রুম্পাদের বাড়ি বাঙ্গালী নদীর পাড়ের এক নিভৃত গ্রাম। গ্রামের নাম রংরার পাড়া। বর্তমানে সোনাতলা উপজেলায় হলেও একসময় এটা গাবতলি থানার অধীনে ছিল। বগুড়া জেলার বাঙ্গালী নদি বেষ্টিত এই গ্রামের রূপ শুধা যে কিছিল, যারা এখানে বাস করে তারাই জানে। কি ছিল না এখানে? ধান, পাট, মরিচ, মশুর,মুগ, ছোলা, আখ, কাউন, খেরাচি, তিল, তিশি, যব আরও কত কত সবজি; তার সব কিছুর নাম কি সে জানে?সাথে এই নদীর টাটকা মাছ যেন সেই রুপের সাথে অলংকারের শোভা বাড়িয়েই চলে এই গ্রামের!পলিমাটি দিয়ে ঘেরা অপরুপ এই গ্রাম রুম্পার মতে শ্রেষ্ঠ গ্রাম। যদিও রূম্পা একমাত্র শীতকালেই নদীর কুলে যেতে পারে, বালুচড়ে বড়দের সাথে খেলতে পারে, অন্য সময় নয়। কারন, অন্য সময় নদিই চলে আসে তাদের বাড়িতে। তখন দেখা যায় আরও এক সুন্দর জলের খেলা। বাড়ির উঠানে বসে নদীর ঢেউ দেখতে রুম্পার খুব ভালো লাগে। বাড়িরসামনে তখন ৩-৪ টি নৌকা সবসময় বাঁধা থাকে। কত বড় বড় নৌকা পাল তুলে ভেসে যায় নদি দিয়ে, যার বেশির ভাগ পালের রং সাদা । আবার সে সময় তার মন খারাপ থাকে, কারন তখন প্রায়ই স্কুলে যাওয়া হয়না। স্কুলের ঘর থাকে এক হাঁটু বা এক কোমর পানিতে তলিয়ে। স্কুলে না যেতে পারলে রুম্পার খুব কষ্ট হয় । স্কুল ওর খুব ভালো লাগে, স্বাধীনভাবে বাইরে থাকতে পারে যে !
রূম্পা সকাল থেকেই খুব বিস্ময়ে একটা বিষয় লক্ষ্য করছিল যে, তাদের বাড়িতে কারা যেন এসেছে; তাদের কে আগে দেখেনি। রুম্পার বয়স ৬ কি ৭ বৎসর হবে। সবাই তাকে খুব আদর করে, কিন্তু তার মনের জমে থাকা সকল প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে চায় না। রূম্পা তাই বড়দের মত গম্ভির হয়েই থাকতে চায়, কিন্তু পারে না।তাদের বাড়ির কোল ঘেঁষে আরও একটি বাড়ি ছিল। বাড়ি না ছাই ! সে এখন স্কুলে যায় স্কুলের বইতে পড়েছে,‘দুই বা দুইএর অধিক ঘর একত্রে বাড়ি বলে।’ কিন্তু এখানে একটি বড় ঘর আছে, অবশ্য সাথে একটি ছোট্ট রান্নাঘরও আছে। সেই হিসাবে একে বাড়ি বলা যায়। তাদেরও দুইটি বড় ঘর ও একটি রান্না ঘর আছে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে যে বড় ঘরটি আছে, তার ভিতর আবার আরও ৩ টি ঘর বানানো আছে। একটিতে তার দাদি, একটিতে তার সবচেয়ে বড় জ্যাঠা আর একটিতে তার বড় ৩ ভাই ঘুমোয় ! অন্য বড় ঘরটিতে সে, তার এক বোন, বাবামা ঘুমোয়। এই ঘরে ২ টি চৌকি আছে। মাঝে মাঝে সে দেখে বড়বোন তাহেরার বুকে ঘুমিয়ে আছে। আবার কোনদিন দেখে সে বাবামায়ের মাঝে সীমানা প্রাচীর হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু রূম্পা একটি বিষয় জানেনা বা বুঝেনা যে, সেতো প্রতিদিনই বাবামায়ের সাথে ঘুমোয়! কিন্তু মাঝে মাঝে কেন তাহেরা আপুর বুকে তাকে পাওয়া যায় ?
রূম্পা আপনমনে ভাবছিল যে,বইয়ে যতই লেখা থাক না কেন,শুধু কয়েকটি ঘর একসাথে থাকলেই তাকে বাড়ি বলা ঠিক নয়। তারমতে কয়েকটি ঘরে যখন মানুষ বাসকরে, তখন তাকে বাড়ি বলা যায়। একদিন বড় ভাই আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করেছিল এই কথা। উনি কত্ত বড় বড় বই পড়েন !
