জারজ

শিশু (সেপ্টেম্বর ২০১৯)

মোজাম্মেল কবির
  • 0
  • ৪৮
বিজয় আবার আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবার ফাইনাল। এবার আর সে ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফিরে আসতে চায় না। পরিচিত কাছের লোকজনকে বলে কয়ে এর আগেও বেশ কয়েকবার বিদায় নিয়েছে। বারবার নানা কারণ দেখিয়ে আত্মহত্যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে ফিরে আসে। চেনা জানা লোকেরা তাকে ছিটগ্রস্ত মনে করে, এমনকি পরিবারের লোকেরাও। পরিবার বললে ভুল হবে, আসলে আপন বলতে কেউ আছে বলে জানা নেই তার। আটচল্লিশ বছর বয়সী এক অবিবাহিত মানুষ। দুই দুইবারের সাবেক সাংসদ নামকরা ব্যাবসায়ি জয়নাল তালুকদারের পালিত পুত্র।
সন্ধ্যার পর বিজয় ক্লিন সেভ করে ভালো জামা কাপড় পরে নেয়। পকেটে পথ খরচের জন্য কিছু টাকা। টাকাটা এই জন্য দরকার জীবনে শেষ বারের মতো কিছু খেতে ইচ্ছে করতে পারে। পথে গরীব দুঃখী মানুষের হাতে কয়টা টাকা দিতে ইচ্ছে জাগতে পারে।
মোড়ের ফুটপাতে চায়ের দোকানী বৃদ্ধ রহিম চাচা সিগারেটের বাকি একশ টাকা পায়। দোকানে গিয়ে একশ টাকার নোট হাতে দিয়ে বলে –রহিম চাচা আপনার টাকাটা বুঝে নেন। হয়তো এটাই আপনার সাথে আমার শেষ দেখা। রহিম চাচা টাকাটা হাতে নিয়ে হেসে ফেলে। -বাবাজী, এককাপ চা খায়া যান, টাকা লাগবো না। ভালো মানুষের কাছে কিছু পাওনা থাকা ভালো। চা খেয়ে বিজয় ফুটপাত ধরে হেঁটে চলে যায়।
কিছু দূর হাঁটতেই পর্যটন অফিসের সামনে দেখা হয় স্কুলের বন্ধু কুদরতের সাথে। অজ্ঞাত কারণে দুজনেই দুজনকে ছোটকাল থেকে মামা বলে ডাকে। আত্মায় আত্মায় সম্পর্ক। কুদরত সংসারের বাজার করে ঘরে ফিরছিলো। কাছে এসে বাজারের ব্যাগটা রেখে বিজয়ের হাত ধরে বলে –এতো সাজগোজ কইরা কই যাও মামা?
-মরতে যাই মামা। অনেকবার তো চেষ্টা করলাম, এইবার ফাইনাল।
-তো মামা কি সিদ্ধান্ত নিলা? মানে কেমনে কি করবা...?
-একবার চিন্তা করছিলাম ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিবো, পরে সিদ্ধান্ত পাল্টাইছি। এইটা খুব বিচ্ছিরি রকমের মৃত্যু। মানুষ ট্রেনে কাটা টুকরা টুকরা লাশ দেইখা ভয় পায়। আমার মৃত্যুর কারণে মানুষ ভয় পাক এইটা আমি চাই না।
-নতুন পদ্ধতিটা কি?
-ভাবতাছি বর্ষার মৌসুম, নদীতে অনেক পানি, অনেক স্রোত... ব্রীজের উপর থেইকা লাফ দিলে লাশ অনেক দূরে ভাইসা যাইবো, কেউ চিনলো না জানলো না। মাছে ঠোকরায়া খায়া ফেলবো। মাছ গুলা পেট ভইরা দুই চাইর বেলা খাইলো এইটা মন্দ কি!
-মামা আমারে একবার সাথে নিয়া যাইবা?
