নিজের সাথে দেখা

ঈদ (আগষ্ট ২০১৩)

বিদিশা চট্টপাধ্যায়
  • ৪৩
কি ছিল?কি ছিল সেই সকালে?
এক রাশ সোনা ঝরা রোদ। নীলাকাশের তলায় সবজে গালিচা। এক মুঠো ফুরফুরে হাওয়া। হাজারো মরসুমি ফুলের রঙিন ফ্রেম। সঙ্গীতের মূর্ছনা। বুকের ভেতর দিম দিম দ্রিমি। আর আর আর এক মোবাইল ভর্তি ভালবাসার মেসেজ।

হ্যাঁ, আর ভনিতা না করে বলেই ফেলি--- ঘুম থেকে উঠে মোবাইল চেক করে দেখি এক ডজন বীয়াসের মেসেজ—জানিয়েছে সেও আমায় ভালবাসে। আমার প্রপোজ্যাল একসেপ্ট করেছে। পাঁচ দিন বাদে আমি এর উত্তর পেলাম। উফ! ভেতরে তখন যে কি আলোড়ন শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছিল---আজ ম্যাই ঊপর/আসমান নীচে/ আজ ম্যাই আগে/ জমানা হ্যাঁই পিছে।
হ্যাঁ, আমি এই পৃথিবী জয় করব বিয়াসকে আমার সহযাত্রী করে। আর তার অভিযান আজ থেকেই শুরু।
আজ পড়তে যাওয়া আছে। আমি দ্ব্বিগুন উৎসাহে বিছানা ছাড়লাম। দ্রুত জিনস আর টী- শার্ট গলিয়ে কে এস ওরফে কণাদ সম্মাদার- এর কোচিং –এ যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম।অটো নিয়ে দক্ষিণেশ্বরের দোলপিড়িতে নেমে খুচরো পয়সা বের করছি তো বিয়াসের আবার একটা মেসেজ ঢুকল। ওখান থেকে স্যারের বাড়ী বেশী দূর নয়। হেঁটেই চলে যাওয়া যায়। তা মুচিপাড়ার মোড়টা ঘুরব , হঠাৎ একটা তীব্র বোম ফাটার শব্দে চমকে উঠলাম। সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার--- না না যেও না।
দেখি আমার দিকে একটা ছেলে ছুটে আসছে। আমার সামনে এসে সে লুটিয়ে পড়ল। অত্যাশ্চর্য হয়ে দেখি ---সেকি! এ যে আমি! আমারই চেহারা। আমারই মুখ! এমনও হয় নাকি?
আমার কেমন মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।চোখে অন্ধকার দেখলাম। তারপর কি যে হল আমি আর কিছু জানি না।
ফের চোখ মেলে দেখি শাম্ব আর সিরিন আমার চোখে মুখে জল ছেটাচ্ছে।
--কি রে রাজীব, ঠিক আছিস?
--হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছি।
--ঠিক কি হয়েছিল বলতো?
এক লহমায় আমার মনে পড়ে গেল আমার নিজের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিন্তু এ কথা আমি কি করে কাউকে বলি বা বোঝাই? আর যদিও বা বলি কেউ কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?হেসেই উড়িয়ে দেবে। অথবা পাগল ঠাওরাবে। তাই বললাম,
--- কি জানি ! কি যে হল! মাথাটা কেমন ঘুরে গেছিল।
---প্রেমে পড়লে সবারই মাথা ঘোরে। কিন্তু এমন প্র্যাক্টীকাল ঘোরা! তুই তো কামাল করে দিলি রে।
একটু লজ্জাই পেলাম কিন্তু ঘটনাটা যে কি ঘটল! ভাগ্যিস ওরা আমাকে পড়তে আসার পথে দেখতে পেয়েছিল! কিন্তু ওটা কে ছিল? আমি কাকে দেখলাম? কেনই বা দেখলাম? কই ওরা আসার পর ঐ স্পটে আর কিছু চোখে পড়ল না তো! শাম্ব আর সিরিন তো কোন তৃতীয় ব্যাক্তির উল্লেখ করল না ! তাহলে কি ওটা আমার মনের ভুল? ইল্যুসান বই আর কিছু নয়? একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করতে লাগল আমার মধ্যে।