আব্বাস ভাই রুম্পাকে কোলে নিয়ে আদর করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ওরে আমাদের মাস্টার বুড়িরে, কত ছোট্ট মানুষ, কত বড় প্রশ্ন করেছে ! বড় হলে জানবি এর আসল উত্তর কি !’
আচ্ছা বড় ভাইয়ের এই উত্তর কি ঠিক? উনি আসলে ছোটদের বুদ্ধিকে দাম দিতে চান না। রুম্পাদের পাশের ঘরে ও কোন দিন কাউকে থাকতে দেখেনি। কিন্তু গত ঈদে যখন অনেক লোক এসে ওদের বাড়ি ভরে গেলো, তখন শুধু কাউকে কাউকে থাকতে দেখেছে। কিন্তু গত ৩-৪ দিন হল এই বাড়িতে যারা এসেছে, তাহেরা আপু বলেছে তারাই এই বাড়ির মালিক !
রুম্পাঃ আপু, পাশের বাড়িতে যারা এসেছে তারা এতদিন থাকেনি কেন?
তাহেরা আপুঃ ওরা শহরে থাকে, ওর বাবা আমাদের চাচা হয়। শহরে চাকুরি করে।
রুম্পাঃ তাহলে এতদিন কেন আসেনি? ঈদেও তো আসেনা।
তাহেরা আপুঃ ওদের বাবা অনেক বড় চাকুরি করে, অনেক দূরে থাকে। সেখানেই ঈদ করেন। এখন ঘুমোও !
রুম্পাঃ অ,আচ্ছা।
চুপ করে গেলেও কিন্তু রুম্পার মন ভালো হয় না। মনে আরও অনেক প্রশ্ন ছিল। ওদের বাড়িতে যে ছেলেটি এসেছে সাথে একটি ছোট্ট বোনও আছে, তাদের নাম কি, কি করে... ইত্যাদি। তার ধারনা আপু সব জানে, কিন্তু আপু তার প্রশ্নে রেগে যাচ্ছে। বড়রা এমন একটুতেই রেগে যায় কেন?
**************************************************************************
রূম্পা আজ ঐ বাড়িতে গিয়েছিল একা একা। প্রথমে খুব ভয়ে ভয়ে গিয়ে ওদের বাড়ির দরোজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। চুপ করে দেখছিল ওরা কি করে। বাড়িতে তখন ছিল শুধু ৩ জন। ছেলেটি যার নাম পরে জেনেছে, শিমুল। বোন আয়েশা আর ওদের মা, রুম্পার চাচি। চাচি দেখতে খুব সুন্দর, ফর্সা। দেখলে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা ওর মা কেন এতো ফর্সা হল না ! তাহেরা আপুকে একদিন জিজ্ঞাসা করা দরকার !
ছেলেটি ওকে প্রথম দেখে। ওর চেয়ে বেশ লম্বা। কিন্তু হাল্কা পাতলা এবং ওর মত ফর্সা। এগিয়ে এসে ওকে হাত ধরে ওদের ঘরে নিয়ে যায়।
বলে, ‘এই মেয়ে, তুমি এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো, আমাদের সাথে খেলবে এসো।’
রূম্পা কোন কথা বলতে পারে না; শুধু ছেলেটির হাত ধরে ওদের ঘরে ঢুকে যায় !
ছেলেটিঃ তোমার নাম কি? তোমাদের বাসা কৈ?
রুম্পাঃ আমার নাম রূম্পা। আমাদের বাড়ি ঐযে, ঐটা ! বলেই আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
ছেলেটিঃ তুমি কি একা ? তুমি কোন ক্লাসে পড়?
রুম্পাঃ আমি একা না। আমার বড়৩ ভাই আর ১ বোন আছে, দাদি আছে, জ্যাঠা আছেন। মাবাবা আছেন।
ছেলেটি রূম্পা মেয়েটির উত্তরে খুব মুগ্ধ হয়ে যায় !
এবার নিজের থেকেই বলে, ‘আমরা ১ ভাই ১ বোন। তবে আম্মু বলেছে আরও একজন আসছে। আব্বা ও আম্মু আছে। এই যে আমার ছোট বোন আয়েশা আক্তারি। ওহ, আমি শিমুল। আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আয়েশা এইবার স্কুলে যেত, কিন্তু এখন যে গ্রামে এলাম, তাই কি হবে জানিনা।’
রুম্পাঃ তুমি ক্লাস থ্রিতে পড়? বলেই হেসে দেয়।
শিমুলঃ তুমি হাসলে কেন? তোমার বিশ্বাস হয়না বুঝি ! আমি ইংরেজি পড়তে পারি। আরবি পড়তে পারি। বাংলায় সব বড়দের বই পড়তে পারি। কিন্তু আমার হাতের লেখা খুব খারাপ। আমি এখন সেই হাতের লেখা ভালো অরার চেষ্টা করছি।
রুম্পাঃ না, না । আমাদের তাহেরা আপু বলে যে, ওয়ান ফুলের বাগান, টু আল্লার বন্ধু, থ্রি পায়খানার মিস্ত্রি...হে হে হে !
