সুনিতির ভেজা চোখ আফসানের সামনে এসে আরও ভিজে ওঠে, ফুফিয়ে কাঁদে সে ।ভৈরবের কুল ঘেষে সুনিতিদের বাড়ী, পাশের গ্রামের ছেলে আফসান, আফসানের বাবা মারা গেছে আফসান যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন, একবোন , দুভাইকে নিয়ে মা তার পাথারে পরে, ভাসুরের বাড়ী ঝি বান্দির কাজ করে তিনটি ছেলে মেয়ে কে লেখা পড়া শিখিয়েছেন, মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন, এককালের বনেদী ঘর ছিলো সেই সুবাদে বড় ঘরে, বড় ছেলেটিকে বিয়ে করিয়েছন তেমনই এক ধনাড্য ঘরে , বাকি রয়েছে আফছান, সেখানেও তিনি উচ্চ আশা পোষন করেন ।আফসানের বড় ভাই আরমান , মেধার জোরে পুবালী ব্যাংকে ক্যাশ অফিসারের চাকুরীটা হাতিয়ে নিয়েছে, আফসান যদিও এল এল এল বি করছে , তবু খুব বেশি ভালো রেজাল্ট না থাকায় ভালো কোনো চাকুরীতে এপ্লাই করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আফসাঙ্কে ব্যাবসাতে দিবেন,ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা লোন নিয়ে, দিঘলীয়া উপজেলাতে একটি বড় দোকান দিয়ে দেন, রূপসা থেকে দিঘলীয়া পথের দুরত্ব একেবারেই কম না,সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ফেরে, এর পরও আরমান কন্ডাক্টরীতেঝুকে পরে , যার অর্ধেকের বেশি কাজ আফসানের ঘাড়ে বর্তায়, তাই আফসান এখন ব্যস্ত মানুষ ।
সুনিতি বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা, সংসারে তার বাবা শিক্ষা অফিসার হিসাবে, ডুমুরিয়া থানাতে কর্মরত রয়েছেন ।মা স্বাস্থ কমপ্লেক্স এ কাজ করেন, সুখের অভাব থাকার কথা নয়, তবু কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ম যন্ত্রনা ছিলো পরিবারটিতে , ভৈরবের কুল ঘেষে একটি দ্বিতল ভবন তাদের, নীচ তলা ভাড়া দেওয়া, উপরের পুরো ফ্লাটেই তারা থাকে, সুনিতির অনেক আছে, চাওয়া মাত্র সব কিছুই সে হাতের কাছে পায়, পায় না বাবার স্নেহ, মায়ের সংস্পর্শ, চাপা একটা দুঃখবোধ বাড়ীটা ঘিরে, সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী ।
সুনিতির মাকে প্রশ্ন করে সুনিতি,-মা, তুমি কি হাসতে শেখনি ? তুমি অফিস যেয়েও গোমড়া মুখে বসে থাকো তোমার তো পাবলিক ফাংশন ?
ঝর্না বোবা চোখে তাকায়, মাথা নিচু করে রান্নার কাজে মন দেয়। সুনিতি আবার বলে-,মা আমি একা কেন ? আমার আর একটা ভাই বোন কেন হোলো না ?
ঝর্না শান্ত কণ্ঠে বলে-, পড়তে যা, মা ।
সুনিতি ক্ষেপে যায়-, মা, আমি তো ছোট বেলা থেকে শুনছি ,পড়তে যা, পড়তে যা, এ ভাবে যেত যেতে তো আমি অনেক দূরে চলে গেলাম ,মা !
