১
ঙ কামরার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে মেয়েটি। ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেনের গতি বাড়ছে আস্তে আস্তে। তার হাতে বিশাল বড় সাইজ একটা লাগেজ। এটা না থাকলে হয়তো দ্রুত দৌড়ে ট্রেনের দরজার পাইপ ধরে উঠে যেতে পারতো। দুপুরের ট্রেন। তেমন ভিড় নেই, অর্ধেক সিট ফাঁকা। এক হাতে ভারী লাগেজের হাতল ধরে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছে মেয়েটি। খোলা চুল নীল রঙ শাড়ি গায়ে, শাড়ি পরে দৌড়ে যেতেও সমস্যা হচ্ছে।
বছর কুড়ি কেটে গেছে মানুষের ভালো মন্দ সুখ দুঃখ আপদ বিপদের দিকে তাকানোয় অনাগ্রহ আমার। নিজেকে মাঝে মাঝে পৃথিবীর একমাত্র মানুষ কিংবা জড়পদার্থ ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যার আপন কিংবা পর বলতে কেউ নেই তারা জীবিত আর মৃতের মাঝামাঝি জীবনযাপন করে। আমার অন্তত তাই ধারণা। মসৃণ অনুভূতি বলতে কিছু থাকে না।
মেয়েটি তখনো দৌড়ে ট্রেনে উঠার চেষ্টা করছে। অলৌকিক এক ইচ্ছে মনের ভিতর থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ধাক্কা দেয় আমাকে... কফির গ্লাসটা দোকানের কাউন্টারে রেখে এগিয়ে গেলাম। আমি তার লাগেজের হাতল ধরতেই সাহায্যের হাত বুঝতে পেরে লাগেজ ছেড়ে দরজার হাতল ধরে ট্রেনে উঠে যেতে পারলো সে। এতক্ষণে ট্রেনের গতি অনেকটাই বেড়ে গেছে। চলন্ত ট্রেনে দরজায় দাড়িয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে আমার হাত থেকে লাগেজটা টেনে তুলার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই তুলে দিতে পারছিলাম না। একদিকে ট্রেনের গতি বেড়ে চলেছে আমিও লাগেজটা টেনে দৌড়ে যাচ্ছি। মেয়েটি একটা হাত বাড়িয়ে শেষবারের মতো চেষ্টা করে ব্যাগটা তুলতে ব্যর্থ হলো। এমন একটি অবস্থা যে, মেয়েটি ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেই চেষ্টা করলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
আমি ক্লান্ত হয়ে লাগেজটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছি। যতদূর দেখা গেলো মেয়েটিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। মতিঝিল থেকে ট্রেনে এয়ারপোর্ট স্টেশনে নেমে প্রায় সময় কফিশপ থেকে একটা কফি খাই। আজও খাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে এই বিপত্তি। লাগেজটা টেনে আমি স্টেশনের একেবারে উত্তর পাশে চলে এসেছিলাম। সিলেটগামী ট্রেন। পরের ট্রেনের অপেক্ষমাণ যাত্রীরা আমার দিকে দুঃখ ভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো কেউ কেউ। একজন জানতে চাইলো স্ত্রীকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলেন? হ্যা কিংবা না উত্তর না দিয়ে আমি মন খারাপ করে দাড়িরে আছি দেখে বুঝে নিলো ঘটনা এটাই। আসল ঘটনা বুঝতে দিলে এই লাগেজ নিয়ে আরেক গণ্ডগোল সৃষ্টি হতে পারে। এই ভেবে লাগেজটা টেনে স্টেশন থেকে বের হয়ে সি এন জি নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
চিলেকোঠার একপাশে লাগেজটা রেখে বাথরুমে ঢুকে মুখে হাতে পায়ে পানি দিয়ে সারাদিনের ধুলো ময়লা পরিষ্কার করে চায়ের পানি চুলায় দিলাম। চিনি ছাড়া গ্রীন-টিতে চুমুক দিয়ে ভাবতে থকি লাগেজের ভিতরে নিশ্চই এমন কিছু পাওয়া যাবে যেখানে নাম ঠিকানা কিংবা কন্টাক্ট নাম্বার আছে। সেই সূত্র ধরে মেয়েটির কাছে এই লাগেজ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। চায়ে তিন চার পাঁচটা চুমুক দিতেই মনে হচ্ছে মেয়েটাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি! সে তো প্রায় এক যুগ আগের কথা... রুবি! হ্যা, মেয়েটি রুবিই ছিলো। আমি চব্বিশ বছর পর চিনতে পারিনি! সে কি আমাকে চিনতে পারেনি? নাকি চিনতে পেরেই...। চব্বিশ বছরে তার বয়স কেন বাড়েনি? নাকি আমি ভুল দেখলাম...!
