনা বাবাই। ফিরছিলাম আমরা একটু তাড়া করেই।এখন বেলা ৩ টা বাজে। আমরা কেবল গোয়ালন্দ মোড় ছাড়লাম। ডাঃ সাহেব গতকালচ্যাম্বার করেন নি। আজ করতেই হবে। আমার সামনেই ১৫/২০ জন রোগী ফোন করে জানতেচেয়েছেন আজ উনি চ্যম্বারে বসবেন কিনা ! তাই সন্ধ্যার আগেই ঢাকায় ফিরতেহবে যে !
আমাদের গাড়ি ফেরিতে উঠেছে। নদিতে হটাত করেইঢেউয়ের দোলা লাগছে। বউ আমাকে জড়িয়ে ধরেছে বেশ শক্ত করে। ডাঃ সাহেব এক মনেদোয়া পড়ে যাচ্ছে। ফেরি মনে হয় উল্টে যাবে ! আমরা শখ করে তিন তালায় উঠেছিলামউপর থেকে নদীর অবস্থা দেখার জন্য। আর থাকতে পারলাম না। নিচে আসার জন্যনামতে থাকলাম। কিন্তু দুই তালায় এসে থামতে বাধ্য হলাম। এক মহিলা ভয়ে এমনচিৎকার দেয়া শুরু করল যে, আর নিচে না নেমে খাবার টেবিলে সবাই বসে পরলাম। এমন সময় খাবার টেবিলের পাশের শেলফ থেকে শব্দ করে সব ড্রিংকস পরে গেল । এতেআমার বউও চিৎকার করে উঠল। আসলে আমার বউ জীবনে ২ বা ৩ বার নদি পার হয়েছে।তার নদি ভীতি আছে, তাই লঞ্চে কোনদিন আমরা তাকে নিতে পারি নাই। আরঝড়ের সময় ও বর্ষকালে তো নয়ই। কিন্তু এইবার বাবার মৃত্যু দিবসের অনুষ্ঠানেতাকে কিছুটা জোর করেই নিয়ে এসেছিলাম। গতকাল অবশ্য নদী খুব শান্ত ছিল। আজওসকালে ভালো ছিল। হটাত করে এমন ঝরো আবহাওয়ার কোন কারন খুঁজে পেলাম না।
বউখুব ভয়ে সেরম কাঁপা কাঁপছে। এদিকে আমি সিগারেট খেতেও উঠতে পারছিনা। এরূপ ভয়ের সময় সিগারেট টানতে পারলে মনের ভয় বেশ কমে যায়। কিন্তু বউয়ের ভয়কাটানোর জন্য কিছু একটা করা দরকার। বিশেষ করে তার মাইন্ড ডাইভারট করতেপারলে কাজ হবে। আমার ডাঃ সাদিক ভাইএর কাছ থেকেই শোনা ! সেজন্য ডাঃ সাদিকভাইয়ের সাথে কথা বলে সময় কাটানোর বুদ্ধি আঁটলাম।
আমি ডাঃ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সাদিক ভাই, ভয়ে সিগারেট খেলে ভয় কমে কেন?’
সাদিকভাই বরাবর আমার পছন্দের একজন। উনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন। যুক্তি দিয়ে কথাবলেন বলেই আমি তাকে খুব পছন্দ করি। কিন্তু বর্তমান সরকার কেন যে উনাকেপছন্দ করেন না । আসলে যুক্তিবাদি মানুষকে সকল সরকারই ভয় পায়। সাদিক ভাই এইসরকারের আমলে কিছুই পেলেন না। শুনেছি আগের সরকারও উনাকে বঞ্চিত করেছেন।
সাদিক ভাই দোয়া পড়তে পড়তেই খুব গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ‘নিকোটিনের জন্য। নিকোটিন মগজে গিয়ে কাজ করে বলে এমন হয়।’
আমার বউ বলল, ‘এই যদি ফেরি ডুবে যায়?’ আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।
বললাম, ‘তুমি কি বল? এই ঘাটের ইতিহাসে কোনদিন কোন ফেরি কেন লঞ্চও ডোবেনি, তুমি জানো?’
তার পর পরই আমি আবার বললাম, ‘এই ভাই, আমরা একটু চা খেতে চাই, কেউ আছ?’
