ডাকপিয়নের মেয়ে

শ্রম (মে ২০১৫)

মোজাম্মেল কবির
মোট ভোট ১২ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৬.৪৮
  • ১৫
  • ৩১

দুই মাস আগে এই ঘরে একটা মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ইন্দোনেশীয়ান খাদ্দামা জামী ছিলো অবিবাহিতা। সামনের ছুটিতে দেশে গেলে তার প্রেমিকের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। বুড়ো কফিল সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। এই মৃত্যু নিয়ে তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয়নি।

রান্না ঘরের পাশে ছোট্ট একটা ঘর। ষ্টোর রুম বলা যায়। কাঠের কয়েকটি খালি বাক্স পরে আছে ঘরের কোনে। আরেক পাশে পুরোনো জামা কাপড়ের স্তুপ। মেঝেতে দুটি বিছানা। একটি বিছানা এখন শূন্য। সে বিছানায় জামী থাকতো। মর্জিনা এই ঘরে এখন একা থাকে। মর্জিনা এখন ঘরের বাতি বন্ধ করে ঘুমাতে ভয় পায়। অন্ধকারে মনে হয় সিলিং ফ্যানের সাথে জামীর লাশ ঝুলে আছে। ঝুলে থাকা লাশ মর্জিনাকে ফিসফিস করে বলছে - পালিয়ে যা মর্জিনা। তুইও বাঁচবি না। পালিয়ে যা... প্রথম যে রাতে মর্জিনা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে বুড়ো দানবের ছোট ছেলে ঘরে ঢুকে মর্জিনার বুকে পিঠে লাত্থি দেয় আর অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। এর পর থেকে ভয়ে চিৎকার দিতেও ভয় হয় মর্জিনার।
বুড়ো সাদা দানবটা আজ রাতেও ঝাপিয়ে পড়বে মর্জিনার উপর। এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন পথ নেই। আজ মর্জিনার শরির খারাপ। মাসের বিশেষ দিন। দানবটা সেই অজুহাত মানে না। পশুসুলভ যৌনাচারের একাদিক বিকল্প পথ জানা আছে তার। বুড়োর ছেলেটা তবু মানে। বুড়ো দানবটা মানে না।


গ্র্রামের শত শত পরিবার ডাক পিয়ন মফিজের অপেক্ষায় থাকে। চিঠির অপেক্ষায় থেকে অনেকেই মফিজের বাড়ি চলে আসে প্রিয় মানুষের চিঠির খোজ নিতে। ফজল মাষ্টারের মেয়ে আনোয়ারা প্রতিদিন বিকেলে বাসায় এসে কান্নাকাটি করে। দেড় মাস স্বামীর কোন চিঠি আসে না। গত মাসে পরিবারের খরচের টাকা আসে নি। মফিজ তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দেয় -মারে অপেক্ষা কর তর জামাই আল্লার রহমতে ভালো আছে। যেদিন সত্যি সত্যি চিঠি আসে আনন্দে চোখে জল নিয়ে চিঠি খুলে অজ্ঞান হয়ে মফিজের বাড়ির উঠানে লুটিয়ে পড়ে।
মফিজ চিৎকার দিয়ে ডাকে -মা মর্জিনা, জলদি বদনা ভইরা পানি নিয়া আয়। মর্জিনা দৌড়ে পানি নিয়ে আসে। আনোয়ারার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর চোখ খোলে আনোয়ারা। আবার জ্ঞান হারায়। আগামী শুক্কুরবার বাদ জুম্মা প্রকাশ্যে তার স্বামীর শিরচ্ছেদ করা হবে।
উনিশশ ছিয়াশি সাল। মর্জিনা তখন ছয় বছরের শিশু। সেদিন বাবার চোখে জল দেখে কিছু না বুঝেই সেও কেঁদে ফেলে।


