মিনার ক্ষুব্ধ মনটা অবাক হয়ে ভাবে, এতো যন্ত্রনার মাঝেও তার সবই মনে পড়ে, কেন পড়ে ? কিসের জন্য পড়ে ?বাড়ির সামনের বড় রাস্তা, বাবার অসহায় আবেগ প্রবন মুখটা, ভাইয়ের অনিহার সাথে কর্তব্য পালন, বোনের কিছু করতে না পারার অসহায় দৃষ্টি, সর্বোপরি তার পঙ্গু মাতার আঁও আঁও আর্তনাদ ।পিচের রাস্তার পাশেই তাদের পলেস্তার খসে পড়া একতলা বাড়ীটার তিনটি রূম। সব চেয়ে ছোট ও খুপচির মত ঘরটি তার বাবা মার,বড় রুমটি ড্রয়িং কাম ভাইয়ের শোবার ঘর আর মাঝারি সাইজের মাঝের ঘরটিতে সে থাকতো, আর আত্মীয় স্বজন আসলে তার জন্য তখন মায়ের ঘরের মেঝেতে স্থান হোতো ।ঘরের সামনেই এক চিলতে উঠোন । উঠোনের এককোনে, গোলপাতার তৈরি একটি রান্না ঘর, যেখানে একজনের বেশি কেউ বসে রান্না করা সম্ভব ছিল না, উঠোনে দড়ি বেঁধে ছিল কাপড় নাড়ার ব্যবস্থা, আর বর্ষার সময়, ঘরের ভিতর দড়ি টানানোর জন্য প্রায় শতাধিক লোহা পোতা ।প্রতিদিন ঘর ঝাড় দেবার সময় উঠে আশা আধা গামলা পলেস্তার, এই সব মিনার খুব মনে পড়ছে, ভাই কি কখনও বোনের জন্য এতো বেশি নির্মম হোতে পারে ! কেন তাকে এভাবে বিক্রি করে দিলো, খুচরা ব্যবসায়ী নয়, পাইকারী ব্যবসায়ী নয় একেবারে বড় রকমের ব্রকারের কাছে ।বায়িং হাউজ আছে, ঢাকার বারিধার মত সম্ভ্রান্ত এলাকায় বিশাল বাড়ি আছে।শুধু এতোটা সম্পত্তি মানুষকে সুখী করতে পারে, এরা বাংলা ভাষায় কথা বলে, যার অর্থ মিনা বোঝে না ।মিনা গ্রামের মেয়ে, ভালোবাসার মানুষকে তার নিজস্ব সম্পত্তি ভেবে এসেছে , স্বামী মানেই তো ঘরের মাঝের একটা মুক্ত নির্মল বাতাস ! কখনো কারো জন্য তা কার্বন ডাই অক্সাইডের মত বিষাক্ত হোতে পারে মিনার তা জানা ছিলো না ।রান্নার সময় সারা বাড়ি জুড়ে চুলা থেকে ধেঁইয়ে উঠে আশা ধোঁয়া, চোখে মুখে লেগে গল গল চোখের পানি বের হয়ে আসা, ফুকনি দিয়ে ফুকিয়ে চুলোর জাল ধরানো, এই সব ব্যবস্থা ঢাকার মত জায়গায় নেই, এখানে অন্য ভাবে চোখের জল ঝরে, কাঁদুনি গ্যাসের মত বিষাক্ত গ্যাস এদের আচরণে নির্গত হয় । সকালের আচরণে হতভম্ভ হয়েছে মিনা, বিছানাতে থাকতেই চা চা করে চিল্লানো, নামায পড়লেও একটা কথা ছিলো, একেবারে পচা বাসি গালে আয়েশ করে চা গিললো তার স্বামী মিরন ।এ মা, বাসি গালেই চা, মিরণ গম্ভীর হয়ে বললো,-ছোট বেলার অভ্যাস ।
- এ অভ্যাস পালটানো যায় না ?
- -এটা আমাদের স্টাটাস !