শিমুলঃ এই সব কি বল তুমি। ছি ছি লেখা পড়া নিয়ে এসব বলতে নাই। তাইলে বেশী লেখা পড়া হয় না। আব্বু শুনলে তোমায় খুব পিটনি দিবে। আর কোন দিন এসব বলবে না।
আয়েশা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু এসব বলিনা, তাইনা ভাইয়া ! আমি খুব ভালো মেয়ে, ঠিক না !’
শিমুলঃ হা, তুমি আমার খুব লক্ষ্মীবোন। এসব বলে না। এসব খারাপ কথা ! খারাপ কথা মুখে নিতে নাই, আল্লাহ্ গুনাহ দেয়।
রূম্পা মন খারাপ করে চলে আসে। ও খারাপ মেয়ে হিসাবে ধরা খেয়া গেল ওদের সামনে। কিন্তু নিজের বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে ওর মনে হয়, শিমুল ভাইয়া ঠিক বলেছে। এগুলো কেন বলবে, থ্রি পায়খানার মিস্ত্রি, ফোর হেড মাস্টারের জুতো চোর ! ছি ছি এসব আসলেই পচা কথা। এসব সে আর কোন দিন বলবে না, শুনবেও না। তাহেরা আপুকেও না করে দিবে, এসব পচা কথা যেন আর না বলে। শিমুল ভাইয়া খুব ভালো ছেলে ... রুম্পার খুব পছন্দ হয়ে যায় !
**************************************************************************
শিমুলরা ঢাকা শহরে থাকত। জিগাতলা স্টাফ কোয়াটারে ওদের দুই রুমের সরকারি বাসা। কিন্তু আব্বু বারান্দাকে ঢেকে রুম বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানে অতিথি এলে থাকতে দেয়া হত। অন্য সময় আব্বা ওখানে নামাজ পরতেন, অফিসের কাজ করতেন । বাসার সামনে কত্ত বড় খেলার মাঠ। শিমুল পড়ত ঢাকার বিখ্যাত স্কুল ঢাকা ল্যাবরেটরি স্কুলে। কত্ত ভালো ভালো ছাত্র এখানে পড়ত! কত বড় বড় অফিসারের ছেলে, বড় লোকদের ছেলে। শিমুল তাদের কাছে কিছুই নয়, কিন্তু ও ছিল ভালো ছাত্র। তাই শিমুলের খুব নাম ডাক ছিল। কিন্তু মার্চ ১৯৭১,মাসে কি যেন হল। শুনেছে ২৫ তারিখের রাতে অনেক লোক মেরে ফেলেছে পাক আর্মি। ওদের কোয়াটার এক দিনরাতের মধ্যেই খালি হয়ে গেলো।সকলেই যে যেমন পেরেছে নিজেদের গ্রামে চলে যাচ্ছে। শুধু মসজিদের ইমাম আর মোয়াজ্জিন বলছে যে,‘ভয়ের কিছু নাই। আর্মিরা নামাজিদের মারেনা।‘
ওরা শুনেছে পাক আর্মিরা সকল সরকারি কোয়াটারে আগে হামলা করবে। ওর বাবা প্রথমে কয়দিন চুপ করে দেখতে চেয়েছিল, কি ঘটে! কিন্তু অফিসে যাওয়ার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাশের পর লাশ দেখে, রাতেই হটাত করে দেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে ট্রেন ধরে। কিন্তু ট্রেন জামালপুর এসে আর যায়নাই। সারারাত এক গ্রামে এক লোকের বাড়িতে ওরা কাটিয়েছে। পরেরদিন এক বড় পালতোলা নৌকা করে যমুনা নদি পারি দিয়ে ফুলছড়ির সাঘাটা গ্রামে এসেছে। ওদের সাথে আরও অনেক লোকজন পার হয়েছে। ওর মনে হয়েছে সবাই ওদের মত শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে ! সাঘাটা এই গ্রামে তাদের বড় ফুফুর বাড়ি । সেখানে ৩ দিন বিশ্রাম নিয়েছে। তারপর কিছু পথ গরুর গাড়ি, কিছু পথ হেঁটে আর বাকি পথ নৌকায় করে এই দাদার বাড়ি এসেছে। যেদিন এসেছে সেদিন শিমুলের মনে আছে এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ শনিবার ছিল। শিমুল এর আগেও একবার এসছিল, কিন্তু তার সেই কথার কিছুই মনে নাই। তার মায়ের কাছে শুনেছে। তবে আয়েশা এই প্রথম।
রূম্পা আজ আবার শিমুলের বাসায় বেড়াতে এসেছে। আজ চাচি তাকে খুব আদর করেছে। নিজ হাতে ভাত তুলে খাইয়েছে তিন জনকেই। রুম্পার দুই চোখ জলে ভিজে গেছে। ওর মনেই পরেনা ওর মায়ের হাতে কোন দিন এমন মুখেতোলা ভাত খেয়েছে কিনা। সে শুধু দেখেছে সারাদিন তার মাকে বাড়ির কাজ করতে। বাড়ির রান্না, গরুর খাওয়া, বাড়ি ঝারু দেয়া, কাপড় কাচা...সব কাজ করতে করতে এক সময় নিজেই ঘুমিয়ে যায়; রুম্পাকে তুলে কখন খাওয়াবে !চাচি কিন্তু বুঝতে পারেনি রুম্পার চোখে কেন পানি এসেছে। উনি ভেবেছেন তরকারিতে খুব ঝাল হয়েছে। উনি পানি খাইয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা শহরের মানুষ এতো বোকা আর সহজ সরল ভালো হয় কেন?
