মায়ের ঈদ

ঈদ (আগষ্ট ২০১৩)

ইসহাক খান
  • ৪৩
হাতে সময় বড় কম। কম সময়েই সব গুছিয়ে নিতে হবে। প্রত্যেকবারই চেষ্টা করি আগেভাগে সব করে রাখতে, কিন্তু হয় না। বোধহয় দেরী হওয়া কপালে লেখা আছে, আমার সবসময় দেরীই হয়ে যাবে।

পায়েসটা চুলোয়। কি সুন্দর ঘ্রাণ! চালটা দামী, এবং ভাল। সুঘ্রাণে আমারই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে, ওরা দেখলে তো খুশি হবেই। চালটা ঠিকমতো ফোটাতে হবে। গেলবারের আগের বার কি বিভ্রাটই না ঘটলো, চাল ছিল আধাসেদ্ধ। আর গতবার? ঠিকমতো সেদ্ধ করতে গিয়ে হয়ে গেল জাউ। এতদিন ধরে রান্না করি, তবুও পায়েস রান্না করতে গিয়ে একটু-আধটু এদিক-সেদিক হবেই। এটাও বোধহয় কপাল।
তবে এবার আঁটঘাট বেঁধে নেমেছি, ঠিক সময়েই নামিয়ে ফেলবো। ঠিক সময়ে পায়েস নামানোর মতো ছোটখাটো ব্যাপারেও রাঁধুনির বাহাদুরি আছে, অনেকেই বছরের পর বছর পায়েস রেঁধে যাচ্ছে, কিন্তু জানে না কখন নামাতে হয়।
পায়েসে পেস্তাবাদাম দিতে হবে। সোহেল খুব পছন্দ করে। দাঁতের নিচে নিয়ে অনেকক্ষণ চিবোয়, বলে পেস্তাবাদাম না দিলে খাবেই না। আনিয়ে রেখেছি। সবুজগুলো কুচি কুচি করে দেবো, আর বড় কয়েকটা দেবো আস্তই। সোহেলের জন্যই এই কষ্ট, বড় জামবাটির এক বাটি পায়েস ও একবারেই খেয়ে ফেলতে পারে। বালাই ষাট, খেতে পারা তো ভাল। এই বয়সে খাবে না তো কবে খাবে?
পায়েস নিয়েই শুধু কথা বলছি। শুধু পায়েস রাঁধলেই কি হবে? আরও কত কিছু আছে। ছেলে তো আমার একটা নয়, দুটো। মেয়ের কথাই বা ভুললে চলবে কেন? কেউ মিষ্টি পছন্দ করে, কেউ পছন্দ করে ঝাল। সবার জন্যই সব কিছু থাকবে, কারো পছন্দের খাবার বাদ পড়বে না।

মাংসটা ভাল করে কেনা চাই। মবিনকে বললাম যে হাড় ছাড়া মাংস আনিস। গাধাটা হাড় তো এনেছেই, সেই সাথে এনেছে চর্বি। এদেরকে নিয়ে আর পারা গেল না। একসাথে সব মাংস বসিয়ে দিলেই তো আর হবে না, একেক জায়গার মাংস একেক রকম। আলাদা আলাদা রাঁধলে বোঝা যায় কোনটার স্বাদ কী রকম। তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ঘাড়ের মাংসের কাছে আর কিছু দাঁড়াতে পারে না। অথচ সবাই বলে, সিনার মাংসই নাকি ভাল।
গরুর মাংসটা ভুনা করবো, প্রচুর ঝাল দিয়ে। সিমির পছন্দের জিনিস। খাবে, ঝালের চোটে চোখ দিয়ে পানি পড়বে আর উহ-আহ করবে। এটাই নাকি মাংস খাওয়ার মজা। তাই সই। ওদের খাওয়া দেখেই তো আমার সুখ।

মুরগীর কোরমা করবো। একগাদা চিনি ঢেলে দিয়ে মিষ্টি করলেই তো হবে না। এটাতে ঝাল আর মিষ্টির পরিমাণ ঠিক রাখতে হবে, যাতে দুটোই টের পাওয়া যায়। এটা তো শরবৎ নয় যে মিষ্টি হলেই হবে। আবার এটা ভুনাও নয় যে ঝাল হলেই হবে। কাজেই সাবধান।
আরও অনেক কিছু হবে। সেমাই থাকবে দু’রকমেরঃ এমনি সেমাই আর লাচ্ছা সেমাই। দু’রকম কেউ খায় না, তবুও রাখা তো চাই।
চটপটি থাকবে। ডাবলু বুট আর ফুচকা এনে রেখেছি। এটা বানাতে হবে একেবারে শেষে, নইলে খেতে ভাল লাগবে না। তবে তেঁতুলটা আগের রাতেই ভিজিয়ে রাখতে হবে, টক বানানোর জন্য।
কাবাব হবে, টিকিয়া। এটা সবাই খুব করে খায়। কাজেই কিমা এনে রেখেছি। গোল গোল ডুমো ডুমো করে বানিয়ে ফ্রিজে ভরে রেখেছি। ঈদের দিনে গরম গরম ভেজে দেয়া হবে। আমি তো আর ওদেরকে বাসি জিনিস খাওয়াতে পারি না।

