১ সত্যি এমন একজন মানুষ হয় না। একসাথে আন্দোলন করেছি। সমান অধিকারের আন্দোলন। একসাথে জেল খেটেছি। দাদা স্বপ্ন দেখিয়েছে -দেখিস মোল্লা এই দেশে একদিন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই সমান খাবে সমান পড়বে। ক্ষেতের ফসল সমান বণ্টন হবে। আরও কতো সুন্দর কথা বলতো দাদা! আমি মোল্লামাঝি এতো কঠিন কথা কি আর বুঝি? সেই কতো আগের কথা! ত্রিশ বছর তো হবেই। দাদা তখন কলেজে পড়ে। তার নামে মামলা হলো। পুলিশ তাকে খুঁজে। রাতের বেলা আমার নৌকায় এসে ঘুমাতো। নৌকা থেকে দাদার সাথে পুলিশ এসে আমাকেও ধরে নিয়ে গেলো। এক আকিজ বিড়ি দুই ভাগ করে খেয়েছি। শুনেছি দাদাদের পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। এতোটুকু অহংকার নেই দাদার মনে! আমি বিড়ি টানলে মুখের লালায় ভিজে যেতো। তাই দাদাকে বলতাম -দাদা বিড়িটা জ্বালিয়ে তুমি আগে টানো। দাদা বলতো -আরে মোল্লা তোর মুখের ভেজা বিড়ি টানতে আমার কি যে ভালো লাগে তা তুই কি বুঝবি রে পাগল? নে তুই ধরিয়ে দে! আমার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যেতো। আমার চোখে জল আসতো। নৌকায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাদা গান গাইতো। দেশের গান । হঠাৎ গান থামিয়ে বলতো -মোল্লা তোর বউ রসুন দিয়ে যে কবুতর রান্না করে না! আহ... সে কি আর বলবো! -দাদা নিয়ে আসবো কাল রান্না করে? -না রে, কাল না। কাল মধুপুর যেতে হবে। পরশু শুক্রবার রাতে খাবো। এই নে টাকাটা রেখে দে। তোর বউকে দিবি। -লাগবে না দাদা । আমার ঘরের কবুতর। বাজার থেকে কি আর কিনতে হবে? চার জোড়া বাচ্চা আছে! দাদা কি আর মানে? পঞ্চাশ টাকার নোটখানা আমাকে নিতেই হলো।
২ ব্রীজ হওয়ার পর নৌকায় পারাপার নেই। মানুষ এখন গাড়িতে চলে। আমি এখন জমি চাষ করি। মানুষ এখনো আমাকে মোল্লামাঝি ডাকে। নৌকা ছেড়ে দিয়েছি পনেরো বছর হলো। এখনো ডাকে। জমিটা আমার তিন পুরুষের। গ্রামের সবাই জানে। আমার দাদা বাঁশবন কেটে চাষের জমি বাড়িয়ে ছিলো। বাবা মাঝি ছিলো জমিও চাষ করতো। বহু দিন ধরেই শুনছিলাম এই জমির উপর দিয়ে পাঁকা রাস্তা হবে। সরকার জমি নিয়ে যাবে। হলে হবে। সরকার নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। সবার যা হবে আমারো তাই হবে। নভেম্বর মাসের পনেরো তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ধানের ক্ষেতে অনেক গুলো টিনের ঘর! লোকে বলা বলি করছে আমার বাবা নাকি শুক্কুর হাজীর কাছে জমি বিক্রি করে গেছে। বাবাতো এমন কিছু বলে যায়নি! বাবা গোপনে জমি বিক্রি করার মানুষ ছিলো না। কই বাবা মারা যাওয়ার পর দশ বছর তো এমন কথা কেউ বলেনি! লোকজনকে নাকি হাজী সাহেব জমির দলিল পত্র দেখিয়েছে। পাশে তার পনেরো বিঘা জমি আছে এটা ঠিক। তাই বলে আমার তিন বিঘা জমি সে গায়ের জোরে নিয়ে যাবে! দেশে কি আইন কানুন নেই? পুলিশ এসে আমাকে ধমকে গেছে আমি যেনো সেই জমির ধারে কাছে পা না রাখি। মগের মুল্লুক! আমার কি আর কেউ নেই? বউ আমাকে সঠিক পরামর্শ দিয়েছে। আমি ঢাকায় যাবো।
৩ আজ বিশ বছর দেখা নেই দাদার সাথে। টেলিভিশনে প্রতিদিন দেখি। দাদা এখন সরকারের মন্ত্রী। এখনো কি যে সুন্দর করে কথা বলে! আমি জানি দাদা আমাকে দেখলে খুব খুশী হবে। ভালো একটা জামা পড়ে নিয়েছি। দাদা যেমন মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারে। তখন আমার গায়ের ঘাম যদি তার জামায় লেগে যায়! শুনেছি দাদা দল পাল্টেছে। তা পাল্টাক দল পাল্টালে কি মন পাল্টায়! ট্রেন থেকে নেমে বাসার গেট পর্যন্ত যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দুই তিন বার দেহ তল্লাশি করেছে পুলিশ। তা করবে