কত রঙ, হায়রে ঈদ-পার্বণ

ঈদ (আগষ্ট ২০১৩)

জায়েদ রশীদ
  • ৫৭
ঈষৎ পরিবার। তা হলে কি হবে, অর্থের টানাটানিতেও সামান্য পরিমাণ মেদ জমতে পারেনি। বাবা ছাপোষা কেরানী। অর্থসঙ্কট তার কাছে নতুন কিছু নয়। পরিবারের ওপর তার যতটা না ভ্রুকুটি, ব্যয় নির্বাহের দীর্ঘশ্বাসটা তার চেয়ে একটু বেশী। মা গৃহবধু, কচুপাতায় একবিন্দু জলের মতই সংসারকে আগলে রেখেছে। রেখেছে কি বরং রাখতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। একটাই ছেলে, পুলক। আদরের মধ্যমণি নয়, দারিদ্র্যের। এই দুঃখভরা সংসারে পুলক নামটা বুঝি নিতান্তই বিধাতার উপহাস বই অন্য কিছু নয়।

মাস যায়, তারিখ যায়, কিন্তু পুলকের বাবা-মায়ের ঝগড়া বেধেই থাকে। এই ঝগড়ায় নতুন কোন বিষয়ের জন্মই হয় না, কারণ পুরোন বিষয়গুলোরই এখনও ইতি টানা হয়নি। আর এটা এমনই নিত্য পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, পাশের বাসার নিলুও এখন আর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে না, কিংবা ওপর তলার পার্বণীর মাও অকস্মাৎ জীব কেটে উঠে না। তবে হ্যাঁ, ঝগড়ার চূড়ান্ত পর্যায়ের একটা মাপকাঠি আছে। তিনতলার সাবলেটের বেকার মজিদ যিনি সম্ভবত বিসিএস পরীক্ষার তৃতীয় অভিযাত্রী, তাঁর নির্দয় অনুপ্রবেশে এই ঝগড়ার ছন্দপতন ঘটে।

রমজান মাস চলছে। অভাবের পিড়াপীড়িতে ছোট্ট পুলকের রোজা রাখার প্রচেষ্টারও ক্রমান্বয়ে উন্নতি হচ্ছে। ইফতারিতে খেজুর পুলকের দারুন পছন্দের। বাবাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বহুবার বলেছে। কিন্তু সেটা ছোট মানুষের অগুনতি বাতিকের একটা বলে বিবেচ্য হওয়ায় আর সাফল্যের মুখ দেখেনি। হাজার হলেও নিদারুণ ঊর্ধ্বমুখী বাজারদরের চেয়ে ছেলের সখকে বড় করে দেখবে এতটা অবিবেচক নয় পুলকের বাবা। এদিকে ঈদও ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। পুলকের সব বন্ধুরা জামা কাপড় কিনে ফেলেছে, কিন্তু বাবার গড়িমসির জন্য ওরটা হয়ে উঠছে না। পাশের বাড়ির রঞ্জিত এই সেদিনই ওর চকচকে নতুন কাল জুতো জোড়া দেখাল। পুলক সেই জুতো জোড়া অনেকক্ষণ হাতে ধরে লেদারের ঘ্রাণ নিয়েছে। রঞ্জিতরা অবশ্য ঈদ করে না ওরা পুজো দেয়। কিন্তু ওরা অনেক বড়লোক। বাজারের সেরাটাই ওরা কিনতে পারে। রঞ্জিত জিজ্ঞেস করেছিল পুলককে, এই ঈদে ও কি কিনেছে। পুলক এমনিতেই লাজুক ছেলে। ও জানে ওরা অনেক অসচ্ছল। কিন্তু ওর ছোট্ট মনে ও ভেবে পায়নি কি করে কথাটা রঞ্জিতকে বলবে। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করায় পুলক লজ্জায় গুঁটিয়ে গিয়ে কোনমতে বলেছে ওর জামা এখনও কেনা হয়নি। দৃষ্টি কোন ফাঁকে যে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল তাই ও আর দাঁড়ায়নি।