যাই হোক , কে এস-এর ওখানে গিয়ে বন্ধুদের সান্নিধ্যে এবং লেখাপড়ার একটা ভিন্ন আবহাওয়ায় জিনিসটা আপাততঃ ছিপি আঁটা বোতলে বন্দী রইল। কোচিং থেকে সোজা কলেজ। কলেজ যাবার আজ আলাদা আকর্ষণ। বিয়াসকে নতুন করে পাব বলে। নিজেকেও কেমন অন্যরকম লাগছে। মনের ভেতর এক অদ্ভুত ছন্দে যেন তিরতির করে ঝর্না বয়ে চলেছে। চিনচিনে একটা ব্যাথা। এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থান। তীব্র উত্তেজনার সাথে এক ভাললাগার আমেজ। আজ কলেজ বাঙ্ক করে দুজনে মিলে ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে শুধু গল্প করলাম।
এই দিনটা মানে পয়লা আগস্ট আমার জীবনে এক স্মরণীয় দিন হয়ে রইল। কিন্তু এই পয়লা আগস্টের যে আরও তাৎপর্য রয়েছে আমার জীবনে তা কি আর তখন বুঝেছিলাম!

রাতে খেয়ে দেয়ে একটা মাইন্ড পাওয়ারের বই হাতে নিয়ে শুতে গেলাম। প্রতিদিনই রবিন শর্মার কোন না কোন বই হাতে নিয়ে আমি ঘুমোতে যাই। মাইন্ড পাওয়ারের বই পড়তে আমি ভীষণ ভালবাসি। অনেক বেশী ফোকাসড থাকি এবং আমাকে আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে। নিজের স্বপ্ন পূরণের খিদেটা অনেক বেশী বাড়িয়ে তোলে এই ধরনের বইগুলো। বিয়াসের সাথে যেহেতু আমার প্রথম দিন তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ওর সাথে নিশ্চই ঘুমের ওপাড়েও দেখা হবে। কিন্তু কোথায় কি! উল্টে আমি একটা উদ্ভট স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম বেলবোরটস প্যান্ট পরা একটা ছেলে আমার পেছনে ছুটছে। আমিও ছুটছি। ছুটতে ছুটতে খেয়াল করলাম খুব জোরে বোম ফাটার মত একটা আওয়াজ হল। ছেলেটা লাফ মেরে আমাকে আর শাড়ি পরা কাকে যেন সরিয়ে দিয়ে নিজে লুটিয়ে পড়ল। মুখ ঘোরাতেই দেখলাম আমারই আমি মাটিতে শুয়ে পড়ে আছে। সকালের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দরদর করে ঘাম দিতে শুরু করল আমার গায়ে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। চোখে মুখে ঘাড়ে জল দিয়ে আয়নায় চোখটা যেতেই থমকে গেলাম। আর কোন সন্দেহ রইল না। ওটা আমারই মুখ ছিল। ঐ চোখ। ঐ নাক। ঐ চিবুক।

আমি এতদিনে নিজেকে বুদ্ধিমান, বাস্তববাদী, বিজ্ঞানমনস্ক , মেধাবি ছেলে হিসেবে জানতাম। কিন্তু এই ঘটনাটা আমার ভাবনা-চিন্তা দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ উল্টে পাল্টে দিল। ঘুরে ফিরে আমার মনশ্চক্ষে একই শট রীটেক হয়ে যাচ্ছে বারবার। আমার কেমন ভয় ভয় করতে শুরু করল।
এবার আর এক নতুন জীবন শুরু হল। প্রতিদিন কিসের এক আমোঘ টানে আমি ঠিক ওখানে হাজির হতাম। কোচিং না থাকলেও মর্নিং ওয়াকের বাহানায় আমি ঠিক চলে যেতাম সেই নির্দিষ্ট জায়গায় এবং আমার প্রতিমূর্তিকে খুঁজে খুঁজে বেড়াতাম। সারাদিন আমি ঐ চিন্তায় মগ্ন। পড়াশোনায় ক্ষতি হতে লাগল। বীয়াসের চোখেও আমার পরিবর্তন এড়াল না। শেষে ওকে সবিস্তারে সব বলতেই হল। ও এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
---যাক বাবা! আমি ভাবলাম তোর জীবনে বুঝি অন্য কোন মেয়ে এসে গেছে। তবে আমি এ ধরনের ঘটনা যখনই শুনেছি তখনই দেখেছি কোন না কোন বিপদের পূর্বসঙ্কেত এটা। আমার এক দূরসম্পর্কের কাকা আছেন, তার এইসব প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটির ওপর অগাধ পড়াশোনা। তোকে তার কাছে নিয়ে গেলে হয়।