-না মামা এইটা সম্ভব না। আত্মহত্যার সময় একলা যাইতে হয়।
-ঠিক আছে মামা সাবধানে যাইও।
বিজয় প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দুইটা টান দিয়ে কুদরতের হাতে দেয়। কুদরত ব্যাগটা হাতে নিয়ে সিগারেট টানতে টানতে চলে যায়।
জীবনের মায়া বড়ই অদ্ভুত। মনে ব্যথা বেদনা যাই থাকুক স্বর্গের নিশ্চয়তা পেলেও মাটির পৃথিবীর সাথে বন্ধন ছিন্ন করা কঠিন। সবাই কম বেশী কিছু একটা দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পৃথিবীতে আসে, অনেক চেষ্টা করলেও মানুষ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে যেতে পারে না। বিজয় এখনো তার দায়িত্ব খুঁজে পাচ্ছে না -পৃথিবীতে তার আর কাজটা কী?
বিজয় বসিলা সেতুর উপর দাড়িয়ে আছে। জলের দিকে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। সেতুর উপর দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে মাল বোঝাই ট্রাক যাত্রীবাহী বাস। দুই দিন পর ঈদ। ঘরে ফেরা মানুষের মনে কী আনন্দ! অপেক্ষায় থাকা পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার আনন্দটা কেমন হয় এই অভিজ্ঞতা নেই তার। স্ত্রী সন্তান ঘর সংসার... সে এক অদ্ভুত ব্যাপার! অদ্ভুত আনন্দ। এই আনন্দের অভিজ্ঞতা না থাকলেও তার কান্নার অভিজ্ঞতা আছে প্রচুর। শৈশবে পেটের ক্ষুধার কান্না, অভিমানের কান্না, ভয়ের কান্না, অপমান অবহেলার কান্না আরও বিচিত্র রকমের কান্নার অভিজ্ঞতা আছে বিজয়ের। এই কান্না গুলো দেখার মতো কাছের মানুষ না থাকলে এক ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি জাগে মনে। তখন এই দুনিয়াতে একজন মানুষের থাকা আর না থাকা সমান কথা।
বিজয় বসিলা সেতুর উপর থেকে এখনি লাফিয়ে পড়বে ভরা বুড়িগঙ্গার জলে। এবার আর সে পিছন থেকে মায়ের ডাকে ফিরে যাবে না। যেই মা পঁয়ত্রিশ বছর আগে তাকে ফেলে চলে গেছে পরপারে সেই মৃত মায়ের পিছু ডাকের কী দাম আছে! এবার আর কিচ্ছু শুনবে না সে... ঠিক লাফিয়ে পড়ার সময় আবার সেই মায়ের ডাক শুনতে পেলো বিজয়। এবার আর পিছন থেকে নয়! জলের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মায়ের মুখ! সেই শৈশবের হলুদ বরণ মায়াবী মুখ! –বাবা, তুই ফিরে যা! তুই প্রতিশোধ নিবি না? এই পৃথিবীতে শয়তানটার বিচার কেউ করতে পারবে না বাবা... তুই প্রতিশোধ নে... প্রতিশোধ!
প্রতিশোধ! এই একটা শব্দ বিজয়ের নিথর শরীরের পেশী গুলোকে শক্ত করে দিলো। তার এই একটা কাজ বাকী রেখে আত্মহত্যা করলে মায়ের প্রতি অন্যায় হবে। সে তার দায়িত্ব খুঁজে পেয়েছে।
দুদিন পর কোরবানির ঈদ। চার দিকে গরু ছাগলের হাট, সাথে বিক্রি হচ্ছে ছুরি চাকু। ধারালো ছুরি চাকু কিনে এই বাজারে হাতে নিয়ে ঘুরাফেরা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। গরুর হাট থেকে একটা ধারালো লম্বা ছুরি কিনে নেয় বিজয়। বাসার নিচতলায় তার শোবার ঘরে বিছানার নিচে রাখে চাকুটা।
বাসার সামনে বিশাল আকারের একটা গরু বাঁধা। তালুকদার সাহেব চেয়ার নিয়ে বসে আছে কাছেই। প্রতিবেশীরা এসে গরুর দাম জিজ্ঞাসা করছে –কতো নিলো আঙ্কেল?