ঊনত্রিশ রোজার বিকেল বেলা। সবাই বলছে আগামীকালই ঈদ হবে। পুলক অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। বাবা এলেই জামা কিনতে যাবে। মা বলেছে, ফুঠপাথে কম দামে অনেক ভাল ভাল জামা পাওয়া যায়। তবু পুলকের অপেক্ষার পালা আর শেষ হয় না। আজ বাবা এত দেরী করছে কেন। বাবা কি ওর জন্য জামা কিনেই বাসায় আসবে? তাহলে ঠিকই আজ ও আদর করে বাবার গালে চুমু দেবে। কিন্তু কোথায় বাবা আসছে না কেন?

পুলকের বাবা সেদিন এল ঠিকই কিন্তু হাতে ছিল না ওর জন্য কোন নতুন জামা। ঈদের আগের রাস্তাঘাট। ওর বাবার মানিব্যাগটাই পকেটমার হয়ে গেছে। ওতে সামান্য যে কটা টাকা ছিল এই ধাক্কায় সেটাও গেল। পুলকের মনের অবস্থা আর বলার কিছুই নেই। কারণ বাসার কেউ সেই অবস্থা বোঝার জন্য বসে নেই। বরং টাকা হারিয়ে ওর বাবার মেজাজ আজ সপ্তমে। এসেই মাকে না পেয়ে শুরু হয়ে গেল প্রলয় প্রহর। পুলক ক্রমাগত গালদুটো মুছে যায়। পুলক বুঝতে পারে না ও কাকে দোষ দেবে। কিন্তু ওর খুব কষ্ট হয়। ও ভাবতে চায় যদি এমন হত, কারও নতুন জামা কিনতে হত না, পুরোন সব জামাগুলো নতুন হয়ে যেত...!

বিধাতার একটু বাড়তি করুণায় সেদিন সন্ধ্যায় আর ঈদের চাঁদ দেখা গেল না। নতুন জামা কেনার ইচ্ছেটা সামান্য হলেও পুলকের মনে জীইয়ে রইল, যদিও ও জানে সংসারে নতুন করে অর্থ সমাগমের অন্য কোন রাস্তা নেই। ওদিকে পুলকের মাও যে ছেলের প্রতি একেবারে উদাসীন তা নয় । কিন্তু সামান্য ভ্রূক্ষেপ যদি আহ্লাদ বা আব্দারে গড়ায় সেই সঙ্কায় সব ব্যথা দেখেও দেখে না। খুব ইচ্ছে ছিল অল্প যে কটা টাকা জমা আছে তা থেকে সস্তায় পুলককে কিছু কিনে দেবে। কিন্তু পাশের বাসার নিলুর অসুখ চোখের সামনে দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেদিন তো নিলুর মা জ্ঞানই হারাল। জ্ঞান ফিরলে বললেন, ঘরে কোন পয়সা নেই, মেয়েটা অসুস্থ তার ওপর স্বামীর কোন খোঁজ পাচ্ছেন না। তখন পুলকের মা আর থাকতে পারেনি। ওদের খাওয়া আর ওষুধের জন্য সব টাকা দিয়ে দিয়েছে। এখন তাই অন্তরজ্বালা নীরবে সওয়া ছাড়া উপায় কি!

ওদিকে রঞ্জিতকে সব বন্ধুরা এসে নতুন জামা দেখাচ্ছে নয়তো জামার কথা বলছে। কিন্তু পুলক তো বলা দূরে থাক ওর দেখাই মিলছে না। ওরা ছোট হলেও একে অপরের বন্ধু। রঞ্জিত কথায় কথায় ওর মাকে সব বলে। রঞ্জিতের মা শিক্ষিত সচেতন নারী, তিনি বুঝতে পারেন।

ঈদের আগের রাতে রঞ্জিত পুলককে ওদের বাসায় ডেকে আনলে রঞ্জিতের মা ওকে জড়িয়ে ধরে একটা ঝলমলে রঙ্গিন জামা দেন। এতে পুলক খুবই লজ্জা বোধ করে। বিবেকের তর্জনী আঙ্গুল উঁচিয়ে ওকে নিষেধ করে। রঞ্জিতের মাও পুলককে চেনেন। ও যে নিতে চাইবে না এটা তিনি জানতেন। উনি পুলকের কানে কানে বললেন, মাকে আমার কথা বলো।