ঝর্না জবাব দেয় না । নিরবে হাতের কাজ সারতে থাকে ।সুনিতির ভালো কোন বন্ধু তৈরি হয়নি, ছোট বেলা থেকে দূর সম্পর্কের আফসান ভাই কে সে বাড়ীতে দেখে আসছে । সেই তার ভালো বন্ধু ।
মাঝে মাঝে সুনিতি নিজেকে প্রশ্ন করে আফসানকে কি সে ভালোবাসে ? উত্তর পায়নি । আফসানও কখনও বলিনি সে সুনিতিকে চাই, সুনিতি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই যাকে দেখে সে আফসান, ব্রাশ হাতে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আফসান, দুপুরে গামছা ঘাড়ে স্মৃত হেসে যে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে সে আফসান ,, সুনিতির বাড়ীতে এই একজনেরই পারমিশন আছে ,পাড়ার ছেলেরা সুনিতিকে সমীহ করে, শ্রেণিমত স্নেহ ভালোবাসা দেয়, ওকে কাছে টানার কথা কেউ কখনও ভাবেনি,আর আফসানের মনের গভীরে সে যেতেও পারিনি । কিভাবে যাবে, যখনই বলতে যায়-, আফসান ভাইয়া এতো সকালে তুমি এদিকে ?
-প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়েছিলাম , ভাবলাম তোদের দেখে যায়, ফুফু আম্মা কেমন আছেন ? উনি বোধ হয় এখন রান্না ঘরে তাই না, সুনি ?
-শুধু ফুফুকে দেখতে আসো ?
-হা রে বুন্ডি ।
এই বুন্ডি শব্দটা সুনিতিকে থামিয়ে দেয় , আফসানের কাছে সে ছোট বোন ছাড়া আর কিছুই না , তাহলে তার বুকের ভিতরের শুন্যতা আফসান দেখে না, দেখতে পায়নি বুকের শুন্য ঘরে সে আফসানকেই বসিয়েছে , ভার্সিটির ছেলেরা অতি বেশি আত্মকেন্দ্রিক । কেউ বাইকের প্রতিযোগিতা, কেউ রেজাল্টের অহমিকা, কারো চোখের মনিতে খেলা করে সুপ্ত পাপের ছবি । কালো বোরখা পরা মেয়েটার শরীরটা অনেকেই খুলে দেখতে চা্য , সুনিতি কুঁকড়ে যায়, সে একটু অন্তঃমুখী, সে নিজেও বোঝে তা, হয়তো ছোট বেলা থেকে সংসারে একা ঘুরতে ঘুরতে সে এরকম চুপচাপ স্বভাবের হয়ে গেছে ।তার বাবা সোয়েব ,বাইরে প্রচন্ড হাসি খুসি, কিন্তু ঘরে সে ভিন্ন মানুষ, কি মেয়ে , কি স্ত্রী ! কারো কাছেই সে খোলা হতে পারে না, সুনিতি দেখেছে তার বাবা অফিসের লোকদের সাথে প্রাণ খুলে হাসেন, স্কুল শিক্ষকদের সাথে বেশ খোলা মেলা কথা বলেন, শুধু সন্তান এবং স্ত্রীই তার কাছে ভিন্ন জগতের মানুষ । সুনিতি বোঝে না, কেন তার বাবা, তাদের কে আপন ভাবে গ্রহণ করতে পারে না, কেন তার বাবা দূরে থাকতেই বেশি ভালোবাসে, কার জন্য বাবা তাদের সাথে পরের মত আচরণ করে, কেন তার বাবা ঘরে এতো গম্ভীর । সুনিতির মনে আছে, অনেক বলে কয়ে দু’বছর আগে সে বাবাকে নিয়ে বাগের হাত ষাট গম্বুজ মসজিদ, পীর খান জাহান আলীর মাজার দেখতে গিয়েছিলো , রুপসা থেকে বাসে উঠে তারা রওনা দিয়েছিল, সারা বাসের ভিতর বাবা ভীষন গম্ভীর ছিলো, সুনিতি প্রশ্ন করে ,-বাবা তুমি চুপ কেন বাবা ?
-কি বলবো ,সুনি ?
-আমি তোমার মেয়ে ,বাবা ?
-আমি তো না করছি না।
-তাহলে তুমি কথা বলো না কেনো ?
-কি বলবো, সুনি ?
-এই একটা কথা, কি বলবো , এটা বাদ দিয়ে যে কোন কথা !
সোয়েব অবাক হয়ে সুনিতির দিকে তাকায়, চোখের কোনে পানি চিক চিক করে ওঠে।কিছুই বলে না।
সুনিতি বলে,-বাবা তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না ?
সোয়েব আবার অবাক হয়ে তাকায়- এ কথা বলছিস কেন ? তুই কি চেয়েছিস যা তোকে আমি দেইনি ?