- স্টাটাস ? অবাক হয় মিনা, সে আবার কেমন হোলো, বাসি গালে চা গেলা স্টাটাস ? ঘুম থেকে এগারোটায় উঠা স্টাটাস !একডজন বান্ধিব থাকা স্টাটাস । মিনা ছোট্ট কুপ থেকে মহাসাগরে এসে পড়েছে কে ফেললো তাকে ! কেন ফেললো, বড় আয়নাতে তাকে দেখে সে, কি অপরুপ দেখতে সে ! সে কুতসিত হোলে তো এবাড়িতে তার স্থান হোতো না! উহ! সে যদি কুতসিত হোতে পারতো !! সিনেমাতে সে দেখতো ধনীর ছেলে, আর গরীবের মেয়ের প্রেম ! হায়রে পরিচালক! তোমরা নির্বুদ্ধিতার মত সমাজ টাকে দেখো ! এই তুফানে গরীবের মেয়ের অস্তিত্ব আসলেই কি থাকে !যে তার ব্যাক্তিত্ব বিক্রি করে মাথা নোয়াতে পারে সেই তো, পারবে কেবল দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে এখানে থাকতে ! কিন্তু মিনারা সে জাতের নয় ! মিনা তার স্বামীর সব কিছুর অধিকার পেতে চায় , যারা স্টাটাসের কাছে নিজেদেরকে বলি দিয়েছে, মিনা তাদের জন্য নয় ।মিনা স্বতন্ত্র ! মিনা দরিদ্র ঘরের গ্রামের মেয়ে হোলেও সে লেখা পড়া জানা মেয়ে, হোক না দরিদ্র, তাই বলে কি আত্মার অপমৃত্যু ঘটাবে সে ? হোতেই পারে না ।
মিরন অফিস যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে, - মিনা, একটু গাড়ী নিয়ে পার্লারে যেও, বিকালে এক পার্টিতে যাবো,
-কেন ?
-তোমার অতো বড় লম্বা চুল এখানে মানায় না
-আমি চুল কাটবো না ।
-গোয়ার্তুমি কোরো না
-এটা কে গোয়ার্তুমি বলছো কেন ?
আমি যা বলছি তা কোরে এসো
মিনা রাগে ফুঁসতে থাকে, কিন্তু চুপ করে চেয়ে থাকে, কিছুই আর বলে না, ড্রাইভার এসে বলে-ভাবী ,ভাইয়া আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে
মিনা শান্ত হয়ে বলে-যাও, আমি আসছি ।
পার্লারে যে এতো আরাম আয়েশে বসিয়ে মাথা ম্যাসেজ করে, তার লম্বা চুল গুলো কেটে দিলো, অনেক ক্ষুব্ধ সে তার ভাইয়ের উপর, বোনের সুখ কিনতে গিয়ে আজ বোনের সত্ত্বাকে কাচি দিইয়ে ক্যাচ ক্যাচ করে কেটে দিচ্ছে, কাটুক ! কেটে দিক এভাবে সভ্যতার সত্ত্বাকে, সভ্যতার ঐতিহ্য ধবংশ করে দিচ্ছে, দিক, মিনার কি ? মিনা তো ভিতরে বাইরে মিনাতেই স্তির থাকবে ,
পার্লার থেকে ফিরে এসে আয়নাতে দেখে, অন্য রকম মিনা তার সামনে দাঁড়ানো ।তার বয়সের থেকেও তাকে ছোট লাগছে, এটাই কি তবে শহুরেদের, আল্ট্রা মডার্নদের যৌবন ধরে রাখবার ইতিহাস ?
মিনা অবাক হয়ে ভাবে, তার এখনো মনে হোচ্ছে পুতুল খেলার সময় পার হয়নি, সে এখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী । কে বলবে সে অনার্স শেষ করে এখানে এসেছে ? বাহ!!
মিরন ফোন দেয়,-চুল কেটেছো ?
-হা, কেটেছি
-দুপুরে পার্লারে যেয়ে পার্টি মেকাপ নিয়ে এসো, হা ?