খাওয়া শেষে শিমুল ভাইয়েরা ঘুমুতে গেছে। দুপুরে নাকি খাওয়ার পর ঘুমুতে হয়। আজ রুম্পাও ওদের সাথে বিছানায় উঠেছে। সে এতো দিন এই সময় পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াত। গ্রামের শেষভাগে যে বাঁশঝাড় আছে, তার ছায়ায় বসে বসে হাড়ি পাতিল নিয়ে খেলত। হাড়ি পাতিল হল মাটির, আর প্লেট হল কাঁঠাল পাতা দিয়ে। ওর বয়সের আরও ৪-৫ জন আছে, তারাও আসত। কত কি রান্না করত আর সবাই মজা করে খেত ! কিন্তু শিমুলরা এখনো কোনদিন বাহিরে যায় নি। ওরা বাড়ির ভিতরেই থাকে। রূম্পা চায় ওদেরকে নিয়ে বাঁশঝাড়ে গিয়ে মজার মজার রান্না খাওয়ায়। শিমুল আর আয়েশার সাথে রুম্পাও শুয়ে আছে। ওরা কেউ ঘুমোয় নি। আয়েশার পেটে শিমুল ভাই এমন করে চিমটি দিয়েছে যেন ও ভাবে রূম্পা দিয়েছে। রূম্পা এতে খুব মজা পেয়েছে। সে ভাবছে শিমুল ভাইয়া যদি আমাকেও অমন করে চিমটি দিত, কতই না মজা হত! শিমুল ভাই কি রুম্পার মনের কথা বুঝতে পেরেছে? সে এবার ওর পেটে ক্যাতু কুতু দিয়েছে। রূম্পা খুব হাসতে লাগলো।
চাচি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘এই বেশী হাসা ভালো না, পরে কাঁদতে হবে কিন্তু। হাসির পর কান্না, সুখের পর দুঃখ আসে,জেনো!’ চাচিকে দেখেই শিমুল ভাইয়া চুপ চাপ হয়ে গেলো। যেনো সে এর কিছুই জানেনা, সুবোধ বালক। আয়েশা আসলেই তখন ঘুমিয়ে গেছে।
চাচি বলে গেলেন, ‘আমি এখন গোছল করতে যাচ্ছি। তোমরা চুপ করে শুয়ে ঘুমোও। আমার আসা পর্যন্ত বাড়িতেই থেকো।’
চাচি চলে যাওয়ার পর শিমুল ভাই কিছুক্ষন চুপ করে বিছানায়বালে মাছের মত পরে থাকলেন।রূম্পা নড়াচড়া করে উঠল। কারন সে এমন করে ঘুমিয়ে থাকতে অভ্যাস্ত নয়। শিমুল উঠে মেঝেতে বসল। রুম্পাও ওর দেখাদেখি উঠে এলো। মেঝেতে নেমে দেখে শিমুল ভাইয়া চৌকির নিচ থেকে একটা রেল গাড়ি বের করেছে। সেখানে কি একটা চাবি দিলে চলতে থাকে।
রূম্পা খুব বিস্ময় নিয়ে গাড়ির চলাচল দেখতে থাকল, আর শিমুল ভাইয়ার দিকে লক্ষ্য করতে লাগল।
শিমুলঃ তোমার ভালো লেগেছে?
রুম্পাঃ খুউব।
শিমুলঃ গাড়িটা সুন্দর না?
রুম্পাঃ খুউব সুন্দর।
শিমুলঃ তোমার এমন গাড়ি আছে?
রুম্পাঃ না। আমাদের কেউ এমন গাড়ি আগে দেখেনি। আচ্ছা এইটা কি খুব দামী?
