আমি ডাক্তার মানুষ,কত অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়া যে ঘুরে বেড়াই! অনেক রুগিদের কথা ভালো লাগলেও কিছু বলতে পারিনা, কারণ আইন ভঙ্গের হাতকরা পড়তে চাইনা।চাই নিয়ন্ত্রিত শুদ্ধ জীবন।
আমার এক বন্ধু রোগী হিসাবে নয়, সময় কাটাতে এলো চ্যাম্বারে। শীতের শুরুতে রোগীর যোগান কম।আমি আড্ডাবাজ মানুষ। লোকজন এলে খারাপ লাগে না।বন্ধুর সাথে অনেক আলাপ হচ্ছিল। ভালো কথা, জ্ঞানের কথা, স্যাটেয়ারধর্মী আলোচনা কি নাই! মাঝে ফুচকা খাওয়াও হল । ফুচকা আবার ভাবির খুব প্রিয়। তাই খেতে খেতে ভাবির প্রসংগ অবিসম্ভাবি ভাবেই উঠে এলো।
শুরুটা আমিই করলাম, ‘মফিজ ভাই, ভাবি কেমন আছেন? উনি খুব ফুচকা খেতে পছন্দ করতেন!’
“আরে ভাই, সে আর বলতে ! অনেক কাহিনী। পেট ভরে আছে... সময় পাইনা, তাই বলতে পারছি না,” মফিজ ভাই বলে উঠলেন।
আমি নড়েচড়ে বসলাম। আমার দোকানের সেলস ম্যান রাজুকে ডেকে বললাম, ‘রুগী নাই তো?’
রাজু বলল, “না, আজ নিরামিষ মনে হচ্ছে”। রাজুর আবার তুলনা ছাড়া কথা বলতে কষ্ট হয়।
মফিজ ভাই শুরু করলেন, “ডাঃ সাহেব আপনিতো সবই জানেন। ঐ যে রাতের সেই কাহিনীর পর থেইক্কা, ও তো প্রায়ই আলাদা বিছানায় শোয়।”
আমি বে-রসিকের মত বলে উঠলাম, ‘বুঝলাম না,রাতের কাহিনী মানে? গায়ে হাত তুলেছেন নাকি?’
মফিজ সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “যদি পারতাম, তো ভালই হতো।পারলাম কই?”
আমি বললাম,‘না, না অনেকদিন দেখা হয়নাভাই, আসলেই ভুলে গেছি!’
উনি বললেন, “হ ভাই, এখন বড়লোক হইছেন, ঢাকা শহরে গাড়ি হইছে, বাড়ি হইছে, এমন কথা তো বলবেনই?”আমি মৃদু প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলতে যাব, কিন্তু পারলাম না।
উনি বলে চলেছেন, “রাজকপাল ভাই, ছেলেমেয়ে ভালো ভালো যায়গায় চান্স পাইছে, আপনার এমন ভুলে যাওয়ারই কথা, আমরা হালায় মফিজ মানুষ, বাপে নামটাও ঠিক রেখেছিল ...”
আমি বুঝলাম অনেকদিন পর এই মিলন বিরহে... সম্ভব হলে চিরস্থায়ী বন্ধের দিকে চলে না যায় !
বললাম থাক না, ‘মফিজ ভাই, মরা বাপকে নাই বা টানলেন!মন নরম করুন,আগামীকাল আপনার বাড়ি যাব,সকালে নাস্তা খাব।’মফিজ সাহেব আবার কেউ খেতে চাইলে খুব খুশী হন!
উনি বললেন, “তাইলে আজ উঠি, কাল আগে আমার বাড়ি আসেন। খাওয়া-দাওয়া করেন, তারপর এই গল্প বলব!আপনি কতদিন যান না, মনে আছে? আপনার ভাবি তো আমাকে বলতে বলতে এখন বলাই ছেড়ে দিয়েছে!”
আমি পড়লাম মহাসমস্যায়। কাহিনী যদি আজ শুনতে নাপারি হয়ত আর শুনাই হবেনা।তাই একটু জোর দিয়ে বললাম, ‘কালকের কাজ কাল হবে, এখন আপনি কাহিনী বলুন।’
মফিজ সাহেব বললেন, “কাহিনী কই পেলেন? আমি কাহিনী কখন বললাম!”
এইবার আমি আসলেই বিপদে পড়লাম। পাঠক বুঝেনা, একটা গল্প পাইতে লেখকরা কেমন কষ্ট করে!