-আচ্ছা ।
মিনার বুক ফেঁটে কান্না আসে, ওর বাবা হাসেম মাষ্টার বলতো- জানো বাবুলের মা, মিনার লম্বা চুল দেখে, আমার জামাই ঘরে এসে মেয়েকে নিয়ে যাবে, মেয়ে বিয়ে দেবার জন্য চিন্তা করতে হবে না
মিনা মনে মনে বলে ,-না, বাবা, লম্বা চুল ছেটে যারা বিলেতি কাট কাটতে পারবে এখন তাদের ঘরের বউ করে, তোমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য যারা হত্যা করতে পারবে তারাই আধুনিক সভ্যতার ধারক ও বাহক । তোমরা পুরোনো, দেহ তত্ত্ব গান গুলো যেমন পুরোণ হয়ে গেছে, তোমরা তেমনই পুরোনো ।এখন যেমন যাত্রার দল প্যান্ডেল করে বট তলায় স্কুল মাঠে আর যাত্রার পালা করে না, এখন মঞ্চ নাটকের চলন কিছু সাংস্কৃতিক মহল ছাড়া জনগণের মন থেকে উঠে গেছে, তেমনি পুরোনো হয়ে গেছে সব !এখন কবিতার বই শুধু কবিদের হাতে দেখি, যারাই পাঠক , তারাই কবি, তারায় শ্রতা !নায়কের সুনামে যেমন সিনেমা চলে, পরিচালকে, ক্যামেরা ম্যান, নাট্যকররা যেমন থাকে সবার অলক্ষ্যে এখন আমাদের আদি ওইতিহ্য সবার অন্তরালেই হারিয়ে গেছে । ঘুম থেকে উঠে ওযু কালাম করে নামাযে যায় শুধু বয়স্করা, যখন মৃত্য ভয় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ,যখন সঙ্গী বলতে ছড়ি, লাঠি চশমা ছাড়া আর কেউ থাকে না ।
তখন ঢিলে বাঁধনে আল্লাহরে আঁকড়ে ধরতে চায় সর্ব শক্তি দিয়ে, কিন্তু তখন বাহুতে বল কোথায় !গায়ের তেমন জোর কোথায় !সবই তখন অতীতের গল্প মাত্র । তারপর মানুষের আহম্মক মনটা প্রাণ পনে ধার্মিকের পথ ধরে ।
মিনার পার্টিতে মন বসে না, চিয়ার্স বলে ড্রিংকস এর গ্লাসে চুমুক, ওমুকের বৌয়ের গ্লাসে ওমুকের ঠুকা ঠুকি !
মিরন বলে- তোমার মন খারাপ কেন ?
এগুলো আমার ভালো লাগে না মিরন, ঠান্ডা হয়ে বসে খায় , দাড়িয় দাঁড়িয়ে খাওয়া টাতে আমার অরুচি আছে ,
-আচ্ছা তুমি বসো
মিরন ওদিকে চলে যায় ।তুলিপের বউ সহাস্য পাশে বসে-আপনাকে সুইট লাগছে।
মিনা শান্ত স্বরে বলে-, আমি বরাবর সুইট
তুলিপের বউ একটু খানি চমকায়, তবু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে।–ঠিকই তো
-কোন দিন তো ভুল ছিলো না ভাবি !
বাসায় এসে মিনা কথা বলে,-মিরন তোমরা নিজেদের কি মনে করো ?
-মানে ?
ওই যে এই বয়সে লাফালাফি, হাত পা ছোড়া ছুড়ি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করা, এগুলো,- ধর্মীয় বিধি নিশেধ ছাড়া, ডাক্তারী কিছু নিশেধাজ্ঞা আছে , সেটা কি মানো ?
তোমার মত আন কালচারের কাছে আমার শিক্ষা নিতে হবে ?
উহু, তা বলছি না, বলছি, শরীর তবিয়ত ঠিক রাখার মত কিছু বিষয় তো তুমি মানবে ?