রুবিকে একটা সময় আমি পাগলের মতো চাইতাম কিন্তু সে পছন্দ করতো ফাইয়াজ নামে এক যুবককে। সেই ফাইয়াজ যাকে...! আমার সামনে পিছনে ফেলে আসা সময় আয়নার মতো ভাসছে। যেই নষ্ট অতীতকে দুই যুগের ঘষামাজায় মন থেকে মুছে ফেলেছি, এভাবে ঝড়ের মতো আবার ফিরে আসার মানেই বা কি হতে পারে?
এই মুহূর্তে ঘরে একেবারেই থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ছাদে বসে তিন তিনটা সিগারেট টেনে আরেকবার লাগেজটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। লাগেজে একটা তালা দেয়া। লাগেজের তুলনায় তালার সাইজ একটু বড়ই মনেহচ্ছে। এটা ভাঙতে হাতুড়ি লাগবে। ঘরে তালা দিয়ে বের হয়ে আসলাম। রাতে ফিরার সময় একটা হাতুড়ি কিনে আনতে হবে। আট তলার ছাঁদে আমার একলা থাকার এই ঘরটার প্রতি অনেকের লোভ। চারদিকে বাগান মাঝখানে বিশাল ফাঁকা জায়গা। আমাবস্যা, পূর্ণিমার চাঁদ, রাতের তারা, মাঝে মাঝে ছুটে আসা উল্কা একা উপভোগ করার মতো পরিপূর্ণ আনন্দ সবার ভাগ্যে জুটে না। ভোর রাত পর্যন্ত জেগে আকাশ দেখলেও ঘুমোতে যাওয়ার তাগিদ দেয়ার কেউ নেই। একটা গোপন কথা আমি কাউকে বলিনি। মধ্যরাতে যখন আমি ছাঁদে একা বসে আকাশ দেখি তখন পাশে একটা চেয়ার রাখতে হয়। উনিশ বছর বয়সী এক যুবতী পাশে এসে নীরবে বসে থাকে। সে উঠে না যাওয়া পর্যন্ত আমাকে বসে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তার জন্য সারারাত অপেক্ষা করি, আসে না। তাকে ঠিক চিনতে পারি না। মুখটা অস্পষ্ট, আজ অনেক বছর পর রুবিকে দেখে মনে হচ্ছে আমি রুবির চেহারাটা ভুলে গেছিলাম। অনেক কাছের মানুষের চেহারা স্মৃতি থেকে মুছে যায়, মানুষ চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না।
বাসার কেয়ারটেকার প্রায়ই জানতে চায় –স্যার, চার তলার ফ্ল্যাটটা খালি হইছে উঠবেন নাকি?