শিমুলঃ আমি জানিনা। আমি এইবার ক্লাসে ১ম হয়েছিতো, তাই আব্বু আমাকে কিনে দিয়েছে। বলেছিল, যদি এইবার ১ম হতে পারি তবে একটা হেলিকপ্টার কিনে দিবে। কিন্তু... একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো শিমুলের নাক দিয়ে।
রুম্পাঃ আমাদের অনেক সুন্দর মাটিরহাড়ি পাতিল আছে। আমরা প্রতিদিন এইগুলো নিয়ে ঐ যে বাঁশঝাড়ে বসে খেলি। কত কি রান্না করি। মজার মজার রান্না। মিছেমিছি রান্না। কত মজা হয় !
শিমুলঃ তাই নাকি? তা কি কি রাঁধতে পারো তুমি?
রুম্পাঃ আমি ভাত, পোলাও, খিচুড়ি, শাকের তরকারি, গোস্ত কত কি রাঁধতে পারি !
শিমুলঃ তুমি তো খুব ভালো বউ হবে, দেখছি !
এই কথা শুনে রূম্পার খুব লজ্জা পায়। সে শিমুলের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলে,‘যাও !’
রুম্পার এই ব্যবহার শিমুলের খুব পছন্দ হয়। সে বলে, ‘তা আমাকে তোমার রান্না খাওয়াবে না?’
রুম্পা যেন ঠিক এই কথার অপেক্ষায় ছিল। সে সাথে সাথেই বলে উঠল, ‘যাবে?’
শিমুলঃ অবশ্যই যাব। তুমি আমাকে দাওয়াত দিলে আমি কি না করতে পারব? কিন্তু আজ না। আজ মা আমাদের বাসায় থাকতে বলে গেছেন। মায়ের অবাধ্য হতে হয় না। আল্লাহ্ গুনাহ দেয় !
রুম্পা মাথা দুলিয়ে সায় দিল।
এমন সময় তাহেরা আপুর ডাক পাওয়া গেলো। উনি চিৎকার করে ডাকছেন, ‘রুম্পা, তুই কৈ গেলিরে, বাসায় খেতে আয়!’ রুম্পা ধীর পায়ে একবার চলন্ত রেল গাড়ির দিকে আরেকবার শিমুল ভাইয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেওঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
ওর ঘরের বাহিরে যাওয়ার সময় শিমুল বলে উঠল, ‘হাই, টা টা,’ বলেই হাত নাড়তে থাকল।
রুম্পা কি করবে বুঝতে পারল না। একটু একটু করে দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলো।
**************************************************************************
৩ দিন পর শিমুল আজ দুপুরে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঁশঝাড়ে এসেছে, রুম্পার ডাকে। ওর হাত ধরে গোটা বাঁশঝার ঘুরে বেড়িয়েছে। রুম্পা ওকে অনেক গাছ চিনিয়েছে। শিমুল আগে কোনদিন ডেউয়া, জাম্বুরা, বাতাবিলেবু, ছাতিয়েন গাছ দেখেনি। শিমুল নামের যে গাছ আছে তাও সে আগে দেখেনি। নিজের নামের এই গাছটি দেখে সে বড় কৌতূহলী হয়েছে। গাছের কাছে যেতেই রুম্পা ওকে না করেছে। এই গাছের নিচেই ওদের দাদার কবর আছে যে ! সেখানে জুতো পায়ে যেতে নাই। শিমুল তবুও শিমুলগাছ জড়িয়ে ধরেছে। অনেক মোটা একটি গাছ, যার গোঁড়ায় খুব কাঁটা। শিমুল ফুল নাকি খুব সুন্দর হয়। এখনোফুল কিছু আছে, নীচে পরে। শিমুল ওর একটি তুলে নিল হাতে। মোলায়েম পাপড়ি, অদ্ভুত গাঢ় লাল রং, গোঁড়ায় কালো রংএর কিছু একটা। কিছুটা র্যাএকেট খেলার কর্কের মত। ফুলটি খুব পছন্দ হয় ওর। গাছের তলা থেকে আরও দুইটি ফুল কুড়ে নেয় ও। এরপর তাকিয়ে থাকে গাছের গোঁড়ার দিকে যেখানে সামান্য মাটি উঁচুকরে চিহ্ন দেয়া, তার দাদার কবরের। মনে মনে দাদাকে একটি সালাম দিতে ভুল করল না, শিমুল । ওদের দাদা, যিনি ওর জম্মের ৩ মাস আগেই মারা গিয়েছেন ১৯৬২ সালে।
৩ টি শিমুল ফুলের দুইটি সে রেখে দিল হাতে। ১ টি মাকে দেবে ও দেখাবে, অন্যটি ছোট বোন আয়েশাকে। ভালোবাসার মানুষদের ফুল দিতে হয়, সে ঢাকায় শুনেছে ওর বন্ধুর বোনের কাছ থেকে। রুম্পার হাতে বাকি ১টি শিমুলফুল ধরিয়ে দিয়ে শিমুল বলে উঠল, ‘খুব সুন্দর না ! আমি খুব ভালবেসেছি।’এই ভালোবাসি শব্দ শুনে রুম্পা খুব হেসে দিল।
বলল, ‘ভাইয়া, তুমি খুব মজার লোক তো !’