সুনিতি বাসের ভিতর চারিদিকে তাকায়, কেউ তাদের কথোপোকথন শুনছে কিনা লক্ষ্য করে , তারপর ফিস্ফিস করে বলে-আমাকে সংগো দাওনি, ভালোবাসা দাওনি ।
সোয়েব বলে,-তোর ভুল ধারনা , তোকে এতো ভালোবাসি যা তুই পরিমাপ করার মত পাল্লা পাবি না।
বাগের হাটে যেয়ে প্রথমেই ষাট গম্বুজ মসজিদে নামে, সুনিতি আর একটা কথাও বলেনি, সে একা একা ষাট গম্বুজ গোণে, এক , দুই ,তিন, চার, এভাবে কয়েকবার গোনে কখনও পঞ্চান্ন, কখনো সাতান্নটা হয়, ষাটটা গম্বুজ সে গুনতে পারে না, মিলাতে পারে না, গম্বুজের সংখ্যা, হয়তো তার জীবনের সব নির্ধারিত সত্য গুলো এমনই গুণার বাইরের কিছু , বেহিসাবের দড়িতে বাঁধা হিসাবের সংখ্যা গুলো । যে দুঃস্প্রাপ্য ইট গুলো দিয়ে ষাট গম্বুজ তৈরি হয়েছে, সে ইট গুলো কোনো ভাটার মালিক এখন কেন তৈরি করে না, ভেবে পায় না, সে ।ষাট গম্বুজ থেকে ভ্যানে করে তারা ঢালু পথ পাড়ি দিয়ে যায়, পীরের মাজারে, কি সুন্দর এই পথ, আর মাজার সংলগ্ন দিঘী, বিশাল দিঘী , অনেক দর্শনার্থী । লাল লাল ইটের গাথুনীতে দিঘীর পাড়, কালা পাহাড়, ধলা পাহাড় নামের দু’টো কুমির ছিলো, এখন একটা নাকি আছে শুনেছে ,কিন্তু তারা দেখতে পেলো না, তারা দিঘীর উলটো রাস্তা ধরে কাড়া পাড়ার রাস্তার পাড়ে গেলো , ওখা নে এক খাদেম কে ধরে ওরা নতুন কুমির গুলো দেখলো, খাদেম জানালো কিছুদিন আগে তাদের এক আত্মীয়াকে পাড়ে উঠে কুমির ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে , সে ঘরের সামনে দিঘীর পাড়ে বসে থালা বাসন মাজছিলো ।
দিঘীর পাড়ে বসে ছিলো ওরা হঠাৎ বাবার একসহকর্মীর সাথে দেখা , সুনিতি দেখলো সোয়েব উৎফুল্ল, উল্লাসিত, হোই হৈ করে উঠলো,ছবি তুললো, বাবা তখন দৌড়াচ্ছে ছোট্ট বালকের মত , অথচ তাদের কাছে বাবা এক নিস্প্রাণ মানূষ, কিন্তু কেন ? এই একটা প্রশ্নই সুনিতিকে কুঁড়ে কুড়ে খায়, বাবার সহকমী চলে যাবার পর আবার তার বাবা আগের মত নিস্প্রাণ ।
সারা রাস্তা নিরব ছিলো তার বাবা , সুনিতি কোনো কথা আর কখনো তুলিনি, কি হবে তুলে !তার বাবা মা দু’জন দু’গ্রহের মানুষ, একই ছাদের তলে, কিন্তু কখন সে দেখেনি বাবা মার সাথে খোলা মনে কথা বলেছে, মা বই পড়লে বাবা টিভি দেখেছে, বাবা খবরের কাগজ পড়লে মা টিভি । কোন গ্যাঞ্জাম নেই, কোন ঝগড়া বিবাদ নেই, অথচ বড় কোনো বিবাদ তার বাবা মার চোখে খেলা করে, মা খাবার রেডী করে ডাকে – খেতে এসো।
বাধ্য ছেলের মত বাবা খাবার টেবিলে, নিরবে খেয়ে বাবা উঠে যায়।বাজারে যাওয়ার সময় বাবা বলে-, কি আনতে হবে ?