আজ রাতে ঘুম হবে না মর্জিনার। আজ রাত শুধু কেঁদে ভাসাবার। সেই দিন গুলো মনে পড়ছে খুব। নীলক্ষিয়ার চরে ছোট্ট সেই গ্রাম। পাশে ব্রহ্মপুত্র নদ। মরিচের ক্ষেতে পাকা মরিচে লাল হয়ে আছে মাঠের পর মাঠ। গোটা দশেক ছাগল নিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরে মর্জিনা। বাড়ির উঠানে বেঞ্চে বসে আছে চার পাঁচ জন লোক। এক দেখাতেই পছন্দ। বর ট্রাক ড্রাইভার। সন্ধ্যায় মা খালারা মিলে গোসল দেয় মর্জিনাকে। রাতেই বউ তুলে নিয়ে যায়।
এক জাতের পুরুষ আছে এরা মনে করে একটা বাচ্চা জন্ম দেয়ার পর নারীর আর দেয়ার কিছু থাকে না। মর্জিনার বর খালেক ড্রাইভার সেই জাতের পুরুষ। ঘাটে ঘাটে নানা রকম নারীর শরির ছুয়ে চেখে দেখা খালেকের মন ধরে রাখতে পারেনি মর্জিনা।
ছেলেটা জন্মের পর মর্জিনার গা থেকে মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসতে থাকে খালেকের নাকে। মাস ছয়েকের মাথায় খালেক নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে উঠে। গায়ের রঙ মর্জিনার চাইতে উজ্জল। কেউ কেউ বলে নারায়নগঞ্জ পতিতালয় থেকে নিয়ে আসা মেয়েটিকে খালেক বিয়ে করেনি।
ছয় মাসের শিশু পুত্রকে নিয়ে মর্জিনা বাপের বাড়ি ফিরে যায়। এর মাত্র কিছু দিন আগে মা মারা যায়। মর্জিনার বড় বোন আমিনার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামেই। বোনের জামাই খুব ভালো মানুষ। শম্ভুগঞ্জ বাজারে ফার্নিচারের দোকান। বছর তিনেক ধরে প্যারালাইজড শ্বশুরের খোঁজ খবর রাখে। মফিজের ছেলে সন্তানের অভাব আমিনার জামাই জব্বর পূরণ করে দিয়েছে।
মর্জিনা বাপের বাড়ি ফিরে গেলে বাবার সেবা যত্নের জন্য সকাল বিকাল আসতে হয় না। কিন্তু বাবার মন আরও বেশী বিষণ্ণ হয়ে যায়। মেয়েটার কি হবে? এর ভবিষ্যৎ কি? জমি বিক্রি করে আরব দেশে চাকরী করতে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মর্জিনাকে।


মর্জিনা নয় মাসের শিশু সন্তানকে বড় বোন আমিনার কোলে তুলে দিয়ে জীবিকার খোঁজে চলে আসে সৌদি আরবের রিয়াদে।
গত ছয় বছরে ছেলেটা অনেক বড় হয়েছে। এর মধ্যে বাবা মারা যায়। বাবার লাশ দেখার সুযোগ হয়নি। ছেলেটা আমিনাকে মা ডাকে। মর্জিনা জানে বড় বোনের কাছে তার সন্তান নিরাপদে আছে। তার পরও এই ভেবে বুকটা হাহাকার করে -সন্তান পেটে ধরার পরও তার ভাগ্যে বুঝি মা ডাক শুনার সুযোগ হবে না। মোবাইলে ফোন করে ছেলের সাথে কথা বলে এক দুই দিন পর পর। কিন্তু ছেলের মধ্যে মাকে নিয়ে কোন আবেগ নেই। মায়ের খুব শুনতে ইচ্ছে হয় ছেলে তাকে বলছে -মা তুমি কবে আইবা? কিন্তু ছেলে তাকে এমন কোন প্রশ্ন করে না। তার কাছে মনে হয় আমিনা তার আসল মা। আরেক জন মায়ের মুখ সে মনের আয়নায় ভাসাতে পারে না। সেদিন ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে ছেলের নিঃস্পৃহ উত্তরে দুই চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। মর্জিনা জানতে চায় -বাবা ভালা আছ?
-হুম... ছেলে উত্তর দেয়।
-ভাত খাইছো?
-হুম...
-ইশকুলে যাও?
-হুম...
-তোমার খালা তোমারে আদর করে?
-আমার খালা নাই।
-আইচ্ছা রাইখ্যা দেই বাজান।
-আইচ্ছা।