শিমুল বুঝল না ভালোবাসি শব্দের সাথে কিসের এত মজা লুকিয়ে আছে !
রুম্পা অনেক যত্নকরে আজ রান্না করল। কেন যেন সে আজ পোলাও রান্নাকরল, মাংস রান্না করল। এমন সময় পাশের বাড়ির সিরাজ ভাই এসে পড়ল। উনি ওদের সবাইকে খুব আদর করেন। অনেক বড় ভাই। ওনার দুইটা ছেলে মেয়ে ছিল , বানের সময় ডুবে মারা গেছে।
সিরাজ ভাইঃ রুম্পা বোন, আজকে কি রেঁধেছ? আমাকে দিবে? খুব ক্ষুধা লেগেছে যে !
রুম্পাঃ ভাইয়া বসুন। ভালো খাবার রেঁধেছি। পোলাও, মাংস । একটু বস, চুলো থেকে গামলায় ঢালতেছি।
সিরাজ ভাইঃ তা আজ এতো ভালো খাবার কেন রেঁধেছ? আজ কি ঈদের দিন !
রুম্পাঃ কি জানি, আজ আমার খুশি লাগতেছে, ভাইয়া। তাই রেঁধেছি। আজ শিমুল ভাইকে খাওয়াব যে !
সিরাজ ভাইঃ ও, আমাদের শিমুলও এসেছে দেখছি। কি ভাই, তুমি কি ভয় পাচ্ছ না, বাঁশঝাড়ে?
শিমুলঃ (মিন মিন করে) কৈ, নাতো ! ভয় পাবো কেন, রুম্পা সাথে আছে না !
সিরাজ ভাই ও রুম্পা ওর এই মিনমিনে উচ্চারনে কথা শুনে হেসে উঠল। শিমুল কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো। রুম্পার চোখেও তা ধরা পড়লে, সে সিরাজ ভাইকে খেতে ডাকল।
সিরাজ ভাই শিমুলকে উদেশ্য করে বলে উঠল, ‘ভাই আসো, তোমার জন্যে রেঁধেছে আমাদের পাকা রাঁধুনি রুম্পামনি, চল দুইজনে পেট ভরে খাই !
মাটির রান্না এর আগে কোনদিন শিমুল খায়নি। তাই সে চুপ করে বসে আছে। সিরাজ ভাই উঃ আহঃ খুব গরম! বলছে আর মুখে চুক চুক করে শব্দ করছে। যেন সে সত্যিই গরম আর ঝালে মরে যাচ্ছে। পেট ভরে খেয়ে উঠে পড়ল সিরাজ ভাই।
রুম্পার হাতে একটি কাঁঠালের পাতা ধরিয়ে দিয়ে, রুম্পার গালে একটি চুমো দিতে দিতে সিরাজভাই বলল, ‘আমার রুম্পামনি, একদিন খুব বড় সাহেবের ঘরের বউ হবে। খুব ভালো ভালো রান্না করবে। আমি যেয়ে সত্যি সত্যি খেয়ে আসব।’ সিরাজ ভাইয়ের চোখের কোণে পানি দেখা গেলো। উনি চোখ মুছতে মুছতে যেদিক দিয়ে এসেছিলেন, সেই দিক দিয়েই চলে গেলেন।
রুম্পা এইবার শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের সিরাজ ভাইয়ের মনে খুব কষ্ট। উনার দুজন ছেলেমেয়ে গত বৎসর বানের সময় ডুবে মারা গেছে। উনার মেয়েটি আমাদের সাথে খেলত।’
শিমুল কোন কথা বলছে না, শুধু শুনেই যাচ্ছে। তার কাছে যেন মনে হচ্ছে তারা কোন ছোট শিশু কিশোর নয়, তারাই ভবিষ্যতের এক ছোট্ট সুখি পরিবার। যেখানে সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা হাত ধরে সমভাবে চলছে!
রুম্পা এবার নিজের জন্য একটি থালা নিয়েছে। কাঁঠালের পাতার এই থালা ভরে পোলাও মাংস নিয়ে শিমুল কে বলছে, ‘তুমি কিন্তু কিছুই খাচ্ছ না, ভাইয়া। তোমার কি রান্না পছন্দ হয় নি ?’
শিমুল থতমত খেয়ে বলে উঠল, ‘না না, খুব মজা হয়েছে। তুমি খুব ভালো রাঁধতে পারো, রুম্পা !’
রুম্পা শিমুলের এই কথা শুনে আনন্দে কেঁদে ফেলে। ওর কাছে মনে হয়, যুগ যুগ যদি এমন করে রেঁধে খাওয়ানোর সুযোগ এই জীবনে সে পেত !
শিমুল বলে উঠে, ‘কাঁদছ কেন?’
রুম্পাঃ এমনি !