আজ সারাটা দিন বড় ব্যস্ত গেছে। রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, সবার ঘর টিপটপ করে দেয়া। কে কখন এসে পড়ে ঠিক তো নেই। এই হয়তো ডোরবেলটা বেজে উঠলো।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে একটু আগেই। টিভির পর্দায় চোখ রাখার অবসর হয়েছে এইমাত্র। রোজার দিন, সারাদিন খাটুনি, এই বয়সে একটু কষ্টই। তবু, বছরে দু’বার এই কষ্টটা খুশি হয়েই করি। ওরা বলে, কী দরকার মা? ওরা কী বুঝবে, এই কষ্টটাও কত আনন্দের?
টিভির অনুষ্ঠানের দিকে আমার চোখ নেই, নিচ দিয়ে চলমান শিরোনামে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। হ্যাঁ, ঐ তো, দেখাচ্ছে, পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে। আগামীকাল পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। সবাইকে অভিনন্দন।
এখুনি টিভিতে দেখানো শুরু হবে আগামী সাত-আট দিন ধরে কী দেখাবে তারা। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অনুষ্ঠানগুলো কখন হয় টেরই পাওয়া যায় না, শুধু দেখায় অমুকদিন অমুক জিনিস দেখাবে। এত চ্যানেল, তাদের এত অনুষ্ঠান। মানুষ মনে রাখে কী করে আল্লাহ মালুম।


আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখার মানুষ নই। একটু পর পর চুলোয় গিয়ে খাবারগুলো দেখে আসছি, আর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে মিনিট খানেক করে অনুষ্ঠান দেখছি।
রাত ন’টা বাজে, কই, বেল তো বাজলো না। ওরা কি আসবে না?
বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো, যখন বেজে উঠলো টেলিফোন। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম।
ফোনের ওপাশ থেকে যেন খুব কষ্টে, খুব অস্পষ্ট স্বরে সোহেল বলল, সরি মা।
আমি হাসি। সরি বলার কী আছে? এবার আসতে পারবি না, পরেরবার আসবি। তবে কীনা অনেক আয়োজন করলাম ... ...
সোহেলের কণ্ঠস্বর অসহিষ্ণু শোনায়। কেন মা বারবার এসব কর? আগে তো শিওর হয়ে নেবে, তারপরই না ... ...
আমি জবাব দিই না। খানিকটা লজ্জাই লাগে। সোহেলের গলাটা কেমন ভারিক্কী, ঠিক যেন অভিভাবক। হ্যাঁ, ছেলে বড় হয়েছে, এখন ওর গলার স্বর একটু পাল্টাবেই, এতে অবাক হবার কিছু নেই।
বেশীক্ষণ কথা হয় না, বড়জোর দু’মিনিট। নিজের পরিবার নিয়ে বড় ব্যস্ত সবাই। বুড়ি মা এখন বাইরের মানুষ হয়ে গেছে।
আমি অভিমান করি না। মায়েদের অভিমান করলে চলে না। হাসিমুখ করে রাখার একটা চেষ্টা চালাই।

সিমির ফোন আসে। ওর দু’পাশে বসে ওর বাচ্চা দুটো নিশ্চয়ই চেঁচামেচি করছে, এপাশ থেকে শুনতে পাই আমি।
এটা-সেটা বলে উশখুশ করে সিমি। আমি নিজেই খোলাসা করি, আসছিস না, তাই না রে?
সিমি বলে, সরি মা। অবিকল সোহেলের মতো ভঙ্গীতে, একটু আগে যেমন করে বলেছিল।
আমিও একই জবাব দিই। এবার হয় নি, পরেরবার হবে।

সজীবের ফোন আসে। না, সে-ও আসতে পারছে না। এবারের ঈদ একটু “অন্যরকম করে” করতে চায় সে। মায়ের হাতের পায়েস-পোলাও খেয়ে ঈদ করা বড় আটপৌরে হয়ে গেছে।