মিরন অবাক হয়, চুপ করে ঘর থেকে বের হয়ে যায় ।
মিনা নিজের রুচির সাথে মিরনের রুচির বিশাল ব্যাবধান দেখে , ভাল লাগে না তার কিছুই । অভাব নেই ধন সম্পদ, ভালোবাসার, তার পরও বড় একটা ফারাক থেকে যায় তাদের দুজনার মাঝে, এতো অমিল নিয়ে কিভাবে সে থাকবে এখানে ?
তাদের গ্রাম থেকে আনোয়ার এলো একটা কাজের খোঁজে, তার ভাইয়ের হাত থেকে একটা চিঠি নিয়ে এসেছে,- আনোয়ার সপ্তাহ খানেক তোদের ওখানে থাকবে, ওর দিকে বিশেষ খেয়াল করিস, বোন !
মিনা সংকুচিত হোলো, ভাইটা কি ভেবেছে, গ্রামে যেমন ভাবির হাতেই তার ইচ্ছা অনিচ্ছা ?এখানে মিনা আর মিরনের ভিতর অনেক রেস্ট্রিকশন আছে ।
ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে সে মিরনের সামনে চিঠিটা ধরিয়ে দিলো,
মিরন বলল-সমস্যা কি, নিচে ড্রাইভারের সাথে থাকবে ?
মিনা বললো,-তা কি করে হয় , গ্রামের মানুষ, ওতো গ্রামে যেয়ে এসব বলবে।
তাহলে ড্রয়িং রুমে অথবা গেস্ট রুমে থাকবে, কিন্তু মার তো আবার গেস্ট রুমটা লাগে, ওখানে লো কোয়ালিটির মানুষজন, মা ঠিক লাইক করে না ।
আর ড্রয়িং রুমে তো সারাক্ষন কেউ না কী আসছেই ।
মিনার ক্ষোভটা এবার সাংঘাতিক ভাবে প্রকাশ পেলো, তাহলে আমিও কি লো কোয়ালিটির লোক নয় ?
-সে কেন, আগে কি ছিলো তাতো বড় কথা নয় মিনা, এখন তুমি মিরনের স্ত্রী ।
-খ্যাতা পুড়ি মিরনের স্ত্রীর !আমার মা বাবাকে তুমি লো কোয়ালীটীর বলছো, আর তোমার সাথে থাকাটা আমার সমীচিন কিনা , তুমিই বলো ?
-এ তোমার বাড়া বাড়ি
-কেন, বাড়াবাড়ি কেনো?
-যা বোঝো না, শুধু তা নিয়ে বিবাদ কর না মিনা ।
ওকে স্টোর রুমে থাকতে বলো তাহলে ।
মিনা চলে যায়, কাজের লোক দিয়ে স্টোর রুমটা পরিস্কার করিয়ে তাতে বসায়-আনু ভাই তুমি এখানেই থাকবে
-তোদের খুব অসুবিধা করলাম নাতো
-করলে করেছো, তা নিয়ে তোমার মাথা ব্যাথার দরকার নাই
-তুই তেমনই আছিস, এতো বড় বাড়ী গাড়ি, বড় লোকের বৌ, তারপরও তোর মুখের সেই স্পস্ট কথা এখনও তেমনি আছে ।
মিনা হেসে ফেলে- কয়লা ধুলে ময়লা যায় না, আনু ভাই !
মিনার অনেকদিন পরে ভালো লাগে, ভালো লাগে গায়ের মানুষের উপস্থিতি
বলে- আনু ভাই, আমাদের বাড়ীর সামনের পুটিমারির বিলে কি ইরি ধানের ব্লক এখনো হয় ?
-হবে না কেন ?
-ফতেমা কেমন আছে ?
-ভাল নেই , ওর বরটা আবার বিয়ে করেছে, তাকে নিয়ে শহরে বাসা নিয়ে থাকে , ফতের কোন খোঁজ নেই না ।
ফতেদের চলে কিভাবে ?
চলছে, ওর মামাদের বাড়িতে কাজ কাম করে ছেলেটাকে এবার স্কুলে ভর্তি করেছে, আছে , আর কি !
আর তুমি কেমন আছো আনু ভাই ?
