তমিস্রা

ব্যথা (জানুয়ারী ২০১৫)

মীর মুখলেস মুকুল
এইমাত্র ‘এমিরাটস্ এয়ার লাইন্স’ এর বোয়িং ৭০৭ বিশাল দেহ নিয়ে বিকট শব্দে ঢাকার মাটিকে আড়ি দিয়ে উড়ে গেল।
মানুষের জীবনে মানুষের আগমন অনিশ্চিত কিন্তু প্রস্থান সুনিশ্চিত। আকাশের মনে অনেক আশা ছিল ঠিক কিন্তু জোর করে সে কিছুই চায় নি। অথচ তাকে জোর করে এনে, দাঁড় করিয়ে, বছরের পর বছর হাঁটিয়ে, মাঝ পথে এসে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে ফেলে চলে গেল। শুধু গেলই না, শৃঙ্খলিত দুঃসহ জীবনে ঠেলে দিল। অই মানুষটা...।
আকাশের পথ এখন আরও দুর্ভেদ্য, অনিশ্চিত আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবুও তাকে চলতে হয়, হবে...।
এখনই আকাশকে পৌঁছতে হবে কর্মক্ষেত্রে। কেননা সে একটা দেশীয় ঔষধ কোম্পানির দায়িত্ববান প্রতিনিধি। মাঘ মাসের ঠাণ্ডাটা জেকে বসতে শুরু করেছে। ন’টার বেশী নয়। অথচ মনে হচ্ছে অনেক রাত। কুয়াশা ভেদ করে আকাশ দ্রুত মোটর সাইকেল চালায়। সে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষ্ঠান ফেলে এসেছিল বিমান বন্দরে, একজনকে বিদায় দিতে। সে জানে, এজন্য তাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। তবুও সে নিয়ম ভেঙ্গেছে, নিয়মের প্রয়োজনে...।

এরিয়া ম্যানেজার সোহরাব মৃধা শেরাটন হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে চা পান করছেন, আকাশকে দেরীতে আসতে দেখে বড় বড় চোখে এক নিশ্বাসে তুলো ধুনো করেন, আকাশ ! এতো দেরী? লাঞ্চের পর দু’ঘণ্টার জন্য ছুটি নিয়ে আসছেন ডিনারের সময়। ‘ইয়ার্লী কনফারেন্সের’ গুরুত্ব নতুন করে বোঝাতে হবে নাকি? রিজিওনাল ম্যানেজার হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজছেন। জানেন না আজই শেষ দিন? এখুনি এমডি স্যারের বক্তব্য শুরু হবে। ফার্মাসিউটিক্যালে এভাবে চাকরি করলে চলে? এ ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হলে আত্মীয়, বন্ধু, প্রেম, ভালবাসা থু করে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
আকাশের মনে হল তার গায়ে ঐ লোক এক বোতল এসিড ঢেলে দিয়ে নেড়ি কুকুর বানিয়ে দিল। তবুও সে এরকম মুহূর্তে নিজেকে গণ্ডার ভাবে। আর বুলেটের মত কথাগুলো নিজ কলিজায় হজম করে। এভাবে দিন দিন তার অন্তরটা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তাতে কি? সে ধীর পায়ে হল রুমের দিকে যায়। কয়েক দিন হয় তার ঝাঁঝরা কলিজায় অনবরত রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। এখন সেটা ফিনকি দিয়ে বেরুতে শুরু করে...।

কনফারেন্সের পরদিন ছুটি শেষে আবার শুরু হয় সেই রুটিন মাফিক জীবন। আকাশ থেমে থাকে না। সুযোগও নেই। কখনও হেটে, কখনও মোটর সাইকেলে। সকাল-সন্ধ্যায়, এমন কি ছুটির দিনেও। ডাক্তার, কেমিস্ট আর ড্রাগিস্টদের দ্বারে দ্বারে...।
একদিন সন্ধ্যার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের সহঃ অধ্যাপক কামাল মজুমদারের প্রাইভেট চেম্বারের পর্দা তুলে আকাশ বলে, মে আই কাম ইন স্যার।
আকাশ ব্যাগ মেঝেতে রেখে চেয়ারে বসে ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দেয়, দিস ইজ আকাশ আহমেদ, মেডিকেল প্রমোশন অফিসার, লাইফ লাইন ফার্মাসিউটিকেল্স লিঃ। স্যার, অনুমতি দিলে কম্পানির প্রোডাক্ট নিয়ে কথা বলি।
ঠিকাছে। তবে সংক্ষেপে।
আকাশ প্রোডাক্ট নিয়ে ব্রিফ করছে এমন সময় প্যান্টের পকেটে রাখা মোবাইল ভাইব্রেট করে। পর পর তিন বার রিং হয় । ভদ্রতার খাতিরে এবং নিষেধ থাকায় সে ফোন রিসিভ করে না। একটা তীব্র উত্তেজনাকে গলা টিপে হত্যা করতে গিয়ে আমতা আমতা করতে থাকলে অধ্যাপক বলেই ফেললেন, আর উ ইন ট্রাবল? এনিথিং রং?