তালুকদার সাহেব খানিকটা সংকোচিত হয়ে উত্তর দিচ্ছে -পনেরো লাখ সত্তুর হাজার। সাবেক সাংসদ হলেও সরকারে বেশ প্রভাব আছে এখনো। ব্যাবসাপাতি নিয়ে বেশী ব্যাস্ত হয়ে যাওয়াতে ইলেকশনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। লোকে বলাবলি করছে সরকার তাকে মন্ত্রী বানাতে পারে। এলাকায় জনপ্রিয়তা বেশ। গরীব দুঃখী মানুষ খালি হাতে ফিরে যায় না। এই লোক এর আগে চল্লিশ লাখ টাকায় গরু কোরবানি দিয়েছেন, এবার কমদামী কোরবানির গরুর জন্যই সংকোচ।
পাশে লোকজন ব্যাস্ত গরুর খাবার নিয়ে। কেউ ব্যাস্ত ছুরি চাকু শান দেয়া নিয়ে। ওদিকে বিজয় বিছানার নিচ থেকে চাকুটা বের করে মেপে নেয়, প্রায় এক হাত লম্বা। এর আগে কোনো দিন মানুষের গায়ে ছুরি চালানোর অভিজ্ঞতা নেই তার। অনভিজ্ঞ হাতে মানুষ খুন প্রথম চান্সে মিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু তার মিস হলে চলবে না। জায়গা মতো এক ঘাতেই ঘায়েল করতে হবে। ধারালো ছুরিটা হাতে নিয়ে বার বার শুধু মায়ের একটা কথা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে –প্রতিশোধ! যতবার কথাটি মনে হয় বিজয়ের হাতের পেশী গুলো লোহার মতো কঠিন হয়ে যায়।
ঈদের জামাতে দ্বিতীয় কাতারে ঠিক পিছনে বসেছে বিজয়। পিছন দিকে পাঞ্জাবীর নিচে চাকুটা খুব সাবধানে রেখেছে। পিছনে ডান হাত ঢুকিয়ে এক টান দিলেই বেরিয়ে আসবে। জামাত শেষে খুদবা পাঠের পর মোনাজাত হয়। মোনাজাত শেষে দাড়িয়ে কোলাকোলি শুরু হয়। জয়নাল তালুকদার দাড়িয়ে ডানে বায়ে দুজনের সাথে কোলাকুলি করে পিছনে ফিরে দেখে বিজয় দাড়িয়ে আছে। হাত দুটি বাড়িয়ে দিতেই বুকের মধ্যে তিন চার ইঞ্চি ঢুকে যায় চাকু। চাকুটা এক টানে বের করার সাথে সাথে ফিনকী দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে। তালুকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বুকের উপর বসে মাথায় আরও কয়েকটি আঘাত করে তাৎক্ষনিক মৃত্যু নিশ্চিত করে। এতক্ষণে মানুষ ঘিরে ফেলেছে বিজয়কে। কিন্তু যা ঘটার ঘটে গেছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই রক্তাক্ত ছুরি হাতে ধরে ফেলে খুনিকে।
পাঁচ দিনের রিমান্ডে বিজয়ের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের মতো কিছু বাকী নাই। কারণ সে খুনের কথা আত্মবিশ্বাসের সাথে স্বীকার করেছে। কিন্তু তার জবানবন্দী কোন পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশন নিউজে আসেনি।