না? আমাদের দাদা যে মন্ত্রী এখন! আমার মন্দ লাগে নি। গর্ব হয়েছে। এই আমার সেই দাদা! যে কিনা... সন্ধ্যায় এসেছি রাত এখন দশটা বাজে। আমার কিন্তু মোটেই খারাপ লাগছে না। আসুক না রাত বারোটায়। সমস্যা কি! দাদা এলেই তো... রাত এগারোটার দিকে সামনে পিছনে পুলিশ প্রহরায় দাদা এলো। আমি তখনো গেটের কাছে দাড়িয়ে। গাড়ি ততক্ষণে গেটের ভিতরে ঢুকে গেছে। দারোয়ান ভাই খুব ভালো মানুষ। সে বলেছে -স্যার এলে আমার নাম বলবে। গাড়ি থেকে নেমে দাদা এগিয়ে এলো আমার কাছে। কাধে হাত রেখে সেই হাসি -কিরে মোল্লা কেমন আছিসরে তুই? -ভালো আছি দাদা। একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি দাদা... -আমাদের সমস্যা এখনো দূর হলো না রে মোল্লা। আমরা পারলাম না। আমাদের এমন থাকার কথা ছিলো না। আমি সত্যি কথা বলতে পারি না আগের মতো। আগের মতো জীবনের স্বাদ পাই না। চার দিক শুধু ছলচাতুরী। তোর সাথে আমি, আমার সাথে তুই... আমরা সবাই... পকেট থেকে গোটা দশেক হাজার টাকার নোট আমার হাতে গুঁজে দিয়ে দাদা বললো। -যারে মোল্লা, রাতে কোন ভালো হোটেলে খেয়ে নিস। সামনে থাকার ভালো হোটেল আছে। রকিব ড্রাইভার তোকে সেখানে দিয়ে আসবে। -আসলে দাদা আমি টাকার জন্য আসিনি। অন্য একটা দরকারে এসেছিলাম। আমার টাকার দরকার নেই... -আরে টাকাটাই তো দরকার আর সব মিথ্যে। তোর দরকার না থাকলে বউকে দিয়ে দিবি। চলিরে মোল্লা রাতে জরুরী মিটিং আছে। রাতে খেয়ে নিস কিন্তু। -দাদা আমার কথাটা... -সে আরেক দিন শুনবো। ভালো থাকিস মোল্লা। আমরা পারলাম নারে... তবুও ভালো থাকিস। আমি রাতে আর এক মুহুর্ত ঢাকায় থাকতে চাই না। রাত বারোটা ত্রিশে ট্রেন। হাওড় এক্সপ্রেস। আমি হাটতে হাটতে ষ্টেশনের দিকে যেতে থাকি। যেতে যেতে দাদার জন্য আমার বেশ কষ্ট হলো। উপরে উঠেও মানুষ কতো অসহায় ভাবে বাঁচে... আপোষ করে। দাদার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার সাথে একটা আকিজ বিড়ি ভাগ করে খেতে কিন্তু দাদার সেই সুযোগ আর রইলো কোথায়? এভাবেই সময় মানুষের শত্রু হয়ে যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্
উপরে উঠেও মানুষ কতো অসহায় ভাবে বাঁচে... আপোষ করে। দাদার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার সাথে একটা আকিজ বিড়ি ভাগ করে খেতে কিন্তু দাদার সেই সুযোগ আর রইলো কোথায়? এভাবেই সময় মানুষের শত্রু হয়ে যায়। --------------------আপনি জানেন না, এসব কথা বলতে মানা ! গল্পটা তো ভাল লাগার মতই ।
জুন
আপনার লেখাটাই খুঁজছিলাম।পেয়েও গেলাম।
খুব সুন্দর শুরু করেছেন।শেষটাও মনে লেগেছে খুব।ছোট গল্পের পরিপূর্ণ স্বাদ দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
শুভ কামনা ও ভালো লাগা।
Fahmida Bari Bipu
গল্পটার মধ্যে চমৎকার একটা আপন করা টান আছি। পড়তে খুব ভাল লাগে। তবে শেষে এসে একটু তাড়াহুড়ো হয়ে গেছে মনে হল। আরো যেন কিছু বলার ছিল। বৈরিতা কে ঠিক খুঁজে পেলাম না, আর 'আকিজ' বিড়ি যে সময়ের কথা বলছেন তখনো পাওয়া যেত কি? (মোজাম্মেল ভাই, অধম কে ক্ষমা করেন। অনেক উলটাপালটা কথা বলে ফেললাম)।
ছোটগল্প টেনে লম্বা করা যায়। অসম গল্পটা টেনে লম্বা করা যেতো। কিন্তু তা করলে ছোটগল্পের স্বাদ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। টেনে লম্বা করলে অপ্রসঙ্গিক কিছু কথা চলে আসে। পাঠাক বিরক্ত হয়। গল্প তার নিজস্ব পথ হারায়। আমি যে সময়ের কথা বলেছি বাংলাদেশে তখন আকিজ বিড়ির রমরমা ব্যাবসা। ৮০ এর দশক। গল্পের কোন এক ফাঁকে লুকিয়ে আছে বৈরিতা... ভালো থাকুন আপা...
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।