আমি বললাম, ‘মফিজ ভাই, কি হল? আপনি রাতের কাহিনী শুরু করে থেমে গেলেন,এখন আকাশ থেকে পড়ছেন?’
উনি বললেন, “ভাই আপনার দোকানের পাশে কে এসে দাঁড়াইছে দেখেন নি?”
আমি বললাম, ‘না তো?’
উনি বললেন, “হারামযাদা, মাসুম! সারাদিন আমার পিছে পিছে ঘুরঘুর করবে, আর বিকালে যখন আমি বাইরে যাব, তখন আপনার ভাবির কাছে গিয়ে সব বলবে, আর বিকেলের নাস্তাটা সাবার করবে।”
আমি একটু রসের গন্ধ পেয়ে বলে উঠলাম, ‘তা, ওরে না করে দিলেই তো পারেন।’
মফিজ সাহেব হটাত করেই ম্রিয়মান হয়ে উঠলেন। তার জীবন প্রবাহ মনেহয় কিছুটা স্থগিত হয়ে গেলো। মনের অজান্তেই আমি বিপি মেসিনের দিকে তাকালাম।পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠার লক্ষন পাওয়া গেলো।
মফিজ সাহেব জ্ঞানী লোকের মত বললেন, “দুনিয়ায় কত কিছিমের লোক আছে ভাই, ঐ ব্যাটা হল,মাউরা।”
আমি বললাম, ‘বুঝলাম না।’
উনি বললেন, “বুঝলেন না? মাউরা হল, মাইয়া মানুষের কাছে মিউ মিউ করে কথা বলে মজা করে এক গ্রুপ। ঐ শালারা আমার জানের দুশমন।আমি না করলেও ঐ হালায় যাওয়া বন্ধ করে না। মনে হয় মার দিই। কিন্তু আপনার ভাবি বলে, কেন, মার দিবে কেন?আপনার ভাবিরে রাগাইয়া কিছু করন ঠিক হবে কি?”
আমি বললাম, ‘না।’
উনি এইবার বলে উঠল, “তা ভাই চায়ের অর্ডার দেন, খাইয়া গল্প করি। আমিই বিল দিবোনি ।আপনারতো দেখি আজ কোন রুগিই নাই!”
আমি বললাম, ‘নারে ভাই, রুগী কম। কিন্তু তাই বলে একেবারেই নাই, তাতো না। তবে আমার এখানে চা খাওয়া যাবে না। কোলড্রিঙ্কস খাওয়াতে পারি।’
উনি বললেন, “আনুন না, ভাই।”
আমি রাজুকে এক লিটার কোকাকোলা আনতে বললাম - সাথে ‘ফিট’ বিস্কুট।
এই খাবার আসার ফাঁকে আমি মফিজ সাহেবকে নিয়ে পাঠকের কাছ থেকে ঘুরে আসি। মফিজ ভাই পঞ্চাশ উর্ধ একজন ছাপোষা মানুষ। দিন আনে দিন খায় এর পর্ব পাড়ি দিয়ে আজ প্রায় ১৫ বৎসর ঢাকার আশেপাশেবাড়ি নির্মাণের ঠিকাদারি করছেন। সারা বছর কাজকাম করে খেয়ে পরে ঢাকা শহরে ভালই আছেন। দুই মেয়ের বড়টির সম্প্রতি বিয়ে দিয়েছেন।বিয়েতে নিজেকে স্থপতি ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। বয়স হইলে এই এক সুযোগ থাকে। বরপক্ষ কনের বিভিন্ন বিষয় দেখে, কনের বাবামায়েরও খোঁজ নেয়, তবে সার্টিফিকেট তো আর দেখাতে হয় না। আমার সাথে প্রথম থেকেই মফিজ সাহেবের পরিচয়। এই এলাকায় প্রায় আমার সাথেই ঢুকেছেন। ১৮বৎসর আমি এই এলাকায়, সুখে দুখে প্রায় সবসময় মফিজ সাহেব আমার সাথে। ১০ শ্রেনি পাশ উনার এইশিক্ষাগত যোগ্যতার উন্নয়ন নিয়া কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। কারণ আমি তো আর শিক্ষা বিভাগের পরিদর্শক নই? তাছাড়া বাজারে এত প্রকারের ডাক্তার আছে,যদি এতে আম-জনগনের কিছু সমস্যা না হয়, তো রডমিস্ত্রি থেকে সামান্য একজন এই স্থপতি ইঞ্জিনিয়ারথাকলে আম-জনতার একজন আমারই বা কি আসে যায়?মফিজ সাহেব মানুষকে খুব আপন করে নিতে পারেন বটে, তবে বেশিদিন কারো সাথে এক থাকতে পারেন না। মনেহয় আমার পেশাগত গণ্ডারী চামড়ার অবস্থানে আছি নাই করে আমি ১৮ বৎসর পারি দিলাম, মন্দ কি !