আই এ্যাম ও কে স্যার।
কুয়াসাচ্ছন্ন মন নিয়ে কোন রকম ভিজিট শেষ করে, বাইরে এসে মোবাইল চেক করে অপরিচিত নম্বর দেখে আফসোস করে। বুকের শ্বাস যন্ত্রটা একটা দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে। মনে হয় আসে পাশে বাতাসে অক্সিজেন কমে গেছে। হাপানী রুগীর মত হাস-ফাস করে। রাস্তায় এসে আকাশ মুখী হয়ে হা করে কিছুক্ষন নিশ্বাস নেয়...।
তেজকুনি পাড়ায় আকাশ যখন পোঁছায় তখন রাত এগারটা বিশ। সে এখানে একটা পাঁচ তলা বাড়ীর নীচের তলায় থাকে। সিড়িঘরের পাশে এ্যাটাস্ট বাথ আর ছোট্ট বারান্দাসহ এক কামরা বিশিষ্ট ঘর। ভাড়া একটু বেশী। আর্থিক সাশ্রয় পাওয়ার জন্যে একজনকে সাবলেট দিয়ে এটাকে কৃত্রিম মেস বানিয়েছে। নাম শফিক আহমেদ।
দরজা ভিতর থেকে লক টিপে আটকানো। আকাশ বাইরে থেকে চাবি দিয়ে ক্লিক করে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে শফিককে বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়তে দেখে। তিনি দৈনিকটা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে গোটা চারেক কোদালের মত দাঁত বের করেন, মুড অফ কেন? বুঝেছি, যোগাযোগ হয়নি। হতাশ হলে চলবে না, ভায়া। লেগে থাকুন। সে তো এখন আমেরিকার বাসিন্দা। হ্যালা ফ্যালা ব্যাপার নয়। একবার যদি বাগিয়ে ছাগিয়ে পাগার পার হতে পারেন, জীবনটা গরমা গরম হয়ে যাবে।
আকাশ খেয়ে ডেইলি কল রিপোর্ট তৈরী করতে বসে। কিন্তু কিছুতেই মনোসংযোগ হয় না। কিন্তু উপায় নেই শেষ করতেই হবে। প্রতিদিনের রিপোর্ট প্রতিদিনই জমা দিতে হবে। অন্যথায় চাকরি থকবে না। এভাবেই চলে তার জীবন। তারপরও উপরঅলারা বড়ই বে-রহম। কথায় কথায় ঝারি, বদলীর ভয়, প্রমোশন হেল্ড আপ, ইনক্রিমেন্ট কর্তন, চাকরি যাওয়া তো কোন ব্যাপারই না। জীবন থাক আর যাক টার্গেট ফিল-আপ করতেই হবে।
দিন দুই পর সকাল ন’টায় ফার্মগেট এলাকায় ‘জননী রেস্টুরেন্টে’ বসে অপেক্ষা করে আকাশ আর তার তিন কলিগ। এরিয়া ম্যানেজার মৃধা আসেন ঠিক দশটায়।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, রিজিওনাল ম্যানেজার ডেকেছিলেন, আপনাদের কাজের যা অবস্থা। এ মাসে টার্গেট অতিক্রম করতে না পারলে খবর আছে। এবার আকাশের দিকে গোল্লা গোল্লা চোখে তাকান, আপনার কি হয়েছে? সেভ করেননি কেন? কোন সমস্যা? কয়েক দিন থেকে অন্যমনষ্ক দেখছি। তালটি-বালটি ছাড়েন, কাজে মন দেন। আজ এই এলাকায় সার্ভে টিম থাকবে। যান, যান, সেভাবে কাজ করেন, যান। ধমকে উঠেন।
শালা ছুঁচোর বাচ্চা, আকাশ মনে মনে বলে।
প্রত্যেকে কাজের দিক নির্দেশনা নিয়ে চলে গেল। আকাশ গেল গ্রীন রোডে নীলা ডায়াগনোস্টিকে, ডাক্তার আঃ আজিজ পাশাকে ভিজিট করার জন্যে।
তরুণ ডাক্তার পাশা’র চেম্বারে তেমন ভীড় নেই। আকাশ বেশ আগে ভিজিটিং কার্ড দিয়েছে। কিন্তু তখন অব্দি কল হয় নাই। চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দেয় সে। দরজা ভীঁড়িয়ে আধা ঘন্টারও বেশী সময় নিয়ে একজন তরুণীকে দেখছেন। অসুস্থ কিনা বোঝা গেল না। মাঝে মাঝে রহস্যময় হাসির শব্দ। আবার নিরবতা। আকাশ দাঁতে দাঁত পিষে মনে মনে একটা বিশ্রী ভাষায় গাল দেয়। বেলা সাড়ে বারটার দিকে তার ডাক পড়ে।
ডাক্তার পাশা কটমট করে তাকিয়ে, গোখরা সাপের মত ফুসছে, কোন্ কোম্পানির লোক, হ্যাঁ? আপনাকে তো দেখা যায় না। আপনার বসের কাছে অভিযোগ করবো।
এক্সকিউজ মি স্যার! আমি গত সপ্তাহেও ভিজিট করেছি। আপনার হয়তো মনে ...
আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। যা বলার, তাড়াতাড়ি বলেন। এসব ঘোড়ার ডিম কি স্যাম্পল দেন? স্ট্র্যাটেজি চেঞ্জ করেন। গিভ এন্ড টেক পলিসি বোঝেন?
জ্বি, জ্বি স্যার, চেষ্টা করবো। স্যার, আর একটা রিকোয়েস্ট করবো। আকাশ মুখটা পোষা কুত্তার মত করে, স্যার, আশে পাশে সার্ভে টিম আছে। কাইন্ডলি যদি একটু সাপোর্ট দিতেন। তা না হলে আমার বস...।
আরে রাখেন আপনার বস। এখন যান তো, যান। মুখ খিচিয়ে বলে। আকাশ অদৃশ্য গলা ধাক্কা পেয়ে বেরিয়ে গেল...।
আকাশ তার ভাগ্যদেবীকে কখনও দেখেনি। এখন দেখতে ইচ্ছা হয় এবং কিছু প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কোথায় সে...?
সে বাইরে এসে পাশের ঔষধের দোকানে ঢোকে। দোকানদার অন্য দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুকছিল। তাকে দেখেও না দেখার ভান করে। সে বলে, ভাই, অর্ডার টর্ডার দেবেন না? কিছু লাগবে না?
সেই মুহূর্তে আকাশের মোবাইল বেজে উঠে। স্ক্রিনে একটা অজানা নম্বর। কিন্তু ধরতে ধরতে অফ হয়ে যায়। চার্জ নাই। গত রাত্রে চার্জ দিতে বেহুদার মত ভুলে গেছে। একটা হতচ্ছাড়ার মত কাজ করেছে সে। নিজের চোয়ালে কষে থাপ্পর মারতে ইচ্ছা হয়...।
বেচা-কেনা থাকলে তো অর্ডার দিমু। তয় কিছু কিছু হাতে কাইটা বেচপার পারি। আমগো লাভ কি? কম্পানিরে বোনাসটা একটু বেশি দিবার কন। আর আপনে ব্যক্তিগত কি সুবিধা দিবেন, হেইডাও কন। না পারলে যানগা। মুখ খিঁচিয়ে বলে দেকানদার।
আকাশ ঘ্যাচ করে ব্যাগ নিয়ে হন হন করে চলে যায়। মেজাজ ঠিক রাখার জন্য গুন গুন করে গান ধরে, বন্ধু তিন দিন তোর বাড়ি গেলাম দেখা পাইলাম না...।
সেদিন রাত দশটায় বাসায় ফেরে আকাশ। এসেই মোবাইলের নম্বরগুলো খুঁজে বের করে। দুটো নম্বরের অমিল দেখে হোঁচট খায়। ঘটনার অস্পষ্টতা হাতুরির মত মাথায় পেটাতে শুরু করে। সব কিছু কেমন এলোমেলো সুতোর মত জট পাকিয়ে যায়। যতই খোলার চেষ্টা করছে ততই প্যাঁচ খায়। কি হতে পারে...? শফিক সাহেব না থাকায় ঘরটা কেমন ফাঁকা মনে হয়। আগামীকাল ছুটি। সম্ভবত সেসব কারণে ঘুমটাও বিট্রে করে। শুয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে। অপরিচিত নাম্বার দু‘টো তাকে অস্থির করে তোলে। ওগুলো বাইরের নাম্বার বলেই তার মনে হয়। ফোন-ফ্যাক্স এর দোকানে কয়েক বার চেষ্টা করেও সংযোগ ঘটাতে পারেনি। কি হতে পারে? ওকি তাহলে সত্যি সত্যি এরই মধ্যে ভুলে গেল? মাথার ভেতর এক অসহ্য যন্ত্রনা হয়। সে আর কিছুই ভাবতে পারে না। সারা দিনের খিস্তি-খেওড়গুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠে। ডাক্তার পাশার চেম্বারের তরুণীর অস্বাভাবিক হাসির শব্দটার কথা মনে হতেই তার দেহটা শির শির করে উঠে। ওটার সঙ্গে কিসের একটা মিল আছে...। মিনি পর্দায় দেখা কোন নীল ছবি...? নাকি অন্য কিছু...? কিছুতেই মনে করতে পারে না। সব কিছু যেন দুর আকাশের মেঘের মত অস্পষ্ট মনে হয়। মন একটু একটু করে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে অচিন দেশে কোন এক স্বপ্নের গভীরে তলিয়ে যায়...।