ব্যাস এখানেই শেষ । প্রয়োজন ছাড়া কি বেশি কথা বললে তাদের ট্যাক্স দিতে হয় ?
কি সেই ট্যাক্স ?
সুনিতি কৌতুহল মিটাতে প্রশ্ন করে খাবার টেবিলে,-বাবা, তোমরা কি কখনো প্রয়োজনের বেশি একটা কথাও বলোনি ?
সোয়েব একবার মাথা তুলে তাকায়, তারপর খাবারে মনোযোগ দেয় । সুনিতির খুব কষ্ট হয়, ভীষণ রাগ হয়, তার কাঁদতে ইচ্ছে করে , কেন তাদের পরিবারটা অন্য রকম, সমাজের বিশেষ কোন কাজে সোয়েবকে যেতে দেখিনি সুনিতি, পাড়ায় নাটক হলে বাবার কাছে মোটা টাকা দাবি করে, বাবা বিনা বাক্য ব্যায়ে দিয়ে দেয়, সেখানেও কথার সীমা আঁকা, অথচ এই পাড়ার বাইরে সোয়েবকে সুনিতি অন্য রকম্ ভাবে ।কী এমন যন্ত্রনা তার বাবা মায়ের জীবনে ।
নিরব সময়গুলোর মাঝে আফসান তার একমাত্র সাথী, বিকালে এসে হাজির হয় আফসান,-সুনি, চা দিবি এক কাপ ?
-না।
-কেনো ?
- এমনি?
-আচ্ছা দোকান থেকে খেয়ে নেবো ।
সুনিতির রাগ ধরে কেন প্রতিবাদ করতে পারে না, কেন বলে না-তোকে দিতেই হবে ।সুনিতি বলে- দাড়াও , দিচ্ছি ।
-থাকরে তোর অসুবিধা থাকলে দরকার নেই।
সুনিতি মাথা দুলায় –না, সমস্যা নেই, এমনি বলছিলাম ?
আফসান অবাক হয়ে বলে,-এমনি কেন ?
সুনিতি এমন নিস্প্রাণ প্রশ্নের উত্তর দেয় না । আফসানকি কিছুই বোঝে না, এতো নিস্প্রাণ কি করে হয় মানূষ ?
তার দিন গুলি এভাবেই চলছিলো । হঠাৎ আফসানের স্বভাবিক আসা যাওয়াতে পড়ে ছেদ, তার কাজের পরিধী বেড়ে যাওয়াতে সে এখন ব্রাশ হাতে সকালে হজির হয় না। সে তখন টিফিন বক্স হাতে ছোটে দিঘলীয়ার পথে, তার কাজের সাইডে,ব্যাপসার পরিধী যায় বেড়ে, অর্থের পরিধী বাড়ার সাথে সাথে তার মা ছেলের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন , একদিন আফসানের বিয়েও ঠিক হয়ে যায় ।
নতুন বউয়ের স্পর্শ সুখের চিন্তায় আফসান যখন বিভোর, সুনিতি তখন গুমরে গুমরে কাঁদে, তার বুকের মাঝে লালিত স্বপ্ন আজ ঝরে গিয়ে পুড়ে ছাই হতে যাচ্ছে, তার নীরব মুহুর্তগুলো আরও বেদনায় মুশড়ে গিয়ে তাকে বোবা করে দেয়, কা্কে বলবে তার মনের কষ্ট গুলো ?কে শুনাবে তাকে শান্তনার বাণী ! হাইরে নিষ্ঠূর সময় ! নিষ্ঠুর জীবন! বোঝে না, কেউ কাউকে ।
সুনিতি নিজেকে এই নির্মম মুহুর্তের জন্য তৈরি রেখেছিলো, কিন্তু তা তাকে এতো বেশি আঘাত করবে ভাবিনি । অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে তার, তার বাবা সোয়েবকে সে বললো-, বাবা আমাকে দেশের বাইরে পাঠাতে পারবে ?
সোয়েব বিস্ময়ে বললো-বিদেশে কার কাছে যাবি ?কেন যাবি ?