একজন বেয়ারা এসে বলল, ‘কয় কাপ দিব স্যার !’
আমি বললাম, ‘৩ কাপ দাও, রঙ চা !’
সরাসরিনিকোটিন যদি মগজে ঢুকে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা আর কি ! বেয়ারা হাফ কাপ করে ৩ কাপ চাদিল, টি ব্যাগের চা। দাম ১০ টাকা প্রতি কাপ। বান্ধা ছাগলেরে পাল দেয়ারব্যবস্থা আর কি !
আমি এইবার গল্প করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারন আমাদের আরও কমপক্ষে ২০ মিনিট নদিতে থাকতে হবে।
আমি বলতে শুরু করলাম ডাঃ ভাইকে উদ্দেশ্য করে, ‘সাদিক ভাই, আব্বার একটা ঘটনার কথা কি বলব? যদি শুনতে চান !’
সাদিক ভাই বললেন, ‘না না বলেন, শুনব না কেন? বলুন বলুন !’
আমি বলতে শুরু করলাম।
আমিছিলাম ৭৪ সালের এস এস সি পরীক্ষার্থী। গ্রামের ছেলেতো একটু বেশী বয়সে আমারএই পরীক্ষা দেওয়া। আমার বয়স প্রায় ১৭-১৮ হবে। আমি বাবার ১ম সন্তান, তখনোএকমাত্র। আমার কোন বোন নাই, মা অসুস্থ্য থাকেন নিয়মিত। বাবা আমাকে বিয়েদিয়ে বাড়িতে একজন মেয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বুঝলেন সাদিক ভাই, আমরাবাবাকে খুব ভয় পেতাম। তাই বিয়ের ব্যাপারে না বলতে পারিনি। বাবা আমার জন্য ৫জন মেয়ে দেখে রেখেছেন। ৪ জন কুমারী, ১ জন বিধবা। বিধবা মেয়েটি মাত্র ৩ মাসআগে বিয়ে হয়েছিল। কখনো শশুর বাড়িতে যায় নি। এক্সিডেন্ট থেকে স্বামী মারাগেছিল। আমার বউয়ের হাত আমার থেকে খুলে গেল। বুঝলাম বউয়ের ভয় কেটে যাচ্ছে।আর আমার বিয়ের খবরে সে কোন নতুন রহস্য খুঁজে পেতে সোজা হয়ে উঠছে।
সাদিক ভাই বললেন, ‘ইসমাইল ভাই, চা টা একটু দেরীতে হলে ভালো হত। ফেরি ঘাট এসে গেল মনে হচ্ছে। আর এক কাপ চা খাওয়া যাবে?’
আমি বললাম, ‘দেখি ওরা কি বলে?’ বলেই বেয়ারাকে চা দিতে বললাম। কিন্তু দুই কাপ। বউ খাবে না।
ড্রাইভার এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আমি নিচে যাব?’
আমি আমার এই সোজা টাইপ ড্রাইভারকে খুব পছন্দ করি। কিন্তু ও এতক্ষন কই ছিল?
আমি ওকে কাছে ডেকে বললাম, ‘তুই এতক্ষন কই ছিলি রে? দেখলাম না কেন?’
ড্রাইভাররহমত বলল,’ স্যার আমি নিচে ছিলাম। গাড়ির পাশেই ছিলাম। আপনাকে বলতে এসেছি।আপনারা চা খেয়ে নিচে আসুন। গাড়ি নামিয়ে আমি সাইডে দাঁড়াই।’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। রহমত চলে গেল । গরম চা চলে এলো।
চাখেতে খেতে আমি গল্প শুরু করতে চাইলাম। কিন্তু লোকজন খুব শব্দ করতে করতেফেরি থেকে নামছিল বলে মুড নষ্ট হয়ে গেল। চা খাওয়া শেষ করে আমরাও নামারজন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। নিচে গিয়ে দেখলাম গাড়িটা তখন নামার লাইনে উঠেনি। আমরাসকলে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি নেমে পড়ল ফেরি থেকে।
গাড়ি চলছে।
সামনেরসিটে খুব আয়েশ করে সাদিক ভাই বসেছেন। আমি বউকে নিয়ে পিছনে। সাদিক ভাই পাছেড়ে আরাম করে বসে ঘুমিয়ে পড়েছেন বলে আমি ক্যাসেট ছাড়তে বললাম। বারীসিদ্দিকির গান...প্রেমের গান, দেহতত্ত্ব নিয়ে গান।
সাদিক ভাই আমাকে চমকে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ইসমাইল ভাই, গল্পটা শুরু করেছেন, শেষ করুন !’