উত্তরোত্তর আমার এই পাগলামি এত বৃদ্ধি পেতে লাগল যে আমি বীয়াসের কাকার কাছে যাওয়াই মনস্থ করলাম।

এক মাথা কাচা পাকা চুল। ছিপছিপে চেহারার পেছনে মানুষটা বেশ হাসিখুশি । প্রথম দেখাতেই আমার তাঁকে ভাল লেগে গেল। তিনি মনোযোগ সহকারে আমার সব বৃত্তান্ত শুনলেন। তারপর বললেন ,
---জার্মান ভাষায় একটা শব্দ আছে জান ত---ডপেলগ্যাঙ্গার (doppelganger)। ইংরাজিতে যাকে আমরা বলি ডাবল-অয়াকার। নিজের ছায়াসঙ্গী।এদের আগমন সাধারনতঃ আসন্ন কোন বিপদের বার্তা জানায়। নিজের বা নিজের খুব কাছের মানুষের। ইন্টারনেট ঘাঁটলে এরকম অনেক তথ্য তুমি দেখতে পাবে। অনেক বিখ্যাত মানুষের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমাদের বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ,মপাসা, জন ডান, গয়েথে ইত্যাদি। এখন কথা হচ্ছে যদি ধরে নিই তোমার সঙ্গে তোমার ডপেলগ্যাংঙ্গারেরিই দেখা হয়েছে, দ্যান দ্যা মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন আরাইসেস—অয়াই?
কেন? কেন সে তোমাকে দেখা দিচ্ছে? কোন বিপদের সংকেত তোমায় দিতে চাইছে? কি বলতে চায় সে?
আমিও মাথা খুঁড়ে মরি কি বলতে চায় সে?

তবে বেশ কিছুদিন হল আর তেমন কিছু হল না। দেখতে দেখতে একটা মাস কেটে গেল। পরীক্ষা চলে এল সামনে। পড়াশোনায় মন দিলাম। সেই স্বপ্ন, সেই প্রতিমূর্তি বর্তমান জীবনের ঘনঘটায় এবং আগামী দিনের সোনালি স্বপ্নের রেশে ফিকে হয়ে গেল।এরপর যথারীতি পরীক্ষা চলে এল।
পরিক্ষার পরপরই পুজো। পুজোতে দেদার মজা করলাম। ইতিমধ্যে আমি আর বিয়াস আরও কাছাকাছি এসেছি, নিবিড় হয়েছি, ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। আর বাঙালীর তো বারো মাসে তেরো পার্বণ। ফের কালীপূজো, ভাইফোঁটা, জগদ্ধাত্রী পুজো, কার্ত্তিক পুজো ইত্যাদি ইত্যাদি। শীতের ছুটিতে ভাইজ্যাক বেড়াতে যাওয়া হল। মন্দ কাটছিল না দিনগুলো। কলেজ সোশ্যাল—নিউ ইয়ার্স ঈভ—ভ্যালেন্টাইন্স ডে। বৃত্তাকারে ফের সেই আমোঘ পরিক্ষার মুখোমুখি। সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারে ওঠার পরীক্ষা।
প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহ কাটিয়ে সবে বর্ষা নেমেছে---তারিখটা স্পষ্ট মনে আছে—পঁচিশে জুলাই। আবার সেই রাতে স্বপ্নটা ফিরে এল।

আমার ডায়রি লেখার অভ্যাস আছে। তাছাড়া পয়লা আগস্ট ছিল আমাদের কমিটমেন্ট ডে। অতএব স্পষ্ট মনে আছে কে এস-এর কাছে যাওয়ার পথে প্রথম ঘটনাটা ঘটেছিল। তবে কি এ বছর ঐ দিন কোন বিপদের সম্ভাবনা আছে? এটা কি তারই আগাম সংকেত?