-একা মানুষ তিন রুমের ফ্ল্যাট দিয়ে কী করবো আমি? আমি উত্তর দেই। তার মানে এই রুমটা বেশী ভাড়ায় অনেকেই নিতে ইচ্ছুক। কিন্তু বাসার মালিক আমাকে বেশ পছন্দ করে। সে চায় আমিই থাকি। ঢাকার যে অবস্থা, ব্যাচেলর ভাড়া দিলে অনেক ঝামেলা। দিনে দুপুরে গার্লফ্রেন্ড এনে আকাম কুকাম করবে। আমাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে বাড়ির মালিক। ভাড়া একটু কম হলেও ঝামেলা মুক্ত।
২
রুবি। বলতে পারেন রাজকন্যা। দাদা ছিলেন খান বাহাদুর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও রুবির বাবা আজগর চৌধুরী সেই খান বাহাদুরের মেজাজেই চলতেন। অঢেল ধন সম্পদ থাকলে মানুষের মন বড় হয় এটা আমার নিজ চোখে দেখা। ভবগ্রামে ওদের প্রাসাদের মতো বাড়িটিতে আমি আশ্রিত ছিলাম। প্রায় প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে ডাকে চৌধুরী সাহেবের নামে চিঠি আসতো, কন্যার বিবাহের সাহায্যের আবেদন, ছেলের পড়াশোনার খরচ চেয়ে আবেদন, সুসংবাদ, দাওয়াতপত্র নানা রকম চিঠি। কোন কোন দিন চার পাঁচটা চিঠি আসতো আর সে সব চিঠি তাঁকে পড়ে শোনাতে হতো আমার। আমি চৌধুরী সাহেবকে কাকা বলে ডাকতাম। কাকা আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে পাইপ টানতেন আর মনোযোগ দিয়ে চিঠির কথা গুলো শুনতেন। তারপর কাকা বলে যেতেন আর আমি কাগজ কলম নিয়ে চিঠির উত্তর লিখতাম। তারপর খামে ভরে চিঠি গুলোর উত্তর আমড়াতলী ডাকঘরে পোস্ট করে আসতে হতো আমাকেই। সাথে কখনো এর তার জন্য সাহায্যের টাকা মানি অর্ডার করতে হতো। আমি যেই পুরনো ফনিক্স বাইসাইকেলে করে ডাকঘরে যেতাম এই একই সাইকেলে আমার বাবাও একই কাজ করতেন। মাত্র পয়তাল্লিশ বছর বয়সে আব্বা যক্ষ্মায় মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায় মাও চলে যায়। শেষ সময়ে বাবার সেবা যত্ন করে করে ক্ষয় রোগের জীবাণু রেখে যায় মায়ের শরিরে। এরপর থেকে আমার লেখাপড়া বরণ পোষণ চৌধুরী কাকাই দেখতেন। কাকার আদর স্নেহে মাঝে মাঝে ভুলেই যেতাম আমার কেউ নেই। শুধু যখন বাইসাইকেলে প্যাডেল দিয়ে মাটির রাস্তা ধরে বনের মাঝখান দিয়ে যেতাম মনে হতো বাবা আমার পাশে পাশে চলছেন।
কাকার বাড়ির প্রতিটি ঘরে অবাদ যাতায়াতের অধিকার ছিলো আমার। একমাত্র কন্যা রুবি, কোন পুত্র সন্তান না থাকায় সেই দুঃখ তিনি কিছুটা ভুলে থাকতেন আমার চোখের দিকে চেয়ে, এই বিশ্বাস আমার মিথ্যে ছিলো না। বিলেত থেকে আনা ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র, দামী পর্দা মখমলের কার্পেট কোন কিছুই পর মনে হতো না আমার কাছে। আমি যেন নিজের ঘরেই বেড়ে উঠছি। শুধু একজন মানুষকে দিন দিন বয়স বাড়ার সাথে সাথে চোখের সামনে পর হয়ে যেতে দেখলাম। রুবি।