আনোয়ার হেসে ওঠে , ভুলে যায় স্থান কাল পাত্র, তেমনই প্রাণ খোলা হাসি তার- আমার চাল নেই চুলো নেই, বউটা মরে গেলো ।এখন যাযাবর, একজন বলেছে একটা চাকুরীর কথা তাই ঢাকাতে এসেছিলাম, এসে দেখছি, সে সিঙ্গাপুর গেছে, সামনের সপ্তাহে আসবে ।
-ভাবির কি হোয়েছিলো ?
-টিউমা্র জরায়ুতে, পরবর্তিতে ক্যান্সার, বাঁচান গেলো না তাকে ।ভালো হয়েছে রে, বাচ্চাকাচ্চা হলে কি খাওয়াতাম বল ?বউটার খাওয়া পরা দিতেই হিমশিম খাচ্ছিলাম, টিঊশনিতে আর কত চলে বল !তারপর আনোয়ার আবার হাসলো, জানে এ নির্থক হাসিতে কষ্ট মাখা আছে। মিরন এসে উঁকি মারলো, বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো
বলল-মিনা এদিকে একটু আসবে ?
মিনা আসলেই ফুঁসে উঠলো মিরন-এই সব মানুষদের সাথে হাসাহাসিও করো
আনু ভাই খুব রসিক মানুষ , ভালো বক্তা , ভালো লিখেন ? জানো আনো ভাইয়ের লেখা পেপারেও যায় !
তাতে কি, যতসব পাগল ছাগল !!!!!
পাগল! কি বলছো, এক কলম লেখার মুরোদ আছে তোমার ? যারা লিখে তারা পাগল ?হতে না পারল হুমায়ুন আহমেদ, শামসুর রহমান, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ ! নাইবা যেতে পারলো মন্ত্রীদের কাছাকছি, কিন্তু ওনার লেখা আমাকে মোহিত করে, ম্র আনু ভাইকে নিয়ে গর্ব হয়, সবাইকি লিখতে পারে ? সবাইকি বড় লেখিয়ে হোতে পারে, এই সব লেখকদের টাকা আছে, লোকবল আছে অনেক সার্টিফিকেট আছে, সেই বলেই ওনারা অনেক উপরে, কিন্ত আনো ভাই, অনার্স করেছে, সেকেন্ড ক্লাস, সবাইকি ফাস্ট ক্লাস পায় , তুমি পেয়েছিলে ?
মিরন শান্ত কন্ঠে বলে-বাসায় ভদ্রলোকদের আনাগুনা, চেচিয়ো না, ছোট লোকের মত !
আমি চেচালাম ? আমি তো বললাম, মানুষকে বড় চোখে দেখ, মানুষ, তার আপন কৃতিত্বে অমলিন থাকতে চায়, তুমি চাও না কেন ? কি আছে তোমার এই অর্থ সম্পদ ছাড়া, না আছে মানুষের মত মন, না আছে নিজের ভিতর এমন তরো কিছু যা নিয়ে গর্ব করা যায় !
-তুমি কি ঝগড়া করছো মিনা ?
না তা করবো কেন ? ঝগড়া কি মানুষে করে, অমানুষে করে, তোমার সাথে বিয়ে হয়ে আমি অমানুষ হয়েছি বলেই ঝগড়া এসে যাচ্ছে ।
মিরন নিরবে বাইরে বেরিয়ে গেল,
আনোয়ার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মিনা তুই ঝগড়া করিস ? কত্ত বর মানুষ তোর বর, গেটের কাছে গেলে দারোয়ান গেটটা খুলে দেয়, ড্রাইভার গাড়ীর দরজা খুলে অপেক্ষা করে, কি তোর ভাগ্যরে !তুই এতো বললি, ও মাত্র দু’একটি কথা বলল, অনেক ভাগ্য তোর!
দেখিসনি আমাদের গ্রামের বর রা কেমন কচার ডাল, ঝাটা, অথবা গরানের চলা নিয়ে বউ পেটায়, কত অমানুষরে আমরা, বড় লোকেদের ঝগড়া কত সংক্ষিপ্তরে !
মিনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে-বড় লোকদের আদরও এমনই সংক্ষীপ্ত !ভালবাসা আরও সংক্ষীপ্ত !
আনোয়ার বিস্ফাড়িত নয়নে তাকায়, তার সন্দেহ হয় মিনাকে নিয়ে , মিনা কি এতো কিছু পেয়েও সুখী না, ও কি এখনও সেই আনু ভাইকে ভালোবাসে, কবি আনু, পাগলা আনু, যার কাছে মিনা ছুটে যেত- আনু ভাই, আজ কবিতা লেখনি ?
না
কেনো
উপলক্ষ্য না পেলে লিখবো কেমন করে?
আমাকে নিয়ে লেখো!
তোকে নিয়ে?
হা
কেন ?
আমি তো তোমাকে আকাশের মত বিশাল করে ভালোবাসি
যাহ! পাগলি ! এসব বলে না, লোকে মন্দ বলবে !
তাতে আমার কি ?
কিন্তু আমার যে আসে যায়রে, বাবুল তোকে নিয়ে অনেক বড় সপ্ন দেখে, অনেক সুন্দর তুই, প্রজাপতির মত সুন্দর তুই, গোলাপের মত সুবাস তোর, শিউলির মত কোমল তুই, নদীর মত বহমান তুই, আমার জীবন স্থবীর, চলে নারে, চলে না, আষাড়ে ঢল নামে আমার ঘরে, গামলা বাটি কুল খায় না, ঘরের এককোনে কোন মতে পড়ে থাকি, এখানে তোকে মানাবে না, পচা কথা মুখে আনবি না ।
তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না , আনু ভাই ?
নাহ ! কখনও না, আমি তোকে ভালোবাসতে যাবো কেনো? আমার মনের রাণী অন্য কেউ , তুই না !
মিনা হাসে-জানি সেখানেও আমিই তোমার রাণী, স্বীকার করবে না তো !একদিন দেখবে, আমার জন্য তোমার খুব কষ্ট হবে !
নাহ! তোর জন্য ?বইয়ে গেছে আমার, তোর মত পরীর জন্য কষ্ট পেতে ! তুই এতো সুন্দর না হোলে হয়তো কষ্ট পেতাম ! কিন্তু আমি তো তোকে কল্পনাতেও দেখি না !
তারপর মিনার অপূর্ব সৌন্দার্যে মোহিত মিরন বিয়ে করে নিয়ে এলো মিনাকে ! সাজালো নিজের মত করে, পুতুল পুতুল বউ !
গ্রামের আনোয়ার, কোথাকার আনোয়ার বিয়ে করলো, আনাড়ী এক গ্রামের মেয়ে, এই জীবনে এর থেকে বেশি কি চাওয়ার থাকবে আনোয়ারের !
বঊটাও একসময় নেই হয়ে গেল,
মিনা বলে-তোমার লেখা এখন কাগজে আসে ?
আসে ।
আমাকে একটা শোনাবে ?
না ।
কেন ?
তুই এসব বুঝবি না, তোর সুন্দর চুল গুলো কেটে ফেললি কেন ?
এমনি ।
তুই অনেক সুখী তাই না ?
না ।আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে আনু ভাই ?
এসব কি বলছিস ?
ঠিক বলছি, তুমি সারাদিন লিখবে, আমাকে নিয়ে, আমার প্রজাপতি মন নিয়ে, আমার গোলাপী সুবাস নিয়ে, আমার ক্লান্ত মিষ্টি মুখের ছবি নিয়ে, পারবে না, আনু ভাই ? আনু ভাই, চলো পালিয়ে যায়, জীবনতো এতো টুকু, একটায়তো জীবন, আমাকে ছুটতে দেবে তুমি ? তোমার আংগুল ধরে আমি হাটবো, ক্লান্ত হলে তুমি আমাকে কবিতা শুনাবে, তুমি যে লিখেছিলে………আমি এক সমুদ্র নোনা জলে ভিজেছি, তবু তোমার চোখের জলেই মুক্তার স্বাদ নিয়েছি, অন্তর বিরহী বাজনা বাজাবে যদি তোমার অনামিকাতে আমার অনামিকা না ছোয়……………।
ছঁইয়ে দেখবে আমার অনামিকা একবার ? একবার আমার গোলাপী সুবাসে তুমি মোহিত হবে ? আনু ভাই, আমার উঠোনের বেড়ার চারিপাশে এখনো কি ঢোশ কলমি ফোঁটে ?আমার ছোট্ট পথের দু’পাশে এখনও কি বেলী ফুলের সুবাস ছোটে ? আনু ভাই, আমাকে নিয়ে যাবে তুমি ? বলো ? নিয়ে যাবে !