আজ ঠিক করলাম কে এস-এর কোচিং থেকে ফেরার পথে ভাল করে জায়গাটা দেখব এবং আশেপাশের লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করব। মোড়ের মাথায় একটা পাঁচতলা এপার্টমেন্ট আছে—দেবাঙ্গনা। উল্টোদিকে একটা চায়ের দোকান। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,
---আচ্ছা , মনে করতে পারেন এখানে কোন বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে কিনা?
---বোমাবাজি? কি জানি? কই জানি না তো!
---না মানে হালের কোন ঘটনা বা ধরুন অনাকদিন আগে কখনো শুনেছেন?
আমার মত দেখতে কোন ব্যাক্তি আহত হয়েছিল?

বুঝতে পারছিলাম প্রশ্নগুলো কেমন বোকা বোকা অবান্তর হয়ে যাচ্ছিলো। উল্টে লোকগুলো আমাকেই সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল ।
এভাবে ঠিক হবে না।
অতঃপর বীয়াসের কাকাকেই ফোন করলাম। ওনাকে জানালাম যে সেই স্বপ্ন আবার দেখছি আমি। তিনি বললেন,
----দেখ, তাহলে পয়লা আগস্ট, এই ডেটটা ইম্পরট্যান্ট। এক কাজ করা যাক। আমি বেশ কিছু লাইব্রেরির মেম্বার। তাছাড়া আমার এক সাংবাদিক বন্ধুও আছে। আমাদের পুরনো খবরের কাগজ ঘেঁটে দেখতে হবে। তুমি বেলবোরডস প্যান্ট দেখেছ মানে প্রাক স্বাধীনতার কোন ঘটনা নয়। আমি প্রথমে সেটাই আন্দাজ করছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলনের দিকে নির্দেশ দিচ্ছে। তুমি কালই চলে এসো। আমরা খুব তাড়াতাড়ি খুঁজতে শুরু করব।

কাকা তার সাংবাদিক বন্ধুকে নিয়ে কলকাতার এক ঐতিহ্যশালী ,পুরনো গ্রন্থাগারে নিয়ে গেলেন। পুরনো আর্কাইভ থেকে আমরা সব সংবাদপত্র দেখতে লাগলাম। সত্তর সালের পয়লা আগস্ট দক্ষিণেশ্বরের ঐ এলাকায় সেরকম কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেল না। এরপর থেকে ঠিক হল আমি প্রতিদিন এসে খবরের কাগজগুলো দেখব কারণ সবারই নিজ নিজ কাজ আছে। নামি অনামি সব সংবাদপত্রেই চোখ রাখতে বলেছে। খুঁটিয়ে পড়তে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে আমি সারাদিনই প্রায় লাইব্রেরীতে পড়ে থাকতে লাগলাম। চোখের তলায় কালি পড়ে গেল। রাতে ঘুমোতে পারি না। ঘুমলেই সেই স্বপ্নটা ফিরে ফিরে আসে। মনে যে কি অশান্তি! তীব্র একটা উত্তেজনা। কি হবে? কি হবে পয়লা আগস্ট? বাড়ীতে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল আমার ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখে যদিও আমি বাড়ীতে কিছু জানায়নি। একাত্তর, বাহাত্তর, তিয়াত্তর সালেও কিছু পেলাম না। এর মধ্যে দু তিন দিন কেটে গেছে। একত্রিশে জুলাই উপস্থিত। আমার মাথায় আর কিছু নেই। শুধু এই এক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন চুয়াত্তর সাল দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল এক টুকরো খবরে।

আহত অন্যতম নকশাল নেতা---উতপল চ্যাটারজি
আদ্যাপিঠ সংলগ্ন এলাকায় বোমাবাজিতে গুরুতর আহত অন্যতম নকশাল নেতা –উতপল চ্যাটারজি এবং তার সঙ্গী বিপাশা বিশ্বাস। তাদের অবস্থা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। গোষ্ঠীদ্বন্দের জেরে বোমাবাজিতে আহত বলে দাবি করলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারনা পুলিসই বোমা ছুঁড়েছিল। তার বাঁ পা লক্ষ করে গুলিও চালানো হয়েছিল বলে বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গিয়েছে। পরনে ছিল হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট আর ধূসর রঙের বেলবোরডস প্যান্ট।


গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। আমার বাঁ পায়ে সত্যি গোল মত একটা দাগ আছে। আর নাম দুটো —উতপল, রাজীব উভয়ই পদ্ম ফুলের প্রতিশব্দ। আর রায়চউধুরি টাইটেলটা যে আমাদের উপাধি পাওয়া এও তো আমার অজানা নয় পারিবারিক সুত্রে। আসল পদবী আমাদের চ্যাটারজি। এদিকে বীয়াস নদীর যে অপর নাম বিপাশা তা কে না জানে! আর ওদের পদবীও বিশ্বাস। বিশেষ করে কাগজে যে ছবিটা রয়েছে উৎপল চ্যাটারজির---হেয়ার স্টাইল এবং মোচ বাদ দিলে ---আমারই মিরর ইমেজ।
গলা কেমন শুকিয়ে যেতে লাগল আমার। আজ দুপুর একটা থেকে লোডশেডিং হয়ে গেছে। কি হয়েছে কে জানে? তবুও আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মাথাটা বনবন করে ঘুরছিল। লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে সামনে একটা বেঞ্চে চুপ করে বসে ছিলাম। সব জিগ-স- পাজলগুলো ঠিক ঠাক ফিট হয়ে যাচ্ছে। বীয়াসও এর সাথে জড়িত। তার মানে আগামীকাল আমাদের অগ্নি পরীক্ষা।

ধীর পায়ে বাসস্টপে এগোতেই দেখি প্রচণ্ড ভিড়। থিকথিক করছে লোক। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে এক ভদ্রলোক বল্লেন----সেকি মশাই! কোন জগতে আছেন! কোন খবরই রাখেন না দেখি! জানেন না সবচেয়ে বড় পাওয়ার ফেলিয়োর। নিউ দিল্লী থেকে কলকাতা। নর্থ গ্রিডটাই কোল্যাপস করে গেছে মশাই। কোথাও কোন কারেন্ট নেই বুঝলেন!
---মানে!
----মানে আর কি! চোখের সামনে দেখতেই তো পাচ্ছেন মানুষের ভোগান্তি। ট্রেন চলছে না। হাসপাতাল—বাড়ী—ঘর—স্টেশন চত্বর এমন কি খোদ মন্ত্রীর বাড়ী পর্যন্ত নিষ্প্রদীপ।


আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। এত ভিড় বাসে! কি করে যে উঠবো ভেবেই পাচ্ছি না। এমনিতেই আমার বাড়ী এক প্রান্তে আর এই গ্রন্থাগার সম্পূর্ণ অন্য প্রান্তে। স্বাভাবিক ভাবেই আমার এখানে আসতে দেড় দু ঘণ্টা লেগে যায়। আমি একটু কিছু খেয়ে নিয়ে একটা বাসে যখন কোনরকমে নিজেকে ঢোকাতে পেরেছি তখন প্রায় রাত আটটা। বাসটা করে শ্যামবাজার পর্যন্ত এলাম। বাড়ীতে ক্রমাগত ফোন করে আপডেট দিচ্ছি। বিয়াসের ফোনটাই অনেকক্ষণ ধরে পাচ্ছি না। একটা ট্যাক্সি করে ডানলপ এসে অন্যোন্যপায় হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। তখন প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। হঠাৎ মোবাইলে বীয়াসকে ধরতে পারলাম।
---কি রে তুই কোথায়?
---আর বলিস না। খুব বিপদে পড়ে গেছি। দুপুরে মা হঠাৎ বলল ,আজ মঙ্গলবার। খুব ভাল দিন। আজ দক্ষিণেশ্বরে একটু মায়ের বাড়ী নিয়ে যাবি। তখনো আমি এই পাওয়ার ফেলিওরের কথা জানি না। তাই রাজি হয়ে গেলাম। মন্দিরে ঢুকলে মোবাইল অফ রাখতে হয়। তাই পাসনি মনে হয়। মা ভবতারিণীর ওখানে পুজো দিয়ে সন্ধ্যা-আরতি দেখে আদ্যামায়ের কাছে এলাম। এখানে এসেই মায়ের শরীর খারাপ করতে লাগল। সারাদিন উপোস। তারই দরুন মনে হয় গ্যাস-অম্বল হয়ে গেছে। মন্দির প্রাঙ্গনেই মাকে জল দিয়ে, পাখা দিয়ে একটু সুস্থ করলাম। কিন্তু চারিদিকে অন্ধকার। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি ভয়ানক অবস্থা। কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও প্রচুর টাকা হাঁকছে। মায়ের শরীর এদিকে আরও খারাপ হচ্ছে। আনচান করছে।
---তুই দাঁড়া। আমি আসছি। আমাদের বাড়ীতে থেকে যাবি। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আসছি।