ছোটকালে একজন শিক্ষক আমাকে আর রুবিকে পড়াতে আসতো। পড়ায় অমনোযোগী আমার থেকে পিছিয়ে থেকে খুব দুষ্টামি করতো। আমার বই খাতা লুকিয়ে রাখতো যেন স্যারের কাছে তার মতো আমাকেও বকাঝকা খেতে হয়। আমি ঠিকই একেকদিন একেক জায়গায় লুকিয়ে রাখা তার গোপন জায়গা থেকে বই খাতা উদ্ধার করে পড়া সেরে নিতাম। স্যারের সামনে যখন সে প্রতিদিনের মতো বকা খেতো তখন মনে মনে খুব খেপে যেতো আমার উপর। রাগে মাঝে মাঝে রুবি আমার চুল ধরে টানতো। কাঠের স্কেল দিয়ে মাথায় পিঠে আঘাত করতো। আমি বুঝতে পারতাম এইসব তার অভিমান। আমি মনে মনে হাসতাম।
আমি যখন এস এস সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম রুবি তখন আমার দুই ক্লাস নিচে। তার চেহারায় মুগ্ধ হওয়ার মতো ঐশ্বরিক পরিবর্তন গুলোর গোপন মুগ্ধতা বাসা বাঁধতে শুরু করে আমার মনে। তখন থেকে তার আর আমার পড়ার জন্য পৃথক রুম বরাদ্দ হয়, আলাদা গৃহ শিক্ষক রাখা হয়। যখন তখন চাইলেই গায়ে হাত দিয়ে আমার সাথে দুষ্টুমি আর করে না। কথায় মেজাজে ভারিক্কী একটা ভাব নিয়ে চলে আমার সাথে। আমি ক্রমশ পড়ায় মনোযোগ হারাই। রাতে ঘুম হয় না। তন্দ্রায় ভেসে উঠে পরীর মতো একটা মুখ। আমি বাড়ির সামনে ছোট একটা পৃথক দালানের দোতলায় থাকি। মাঝ রাতে জানালার পর্দাটা সরিয়ে চেয়ে থাকি মূল দালানের দোতলার মাঝখানের ঘরটার দিকে। আমি কান পেতে ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চেষ্টা করি, ওর গায়ের গন্ধ পেতে চেষ্টা করি। এভাবেই রাত ভোর হয়। চোখে ঘুম আসে না। আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করি চোখ বন্ধ করি তন্দ্রা লেগে আসতেই মনে ভাসে আমি রুবির হাত ধরে নদীর তীরে কাশবনে হেটে যাচ্ছি। ওর গায়ে শুভ্র সাদা জামা, সাদা উরনাটা যেভাবে বাতাসে উড়ছে সেও আমার একটা হাত ধরে উড়ে চলছে। দুঃস্বপ্নে আবার ঘুম ভাঙে। রুবি যার হাত ধরে কাশবনে উড়ে বেড়াচ্ছে, সেই হাত আমার নয়। সেই হাত ফাইয়াজের...! এমন কষ্টকর দিন উদ্ভ্রান্ত রাত আমাকে পাগলের মতো করে তুলে। এই মুহূর্তে আমি তাকে ছাড়া আর কিছুই বুঝি না। জীবনের একটি মাত্র লক্ষ্য রুবি। ওর বাবার ধন সম্পদে কানাকড়ি লোভ নেই শুধু রুবির জন্য আমি পৃথিবীটা উলট পালট করে দিতে পারি। শুধু তার সামনে দাড়িয়ে মুখে বলতে ভয়। আচরণে ইশারায় মনের কথা বুঝাতে ভয়। যেমন করে মানুষ বুকের মধ্যে তরল ভালোবাসাকে জমাটবদ্ধ পাথর করে বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
৩
ফাইয়াজ প্রতিদিন রুবিকে পড়াতে আসতো। আমি জানালার পর্দা টেনে চেয়ে দেখতাম পড়া শেষ হলে রুবি বারান্দায় দাড়িয়ে ফাইয়াজের চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে আছে। যতদূর চোখ যায় রুবি তাকিয়ে আছে ফাইয়াজ দৃষ্টি সীমার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত। ততদিনে আমার কলেজের পড়া প্রায় শেষ। একদিন কাকাকে বললাম –কাকা, আমি ঢাকা শহরে চলে যেতে চাই। -কি করবি শহরে যেয়ে?