শিমুলঃ এমনি কেন? এমনি এমনি কেউ কাঁদে?
রুম্পাঃ তুমি বুঝবে না ! মেয়ে হলে বুঝতে, মেয়েরা এমনি এমনিই কাঁদে, কাঁদতে হয় !
শিমুল আর কথা বাড়াল না। শুধু ভাবল রুম্পা মেয়েটি একটি পাকনা বুড়ি, অনেক কিছুই সে তার চেয়ে বেশী জানে বা বুঝে। ওরা দুই জনেই এক সাথে উঠে পড়ল। শিমুলের হাতে তখনো মা ও বোনের জন্য ২ টি লাল টকটকে শিমুলফুল। রুম্পাও তাকে দেয়া ফুলটি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এরপর দুইজনে অন্য হাত একসাথে ধরে বাড়ির দিকে পথ চলে...
**************************************************************************
মুক্তিযুদ্ধের এই সময় বাড়ির বড়রা কেমন যেন চিন্তিত। সবাই যেন অন্য কিছু নিয়ে ভাবছে। ছোটদের দিকে একটু নজর কম। এই সুজুগে, গত এক মাসে রুম্পা-শিমুল প্রায় প্রতিদিন দুপুরে এই সংসার সংসার খেলে চলেছে। বাড়ির কেউ কিছুই ভাবেনা এই ছোট্ট দুই শিশুর খেলা দেখে। মাঝে মাঝে সিরাজ ভাই এসে ওদের অতিথি হয়। ওদের আদর করে খেয়ে দেয়ে চলে যায়। আজ ওরা রান্না করেনি। বাঁশঝারের পিছনে মরিচের ক্ষেতে ঘুরে ঘুরে দেখছে। রুম্পাদের মরিচের ক্ষেতে প্রচুর মরিচ ধরে লাল হয়ে আছে। শিমুল অবাক হয়ে এই সব দেখতে দেখতে এগিয়ে যায়। পাশের ক্ষেতে আলু লাগিয়েছে ওদের কোন আত্মীয়। সেখানে সবুজ লতানো গাছ, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ শিমুল রুম্পার হাত ধরে ধরে দেখছে আর অবাক হচ্ছে। রুম্পা তাকে গাছ দেখাচ্ছে আর নাম বলছে। এমন করতে করতে আবারো তারা ঘুরে ঘুরে বাঁশঝারের অন্য প্রান্তে এসেছে।
শিমুলের খুব হিসু পেয়েছে। বাঁশঝাড়ের ভিতর কিন্তু খুব পরিস্কার। দেশে যে যুদ্ধ চলছে; সেখানে আর্মি এসেছে শুনলেই গ্রামের সকলে, এই বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নেয়। বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে বাঙালি নদি। নদিতে এখন যৌবন ! এপার ওপাড় কিছুই দেখা যায় না। সেখানে সবসময় ৩-৪ টি নৌকা বাঁধা থাকে। যদি আর্মিরা গ্রামে ঢুকে যায়, তখন যেন এইসব নৌকা করে নদীর মাঝে পালিয়ে থাকা যায়। পাক আর্মিরা নদিকে খুব ভয় পায়। আরও একটি বিষয় শিমুল খেয়াল করেছে। তাহলো, সকলের বাড়িতে মরিচের গুড়ো গুলানো আছে বড় বড় কলসিতে। পাশে রাখা আছে বাঁশ দিয়ে বানানো বড় বড় পিচকারি। যদি আর্মি এসে যায় তখন আর্মির চোখে এই মরিচের গুড়ো গুলানো পানি পিচকিরি দিয়ে ছিটিয়ে দিয়ে, পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা।
শিমুল আব্বার কাছে শুনেছে যে, এই দেশের অনেক বড়নেতা শেখ মুজিবর রহমান ৭ ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক দুনিয়াকে তাক লাগানো বক্তৃতা দিয়েছেন। সেখানে উনি দেশের সকল কে যার যা আছে তাই নিয়ে লড়াই করতে বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম !’
শিমুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেক্ষন চেপে রাখা হিসু ছেড়ে দেয়। হিসুর এত্ত চাপ যে, ভুলেই যায় পাশে রুম্পার কথা। তার শিশ্ন তখন সোজা হিসু নির্গমনে ব্যস্ত। রুম্পা এক নজরে সেই দিকে তাকিয়ে আছে। শিমুল কিছুটা লজ্জা পেলেও কিছুই করতে পারে না। রুম্পাকে অন্য দিকে ফেরাতে কি করা যায় ভাবতে থাকে। সে একটু বাঁকা হয়ে অন্য দিকে ফিরে যায়। রুম্পাও বাঁকা হয়ে যায় নিজের অজান্তেই।
শিমুলঃ কি দেখছ?
রুম্পাঃ সুন্দর !
শিমুলঃ কি সুন্দর? কি বলছ, এসব !