-এ দেশে আমার তো কেউ নেই বাবা, কেন এদেশে থাকবো ? কার কাছে থাকবো ?
-মানে ? তাহলে আমরা আছি কেন ?
-তোমরা নেই, তোমরা তোমাদের নিয়ে আছো ,আমি খুব একা বাবা ।
সুনিতির চোখে পানি এসে যায়, ঝর ঝর করে সে কেঁদে ফেলে ।সোয়েব মাথা নিচু করে বসে থাকে , ঝর্না ঘাড়ে হাত রাখে – কি হয়েছে , সুনি ?
সুনিতি মাথা উঁচু করে দেখে মার চোখে পানি ।
-কেন কাঁদছো, মা? কেন কাঁদো তোমরা ? কিসের তোমাদের অভাব ?
সোয়েব ঘর ছেড়ে উঠে যায় । কান্নায় ভেংগে পড়ে ঝর্না ।
সুনিতি নিজেকে ঠেকাতে পারে না, সে চিৎকার করে বলে –
একদম কাঁদবে না ?তোমরা বলো কে আমি ? আমি কি করেছি ? যে তোমরা কাঁদবে ? বলো মা ।
ঝর্না চোখ মুছে , ঘরে যায় । সুনিতি ছোপার উপর চুপ করে বসে থাকে ।সে এখন নিজেকে আরও বেশি শুন্য মনে করে । এক অসীম শুন্যতা তাকে ঘিরে রাখে ।
ঝর্না ঘরে এসে ছটফট করে তার কি মেয়েকে সব বলে দেওয়া উচিত ?এই মেয়েটিকে এতো বড় কঠিণ সত্যের মুখে না দাঁড়ালেই কি নয় । কিন্তু সোয়েব যখন এখনও স্বাভাবিক হতে পারি নি , তখন কি লাভ সুনিতির কাছে গোপন করা তার জীবনের অলিখিত কিছু ।
ঝর্না আর সোয়েব তখন চিটাগাং ভার্সিটিতে পড়ছে । দু’জন দু’জনকে প্রচন্ড ভালোবাসে ওরা, সিদ্ধান্ত নিলো বিয়ে করবে । বিয়ের সব আয়োজন শেষ, দু’পক্ষের গার্জিয়ানের মতেই তাদের বিয়ের আয়োজন চলছে।বিয়ের জন্য গাঁইয়ে হলুদ হয়ে গেছে,ঝর্নাকে হঠাৎ কিছু লোক এসে তুলে নিয়ে গেলো । দ’দিন ঝর্না গায়েব , ঝর্নার বাবা ছোট বেলায় তার বন্ধুর কাছে অঙ্গিকারবদ্ধ ছিলো, বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দেবে, কিন্তু মেয়ের ভালোবাসাকে মুল্য দিতে গিয়ে সে বন্ধুর কাছে বেইমান সেজে যায়, বন্ধুর ছেলে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তুলে নিয়ে যায় ঝর্নাকে ।সে দৃশ্য ঝর্না মনে করতেচাই না, ঝর্নার বাবার বন্ধুই ছেলের কাছ থেকে ঝর্নাকে উদ্ধার করে । সোয়েবের পরিবার তখন কিডনাপ হওয়া মেয়েকে বাড়ীর বৌ বানাতে অস্বীকার করে , তারা জানায় –ওই মেয়েকে তারা বৌ হিসাবে দেখতে চাই না।
সোয়েব ঝর্নাকে বলে-যে যায় বলুক , তুমি কি শিওর যে ওই বেয়াদব তোমার ইজ্জত হরণ করেনি ?