-একটা কাজ খুঁজে নিবো।
-আমার এই সম্পদ কে দেখাশোনা করবে বাবা? তুই তো আমার পর মানুষ না। ত্রিশ বছর আগে তোর বাবা এসেছিলো এই বাড়িতে। এই বাড়িতেই জন্ম তোর। আমি কাকার কথার উত্তর খুঁজে পেলাম না। নির্বাক দাড়িয়ে থাকলাম মাথা নিচু করে। কাকা আবার বললেন –ঢাকায় যেতে চাস যা, আরও পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলে জানাবি। খরচাপাতি নিয়ে চিন্তা করবি না।
-ঠিক আছে কাকা আমি চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিবো।
দুদিন পর একটা খারাপ খবরে সারা গ্রামে শোক নেমে আসে। স্কুল মাস্টারের ছেলে ফাইয়াজ খুন হয়েছে! নির্মম খুন! রাস্তার পাশে বাঁশ বনে মৃতদেহ পড়ে আছে। গলা থেকে মাথাটা কেটে নিয়ে গেছে। মাথাটা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। মৃতদেহের পাশে পড়ে আছে বাইসাইকেলটি। মাস্টার সাহেব পুত্রের হাতঘড়ি, বাইসাইকেল আর জামা কাপড় দেখে পরিচয় নিশ্চিত করে। গ্রামের মানুষ অবাক হয় এমন সহজ সরল মানুষেরও শত্রু থাকতে পারে!
এই শোক চৌধুরী বাড়ির অন্দর মহলেও প্রবেশ করে। রুবি তিন দিন ধরে ভিতর থেকে ঘরের দরোজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। বাড়ির কাজের লোকেরা বার বার চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারেনি। শেষে চৌধুরী সাহেব নিজে কন্যার দরজার সামনে দাড়িয়ে চোখের জল ফেলে অনেক কাকুতি মিনতি করেও ব্যর্থ হয়। শেষে কাকা আমাকে শেষ বারের মতো চেষ্টা করে দেখতে বলে। আমার আসলে রুবিকে অনুরোধ করার কোন অধিকার ছিলো না। তারপরেও বেশ কয়েকবার নাম ধরে ডাকলাম –রুবি... দরোজা খোলো। ভিতর থেকে কোন উত্তর পেলাম না। পরদিন, মানে চতুর্থ দিন সকালে ঘরের ভিতর থেকে আর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে কাকা দরোজা ভাঙ্গার অনুমতি দিলেন আমাকে। রুবির ঘরে আরেকটি ছোট সাজঘর ছিলো। তার নিজের প্রসাধনী আর পছন্দের জামা কাপড় শাড়ি সাজানো থাকতো সে ঘরে। তার পছন্দের সেই নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ, মায়ের রেখে যাওয়া সব সোনার অলংকার গায়ে জড়িয়ে ঝুলে আছে সিলিং ফ্যানের সাথে।
রুবির এমন অভিমানে চলে যাওয়ায় কাকা একেবারেই ভেঙে পড়েন। শয্যাশায়ী প্রিয় কাকাকে সান্তনা দেবার ভাষা আমার নেই। কন্যার শোকে দিন দিন স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। নিয়মিত খাবার এমনকি ওষুধ পত্র মুখে নিচ্ছিলেন না। আমি বেশীরভাগ সময় কাকার পাশে থাকার চেষ্টা করি। এর মধ্যে একদিন মাঝ রাতে আমার ডাক পরে কাকার শোবার ঘরে। কাকা শোবার ঘরে বিছানায় বসে আছেন। সামনে কয়েকটি নক্সা করা কাঠের ছোট ছোট বাক্স। আমাকে দেখে নিজের বিছানার পাশে বসতে বললেন। হাতের মুঠোয় কিছু অলংকার আর নগদ টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন –আমার হাতে আর বেশী সময় নেইরে বাবা। তোকে তো কিছুই দিতে পারি নি। এই গুলো তুই নিয়ে যা।
