চোর

কোমলতা (জুলাই ২০১৫)

মোজাম্মেল কবির
  • ১১

চোরের খুব ক্ষিদে লেগেছিল। চুরি করার মতো তেমন কিছু ছিলো না ঘরে। প্রথমে চোর রান্না ঘরে ঢুকে। পাতিল থেকে ভাত আর কড়াই থেকে একটু ডাল নিয়ে পেট ভরে খেয়ে নেয়। তারপর ঢুকে শোবার ঘরে। মাটির ঘরের কাঠের জানালার পাল্লা দুটি জংধরা কব্জায় সামান্য আটকে ছিলো। হালকা টানেই খুলে যায়। জানালায় গ্রীল ছিলো না।
সে সময় দেশে খুব অভাব। কাজ করে খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কাজ ছিলো না। উনিশশ সাতাত্তুর সাল। ছিচকে চোরের উৎপাত খুব বেশী। এক বেলা ভাতের যোগান পেতেও চুরি করতো কেউ কেউ। একটা মুরগী একটা ছাগলের বাচ্চা চুরি হতো। এই চোরটাও তেমন ছোট খাট চোর। আমার বড় জ্যাঠার শোবার ঘরে এই চোরের চুরি করে নেয়ার মতো তেমন কিছু ছিলো না। যে মাপের চোর তার চাহিদাও খুব কম। ঘরে ঢুকে আলনা থেকে একটা লুঙ্গী নিয়ে তার মধ্যে গোটা দুই সুতি শাড়ী তিনটা লুঙ্গী দুইটা পাঞ্জাবী পুটলি করে বেধে নেয়। আরেকটা কুড়াল ছিলো দরজার পাশে। এতেই সন্তুষ্ট হয়ে এক হাতে কাপড়ের পুটলি নিয়ে কাধে ঝুলিয়ে নেয়। আরেক হাতে কুড়াল নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। ততোক্ষণে ফজরের আযান হয়ে গেছে। আর একটু দেরী হলেই ধরা পরতে হবে।


আকুয়া । ময়মনসিংহ শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম। ঠিক গ্রাম বলতে যা বুঝায় তেমন না। গ্রাম হলেও জমি চাষ করে খায়না কেউ। স্থানীয়রা লেখাপড়ার বদলে হাতের কাজ শিখে দিনমজুরী লাভজনক মনে করে। শহর খুব কাছে। হেটে যেতে ত্রিশ মিনিট লাগে। গ্রামের উঠতি অকর্মা যুবকরা শহরের ধাঁচে নতুন জামা কাপড় পড়তে পছন্দ করে। রংবাজী করে নিজেকে হিরো ভাবতে ভালোবাসে। এরা খরচের টাকা কথায় পায় তা কেউ জানতে চায় না।
আকুয়া গ্রামের পথ দিয়ে গ্রাম থেকে আসা মানুষের ঘরে ফিরতে হয়। খুন খারাবী মারামারি লেগেই থাকে প্রতিদিন। সন্ধ্যার পর এই পথে ঘরে ফেরা পথচারী নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে এই নিশ্চয়তা নেই।
লজ্জাস্থান ঢাকার কাপড় টুকু রেখে ঘড়ি আংটি এমনকি গায়ের জামাটি পর্যন্ত লোভনীয় বস্তু । বাইসাইকেল আরো বেশী লোভনীয় জিনিস। দাপুনিয়া এলাকা থেকে তরকারি সব্জি বিক্রেতা পায়ে হেটে শহরে এসে ফিরার পথে সন্ধ্যা হয়ে গেলে সারা দিনের রোজগার ঘরে নেয়া হতো না। একবার ছিনতাই হলে পথে আরেক দফা আটকানোর ভয় থাকতো। তখন সাথে নগদ টাকা না পেলে দুই চারটা চড় থাপ্পড় লাত্থি হজম করতে তৈরি থাকতে হতো। সন্ধ্যার পর শহর থেকে রিক্সা আকুয়া এলাকায় আসতে চাইতো না। যাত্রী হয়ে শহর থেকে আকুয়া এলাকায় এসে রিক্সা চালকের ভাড়া না দিয়ে উল্টো সাথে থাকা সারা দিনের রোজগারের নগদ টাকা ছিনিয়ে নিতো।


সকাল থেকে গ্রামে আলোচনার বিষয় একটিই মুন্সী বাড়িতে চুরি হয়েছে। চার দিকে খোজ খবর লেগে গেলো। তিন চারটি দলে ভাগ হয়ে বাড়ির যুবক ছেলেরা চোরের সন্ধ্যানে বেরিয়ে যায়।
চুরি হওয়া মালামাল সহ চোর ধরা পরেছে। ভুল মানুষকে ধরা হয়নি। তার সাথে সব মালপত্র পাওয়া গেছে। মুন্সীবাড়ীর আঙ্গিনায় লিচু গাছের সাথে বেধে সবাই সাধ মিটিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছে। গাছের ঢাল দিয়ে একজন পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আরেক জনের হাতে লাঠি তুলে দিচ্ছে। হাটুতে কোমরে পিঠে লাঠির একেকটা আঘাতে ও বাবাগো বলে লাফিয়ে উঠছে চোর। ঠোট কেটে রক্ত গড়িয়ে পরছে। গায়ের ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জিটা রক্তে ভিজে গেছে। ছেড়া লুঙ্গীটা গা থেকে খুলে মাটিতে পরে আছে। আঠারো উনিশ বছর বয়সী যুবকের শরিরে আরো মার হজম করার শক্তি আছে বলে উৎসাহ দিচ্ছে কেউ কেউ। কেউ বলছে -এই ব্যাটা জাত চোর, চোখ দিয়ে পানি আসছে না। সারা গ্রামের মানুষ দূর থেকে চোর পিটানোর তামাসা দেখছে। এক বৃদ্ধ এসে পেটে পিঠে দুই একটা লাত্থি দিয়ে সাদ মিটিয়ে যায়। তিন দিন আগে তার অভাবের সংসারে পুরাতন কিছু জামা কাপড় আর রান্নার চাল চুরি হয়। সেদিন তার ঘরে রান্না হয়নি। চোর ধরা পরেনি বলে তার মনে ক্ষোভ।