ঝর্না বলে না ।ঝর্নার পথও ছিলো না, কোন মেয়ে তার ইজ্জত নেওয়ার গল্প তার ভালোবাসার মানুষকে বলতে চাই ? কোন মেয়েকি পারবে বেঁচে থাকার সম্বলের কাছে নিজেকে হেয় করতে ? ঝর্নাও তাই পারি নি।ঝর্না আত্ম হত্যা করতে চাইনি।
আত্মহত্যা মহাপাপ বলে নয়, আত্ম হত্যা করে সে সুন্দর পৃথিবী থেকে চলে যেতে চাই নি ।
ঘটনার দু’মাস পরে সব দ্বিধা দ্বন্ধ ছেড়ে ঝর্নাকে বিশ্বাস করে সোয়েব আত্মীয় স্বজন বিসর্জন দিয়ে ঝর্নাকে বিয়ে করে , বাবা মা কে ছেড়ে সোয়েব কষ্ট পেয়েছে তবু ঝর্নাকে কষ্ট দিতে চাই নি , বিয়ের একসপ্তাহ পরেই ঝর্না বমি করতে শুরু করে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে ঝর্না দ’মাসের অন্তঃস্বত্তা সোয়েব স্তম্ভিত হয়ে যায় , তার পৃথিবীটা অর্থহীন হয়ে পড়ে । এতো কিছুর পরও সোয়েব দু’হাত ধরে ঝর্নাকে অনুরোধ করে,-এ সন্তান তুমি ফেলে দাও,
ঝর্না আকুল হয়ে কাঁদে তুমি ওকে ফেলো না, ওর আমার কারোরই কোন দোষ নেই,
ওকে মেরে ফেলো না। আমি ফেলতে দিবো না।
সোয়েব বলে-এটায় তোমার শেষ কথা ?
-হা ,সোয়েব, তুমি আমাদের দূরে ঠেলে দিও না। এ সমাজের কাছে আমাদের ছোট করো না , চাই না তোমার ভালোবাসা তবু, আমাদের একটু ঠাঁই দাও ।
সোয়েব উঠে দাঁড়িয়েছে । ফিরে যায়নি পরিত্যক্ত পৃথিবীতে, কিন্তু থাকতেও পারিনি ওদের সাথে । সে তো মহাৎ নয়, যে ভুলে যাবে বিশ্বাস ঘাতক্তা, সত্য বললে হয়তো ঝর্না কে শুদ্ধ করে নিয়ে সে নতুন একটা জীবন গড়তে পারতো, কিন্তু ঝর্না মিথ্যা বলে যে প্রতাড়না করেছে সে জ্বালা সোয়েব ভুলতে পারিনি আজও ।
মাঝে মাঝে সেও ভাবে ওই নিস্পাপ মেয়েটা সরল বিশ্বাসে তাকে বাবা জানে, তাকে কেন সে এই পৃথীবির স্বাভাবিকতা থেকে বিমুখ করবে ? ঝর্নাকেই বা কেন শাস্তি দেবে । তার আশ্রয়ে যদি সে নিজেকে বাঁচাতে পারে তো চলুক না, কারো দাবী নেই কারো চাওয়া নেই কারো কাছে , জারজ শব্দটা থেকে মুক্তি পাক সুনিতি , সুনিতির কি দোষ !
ঝর্না এতোদিন পরে ভেংগে পড়েছে , সে বলতে চাই তার আর সুনিতির জীবনে সব কথা, সে ছুটে যায়, সুনিতির কাছে , সোয়েব বুঝতে পারে কোনো অঘটন হয়তো ঘটবে আজ , যে ক্কথা ঝর্ন আর সোয়েব ছাড়া আর কেউ জানতো না, তা আর কাউকে জানাতে দিতে চাই না সে, যার জন্য জীবনের সব বিশ্বাসকে মুল্যহীন করেছে তাকে সে সত্যবাদী হয়ে এতোদিন পরে মুক্তি দিতে চাই না, এখানে সে হেরে যেতে পারে না, সে ঝর্নার হাত ধরে বলে,-ও ঘরে একটু আসবে, ঝর্না ?
ঝর্না বহুদিন পর একটা আবদার শুনেছে , অবিস্বাস্যচোখে তাকায়, আমাকে বলছো ?
-হা, ঝর্না, শোন ।
সুনিতি মার দিকে তাকায়-মা, বাবা তোমাকে ডাকছে, যাও, বাবা ডাকছে মা,।
ঝর্না ধীর পায়ে ঘরে ধোকে। সোয়েব নিজ হাতে দরজা লাগায়। ঝর্না অবাক হয়ে তাকায়-কি হয়েছে তোমার ?