আমি একটু বিব্রত বোধ করে বললাম –কাকা আমার এই সবের দরকার নেই। আমি আজীবন আপনার পাশে থাকতে চাই। আপনার দোয়া আর ভালোবাসা আমার মূল সম্পদ।
-আমি যা বলছি তাই কর। তুই ঢাকায় চলে যা। লেখাপড়াটা শেষ কর। তোর জন্য আমার চিন্তা হয়। আমি একটা ব্যাগে ভর্তি কাকার দেয়া উপহার গুলো বাধ্য হয়ে লাজুক হাতে তুলে নিলাম।
এর মাত্র দিন সাতেক পর কাকাকেও হারালাম। ভবগ্রামে আমার আপন বলতে আর কেউ রইলো না। আমি ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। দুই যুগ আগে সেই জন্মভূমির টান পিছনে ফেলে কুমিল্লা রেল স্টেশনে চোখে জল নিয়ে ঢাকার ট্রেনে অজানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
৪
একটা হাতুড়ি নিয়ে বেশ রাত করে ফিরলাম। ছাঁদে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো রাতটা আজ একটু বেশীই কালো। আজ হয়তো আমাবস্যা। কুয়াশায় কাছের আলো গুলো ঢেকে গেছে। ছাঁদের এক পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে মনে সন্দেহ জাগছে মেয়েটি কি সত্যিই রুবি ছিলো? দুই যুগ আগে যে আত্মহত্যা করেছে সে কিভাবে ফিরে আসে? তাও আবার সেই উনিশ বছরের যুবতী হয়ে! আমি পাশের চেয়ারটায় একবার তাকিয়ে দেখলাম আজও সে এসেছে কি না। আসেনি।
এখন আমার মনে হচ্ছে এটা আমার বিভ্রম। মেয়েটা নিশ্চই অন্য কেউ ছিলো। চব্বিশ বছর ধরে একটা মানুষের ছবি যেই মনের মধ্যে বন্দী সেই মন ভুল করতেই পারে। বাস্তবে ঘটনা যা ঘটেছে তাই সত্যি। আমি ভুল দেখেছি। বিজ্ঞানে বিশ্বাসী একজন মানুষের এমন চিন্তা বোকামি। আমি দরজার তালা খুলে লাগেজটা টেনে ঘরের মাঝখানে নিয়ে আসি। হাতুড়ি দিয়ে দুই তিনটি আঘাত করার পর তালাটা না খুলে রিং ভেঙ্গে যায়। চেইনটা টেনে খুলে দেখি মেয়ে মানুষের জামা কাপড়ে পূর্ণ, একটুও বাড়তি ফাঁকা জায়গা নেই। আমি নাম ঠিকানা নোট বুক কিংবা মোবাইল নাম্বার লেখা কোন কাগজ পাওয়া যায় কি না খুঁজে দেখার চেষ্টা করছি। ভাঁজ করা কাপড় গুলো একটা একটা করে বের করে মেঝেতে রাখছি। কয়েকটি কাপড় বের করার পর ভিতরে একটা নীল শাড়িতে তাজা রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। আমি কিছুটা আতংক নিয়ে শাড়িটা সরাতেই যা দেখলাম আমার হৃদকম্পনের শব্দ নিজ কানে শুনতে পাচ্ছি! ফাইয়াজের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথাটা যেন সদ্য কেটে আনা হয়েছে। খোলা চোখ দুটি আমার দিয়ে তাকিয়ে আছে, মুখে লেগে আছে একটা মৃদু হাসি। আমি লাগেজটা বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। রাত এখন প্রায় তিনটা। এটা নিয়ে আমি এখন কী করবো? ঘরে ফাইয়াজের খণ্ডিত মস্তক রেখে রাতে বিছানায় ঘুমানো অসম্ভব। আমার মনেহচ্ছে রুবি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। দরজা বাইরে দিয়ে তালা লাগিয়ে কুয়াশার রাতে খোলা আকাশের নিচে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করছি। সকাল হলে এই আপদ কিভাবে দূর করা যায় তার নানা রকম প্ল্যান আসছে