মফিজ ভাই শুরু করলেন তার রাতের কাহিনী।
“ভাই,আপনি ডাক্তার মানুষ। সবকিছুই জানেন। কি আর লুকাবো! ঐযে রাতে আপনার ভাবি গলায় দড়ি দিতে গেলো, আপনাকে রাত ৩ টায় বিরক্ত করলাম। তারপর থেকে আপনারা বললেন যে, উনাকে দেখে রাখতে।মানসিক রোগের ডাক্তাররা বললেন, উনার মর্জিমত চলতে দিতে।কি আর করা!আমি আগে থেকেই আপনার ভাবির বিষয়ে তেমন নাক গলাই নি, এরপর থেকে নাক কেটেই বাদ দিয়েছি ভাই!আর তাছাড়া মেয়েরা বড় হয়েছে, জামাই এসেছে, বুঝলেন না?”
দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে উনি আমার মুখের দিকে এবং দোকানের বাহিরের দিকেও একটু নজর দিলেন! আমি সবকিছু বুঝার মত করে মাথা ঝাকালাম।
উনি আবার শুরু করলেন। “ঐযে ঐ ঘটনার পর ডাক্তার সাহেবরা যখন আমাকে অমন উপদেশ দিলেন, আমি তখন থেকে চুপ করে শুধু দেখি, কিছু বলি না। আপনার ভাবি যে একেবারেই খারাপ কিছু করে তা না, তবে আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাসটা বাদ দিয়েছেন, বলা যায়!”
আমি চোখ বড় বড় করে বলে উঠলাম, ‘কি বলেন এক বিছানায় ঘুমান না?’
উনি বললেন, “সবই কপালরে ভাই! আমার কপালের লেখা যদি আপনার মতই হতো, তাহলে আমিতো শাওন ডাক্তারই হতাম, মফিজ সাহেব হতাম না!”
ভাবলাম মফিজ সাহেবকে বলি, হ্যাঁ, আপনি সাহেবই তো। নিজেই স্থপতি ইঞ্জিনিয়ার হইতে পারেন... নিজে যারে সাহেব বলে সেই সাহেব হয়... গোটা দেশ চলছে এই নিয়মে, আপনি এর বাইরে যাবেন কেন?কিন্তু বলা হলোনা যদি গল্পের প্লট নষ্ট হয়ে যায়, এই ভয়ে।
মফিজ সাহেব বলে চলছেন,“গত রাতেরে ভাই, আপনার ভাবি হটাত করেই আমার বিছানায় শুতে এলেন। আমি ক্যামন ক্যামন আড়ষ্টভাব বোধ করছিলাম। অনেকদিন একা শুয়ে শুয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে কিনা! তাছাড়া একা হাতপা ছড়াইয়া শুয়ে থাকতে একটা স্বাধিনতাআছে, স্বাধিনতা কে হারাতে চায় বলুন!”
আমি মফিজ সাহেবের মুখে এই জ্ঞান সমন্বিত কথা শুনে কিছুটা পুলকবোধ করলেও ধরতে দিলাম না। শুধু হু হু করেই নিজের অবস্থান জানান দিলাম।
উনি এইবার আবার বলা শুরু করলেন, “ছোট মেয়ে আবার একা হয়ে গেছে। এতদিন বড় বোনের সাথে কিম্বা মায়ের সাথে থাকত। ও কিছুক্ষণ পরপর মায়ের অবস্থান নিয়ে কেমন একটা বেসামাল আচরণ করছে, কিছু মুখে বলছে না। বড় হয়েছে তো!”