মুন্সী বাড়ির মেয়েদের মধ্যে একমাত্র কলেজ পড়ুয়া হালিমা আপা। নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষা দিবে। বাড়িতে সবাই চোর আর চুরি হওয়া মালামালের হিসাব নিয়ে ব্যাস্ত সেদিকে তার খেয়াল নেই। ক্লাস আছে কলেজে। প্রতিদিনের মতো কলেজে চলে যায়। কলেজে একটা ক্লাস শেষ হয়েছে এমন সময় তার কাছে খবর আসে তাদের ঘরে রাতে যে চোরটা চুরি করেছে সে ধরা পরেছে। তাকে খুব পিটানো হচ্ছে।
পরের ক্লাস না করেই দ্রুত বাড়ি চলে আসে হালিমা আপা। তাকে দেখে ছোট বড় সবাই দূরে সরে যায়। চোরের হাতের বাধন খুলে দিয়ে লুঙ্গীটা পড়ে নিতে বলে। একটা কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে ক্ষতস্থান আর গায়ে লেগে থাকা শুকনো রক্ত মুছে দেয়। পুকুর ঘাটে নিয়ে গোসল করিয়ে ঘর থেকে একটা লুঙ্গী আর শার্ট পড়তে দেয়। রান্না করে গরম ভাত আর আলু ভর্তা করে বাড়ান্দায় চট বিছিয়ে খেতে দেয়। পাশে বসে জানতে চায় -তুই কেন চুরি করেছিস?
-ক্ষিদার জ্বালায় আফা।
-এটাই প্রথম নাকি আগেও চুরি করেছিস?
-এর আগে একটা দুহানে চুরি করছি। আরেক বার চাইল আডার গাড়ি থেইক্কা এক বস্তা আডা ফালায়া দিছিলাম।
- চুরি করতে কি তোর ভালো লাগে?
-না আফা। চুরি খুব খারাপ কাম।
-ভালো কাজ দিলে করবি তুই?
-হ আফা করাম।
-ঠিক আছে এখন ভাত খা। আর এই দশটা টাকা রাখ। কোন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত যখনই ক্ষিদা লাগে আমার কাছে এসে ভাত খেয়ে যাবি।
-আইচ্ছা আফা।
এতোক্ষনে চোরের চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখা গেলো। চোখে জল আসতে আবেগ লাগে। গাছের সাথে বেধে পিটানো চোরের আবেগ থাকেনা। মনে তখন ভয় থাকে। ভয়ে চোখের জল শুকিয়ে যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম আমাদের সমাজে হালিমাদের মত কোমল মনের মানুষের বড় অভাব...! গল্পে খুব সুন্দর করে সমাজের কালো দিকটি তুলে এনেছেন। শুভকামনা নিরন্তর...।
লেখাটির যথার্থ মূল্যায়নের জন্য অনেক ধন্যবাদ সেলিনা আপা...
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ।...এতোক্ষনে চোরের চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখা গেলো...। দারুণ লিখেছেন। ভাল্লেগেছে।শুভেচ্ছা রইল।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন।
Rome সুন্দর গোছানো ভালো লাগল।
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক ভালো লাগালো বেশ । রইলো আমার পাতায় আমন্ত্রণ ।
ধন্যবাদ। আপনার পাতায় যাবো।
Salma Siddika ভালো লাগলো গল্পটি. আশা করছি প্রতি সংখ্যায় আপনার লেখা পাবো
এখন পর্যন্ত ইচ্ছে আছে নিয়মিত লেখার... অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
তৌহিদুর রহমান কি বলব...অনেক ভালো লাগলো...পাতায় আমন্ত্রন রইল...আমার গল্প বা কবিতা ভালো লাগলে ভোট করবেন...প্লিজ...
ধন্যবাদ। আপনার পাতায় যাবো।
জুন দারুণ। একটা মনের মত গল্প পড়লাম। প্রতিটা পর্বই বেশ গোছানো। ভালো লাগা ও শুভ কামনা।
এশরার লতিফ ভালো লাগলো প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় নিয়ে সুলিখিত গল্পটি .
ধন্যবাদ এশরার লতিফ ভাই।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম।পাতায় আমন্ত্রন রইল।
অনেক ধন্যবাদ। এই লেখায় ভোটিং বন্ধ আছে...
Fahmida Bari Bipu গল্প ভাল লাগলো। সহজ সাবলীল ভাষায় অনুপম রূপে কোমলতাকে বর্ণণা করা হয়েছে।

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