আমি চুলো থেকে খাবার নামিয়ে রাখলাম। আরেকটু হলেই পুড়ে যাচ্ছিলো। বয়স হয়েছে, আর খেয়াল রাখতে পারি না। অনেক বছর তো হল, আর কত?
রাত জাগবো না। কাল ঈদ, সকাল সকাল শুয়ে পড়ি।
ঈদ মানে সবাইকে নিয়ে ঈদ করা, ব্যাপারটা সত্যি নয়। অনেকগুলো ঈদই আমি একা কাটিয়েছি, কে জানে, হয়তো আরও অনেকগুলো ঈদ এমন করেই কাটবে।
কাল পায়েস হবে, পোলাও হবে, খিচুড়ি হবে; কাবাব-চটপটি-সেমাই কিছুই বাদ যাবে না। কিন্তু শুধু খাওয়ার মানুষ নেই। আমি তো আর নিজে খাওয়ার জন্য এগুলো বানাই না। ছেলেমেয়ে কেউ আসছে না, বুড়ি মা বসে বসে সব গিলছে, ব্যাপারটা বড় অশোভন হবে।
প্রত্যেকবার ওরা খুব দুঃখ করে; বলে, সরি মা। আমি বুঝি। সবারই তো অসুবিধে আছে। নিজের সংসার থেকে একটু সময় বের করে বুড়ি মা’কে দেখতে আসা, তার সাথে ঈদ করা, এটা হয়ে ওঠা কঠিনই, অন্তত আজকের যুগে। নিজের সংসার, নিজের সন্তানই তো আগে। কালকের দিনটা ওদের সুন্দর কাটুক, আনন্দে কাটুক। কেউ ঈদের দিনটা কাটাবে হয়তো বিদেশে, কেউ কাটাবে সমুদ্রসৈকতে। যে যেভাবে আনন্দ করে করুক।

সিলিঙয়ের দিকে তাকিয়ে আছি, ঘুম আসছে না। বুকের ভেতরটা ভার ভার লাগছে কেন কে জানে। চারিদিকে কত হৈচৈ, সবাই কত ফুর্তিতে আছে। কিন্তু আমি একটু পর পর আঁচলে চোখ মুছে যাচ্ছি কেন সেটাও এক রহস্য। আমি তো আর অবুঝ নই, সবাই খুব সুন্দর কারণ দেখিয়েছে কেন আসতে পারছে না।
খাবারের গন্ধে সারা বাসা মৌ মৌ করছে। কে জানে, অনেকদিন ফ্রিজে রেখে রেখে শেষ পর্যন্ত হয়তো বুয়াকেই দিয়ে দিতে হবে। অনেক খাবার হয়তো ফেলে দিতে হবে। ঈদ এলে বুয়ার পোয়াবারো, সে খুশি হয়েই খাবারের ডেকচি নিয়ে যাবে।
আহা, বুয়ার জায়গায় আমার ছেলেমেয়েগুলো একটিবারের জন্য এসেও যদি খাবারগুলো চেখে দেখতো, আমি আর কিছু চাইতাম না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম গল্পটা পড়ে কান্না চেপে রাখতে পারলাম না । হ্যা, এক সময়ে মা এমনই অবহেলার পাত্রী হয়ে যান আমাদের অনেক ---অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রয়োজনের ভারে ।
একজন গুণী পাঠকের আবেগকে স্পর্শ করতে পেরে গল্পটিকে সার্থক মনে করছি। হ্যাঁ, আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রিয়জনকে দূরে ঠেলে দিই। অনেক শুভকামনা পাঠক।
কবি এবং হিমু মাকে নিয়ে লেখাগুলো যখন পড়ি আনমনা হয়ে যাই।মাকে ছাড়া পৃথিবিটা কল্পনা করতে ও ভয় লাগে।ধন্যবাদ গল্পটির জন্য।
মায়ের জন্য সকল সন্তানের অনুভূতিই বুঝি এক। মা তো মা'ই। গল্প ভাল লেগেছে এজন্য আনন্দিত। আরও গল্প উপহার দেয়ার আশা রাখছি।
জায়েদ রশীদ দারুন লিখেছেন। প্রথমে জীভে জল আসা খাদ্যতালিকা পরে মায়ের হৃদয় নিঙড়ানো অনুভূতি। খুব ভাল।
ভাল লেগেছে জেনে পুলকিত। শুভেচ্ছা নিন পাঠক।

২৯ জুন - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