রুম্পাঃ তোমার ঐটা
শিমুলঃ তুমি খুব দুষ্টু
রুম্পাঃ না সত্যি, তোমার ঐটা খুব সুন্দর। আমি আগে কোন দিন দেখিনি।
রুম্পার এই সহজ সরল কথায় কিছুটা বিশ্ময় প্রকাশ করে শিমুল। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারে না। এমন সময় দেখে রুম্পাও হিসু দিতে বসে গেছে তার সামনেই। মনে হয় তার হিসু দেয়া দেখে রুম্পা আর নিজেকে আটকাতে পারে নি। কারন অন্যের হিসু দেয়া দেখলে নিজেরও হিসু পায়, এইটা শিমুলের জানা।
রুম্পাঃ তুমি কি দেখছ?
শিমুলঃ সুন্দর। তোমার ওইটাও খুব সুন্দর। আমিও কোনদিন এমন করে দেখিনি যে !
রুম্পাঃ ভাইয়া, তুমি খুব দুষ্টু।
শিমুলঃ না, আমি সত্যি বলছি, তোমার টা বেশী সুন্দর।
রুম্পাঃ না না তোমার টা বেশী সুন্দর।
বলেই রুম্পা হটাত করে শিমুলের নুনুতে হাত বোলায়। শিমুল চমকে উঠে। ওর শরীরে কেমন যেন এক শিহরণ উঠে। সেও কিছু না বলেই আচমকা রুম্পার নুনু ছুঁয়ে দেয়। যেন নাজানা কোন এক গোপন খেলায় কেউ ওদের আকর্ষণ করছে! ওরা দুইজন দুইজনের টা ছুঁয়ে দেখছে বেশ কিছু সময় ধরে। কারো মুখে কোন কথা নাই, শুধু তাদের ৪ চোখে রাজ্যের বিশ্ময় ! এমন সময় কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। দুই জনেই চমকে উঠে !...
**************************************************************************
খুব জোরে এক ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠে শিমুল।
“এই তুমি এমন করছ কেন? কি হয়েছে তোমার ! তুমি এমন ঘামছ কেন? স্বপ্ন দেখছিলে?” পাশে শুয়ে থাকা বউ ধাক্কা দিচ্ছে আর বলে যাচ্ছে।
শিমুল দেখে ও সত্যি ঘামছে। ওর শরীর কেমন যেন এক মজার শিহরনে এখন মজে আছে। বউয়ের ধাক্কায়ও যেন সেই চরম পুলক থেকে নিজেকে সরাতে পারেনা।
গিন্নী আবারো ধাক্কা দিয়ে বলে, “উঠ উঠ, যাও বাথরুম করে এসো। কি হয়েছে, ভয়ের কোন স্বপ্ন দেখেছ?”
শিমুল গা ঝারা দিয়ে উঠতে উঠতে বলে,‘না, ভয়ের না; মজার স্বপ্ন দেখছিলাম। তুমি মাটি করে দিলে তো সব...’ বলেই শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে বাথ রুমে ঢুকে পরে ।
বাথরুম থেকে মুখহাত ধুয়ে ফ্রেস হয়ে শিমুল বেড় হয়। অতীতের মধুময় কৈশোরের স্মৃতি মনে করে মনটায় কেমন চানক্য এসে ভর করে। এমন সময় ওর মুবাইল ফোনটা বেজে উঠল। অপরিচিত একটি গ্রামিন ফোনেরনাম্বার বেজে চলেছে। মুবাইলের রিং টোনে বেজে চলেছে তার প্রিয় গানঃ
যেতে যেতে কিছু কথা বলব তোমার কানে কানে....... ওবন্ধু, ও আমার ভালোবাসা ...
রিং টোনে গানটি শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে কলটি ধরল, শিমুল। তার গ্রামের বাড়ি থেকে ওর সমবয়েসি চাচাতো ভাই আকবর ফোন করেছে। আকবর বলছে, ‘শিমুল, একটি দুঃসংবাদ আছে। গতরাত ৩ টায় রুম্পা মারা গেছে। ওর জরায়ুতে ক্যান্সার না কি হয়েছিল। সেইটার অপারেশন করিয়েছিল বগুড়ার এক ক্লিনিকে.. কিন্তু অপারেশনের রাতেই সে মারা যায়...’
আর কিছুই শিমুলের কানে ঢুকে না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে আবার বিছানায় ধপাস করে বসে পরে । পাশে গিন্নী দৌড়ে এসে ওকে না ধরলে হয়ত মেঝেতেই পড়ে যেত !
শিমুল ভাবতে থাকে দীর্ঘ ৪৩ বৎসর পর,আজ কেন স্বপ্নে রুম্পাকে দেখল...কেন? কেন? মানব জীবন বড়ই রহস্যময়, যার রহস্য ভেদ করা শিমুলের মত হতভাগ্যের কোনদিন সম্ভব নয় !