শব্দ গাঁথা শেষ হলে মনে সৃষ্টির আনন্দ ঢেউ খেলে। সুর দিলে বিরহের গান হয়ে যাবে। অথচ লিখেছে প্রেমের কবিতা। তখন ইচ্ছে হয় সুর দিতে। কবিতাটা রানুকে নিয়ে লেখা। হেটে যেতে যেতে মতিন ভাবছে একে গান বানাবো নাকি শুধু কবিতাই থাকবে। সূর্যাস্তের ঘণ্টা খানেক বাকী। পাজামা আর নীল রঙের ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে শ্যামগঞ্জ বাজারের দিকে যাচ্ছে। এক কাপ চা খাবে। গরুর দুধের চা। দাড়ি গোঁফ পচাত্তুর শতাংশের বেশী পেকে গেছে। গত ছয় দিন শেভ করা হয় না । বিষয়টা নিজের কাছে পাত্তা দেয়ার মতো না হলেও নিন্দুক যে কোনো ভাবেই কাজে লাগাতে পারে। মুখে যতো সুন্দর হাসি মেখেই কথা বলুক না কেনো, যে কেউ প্রশ্ন করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। –কিরে মতিন অসুস্থ নাকি? মন খারাপ নাকি? অথচ আজকেও একটা প্রেমের কবিতা লিখেছে। মেজাজ ফুরফুরে। বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হওয়ার আকাঙ্খা কোনো কালেই ছিলোনা। মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য অর্থ উপার্জন। এটা যেনো তার কাছে কিছুক্ষণ আগেও ছিলো অর্থহীন। বিষয়টা নিয়ে মনে বিন্দু মাত্র দ্বিধা ধন্ধ থাকতো না। যদি না ইব্রাহিম এমন খোঁচা দিয়ে কথাটা বলতো। চকচকে চার চাকার নতুন গাড়িটা দেখানোই উদ্দেশ্য। এমনটি উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। খোঁচাটা দিয়ে ইবু সফল হলো। কারণ সে মনের মধ্যে কিছুক্ষনের জন্য হলেও একটা আফসোসের বীজ বুনে দিতে পেরেছে যে, মতিনের আসলে সম্পদ অর্জন করার যোগ্যতাই নাই। ইটখলা বাজারের কাছে রাস্তার বাম দিকে হাঁটছে মতিন। মালগাড়িটা ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। বাম দিকে তাকিয়ে ট্রেন দেখছে আর হাঁটছে। পশ্চিম দিকে হেলে পড়া সূর্যটা সবুজ ধানের মাঠে ট্রেনের লম্বা ছায়া নিয়ে ছুটে চলেছে। মনের মধ্যে গানের সুরটা নিয়ে নাড়া চাড়া করছে। হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে মতিন। কালচেলাল রঙের প্রাইভেট গাড়িটা তার দিকেই আসছে। জীবনটা এতো সস্তা না! কথাটা মাথায় চট করে আঘাত করে। রাস্তার পশ্চিম পাশে ধান ক্ষেতে নেমে প্রাণ বাচায়। গাড়ি থেকে নেমে আসে ইবু। চমকে দিতেই এমন কাণ্ড। গ্রামে শোনা যাচ্ছে সামনের সংসদ নির্বাচনে সরকারী দলের টিকিট পাবে সে। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মতিনকে। -কিরে মতিন, বয়স তো সাতান্ন গেলো। ইনকাম কিছু করতাছস ? কবিতা লেইখ্যা দিন চলবো ? মানুষের মুখের উপর কোনো বাঁকা কথার উত্তর দিতে পারে না মতিন। মনে মনে একটা বিদ্রুপের হাসি এসেছিলো, কিন্তু তাও প্রকাশ করতে পারেনা। ইবুর কথার যুতসই একটা উত্তর এসেছিলো মাথায়। তাও আবার রাতের বেলা। বাঁকা কথার উত্তর তাৎক্ষনিক না দিতে পারলে মাথার মধ্যে যন্ত্রণা বাড়ে। রাতে বিছানায় গেলে এই সব উত্তর মনে হয়। রানু বেঁচে থাকতে তার সাথে কথার বীরত্ব প্রকাশ করে মনে শক্তি সঞ্চয় করতো। ও চলে যাওয়ার পর থেকে বুকটা ক্রমশই বরফের মতো জমে যাচ্ছে। ইবু মতিনের সাথে শ্যামগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তো। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে তখন। ক্লাসে ছাত্রদের খাতা কলম চুরির অপরাধে বেত্রাঘাত করে পণ্ডিত স্যার। তার পর আর স্কুলে যায়নি। দেশ স্বাধীনের পর ইবু কুখ্যাত ডাকাত দলে যোগ দেয়। ১৯৮৩ সালের ঘটনা। গোবিন্দপুর বাজারে একবার ডাকাতির ঘটনায় গ্রামবাসী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। বল্লম লাঠি সোঠা নিয়ে আক্রমন করে। ডাকাত সর্দার সহ চার জন মারা পড়ে। বাকীরা পালিয়ে যায়। প্রাণ নিয়ে বেঁচে যাওয়াদের একজন ইবু। বছর তিনেক পরে শোনা যায় সে ঢাকায় এরশাদের এক মন্ত্রীর ব্যাক্তিগত দেহরক্ষীর চাকুরী পেয়েছে। এখন তার নাম এম আই চৌধুরী। চারটা গার্মেন্টস কারখানার মালিক। ঢাকায় গোটা দশেক বাড়ি। বাবা দুই হাতে টাকা কামায় আর পোলায় চার হাতে খরচ করেও নাকি শেষ করতে পারেনা। ছেলে কয়েক বার গ্রামে এসেছে। আদব কায়দা শিখেনি। সাথে একেক বার একেক জন মেয়ে মানুষ থাকে। চোখ দুইটা গাঁজা খোঁড়ের মতো লাল। ইনকাম শব্দটা নিয়ে এর আগে এভাবে ভাবা হয়নি। ইবুর মুখ থেকে শোনার পর মাথায় ইনকাম নিয়ে জট পাকাচ্ছে । এর মানে আয় রোজগার। কিন্তু ইংরেজি In আর Come এই দুইটা শব্দ জোড়া দিয়ে ইনকাম! তার মানে অন্তর্মুখী আগমন! নির্দিষ্ট করে হতে হবে অর্থ আগমন। অন্য কিছু না। আয়ের উল্টো অর্থ দাড়ায় ব্যয়। আয় ব্যয়। আরেক অর্থে আয় আর যায়। আসে আর যায়। একই কথা। এই আসা যাওয়ার মাঝ খানে একটা গ্যাপ থাকে। এর চিত্র আবার দুই রকম। ধনাত্মক আর ঋণাত্মক। ধনাত্মক এর মানে যা আসে তার চাইতে যদি যায় কম তাহলে ধন সম্পদ বাড়ে। এই জন্য ধনাত্মক। যা আসে তার চাইতে যদি যায় বেশী তাহলে সংসার চালাতে কিছু ঋণ করতে হয়। এই জন্য ঋণাত্মক। আমি মতিনের মতো বেয়াকুব ছাড়া কে চায় প্রতি মাসে ঋণ করে চলতে। ব্যালেন্স করতে বাবার রেখে যাওয়া গরু ছাগল থেকে শুরু। এখন চলছে জমি বিক্রি। ভিটে বাড়ি আর সামান্য কিছু চাষের জমি বাকী। আসা আর যাওয়ার গ্যাপটা আজীবন ঋণাত্মক চক্রে আবর্তিত হচ্ছে। এই ঋণের বোঝা বইতেও মনে তিল পরিমাণ দুঃখ নেই। একটা ইচ্ছা যদি পূরণ হয়... সকাল থেকে মনটা খুব অস্থির লাগছে। আজ ছেলেটার পরিক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার কথা। সকাল থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়েও কল করতে বুক ধুকপুক করছে। জেহাদ নিজেই ফোন করুক। খারাপ কিছু হলে ফোন না করার কথা। বাড়ি থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না। যদি কেউ জানতে চায় -কি মতিন তোমার পোলার রেজাল্ট কি? আমতা আমতা করলে ভাববে ফেল করেছে। ঘরে মন টিকছে না। অস্থির লাগছে। হাটতে হাটতে শ্যামগঞ্জ বাজারে যায় মতিন। আবু মিয়ার চায়ের দোকানে বসে। একটা চা দিতে বলে। আজকাল সব চায়ের দোকানে কালার টেলিভিশন। ডিশে ঢাকাই ছবি চলে সারা দিন। কিছু লোক কাম কাজ ঘর সংসার বাদ দিয়ে সারা দিন টেলিভিশন দেখে আর চা বিড়ি খায়। একমাত্র আবু মিয়া একটা খবরের কাগজ রাখে। এর দোকানে টেলিভিশন চলে না। টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় বড় একটা খবরে চোখ পড়ে মতিনের। অজ্ঞাত যুবতীর গলিত লাশ উদ্ধার। পাশে ঘাতকের ছবি। ছবি দেখে পরিচিত লাগছে মুখটা। হ্যা... ঠিক আছে। ভুল দেখছে না সে। রাজধানীর উত্তরায় চার নাম্বার সেক্টরে ব্যবসায়ী এম আই চৌধুরীর পুত্র ডলারের বাসা থেকে অজ্ঞাত পরিচয় যুবতীর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে ধর্ষণের পর ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। বাসায় তল্লাশি করে সত্তুর হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে। ডলার দেশের বড় ইয়াবা ব্যাবসায়ী চক্রের অন্যতম সদস্য। ইয়াবা জিনিসটা কি...? এর আগেও নামটা শুনেছে মতিন কিন্তু এর সম্পর্কে ধারণা নেই। মোবাইল ফোন বেজে উঠে। জেহাদের ফোন। বুকটা ডক ডক করে বাজতে থাকে। না জানি কি খবর... -হ্যালো বাজান, খবর কি কও ? মতিন ফোন রিসিভ করে। -বাবা আমি পাশ করছি। পঞ্চম হইছি বাবা। এখন থেইক্কা তুমি কইতে পারবা তোমার পোলা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তোমার জীবনের একটা ইচ্ছা পূরণ করতে পারছি বাবা। বাবা, তোমার লেখা একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শোনাই ? -শোনাও বাজান। - “ ইচ্ছে গুলো সহজেই পূরণ হতে নেই ভালো দিনের অপেক্ষা শেষ হতে নেই জীবনের সেরা কাজটি করে ফেলতে নেই বেঁচে থাকার আশা ফুঁড়িয়ে যেতে নেই...” মতিনের লেখা কবিতা এতো চমৎকার করে কেউ আবৃতি করতে পারে তা জানা ছিলোনা। মনের অজান্তেই দুই ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে পত্রিকার পাতায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
চমৎকার প্রশ্ন করার জন্য ধন্যবাদটা আগেই দিয়ে নিচ্ছি- মানুষ বেঁচে থাকে আশায়। মানুষ যা আশা করে তা মনের মধ্যে ইচ্ছে হিসাবে সুপ্ত থাকে। মানুষের জীবনের সব আশা যদি একসাথে পূরণ হয়ে যায় তাহলে তার বেঁচে থাকা অনেকটাই অর্থহীন মনে হয়। আমার এক বন্ধু তার শেষ ইচ্ছেটা যখনি পূরণ করে, বড়ই আফসোসের সাথে বলে বাকী আর রইলো কি? সেই অর্থে কবি মতিন তার কবিতায় লিখেছে " বেঁচে থাকার আশা ফুঁড়িয়ে যেতে নেই...”
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।