বউ নেড়েচেড়ে উঠল। বুঝলাম বউয়ের আগ্রহ এখনো আছে !
আমি বললাম, ‘আচ্ছা, কোথায় যেন শেষ করেছিলাম?’
বউ বলে উঠল, ‘তোমার বাবা পাত্রি ঠিক করেছেন ৫ জন। একজন বিধবা।’
আমি বললাম, ‘মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। ধন্যবাদ গিন্নী।’
আমিআবার শুরু করলাম আমার অতীতের স্মৃতিমাখানো ঘটনা, যার সাথে আমার বাবা জড়িয়েআছেন। আমার বাবা আমার জন্য ৫ জন মেয়ে ঠিক করেছেন। ৪ জন কুমারী, ১ জন সদ্যবিধবা। ৪ কুমারী আমার সম্বন্ধে শুনেই না করেছে। হয়ত এসএসসি পরীক্ষার্থীবিবাহের জন্য যোগ্য বয়স নয় বলেই, তারা আমাকে বয়কট করেছে। বাবা বিধবা মেয়েকেদেখতে সব ব্যবস্থা করেছেন।
আমরা জনা ৭ গেলাম বিধবারবাবার বাড়ি। আমার ২ জন চাচাতো বোন জামাইও আছে। তাদের দুই জনের মাঝে আমি বসেআছি। আমাদের পিছনে আরও ৩ জন গ্রামের লোকজন। আব্বা একাই বসেছেন সবার আগেএকটা হাতলওয়ালা চেয়ারে। ঘরটি ছিল দক্ষিনমুখী বেশ প্রশস্থ। চৌচালা ঘর। বিকালপ্রায় ৪ টা বেজে গেছে। মেয়েকে আমাদের দেখানো হয়েছে। সুন্দর মেয়ে। চোখদুইটি পটল চেরা। চাহুনি খুব তীক্ষ্ণ এবং ঝাঁঝালো। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম।
দুলাভাইদের বললাম, ‘এই চলেন না, বাহিরে বেড় হই !’
বাবা আমার কোচরমোচড় দেখে কিছুটা রেগে বলে উঠলেন, ‘শোন, চুপ করে বসে থাকো। মেয়ের দাদা এলে জেনে যাব, মেয়ে তোমায় পছন্দ করেছে কিনা!’
বড় দুলাভাই পুরনো লোক। বংশের বড় জামাই। উনি বললেন, ‘ছেলেকে পছন্দ করবে কেন? আমরা তো মেয়ে দেখতে এসেছি !’
বাবা বললেন, ‘আমার ছেলেকে পছন্দ করলেই আমি খুশী। ৪ জন না দেখেই বাদ দিলো। বুঝেছ !’
আমরাসবাই বুঝলাম আসলে আব্বা আমার বউ দেখা নিয়ে খুব চিন্তিত । আমরা আর কথাবাড়ালাম না। ২০ মিনিট খানিক বাদে মেয়ের দাদা না এসে, চাচা এলেন। তিনিআব্বাকে উঠিয়ে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। আব্বার নরম গলায় কথা শুনা গেল, ‘বুঝলাম ঠিক আছে, আমি মেয়েটার সাথে একটু কথা বলতে চাই।’ বলেই এসে ঘরেরচেয়ারে বসে পরলেন।
এইবার মেয়েটির দাদা এলেন আমাদের সামনে। বললেন, ‘ঠিক আছে বাপু, মেয়েকে আনতে বলেছি। কিন্তু মেয়েকে অপমান করে যাবেন না।’
আমরাঘরের ভিতরের বাকি লোকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি, কিন্তু কেউ কিছু বুঝতেপারছিনা। মেয়ে এলো আবার। আগেরমতই সাজানো। শক্ত পায়ে ঘরে ঢুকল। আমি মুখেরদিকে একটু তাকানোর চেষ্টা যে করিনি তা নয়, কিন্তু মেয়েটির পটলচেরা চোখেসিংহের চাহুনি। আমার গলা শুকিয়ে এলো।
বাবার খুব নরম স্বরে মেয়েকেডেকে কাছে নিল। মেয়েকে প্রায় বুকের কাছে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ বলত মেয়ে, তুমি কেন অপছন্দ করলে আমার ছেলেকে ?’