আনু উপরের দিকে তাকায়, তার চোখ ভিজে উঠেছে !কখন ফিরে এসে মিরন পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, দেখেনি ওদের কেউ ! ছোঁইয়া হোলা না, অনামিকা,মিনা, ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে,মিরন বললো-তুমি যেতে চাও ,মিনা ?
আনোয়ার চিতকার করে উঠলো-কখনও না , আমি ওকে কখনো বলিনি ভালোবাসি, কখনও বলিনি চলো, ও ছোট মানুষ, ওর মনে অনেক কবিতা আসে, আবেগের বসে কিসব বলছে !
মিরন শান্ত কন্ঠে আবারও বললো- মিনা, তুমি যাবে ?
মিনা-কঠিন কণ্ঠে বললো,-হা, আমি যাবো, তবে এই ভীরুটার সাথে না, আমি ফিরে যাবো আমার নিজস্ব অরণ্যে, যেখানে আমার অনেকদিনের লালিত স্বপ্ন কাচি দিয়ে কেউ কেটে দেবে না, আমাকে বিভাজন করবে না আমার সংস্কৃতি থেকে, আমার ভুবন থেকে যেখানে কেড়ে নেবে না কেউ অক্সিজেন , আমি কারো স্টাটাসের বলি হবো না, আমাকে পরিশুদ্ধ বাতাস দাও মিরন, আমাকে মুক্ত বাতাস দাও , আমাকে সুন্দর একটা সাহসী মানুষ দাও, আমার নিজস্ব ভুবন দাও, আমি যাবো, এ আমার অধুনা সভ্যতার প্রতি রাগ, ভীরু মানুষের প্রতি রাগ, তোমাদের আধুনিক স্টাটাসের রতি রাগ, দূর হয়ে যাও আনু ভাই, আমি একাই যাবো…………
মিনা ফিরে তাকায়। কখন চলে গেছে আনোয়ার তা্র ব্যাগ নিয়ে, মিরন চুপচাপ চেয়ে আছে এই বিদ্রোহী নারীটার প্রতি…………
আনু ভাই কোথায় গেলো ?
মিরন হাত ধরলো মিনার-শান্ত হও, এক এক মানুষের লাইফ স্টাইল এক এক রকম, হেরে যেও না মিনা, তুমিই পারবে বদলাতে আমাদের………
তোমরা বদলাবে ?
হা, আমরা বদলাবো, তোমার মতো অনেক গুলো মিনার দরকার আমাদের ।
মিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, তার অনেক ক্ষোভ চোখের জল হয়ে ঝরে পড়ে
মিরনের বুকে মাথা রেখে বলে,- আনু ভাইকে ফেরাও ।
ফিরবে না মিনা,য়ানু ভাইয়েরা ফিরে না, তাদের জগতে আমাদের বসবাস হয়া না, আনু ভাইয়ের প্রতি আমার কোনো অনুযোগ, অভিযোগ রাগ নেই, আমার অভিভাবক তো আমার মত করে তোমাকে বুঝবে না, এই সমাজে আমরা এভাবেই একজন আরেকজনের কাছে কিছু দায়ে বন্দী থাকি, কেউ না থাকুক আমি থাকবো তোমার পাশে ।তোমার মনের ক্ষোভ মুছে ফেলে এসো আনু ভাইয়ের একটা কবিতা পড়ি
ভুলে যাও হানাহানি
মুছে ফেলো লোভ
ভালোবেসে বলে যাও
নেই কোন ক্ষোভ !!!