বিজয়ের বক্তব্য ছিল এইরকম। মুক্তিযুদ্ধের বছর খানেক আগে আমার মায়ের বিয়ে হয় স্কুল মাস্টার আনোয়ারের সাথে। তিনিই আমার জন্মদাতা পিতা। আমার মা দেখতে খুবই সুন্দরী ছিলো। যুদ্ধ শুরু হলে বাবা চলে গেলেন যুদ্ধে। আমার মা আর দাদা দাদী আমাদের সরিষাবাড়ি গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। যুদ্ধের সময় বাবা প্রায়ই মাঝ রাতে এসে মায়ের সাথে দেখা করতেন। আবার সূর্য উঠার আগেই রাইফেল কাঁধে নিয়ে ফিরে যেতেন। বাবা প্রথম যেদিন মাঝরাতে এসে মায়ের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন মা ভয় পেয়ে হারিকেন জ্বালিয়ে দরজার কাছে গিয়ে জানতে চাইলো –কেডা আপনে? বাবা নিচু স্বরে উত্তর দিলেন –আস্তে কথা কও বউ... আমি আনোয়ার, দরজা খোলো! মা দরজা খুলে দিলো। বাবা রাইফেলটা বিছানার পাশে রেখে পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলেন। ঘরে ফিরে বললেন –বারো মাইল হাইটা আইছি, খুব খিধা লাগছে খাবার দিবা কিছু? মা বললো -চিড়া আর গুড় ছাড়া কিছু নাই।
-তাই দেও।
ঘণ্টা তিনেক পর বাবা যখন রাইফেল কাঁধে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন মা বললো –মা বাবার সাথে দেখা করবেন না?
-বোকা মাইয়া মানুষ তুমি, মা আমারে এই অবস্থায় দেখলে ফিইরা যাইতে দিবো? তুমি তো জানোই আমি যুদ্ধে যাওয়ার পর মা শুধু বইসা বইসা কান্দে। দেশ স্বাধীন কইরাই মায়ের সাথে দেখা করবো।
এমন করে বাবা মাসে এক দুইবার মাঝ রাতে আসতেন মায়ের কাছে। কেউ জানতো না। দেশ স্বাধীনের মাস দেড়েক আগে শেষ বার যখন বাবা বাড়িতে আসলেন মা সুখবরটা জানালো বাবাকে। বাবা বললেন -যদি মাইয়া হয় তাইলে নাম রাখমু আমি আর পোলা হইলে রাখবা তুমি। পোলা হইলে কি নাম রাখবা আমারে এখনি কও।
-এখনই কেমনে কই? একটু চিন্তা করার সময় দেন।
-আরে চিন্তার কি আছে? দেশের সাথে যুদ্ধের সাথে মিলায়া একটা নাম দিয়া ফেলো!
-মা বললো বিজয়। আপনে বিজয় নিয়া বাড়ি ফিরবেন আর আজীবন আপনের মুখে মুখে থাকবো বিজয়।
-নামটা আমার বড়ই পছন্দ হইছে বউ। সেদিন আনন্দে আমার বাবার চোখে পানি চলে আসে। বাবা চোখে আনন্দের জল মুছতে মুছতে সেই যে বিদায় নিলেন আর ফিরে আসলেন না।
মায়ের কাছে শুনেছি বাবার সাথের যোদ্ধারা যারা জীবিত ফিরে আসছিলেন তাঁরা বলেছেন নভেম্বরের মাঝামাঝি কামালপুরে পাক বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। একুশ দিন যুদ্ধের পর পাক বাহিনী পরাজিত হয়। সেই যুদ্ধে কর্নেল তাহের নেতৃত্ব দেন। সেই যুদ্ধেই কর্নেল তাহেরের এক পায়ে গুলি লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তেরো জন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সাথে আমার বাবাও ছিলেন।
দেশ স্বাধীনের ছয় মাস পর আমার জন্ম হলো। আমার দাদা দাদী বিশ্বাস করলো না আমার মায়ের পেটের এই সন্তানের বাবা তাদেরই পুত্র! তারা মায়ের পেটে সন্তান থাকতেই বাড়ি থেকে বের করে দিলো। এমনকি আমার মায়ের পরিবারের লোকজনও বিশ্বাস করলো না। তারাও মাকে তাড়িয়ে দিলো। সবাই মনে করলো আমার মা পেটে জারজ সন্তান ধরেছে। মাকে গ্রামের লোকজন জারজ সন্তান পেটে ধরার অপরাধে গ্রাম ছাড়া করলো। মা কিছুতেই হার মানলো না। সে তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েই ছাড়লো। এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক তাঁর ঘরে আমার মাকে সন্তান প্রসবের সুযোগ দিলেন।