মেয়ে কোন সময়ক্ষেপন না করে স্পষ্ট গলায় উত্তর দিল, ‘হাবা’।
বিনাবাক্য ব্যয়ে আব্বা মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। কিন্তু ৫০০টাকার একটা মুজিবওয়ালা কাগজের টাকা মেয়ের হাতে গুজে দিতে ভুল করলেন না।আব্বার সাথে সাথে আমরা ৬ জনের বাহিনীও উঠে পরলাম । ভয়ে কেউ খাওয়ার কথাবললাম না। মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম বসন্তপুর। তা প্রায় এক ঘণ্টার পথ। আমরাফিরছি চুপ চাপ। ক্ষুধায় পা চলছে না। মাঝে এক গ্রামের মধ্যে বাবা দাঁড়ালেন।মসজিদে আছরের নামাজ পড়লেন। বাড়িতে আসতে আসতে মাগরিব হয়ে গেল।
আমি বাড়িতে এসেই মাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘মা ভাত দাও। ক্ষুধায় মরে গেলাম।’
মারান্না ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। বাবা হটাত রেগে মাকে বলতে শুরু করলেন, ‘ইসমাইলের মা, লাঠিটা দাও তো! যেই পোলারে বিয়ে দিতে পারুম না, তারে বাড়িতেই রাখুম না। হাবা গোবারে পাইল্যে কোন কিচ্ছু হবে না।’
আমার অবস্থাবুঝতে দেরী হলনা। বুঝলাম ভাত কপালে নাই। পকেটে হাত ঢুকায়ে দেখি ২৩ টাকা ।পকেটে হাত রেখেই দিলাম ভোঁ দৌড়। দৌড় ... দৌড়... দৌড়। একেবারে রাতেই রাজবাড়ীটু ঢাকা । ঢাকায় এসে এক পরিচিত বন্ধুর মেছে উঠলাম। তারপর এই হোটেল, ঐদোকানে চাকুরি করে জগন্নাথ কলেজের নাইট শিফটে আইএ পাশ করলাম। ঐযে বাড়িছাড়লাম আর বাড়ি গেলাম না। ১১/১২ বৎসর বাবা -মায়ের মুখ দেখিনি।
গাড়ির পরিবেশ কিছুটা শীতল হয়ে গেল। বাড়ি সিদ্দিকির প্রেমের ঝংকার কানে লাগছে।
বউ বলল, 'থামলে কেন? তারপর?'
আমি বলে চলেছিঃ
এইদীর্ঘ সময় বাবাকে আমার খোঁজ কেউ দেয় নি। কিন্তু আইএ পাশ করার পর আমিকোর্টের উকিল পাড়ায় উকিলদের হেল্পারি করতে শুরু করেছি। টাকার ধান্দায় পড়েআর পড়াশুনা করতে পারিনি। আমার গ্রামের একলোক বাবাকে আমার কথা বলেছিলেন।বাবা আমাকে তার মাধ্যমে বাড়ি যেতে বলেছিলেন যে, মায়ের খুব অসুখ; এই বলে।আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এর মাস ৩ পর মায়ের মারা যাওয়ার খবর শুনে বাড়িগেলাম। নিজের ভিতর একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। আমি একটানা ১ মাস বাড়িতেথাকলাম।
ড্রাইভার গাড়ি থামাল পেট্রোল পাম্পে। আমাকে বললযে তেল নিতে হবে। আমি তেল নিতে থাকায় গাড়ি থেকে নিচে নামলাম। রাস্তায়দাঁড়িয়ে একটা বেনসনে সুকটান দিতে মিস করলাম না।
গাড়ি আবার ছাড়ল। আমি চুপ করে বসে আছি।
বউ বলল, ‘বিয়ের কি হল ! তোমার এই এক অভ্যাস। একটা শুরু করে অন্য দিকে যাও !’