আমি প্রায় ছুটতে শুরু করলাম ডানলপ থেকে দক্ষিণেশ্বর। আমি শর্ট কাট মেরে পি ডবলু ডির গেস্ট হাউসের পাশ দিয়ে মুচিপাড়ায় পড়ব, এমন সময় একটা তীব্র বোম ফাটার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আলোর ঝলকানিতে দেখতে পেলাম বীয়াস রাস্তা পার হচ্ছে। একটা অগ্নিপিণ্ড আমার বাঁ পায়ে এসে পড়ার আগেই চকিতে পা টা সরিয়ে নিলাম। তারপর শুধু ধোঁয়া আর তীব্র বারুদের গন্ধ। বুকের ভেতর যেন হাতুরি পিটছে। ছুটে এসে দেখি, বেশ কিছু লোকের জটলা। আমি উঁকি মেরে দেখতেই চোখে পড়ল চায়ের দোকানটায় বিয়াস ওর মাকে ধরে একটা বেঞ্চে বসে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বিয়াসের মা হঠাৎ আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন।
--- বাবাগো! তুমি না থাকলে যে আজ কি হত!
আমি অবাক। উনি আমায় চিনলেন কি করে? আমি কখনো ওদের বাড়ী যাইনি। বিয়াসও আমাকে দেখে বলে উঠল,
---কোথায় চলে গেলি এর মধ্যে?
---মানে ! কি বলছিস তুই? এই তো আমি আসছি।
---তবে যে তুই ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিলি। তবেই না আমি রক্ষা পেলাম।
পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন,
---ঐ তো দুই মাতব্বর প্রমোটারের জমিজমা নিয়ে রেষারেষির জেরেই নাকি এই বোমাবাজি।
বিয়াস ফের বলে উঠল,
---তোর স্বপ্নটা যে এভাবে ফলে যাবে আমি সত্যি ভাবিনি।
---কি বলছিস কি তুই? এই তো আমি আসছি। কি ঘটেছিল ঠিক বলতো আমাকে? কার সাথে আমাকে গোলাচ্ছিস? কেমন দেখতে ছিল তাঁকে? কি পরেছিল সে?
---একদম তোরই মত দেখতে। তবে পরনে ছিল একটা হাওয়াই শার্ট আর......বলতে বলতে বিয়াস কেঁদে ফেলল।

আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি ঘড়ি দেখলাম। বারোটা বেজে দশ। ডেট- এর জায়গায় পয়লা আগস্টই দেখাচ্ছে বটে!!

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রোদের ছায়া নতুন একটা বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য আর এত সুন্দর একটা গল্পের জন্য ধন্যবাদ ... তবে আপনি গল্পটি বিশেষ সংখ্যায় না দিয়ে প্রতিযোগিতার জন্য রেখে দিলে ভালো হত ... পাঠক ও মূল্যায়ন দুটি আরো ভালো পেতেন ..
জায়েদ রশীদ আমার তো সাইফাই - ই মনে হচ্ছে। অনেক নতুন চমক আছে। আর সব ছাড়িয়ে টানটান উত্তেজনা... ভাল লেগেছে।
মামুন ম. আজিজ অতুলনীয়,,, এই Doppelgänger শব্দটার সাথে পরিচিত করানোর জন্য বাড়তি ধন্যবাদ। জানোই তো...এইসব সাইকোলজিক্যাল টার্মগুলো আমার বেশ প্রিয়..আমার গল্প নিশ্চয় তার পরিচয় বহন করে। .. তোমার নিজেকে দেখানোর এই কড়মড়ে গল্প ..একটা সাইফাই হয়ে উঠতে পারে ...দারুন।
অনেক ধন্যবাদ আমার গল্প পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য।

০২ জুন - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