মা শিশু পুত্র কলে নিয়ে দুই তিন মাস এই গ্রাম সেই গ্রামে ভিক্ষা করে পেটের ক্ষুধা মিটালো। দেশে তখন অভাব, ভিক্ষা দেওয়ার মানুষ কই? মা আমাকে কলে নিয়ে জামালপুর রেল স্টেশনে শাপলা হোটেলে কাজ নিলো। মসলা বাটার কাজ পানি টানার কাজ। এর বিনিময়ে তিন বেলা খাবার জুটতো। কাজ খারাপ ছিলো না। কিন্তু সমস্যা ছিলো হোটেলের মালিক। তার কুনজর পড়েছিল মায়ের উপর। হোটেলের পাশেই একটা ছাপরা ঘরে মা আমাকে বুকে জড়িয়ে রাত কাটাতো। প্রায়ই রাতের অন্ধকারে মায়ের ঘরে ঢুকে ধ্বস্তাধস্তি করতো বুড়া হোটেল মালিক। ঘুম ভেঙে আমি যখন চিৎকার দিতাম লোকটা বের হয়ে যেতো।
এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মা একদিন ঢাকার লোকাল ট্রেনে উঠলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় নাকি বাসাবাড়িতে অনেক কাম। ট্রেন থামলো মোমেনশাহী রেল স্টেশনে। লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরা এক লোক মায়ের পাশের সীটে বসলো। বয়স পচিশ ছাব্বিশ। দেখতে শুনতে খারাপ না। আচার ব্যাবহারও ভালোই। ট্রেনে রুটি কলা কিনে খেতে দিলো মাকে। মাকে জিজ্ঞাসা করলো –তুমি কই যাইবা?
মা বললো –ঢাহা যামু।
-ঢাহা কোন খানে যাইবা? আত্মীয় স্বজন কেউ আছে?
-আমার কেউ নাই, কই যামু তাও জানি না।
-তুমি আমার লগে চলো। আমার নিজের একটা ঘর আছে। একটা চা বিড়ির দোকান আছে, দুইজনে মিইল্যা চালামু। পোলাডারে ইস্কুলে ভর্তি কইরা দিমু... কি কও?
নিরুপায় মা কোন উত্তর দিলো না। সরল বিশ্বাসে আমাকে কোলে নিয়ে তার সাথেই গেলো।
এরপর থেকে মা তার সাথেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলো। সাতাত্তুর আটাত্তুর সালের দিকে তড়তড় করে সে টাকার মালিক হতে থাকলো। আমাকে স্কুলে ভর্তি করেছিলো ঠিকই, আমি তখন একটু একটু বুঝি। একটা টিনের চালা ঘরে আমি মা আর ঐ লোকটা সহ তিনজন থাকি। একটাই বিছানা। রাতের অন্ধকারে প্রায়ই আমার মনে হতো লোকটা আমার মাকে গলা টিপে মেরে ফেলছে... তখন আমি মা বলে চিৎকার দিতাম। চিৎকারে বিরক্ত হয়ে আমাকে ঘর থেকে ঘাড় ধরে বের করে দিতো লোকটা। আমি দরজার বাইরে দাড়িয়ে মায়ের গোঙানির শব্দ শুনতাম আর কাঁদতাম। এভাবে অনেক রাত কাটিয়েছি বাইরে দাড়িয়ে। পরে বুঝতে পারি সেটা আসলে মাকে খুন করার চেষ্টা ছিলো না... সেটা ছিলো বরণ পোষণের বিনিময়। মা এভাবে প্রতিনিয়ত খুন হতে থাকলো।
মা তাকে প্রায়ই বলতো –আমারে বিয়া করো না কেন? সে বলতো – এই মাগী বিয়ার কি দরকার? তরে কি খাওন পরন কম দেই?