মাথায়। অন্ধকার থাকতেই ভোরে ময়লার ঝুড়িতে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসবো? নাকি লাগেজ সহ লেকে কিংবা নদীতে ফেলে আসবো? পথে যদি পুলিশ ধরেফেলে? ভয় হচ্ছে ভোর হওয়ার আগেই পুলিশ এসে আমার ঘর তল্লাশি করতে পারে... একটার পর একটা সিগারেট টেনে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ঘর থেকে এক গ্লাস পানি এনে খাওয়ার মতো মানসিক জোর হারিয়ে ফেলেছি। পূর্ব দিকে তাকিয়ে আছি কখন সূর্যের আলোটা উঁকি দিবে। এতোটা দীর্ঘ রাত আমার জীবনে আর আসেনি। বার বার মোবাইল ফোনে সময় দেখছি। ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করে আবার সময় দেখি, মাত্র বিশ মিনিট পার হলো... হঠাৎ দূর থেকে একটা মসজিদে ফজরের আযানের শব্দ শুনে আশ্বস্ত হলাম অপেক্ষার পালা বুঝি শেষ হচ্ছে।
পাখীর কিচিরমিচির শব্দে পূর্ব দিকের আলোটা যখন চোখে লাগে আমি দরজার তালা খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে লাগেজটা খুলে আরেকবার অবাক হই। লাগেজে শুধুই জামা কাপড়। সেই নীল শাড়িটাও আছে। শুধু ফাইয়াজের মাথাটি নেই! রক্তের দাগও নেই! চব্বিশ বছর আগে পুলিশ ফাইয়াজের খুনের কুল কিনারা করতে পারেনি। কিন্তু আজও ফাইয়াজের খণ্ডিত মস্তক মাঝরাতে আমার জানালায় এসে উঁকি দিয়ে যায়। অপরাধী যেন আমৃত্যু নিজের অপরাধ ভুলে যাওয়ার সুযোগ না পায়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বিজ্ঞানে বিশ্বাসী মানুষের জীবনেও এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝামাঝি। পাপবোধ আর ভয় থেকে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আসলে কোন ঘটনা নয়। তাই আবার বিশাল ঘটনা হয়ে জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। দুই যুগ আগে নিজের পছন্দের নারীটি যখন অন্য এক পুরুষের প্রেমে জড়িয়ে যায় আমি এই কষ্ট মেনে নিতে পারি না, অথচ আমার ভালোবাসার কথাটি ভয়ে তার সামনে মুখ খুলে বলার সাহস পাইনি। রুবির পছন্দের পুরুষ ফাইয়াজ খুন হয়। শোকে আত্মহত্যা করে রুবি। চব্বিশটি বছর ভয় আর অপরাধ বোধ নিয়ে যখন ঢাকায় নীরবে নিঃস্বঙ্গ জীবনযাপন করছি হঠাৎ একদিন রেল স্টেশনে রুবির দেখা পাই। নাটকীয় ভাবে আমার হাতে রেখে যায় একটি লাগেজ। যার ভিতরে ছিলো তার প্রেমিক ফাইয়াজের খণ্ডিত মস্তক। পুলিশী তদন্তে খুনের রহস্য বের না হলেও রুবি নিশ্চিত ছিলো কে সেই খুনি। দুই যুগ পর সেই প্রতিশোধ নিতেই খণ্ডিত মস্তক ফিরিয়ে দেয় আমার কাছে। এখনো আমার চিলেকোঠায় ব্যাচেলর রুমের জানালায় ফাইয়াজের খণ্ডিত মস্তক উঁকি দিয়ে যায়। আমার অপরাধ যেন আমৃত্যু ভুলে যাওয়ার সুযোগ না পাই...
গল্পটি বিষয়ের সাথে তো সামঞ্জস্যপূর্ণ তো বটেই সাথে পাঠক নৈতিক একটি মেসেজ পাবেন বলে আমি মনে করি।
২৫ মে - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৪৬ টি
সমন্বিত স্কোর
৬.১৫
বিচারক স্কোরঃ ৩.১৫ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