-কাছে এসো ঝর্না, কাছে এসো ।
জাপটে ধরে ঝরনাকে, বিছানায় শুইয়ে দেই, তারপর শক্ত করে বালিশ চেপে ধরে ঝর্নার মুখে, ঘটনার আকস্মিকতায় ঝরনা কিছুই বলতে পারে না, শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে সে ঝর্না কে সরিয়ে দেয় পৃথিবীত থেকে , তারপর তার পালা, ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে সে, গলায় দড়ি দিয়ে ধাক্কা মারে ছোট টি টেবিলটা, টুক করে শব্দ হয়, শুনিতি তখন ছাদের উপর বাবা মার অপুর্ব মিলনের কল্পনায় আনন্দ সুখে, পায়চারি করছে । তার জীবনের গোপন ইতিহাস জানতে পারলো না সে, কখনও সে পারবেও না আর ।
লাশ কাটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে , সামনে এসে দাঁড়ালো আফসান, সুনিতি তাকালো, তার কান্নায় ভেজা চোখ আবারও ভিজে গেলো,
আফসান ওর মাথায় হাত রাখলো -কেন হলো এমন ?
আমি কিছু জানি না, আমাকে বলতে চাইনি ওরা, ওদের ভিতর কোথায় যেন একটা সমস্যা ছিলো, আমি এখন আরও একা হয়ে গেলাম, ভাইয়া ।
আফসান অবাক হয়ে তাকায়, কোথায় যেন একটু ব্যাথা বাজে তার ।লাশ দাফনের পর সে সুনিতি কে বলে-সুনি এখন তুই কি করবি , দাদা বাড়ী যাবি ?
সুনিতি বলে-কাল তোমার বিয়ে ?
-এই অবস্থায় তোকে একা রেখে কিভাবে বিয়ে হবে ?
-যেভাবে সবার হয়, আমি একা থাকতেই এসেছি ।
-সুনি ,একটা কথা বলবো ?
-বলো
-আমার বিয়ে ঠিক হোলো অথচ তুই কিছুই বললি না,
?
-কি বলবো ?
-তোর কি কিছুই বলার ছিলো না,
সুনিতি ক্লান্ত কণ্ঠে বলে এক অজানা রহস্য আমার বাবা মার মৃত্যু, তোমার কাছেও আমার সব কথা রহস্যময় থাকুক।
-আমার তোর জন্য কষ্ট হবে ,
-এ ক্থা যখন শুনতে চেয়েছিলাম, তুমি বলোনি ।আজ, শুনতে চাই না।
-একা থাকবি কি করে ?
একাই তো ছিলাম, বাকি জীবনটা একাই কাটিয়ে দিবো , আর যদি কখনো না পারি, ডাকবো এসো ।
-তখন কি সময় থাকবে শুনি ?
সুনির চোখ আবার পানিতে ভরে যায় , সে ঘুরে দাঁড়িয়ে শোয়ার ঘরে যায় ,বলে- তুমি যাও, আমি অনন্ত শুন্যতার মাঝেই বেঁচে থাকতে চাই । আমাকে আর কখনো ডেকো না, শুভো রাত্রী ।
সুনিতি ভুতের মত সারা রাত ছাদের উপর হাটে , তার কাছে পুর পৃথিবীটা এখন ধোঁয়া ভরা গোলক ।বীড় বীড় করে আর পথ চলে, শুন্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, এখন মাঝ মাঝে তার মনে হয়, তার কোথায় গন্ডগোল ছিলো , যার জন্য তার বাবা মা পৃথিবী থেকে চলে গেছে , সুনিতি আয়নায় মুখ দেখে, সে কি পাগোল হয়ে গেছে ?
নাকি সে এখন মুক্ত ? তার কি মুক্তি মিলেছে ? নাকি সে কোন খাচায় বন্দী । এই সমাজের সব আফসানরা কি একরকম, ওরা কি অপেক্ষা করে ? নাকি সত্যি একদিন ফিরে আসে ? সেদিন সুনিতি কি সবাইকে চিনতে পারবে ?
হয়তো চিনতে পারবে না, হয়তো চিনতে পারবে! সেদিন সুনিতি হয়তো নীল আকাশের তারা হয়ে যাবে !!!!!!!!!!!