লোকটাকে আমি কাকা ডাকতাম। অনেকবার আমাকে সাবধান করছে –তুই আমারে আব্বা ডাকবি... আমার মুখ দিয়ে আব্বা ডাক আসতো না। যতো বার আমি তাকে কাকা ডাকছি সে আমার গলায় টিপ দিয়ে ধরে বলতো –কুত্তার বাচ্চা আব্বা ডাক... আব্বা! তার পরেও আমার মুখ দিয়ে আব্বা ডাক আসেনাই।
একদিন রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমাদের টিনের ঘরের পাশেই একটা দোতলা সরকারী অফিস ছিলো। লোকটা আমাকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট হাতে দিয়ে বললো -বিজয় তুই দোতলার বারান্দায় বইসা বিস্কুট খা গিয়া। আমি দেখলাম আমার মায়ের ঘরে কিছুক্ষণ পর একজন অপরিচিত লোক ঢুকলো! ঘর থেকে বের হয়ে কাকার হাতে টাকা দিয়ে চলে গেলো। এইরকম আরও কয়েকজন ঢুকলো। এক সময় এই ঘটনা প্রতি রাতেই ঘটতে থাকলো। মা আমাকে নিয়ে কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ততদিনে তার একটা গ্রুপ অস্ত্র হাতে পাহারা দিতো।
মহাখালী এলাকায় তখনো ডোবা জমি জমা ছিলো, পাশেই কিছু কিছু উঁচু জমিতে টিনের ঘর বাড়ী ছিলো। এই এলাকার স্থানীয় বেশীরভাগ মানুষ নেশাপানি করতো। অভাবের দিনে নেশাপানির টাকার টানে এক দুই বোতল মদের টাকা পেলেই জমি লিখে দিতো। কাকা এইভাবে অনেক জমিজমার মালিক হয়ে গেলো। দোতলা একটা বাড়ী বানালো। সামনে খোলা জায়গা। বিশাল বড় গেট। গাড়ি কিনলো। নামের সাথে তালুকদার যোগ করলো। জয়নাল হয়ে গেলো জয়নাল তালুকদার। সেই বাড়িতেও দামী দামী গাড়ি নিয়া লোকজন আসতো। আমার মায়ের ঘরে ঢুকতো... মা থাকতো দোতলায় আমি নিচ তলার একটা ঘরে থাকতাম।
চুরাশি সালের ডিসেম্বরের সতেরো তারিখ, আমার মায়ের লাশ ঝুলে থাকতে দেখা গেলো সিলিং ফ্যানের সাথে। ঘটনাটা আত্মহত্যা বলা হলেও আমি এখনো নিশ্চিত না এইটা আসলে আত্মহত্যা ছিলো নাকি খুন! সেই থেকে আমি আমার অসার শরির আর মন নিয়ে এখানেই পড়ে রইলাম। কিসের টানে রইলাম জানি না। সম্ভবত আমার মায়ের স্মৃতি আমাকে আটকে রেখেছিলো। তালুকদার গুলশানে আলিশান বাড়ি বানালো। সেখানে নতুন সংসারে ছেলে মেয়ে আছে। আমি দেখিনাই শুনছি শুধু। এই বাড়িটা তার ট্রান্সপোর্ট ব্যাবসার অফিস হিসাবেই ব্যাবহার হতো। রহস্যজনক কারণে আমার খরচের টাকার যোগান দিয়ে যাচ্ছিলো সে। তার মনে সম্ভবত ভয় ছিলো আমি তার হাত ছাড়া হয়ে গেলে অনেক অপকর্ম ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
এরশাদ সরকারের সময় তালুকদার রাজনীতিতে নাম লেখায়। এরপর এই দল সেই দলের হয়ে ইলেকশন করে। দুইবার এম পি হয়। ট্রান্সপোর্ট ব্যাবসা আসলে তার মূল ব্যাবসা না। এর আড়ালে হেরোইন ফেন্সিডিল সহ নানান রকম অবৈধ গোপন কারবার আছে। এখন তার ইয়াবার ব্যাবসা রমরমা। চাহিদা মতো ইয়াবা সাপ্লাই দিতে না পেরে নকল ইয়াবা তৈরির কারখানা দিয়েছে ঢাকায়।
রিমান্ডে বিজয়ের এই জবানবন্দি আলোর মুখ দেখলো না। কিন্তু রিমান্ডে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের একজনকে চোখ মুছতে দেখা গেলো, যার সামর্থ্য খুবই সীমিত। বিজয়কে বাঁচানোর ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। উপর থেকে তার ব্যাপারে চূড়ান্ত নির্দেশ অলরেডি চলে এসেছে।