আমিবললাম, ‘অহ, ভুলেই গিয়েছিলাম !’ আব্বা আবার আমার বিয়ের চেষ্টা করলেন, মামারা যাওয়ার ১০ দিনের মাথায়। গ্রামের সহনাভুতি দেখাতে আসা লোকদের বলেন, ‘আমার ছেলে ১১-১২ বৎসর ঢাকায় ছিল । বিএ (বেশী করে বলা, গ্রামের লোকদেরএকধরনের চালাকি বা আমার বিয়ের বাজারে দর বাড়ানো ) পাশ দিছে। এখন ওরে আর কেউহাবা বলে, বিয়েতে না করতে পারবে না।’
মা মারা যাওয়ার ঠিক ২৩ দিনের মাথায়আব্বা আমাদের নিয়ে মেয়ে দেখতে গেলেন। যথারীতি বংশের বড় জামাই আমার দুলাভাইআমার সাথে। এইবার বাবা আমি আর শুধু বড় দুলাভাই; মাত্র ৩ জনের বাহিনী।ফরিদপুরের মুসলিম মিশন এলাকার এক বাড়িতে। ভদ্রলোকের ২ মেয়ে কোন ছেলে নাই।মেয়ে আই এ পাশ করেছে ১ বৎসর। ভালো ছেলে পাচ্ছে না তাই বিয়ে দিতে পারছে না।আমরা যেতে যেতেই বেলা ৩ টা করে ফেলেছি। পেটে খুব ক্ষিধা। দুলাভাই আর আমিমুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। দুলাভাই বললেন যে, মেয়ে দেখার আগে খাওয়ার কথা বলাযাবে না। সবর করতে হবে। পৌনে ৪ টা বাজে। আর কত অপেক্ষা করা যায়। আমার মুখশুকিয়ে রাজহাঁসের মত হয়েছে। এক গ্লাস শরবত দিছে তাতে লবন দেয়া। বাড়ির কেউদুষ্টুমি করেছে। এদেশে বিয়েতে অনেক কিছুই হয় ! মুখটা আরও কাস্টে স্বাধেরহয়ে গেছে।
৪:১৫ তে মেয়ে এলো। ৩ জন মানুষ। সোফায় বসেছি।ডাবল সোফায় আমি দরোজাকে পিছনে রেখে। সাথে দুলাভাই। সিঙ্গেল সোফায় বাবাদরোজার দিকে মুখ করে। মেয়েকে নিয়ে মেয়ের চাচী ঢুকেছেন। আমার সোফার সামনেএসে দাঁড়াল। আমাদের দিকে মুখ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। চাচী কানেকানে কিছু বলে দিল। মেয়ের মুখ একটু উচু করে দিল চাচীয়ে। কনে এইবার আমারসামনে এসে দাঁড়াল। আমার একটু শরম লাগছিল। মেয়ে আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েবলল, ‘আসসালামো আলাইকুম, চাচা !’ বলেই আমার পা ধরে কদমবুছি করার জন্য নিচুহতে শুরু করল। আমি কি করব বুঝতে পারলাম না। মেয়ের হাত প্রায় আমার পায়ে, আমিমেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম। তাকে সোজা করে দাঁড়িয়ে তুলে বললাম, ‘দোয়া করি সুখিহও মা।‘
এরপর আর কারো দিকে না তাকিয়ে হন হন করে বাড়ি থেকে বেড়হলাম। এমন কি বাবার দিকেও তাকালাম না। সোজা ঢাকায় এসে রাতের খাবার খেলামগুলিস্তান রাজধানি হোটেলে। তখন আমি আলুবাজার এক মেছে থাকতাম।
জোরে বলে উঠলাম, ‘বুঝলেন সাদিক ভাই, এইবারও আমার বিয়ে হলনা।’
সামনেরসিটের ডাঃ সাদিক ভাই হাসতে হাসতে মাথা নুইয়ে ফেলছেন। ড্রাইভার হাসছেকিন্তু শব্দ করছে না। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার বউ হাসতে হাসতে মুখ ওড়নায় ঢেকেফেলেছে। কেউ কোন কথা বলছে না।
ড্রাইভার ক্যাসেট বদলিয়ে দিল। মেহেদি হাসানের গজল বেজে উঠল, ‘চুপকে চুপকে...’
