চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে রমাকান্ত বাবু বললেন-রোজকার এই কাজকর্ম , ধকল আর ভাল লাগছে না । যখনই একটু ফাঁক পাই মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা । অরবিন্দ বাবুও তার কথায় সায় দিলেন । বললেন-এটা আপনি ঠিক বলেছেন বৈকি । রোজকার এই কাজকর্মের মাঝে আর একটু ফাঁক পাই না ,এই সন্ধ্যের আড্ডাটা ছাড়া । শান্তিমল বাবুও বললেন-সেই শৈশবের কথা মনে পড়েও যায় । সেই স্কুল থেকে এসে ফুটবল নিয়ে খেলা , বৃষ্টি নামলে বাইরে বেরিয়ে আনন্দ করা । একটা গোল হলেই কাদার ওপর লাফালাফি আনন্দ করা । আজও মনে পড়ে সেই সব দিনের কথা । কিন্তু সেই আমাদের শৈশবের সাথে এখনকার বাচ্চাদের শৈশব কিন্তু একদম মিলবে না । তখনকার দিনে আমরা পড়ার চেয়ে বেশি মাঠে ঘুরে বা খেলে সময় নষ্ট করার জন্য সময় পেতাম । কিন্তু এখনকার দিনে বাচ্চারা সারাদিনই ওই বইয়ের মধ্যেই বসে থাকে খেলার তো সুযোগই পায় না । -এটা কিন্তু ঠিক । সায় দিলেন অমল বাবু । -এখনকার শৈশব এমন হয়ে উঠেছে যে মানুষের কাছে এখন শৈশবের চেয়ে বার্ধক্য মূল্যবান । এখনকার বাচ্চারা সবসময়ে ভাবে বড়ো হয়ে কি হব ! কেউ ভাবে না যে এই শৈশবটাকে কীভাবে উপভোগ করব ! এর ফলে তো আস্তে আস্তে শৈশবের গুরুত্ব একদিন শেষ হয়ে যাবে । পাঁচজনের এই টেবিলে এখনও পর্যন্ত চুপ আছেন শ্যামল কান্তি বাবু । তিনি এই পাঁচজনের মধ্যে সবথেকে প্রৌঢ় এবং সব থেকে জ্ঞানীও । প্রচুর পড়াশোনা করেছেন । তাই এখনও পর্যন্ত তিনি মুখ খোলেন নি , এটা ভালো হয়েছে । কারণ তিনি যদি একবার মুখ খুলেছেন তাহলে সে মুখ আর বন্ধ হওয়ার নাম নেয় না । তিনি চা খেতে খেতে সবার বক্তৃতা শুনছিলেন । সবার কথা প্রায় শেষ হতে তিনি মুখ খুললেন-আমার মনে হয় শৈশব জিনিসটাই মানুষের মধ্যে আর নেই । এখনকার ছোটো ছোটো বাচ্চারা তার এই অল্প বয়স থেকেই ভেবে নিয়েছে যে বড়ো হয়ে সে কি করবে । আর সে সেটাই করবে যাতে তার বাবা-মা সম্মতি প্রকাশ করবেন । হয়তো কোনও কারণে সেই বাচ্চাটি কৈশোর বয়সে সেই লক্ষ্যটি জয় করতে পারল না , তখন তার কাছে বাকি থাকছে ভয়ানক পথ । এই ভাবে এই শৈশব ব্যাপারটা জগৎ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে । আর এখন এই শৈশবে এত পড়ার চাপ যে বাচ্চারা এখন শৈশব বয়সে খালি ভাবে যে কবে যে বড়ো হবে । আর এই শৈশব ভাল লাগছে না । আমাদের মত শৈশব তো তারা পাচ্ছে না । আমাদের মতো তারা তো আর মাঠে ঘাটে অবসর কাটানো , সময়ে অসময়ে বাইরে খেলা , স্কুল থেকে ফেরার সময়ে বাড়ি না ফিরে অন্য কোথাও গিয়ে খেলে কিংবা আনন্দ করে সময় কাটানো – এসব তো তারা পায় না । স্কুল থেকে ফিরেই হয় কোচিং নয়তো বাড়িতে পড়া থাকবেই থাকবে । এই রকম ভাবে মেশিনের মতো শৈশব হলে কারোর আর এই শৈশবকে ভালো লাগে ? অরবিন্দ বাবু মাথাটা একটু নাড়িয়ে বললেন-ঠিকই বলেছেন । আমাদের আগেকার মতো শৈশব তো আর নেই । এখন শুনছি নাকি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেও নাকি পড়বার স্কুল তৈরি হয়েছে । তাকে নাকি বলে ... কি যেন একটা... -প্রিস্কুল । -হ্যাঁ হ্যাঁ । আরে আমরা তো জানি শিশু প্রথম শিক্ষা লাভ করে পরিবারে । তারপর একটু বড়ো হলে যায় স্কুলে । কিন্তু স্কুলে যাওয়ার আগেও যদি স্কুলে যেতে হয় তাহলে লোকে তো ভেবে পাবে না যে লোককে আসল স্কুলে ভর্তি করবে না প্রিস্কুলে । তার কথায় সায় দিলেন রমাকান্ত বাবু-আসলে এই সব স্কুল গুলি আসলে সবই ব্যবসা কেন্দ্রিক । ক’দিন পরে দেখা যাবে যে প্রি-স্কুলেরও প্রি বেরিয়ে পড়েছে । -এটা ঠিক বলেছ রমাকান্ত । সায় দিলেন অমল বাবু । -মোট কথা আজকাল শিক্ষাটাই ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু এই ব্যবসার জন্য যে কত ছেলেমেয়ের ক্ষতি হচ্ছে তার দিকে কেউ লক্ষ্য করছে না । শান্তিমল বাবু উত্তর দিলেন , - ভাবার মতো ! এরকম ভাবে চললে তো আমাদের নবযুগের চালকরা তো তাহলে আশা ছেড়ে দেবে । পৃথিবী তো তাহলে অচল হয়ে পড়বে । শ্যামল কান্তি বাবু আবার শুরু করলেন-এটা কিন্তু একেবারে ঠিক । ব্যবসার জন্য আমাদের তরুণ সমাজ অচল হয়ে পড়ছে একেবারে । মানুষ কেউ আর অগ্রগতির কথা ভাবছে না । সবাই ভাবছে কীভাবে টাকা কামানো যায় । কেউ বাচ্চাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ভাবেই না । আর বাবা-মা-রা নিজের ছেলেদের রোবট বানানোর চেষ্টায় রয়েছে । কীভাবে নম্বর পাবে সেই চিন্তায় রয়েছে । কেউ চাইছে না কীভাবে ছেলেটা জানুক বা শিখুক । কয়েক বছর আগে একটা সিনেমা বেরিয়েছিল , থ্রি ইডিয়টস । তাতে নাকি এই ব্যাপারটা ভালোভাবে দেখিয়েছিল । আমি দেখিনি , কিন্তু লোকের মুখে শুনেছি । মাথায় চাপ দিয়ে দিয়ে এই সমাজটাকে যা করে দিচ্ছে তাতেও মনে হচ্ছে কয়েক বছর পরে এ পৃথিবীতে শৈশব বলে কিছুই থাকবে না । দেখা যাবে যে পূর্ণবয়স্ক লোকেরাই জন্ম হচ্ছে । অমল বাবু বললেন-এখনই তো সেই শৈশবের আনন্দ আর নেই । আমরা যে সব আনন্দ উপভোগ করেছি আমাদের শৈশবে , সেই সব আনন্দ তো এখনকার ছেলেমেয়েরা পায় না । অরবিন্দ বাবু অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন-আমি একটা ছেলেকে জানতাম ।তার খুব ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার । কিন্তু বাবা-মা-র জোর করাতে তাকে আর্টস ভর্তি করল । কিন্তু যখন প্রথম বি.এ. তে ভাল নম্বর পেল না । তখন তার বাবা তাকে খুব বকল । এটা ঠিক না । রমাকান্ত বললেন – এই সমাজের শিক্ষার ফরম্যাট যদি এরকম হয় তাহলে চলবে না । শান্তিমল বাবু বললেন – সব পরিবর্তন হবে । আমার ছেলে অভিজিৎ কিন্তু তার ছেলে ঋককে খুব পড়ার জন্য চাপ দিত । আর বউমা একটু সমঝদার । ফলে ঋকের টিউশন কমেছে । দু-বেলা অভিজিৎকে অফিস যাওয়ার আগে আর অফিস থেকে ফিরেই পড়াতে বসাচ্ছে আর নিজেকেও বসতে হচ্ছে । বউমাও সময় পেলে বসে । আর ঋকও পড়াশুনার সাথে সাথে খেলারও যথেষ্ট সময় পাচ্ছে । পড়াশুনাতেও বেশ মজা পাচ্ছে । ওর সাথে খেলতে খেলতে আমারও বেশ শৈশবের কথা মনে পড়ে যায় । অমল বাবু বললেন – ঠিকই বলেছেন শান্তিমল বাবু । শৈশবকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ও আমাদের । পরিবার যদি ঠিক ভাবে নজর দেয় বাচ্চারা শুধু শুধু ভিডিও গেমে জড়িয়ে পড়বে না । শ্যামল কান্তি বাবু ছড়িতে হাত দিয়ে উঠে পড়ে বললেন – এ আলোচনা চলতেই থাকবে । আমাদের দেশে বাংলা ভাষাতেই বহু বিজ্ঞ ব্যাক্তি আছেন । যারা লাগাতার এ সম্বন্ধে ভাবছেন । যা চলছে এতেও হয়তো আরো ভাল হবে । অরিন্দম বাবুও উঠে পড়ে বললেন - এখন চলো নইলে সোসাইটির দারোয়ান তালা লাগিয়ে দেবে । -কেন ক’টা বাজে ? -সাড়ে নয় । -সাড়ে ন’টা বেজে গেল ! তাহলে তো আর থাকা যায় না । বন্ধুরা , কাল দেখা হবে । সবাই সবাইকে বলল – আবার কালকে আসবে বন্ধু । আর এই আলোচনা কিন্তু ক্রমাগত চলতেই থাকল ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক
সুন্দর ফরম্যাট...ভাবনাটা চমৎকার আর গল্পের ভর্নণাটাও বেশ সুগঠিত...ভালোই লাগলো...কিন্তু এটা বার বছরের ছেলের লেখা বলে ভাবতে পারছি না...যদি তাই হয় তবে আপনার ছেলেকে স্যালুট....
Ei golpo ti oboshyai amar cheler lekha . Or ekhono ac khulini . Tai o amar ac te likhche . O ekta baro uponyas likheche . Bhaloi lekhe. Oke vote din comment karun .
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।