জয়নাল তালুকদার খুনের সাত দিন পর পত্রিকায় খবর আসলো। পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে ইয়াবা সম্রাট বিজয় নিহত।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কাজী জাহাঙ্গীর ভাই জানিনা সত্য ঘটনা অবলম্বন আছে কি না তবে মুক্তিযুদ্ধের ছোঁয়াটা দিতে যেভাবে আবেগঘন করেছেন পাশাপাশি নোংরা লোকদের রাজনীতিতে এসে রাজনীতি যে নোংরামির রাজনীতি হয়েগেছে এযুগে সেটারও রূপ দেখিয়েদিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে। আপনারা অনেক গল্প পড়েছি আর বিমোহিত হয়েছি। অনেক শুভকামনা রইল।
ভালো লাগেনি ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
কিছু সত্যের সংমিশ্রণে সমাজের চলমান বীভৎস চিত্র যোগ করে লেখা গল্পটি। ঘটনার ভিতরের অজানা অনেক সত্যি আলোর মুখ দেখে না কোনোদিন। প্রতিদিন আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে, আমি তার একটির চিত্র আঁকতে চেষ্টা করেছি মাত্র। অনেক কৃতজ্ঞতা রইলো আবেগ জাগানিয়া মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকুন। নিরাপদে থাকুন।
ভালো লাগেনি ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
মোঃ মোখলেছুর রহমান কি বলব ভাই,বলার ভাষা নেই।অসাধারন লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিজয়, স্বাধীনদের আরও গল্প পড়ার আশায় থাকলাম। শুভ কামনা রইল।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
আপনার ভালো লাগায় ধন্য হলাম, লেখা সার্থক হলো। ভালো থাকুন আপনি।
ভালো লাগেনি ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
কাজী প্রিয়াংকা সিলমী শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-সন্তানের করুন উপাখ্যান ও স্বাধীন বাংলাদেশে অসাধু লোকের ক্ষমতাবান হওয়ার চেনা গল্প।
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শুভ কামনা আপনার জন্য।
ভালো লাগেনি ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে রেখে স্কুল শিক্ষক আনোয়ার মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। মাঝে মাঝে মাঝ রাতে স্ত্রীর সাথে গোপনে দেখা করতে আসতো স্বামী। আনোয়ারের বাবা মায়ের কাছে ছেলের মাঝ রাতে আসা যাওয়ার বিষয়টা গোপন থাকে। কামালপুর যুদ্ধে শহিদ হয় আনোয়ার। দেশ স্বাদীনের পর পেটের সন্তানকে সবাই জারজ বলে গ্রাম ছাড়া করে। একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার শিশু সন্তানকে বুকে নিয়ে মায়ের বাকী জীবনের অসহনীয় গল্প "জারজ" আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছি বিষয়ের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এই গল্পটি পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটবে, মনে থাকবে বহু দিন। যথাযথ মূল্যায়ন হলে বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিতে পারে।

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