সামনের সিটের ডাঃ সাদিক ভাই চুপ থাকলেন না। বলে উঠলেন, ‘এরপর কি হল?’
আমিবললাম কি আর হবে ভাই। গরীব মানুষের জীবন। চলতে থাকল। আমি লজ্জায় ক্ষোভে আররাজবাড়ী যাইনা। ৩ বৎসর পর এক বন্ধু এলো আমার মেছে। ওর কাছ থেকে শুনালামআমি চলে আসার ৩ দিন পর আব্বা বিয়ে করেছে পাশের বসন্ত পুরের সেই বিধবামেয়েকে। যার সাথে নাকি আব্বা এতদিন একটা গোপন সম্পর্ক চালিয়ে এসছে।
এইটাজেনে আমি আর মনের দুঃখে বাড়ি যাইনি। সেই ঘরে আমার ২ ভাই আর এক বোন আছে।বোনের বিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ভাইদের বিয়ে দেয় নি। আসলে আব্বা ছেলের বিয়েতেউৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সে মনকষ্ট নিয়েই কিছুটা অভিমানে চলে গেলেন।
অবশেষে৯০ সালে আমার এক বন্ধুর ঘটকালিতে আমি এই মহিলাকে বিয়ে করেছি। কিন্তু বউটাআমার খুব লক্ষ্মী বউ। শুধু স্বাস্থ্য হয়না। শুকনো বউ মনে রস কম... বলেইবউকে চেপে ধরলাম।
বউ হাসতে হাসতে বলতে লাগল, ‘ডাঃ ভাইকে বলে এইবার আমার মোটা হওয়ার ওষুধ নিয়ে দিবে, ঠিক আছে !’
আমি বলে উঠলাম, ‘সাদিক ভাই, শুনলেন তো ... আমার বউকে এইবার মোটা না বানাইলে, আপনার খবর আছে কিন্তু !’
সাদিক ভাই হটাৎ করেই প্রশ্ন করে বসলেন, “তা ইসমাইল ভাই, ঘটনাটা সত্যি হলেও ভাবির সামনে বলা কি ঠিক হল?” বলেই পিছনের দিকে তাকিয়ে আমারে ও আমার গিন্নীকে দেখতে লাগলো।
ডাক্তারি মন আর চোখ সবসময় রুগী খুঁজতে থাকে যে ! আমি ভাবছিলাম ডাক্তার সাহেব কি বন্ধু গিন্নীর চিকিৎসা দিয়ে প্রীত হতে পারছেন না, আমাকেও রোগী বানাচ্ছেন , তাও বউয়ের সামনে ! আমি আসলেই বেকুব হওয়ার যোগার, কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
এমন সময় আমার বোকা বোকা বউ বলে উঠলঃ বুঝলেন না ভাই, শুন্যতা ! বাবার মৃত্যুতে ওর মনে বিরাট শুন্যতা বিরাজ করছে। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। জীবন শুন্যতায় বেশিক্ষন থাকতে পারেনা বলেই লুকিয়ে থাকা অজানা কাহিনী গুলো নিমিষেই বলে বলে, কখনো কখনো সেই শুন্যতা পুরন করতে চায়; ঢাকতে চায় জীবনের ক্ষতগুলো। আপনি আর ব্যাচারাকে প্রশ্ন করে বিব্রত করিয়েন না !”
আমি জীবনের প্রথম আমার বোকা বউয়ের এই বুদ্ধিমান উক্তি শুনে বুঝলাম, আসলেই আমি হাবা, বাবার প্রিয় হাবাই রয়ে গেলাম !
ঘড়িতে৬ টা বেজে ১২ মিনিট । গাড়ি চলতে চলতে নবীনগর ছাড়িয়ে সাভারের জ্যামে ঢুকেপড়ল। সন্ধ্যার আগেই ডাঃ সাদিক ভাইকে চ্যাম্বারে পৌঁছে দিতে হবে। রোগীরা বসেথাকবে।
ড্রাইভার কে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে যা, বুঝলিরে হাবা !’