উনি বলেই চলেছেন, “লজ্জায় হোক আর অসস্থিতেই হোক আমি জড়সড় হয়ে বিছানার ২/৫ ভাগ জায়গায় মুরিয়ে নিয়েছি।ঘুম আসবে আসবে করছে। রাত প্রায় ১২ টা বাজে। টকশো দেখা শুরু করব, এমন সময় গিন্নি বলে উঠলো, ঐ সব ছাইপাঁশ বাদ দাও। ঘুমুতে আসো।আমার খুব ঘুম পেয়েছে।আমি চরম পুলক অনুভব করতে শুরু করেছি।টিভি বন্ধ করলাম!পাশ ফিরে শুলাম, অন্ধকারে!এমন সময় কি ঘটলো, ... জানেন?”
আমি সাথে সাথেই জিজ্ঞাস করলাম, ‘কি ঘটল!’
উনি বললেন, “লাইট জ্বলে উঠলো।”
আমি বললাম, ‘বলেন কি, স্বাঙ্ঘাতিক ব্যাপার!’
মফিজ সাহেব বলা শুরু করলেন এই বলে, “তাকাইয়ে দেখি, মেয়ে এসে বলছে, মা তুমি তোমার বিছানায় শুবে না?”
আমি নিজের অস্থিরতা দমাতে না পেরে বলেই উঠলাম, ‘তা, আপনার গিন্নি কি বলল, মেয়েকে?’
মফিজ ভাই ভনিতা না করে সরল ভাবেই বলে চলেছে মেয়ের কথা শুনে, আমার গিন্নি মেয়েকে উত্তর করল, “না। তুমি তোমার ঘরে ঘুমাও!”
মেয়ে বলল,“কেন আজ তোমার কি হল?”
“মেয়ে বড় হয়েছে না ভাই, কলেজে পড়ে! প্রশ্নতো করতেই পারে, কি বলেন?” মফিজ সাহেব আমাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলেন!
আমি একটু বিরক্তভাবে বললাম, ‘ঠিক কথা।’
বিরক্ত হওয়ার কারণ আমি একটা সিকুয়েন্স মনে মনে তৈরি করেছি...মফিজ মিয়ার মিলন দৃশ্য, এর মাঝে এই মেয়ের আসা ও আলো জ্বালানো, আমার পছন্দ হচ্ছিল না।তাতে স্থপতি ইঞ্জিনিয়ার মফিজ সাহেবের কিছু আসে যায় না।আর এই দৃশ্যের রিমোট আমার হাতে নয়, আমি শ্রোতা মাত্র!
মফিজ সাহেব মনে হয় একটু হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। নাকি বাড়ির গোপন কথা বলে ফেলায় শংকিত বুঝতে পারলাম না। উনি চুপ করে থাকায় আমি নিজেই আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তারপর?’
উনি বললেন, “না থাক ভাই, কি আর হবে মফিজের কাহিনী শুনে! মফিজ তো মফিজই।”
আমি বললাম, ‘কিছু মনে করবেন না, দরকার হলে আজ প্রিন্স হোটেলে রাতের খাবার খাব, তবু বলুন তো, কি হল? ভাবি কি বালিশ নিয়ে মেয়ের ঘরে গেলো?”
মফিজ সাহেব এইবার একটু চ্যাতদেখিয়ে বলে উঠলেন, “নারে ভাই, গেলেতো ভালোই হতো। হাত-পা ছুড়ে ১০ বৎসরের অভ্যাস মত ঘুমাতে পারতাম!”
‘দুরু ভাই, আপনি খুব খারাপ লোক, আসল কথা বলেন না!’ আমি কিছুটা রাগতভাবে বলে উঠলাম কথাগুলো।
মফিজ সাহেব শুরু করলেন কিছুটা নরম ভেজা কণ্ঠে “আপনার ভাবি মেয়েকে বলতে থাকলো, আমার রুমের মশারি নিচু করে টাঙাতে হয়। ঘুমুতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। তোর বাবার মশারিটা সুন্দর উঁচু করে টাঙানো, কি আরাম করে ঘুমায় তোর, বাপ। আমি মশার জ্বালায় আমার বিছানায় ঘুমুতে পারিনা, তাই এখানে এসে শুয়েছিরে মা!”
আমার মনে হলো মফিজ সাহেব এই সময় বিড়বিড় করে সম্ভবতঃ ভা্বিকে ও তার বাবার গুষ্টির কাউকে তুলে গালি দিলেন, আমি শুনতে পেলাম না!
আমি শুধু ভাবছিলাম আজ ১০ বৎসর হল মফিজ সাহেব ‘আলাদা বিছানায়’ ঘুমান!