পুলক জামা হাতে অপরাধীর বেশে ওর মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ও জানে, মা ওকে খুব করে বকবে। চোখের জল লুকিয়ে মা করলোও তাই। তবে ভৎর্সনা শেষে জামাটা পরেও দেখতে বলল। সেদিন পুলক ঘুমালোও জামাটা পাশে নিয়ে। রাতে কতবার যে ছুঁয়ে দেখল তা ও বলতেও পারবে না।

ঈদের দিন। খুব সকালে উঠে, গোসল করে, নতুন জামা পরে পুলক তৈরি। বেরিয়ে পড়ে বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজে। নামাজ থেকে এসে জলদি আবার বন্ধুদের বাসায় যাবে। বেরিয়েই দেখে নিলুর বাবা ফিরে এসেছে। পুলকের গায়ে নুতুন জামা দেখে লোকটা বলে, “কিরে দামি জামা মনে হচ্ছে, কোত্থেকে চুরি করলি?”

ছোট্ট পুলকের উজ্জ্বল মুখে মেঘের ছায়া পড়ে। এক দৌড়ে এসে মায়ের আঁচলে ডুকরে কেঁদে ওঠে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে নিলুর বাবা কি বলেছে। যে মা ছেলের প্রস্রয়ের কথা ভেবে তাকে কখনও আমলে নেয় না, সেও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।

পুলকের চোখে ঈদ, ঈদের আনন্দ, নতুন জামা সব ভিজে একাকার হয়ে অবারিত বৃষ্টির ধারা হয়ে নামে। সেই বৃষ্টির রঙধনুতে যে কত রঙের কষ্ট পুলক বলতে পারবে না। ও জানে না রাঙ্গা ঈদের স্বপ্নিল দিনে ওদের ঈদগুলোই কেন বেদনার নীল রঙ ধারণ করে। ও জানে না কেন ঈদগুলো এত রঙের বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। রঙের বৈষম্য অনুসন্ধানে ব্যর্থ হলেও স্বাদ ওদের ঠিকই আস্বাদন করতে হয় - তা যতই তীব্র, মলিন আর ধূসর হোক না কেন!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শাহনাজ নাসরিন মল্লিকা মন খারাপ করা গল্প ।ভাল লাগল
উঁহু... মন ভাল করা চাই, অন্তত ঈদের সময়টায়। পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম এরকম হাজার হাজার লাখ লাখ পুলকরা এভাবেই ঈদের দিনের ইতি ঘটায়, আবার সূর্য ওঠে, নতুন দিন আসে । পুলকরা স্বপ্ন দেখে, আবার স্বপ্ন বিলিন হয় । এটাই কঠিন বাস্তব । জীবনের গল্প । ভাল লাগল ।
আপনি ঠিকই বলেছেন। আর আমাদেরও উচিৎ ওদের মনকে বোঝা। সময় করে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ও ঈদের শুভেচ্ছা।
রোদের ছায়া ঈদের দিন আপনার গল্পটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো । কেন যে এমন হয় ! কেন সব কিছু ঠিকঠাক চলে না ??
আঁ...হাঁ... হাঁ... সে কী! অন্তঃত ঈদের দিনটা আমার জন্য মাটি করবেন না। আগামীর তালিকায় নিশ্চয়ই রসাল কিছু থাকবে। এত্তো এত্তো ঈদের শুভেচ্ছা রইল। :)
অদিতি ভট্টাচার্য্য এরকমই দুনিয়া। যে দরকারের সময় নিজের কর্তব্য করল না, সেই নীলুর বাবা পুলককে আঘাত করতে ছাড়ল না। গল্প ভালো লেগেছে বেশ।
মন্তব্য পেয়ে অনেক খুশি হলাম। ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।

০৭ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