মর্জিনা তার কফিলের নির্যাতনের কথা কাউকে বলে না। বলে কোন লাভ নেই। বাবার কাছে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাবা নেই কিন্তু বাবার কবর নিজ হাতে ছুঁয়ে না দেখা পর্যন্ত তার বিশ্বাস হবে না বাবা বেঁচে নেই। তার মনে হয় বাবা তার চিঠির অপেক্ষায় আছে। কাগজ কলম নিয়ে বাবার কাছে লিখতে শুরু করে চিঠি।

বাবা,
আমি ভালা নাই বাবা। তুমি কইছিলা বাবা এই আরব দেশে সোনার মানুষ থাকে, কই তোমার সোনার মানুষ? এই দেশে উল্টা নিয়ম। আমার মালিক আমারে যেই ভাবে ইচ্ছা নির্যাতন করে। কোন বিচার নাই। প্রকাশ করলে উল্টা আমার বিচার হইবো। আমি আল্লার কাছে বিচার দিলাম বাবা। আল্লায় যেন এর বিচার করে।
বাবা, একটা খবর শুইনা মনটা আরও বেশী খারাপ হইয়া গেলো। শুনলাম আমগো দেশের সরকার নাকি আবারো এই দেশে কাজের মেয়ে পাঠাইতাছে। মা বইনের ইজ্জত বেইচ্চা দেশে টেকা কামানির কি দরকার বাবা?
তুমি ভালা থাইকো বাবা। আমি ভালা নাই।

ইতি
তোমার আদরের মর্জিনা

চোখের জল মুছতে মুছতে মর্জিনা বাবার কাছে লেখা চিঠিটা ভাঁজ করে বালিশের নীচে রেখে দেয়। তার আশা কোন এক ডাকে এই চিঠি পৌছবে তার বাবার হাতে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Raj Islam Shanto কথা গুলো বাস্তব,,, কিন্তু কি করবো আমাদের দেশের সরকার তো ভালবা তাই এমন নির্যাতন সজ্জ করতে হয় প্রবাসে বাংলাদেশি নারীকে
শামীম খান অভিনন্দন । ভালো থাকুন ।
ধন্যবাদ শামীম ভাই... ধন্যবাদ শামীম ভাই।
Salma Siddika অনেক সুন্দর লিখেছেন. অভিনন্দন
অনেক ধন্যবাদ। আপনার লেখা নিয়মিত চাইছি...
Fahmida Bari Bipu Congratulation Mojammel vai.
অনেক ধন্যবাদ আপা। ভালো থাকুন।
শামীম খান সময়োপযোগী বিষয় । সুন্দর গল্প । শুভ কামনা রইল ।
নাসরিন চৌধুরী অনেক স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে সামনে তুলে ধরেছেন লেখনিও খুব ভাল। অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানবেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন।
জান্নাত সামিয়া ছুঁয়ে গেছে আপনার লেখা। শুভেচ্ছা
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,পাতায় আমন্ত্রন রইল।
মনজুরুল ইসলাম Time and touchable real story.But the dreamy day will come soon, when this sort of pathetic events will not occured.Nice finishing with variation.Good luck and stay blessed.
প্রত্যাশিত সেই সুসময়ের অপেক্ষার পালা শেষ হোক। অনেক ধন্যবাদ...

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

সমন্বিত স্কোর

৬.৪৮

বিচারক স্কোরঃ ৪.০৮ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