আকাশ বিসিএস করে দঃ কোরিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে রাষ্টদূতের পি.এস হিসাবে ফরেন মিনিস্ট্রিতে চাকরি নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে।
বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রী জাফর সাদেক কী এক কাজে দঃ কোরিয়ায় এসেছেন। মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন উপলক্ষে হাইকমিশনের লনে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ আকাশের দম বন্ধ হবার দশা হয়। সে কী ভুল দেখছে? সবার অলক্ষ্যে চিপের এক গোছা চুল টেনে পরীক্ষিা করে। মানুষে মানুষে এত মিল? সবশেষে গাড়ী থেকে নামলেন যিনি অর্থাৎ মন্ত্রীমহোদয়ের বন্ধুর বউটি হুবহু তমিস্রার মত! আকাশের মনে হয় তার মস্তিস্কের সব নিউরোন গলে মাথাটা পারদের মত ভারী হয়ে গেছে। সে ভারসাম্যহীন হয়ে কোন অন্ধকার গহীন তলদেশবিহীন কোন বায়ু শূন্য গর্তে মাথা গেড়ে জনম জনম ধরে তলিয়ে যাচ্ছে...।
আকাশ মহাশ্চর্য হয় পরিচয় পর্বে তমিস্রা যখন তাকে না চেনার ভান করে। রাতে চোখের ঘুম আকাশের তারা হয়ে অসহ্যরকম ভেংচি কেটে তাকে লজ্জা দিয়ে যায়। প্রতিটা ইট, কাঠ, মাটি, বাতাস পরিহাস করে, বিদ্রুপ করে, অট্টহাসি দেয়, আকাশ তুমি ব্যর্থ... ! ছি আকাশ...! ছি...!
এক সময় আকাশের মনে হয়, সাগর কিংবা আকাশ এতই বিশাল যে তাকে কখনও কখনও তুচ্ছ কোন কিছুর চেয়েও তুচ্ছতর মনে হয়...।
হঠাৎ আকাশের মোবাইলটা বেজে উঠে। আকাশ ভাবে, এই মাঝ রাতে নিশ্চয় তমিস্রা। কে তমিস্রা? হু ইজ সি? সি ইজ নো মোর ...! তমিস্রা! তমিস্রা মিথ্যে...! সে ফোনটা কেটে দেয়।
আবারও মোবাইল ফোন বেজে উঠে। আবারও ফোন কেটে দেয়। আবারও বেজে উঠে। অনবরত বেজেই চলে...। আকাশ রাগে ক্ষোভে চিৎকার দিয়ে উঠে, ডোন ডির্স্টাব মি। আমি তমিস্রা নামে কাউকে চিনি না! চিনি না! চিনি না...! চোখ মেলে নিজেকে আবিস্কার করে বিছানায় হাত-পা ছুঁড়ছে। এই মাঘ মাসের কঠিন শীতেও ঘেমে একাকার। তাহলে এতোক্ষণ সে কী স্বপ্ন দেখছিল...? আর তখন টের পায় বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা সত্যি সত্যিই অনবরত বেজে চলেছে। দ্রুত স্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে ফোনটা রিসিভ করে, হ্যালো!
ওপাশ থেকে সুরেলা নারী কন্ঠ, হ্যালো! আকাশ!
সে চমকে উঠে। মনে হয় কোটি বছরের চেনাকে নতুন করে চিনছে। আকাশের কন্ঠ যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে যেন ভাষা না জানা এক নাদান শিশু। ইতিপূর্বে অনেকবার এমন পরিস্থিতিতে লেজে গবরে অবস্থা হয়েছে। তারপরও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে আবেগ মেশান গলায় বলে, তমিস্রা!
বল আকাশ! যান্ত্রিক ফর ফর শব্দ সমেত মিষ্টি কন্ঠ।
তুমি ভাল আছ...?
হ্যাঁ, তার আগে বল তুমি মাইন্ড করনি তো? প্রথমবার প্রফেসরের চেম্বারে আর পরেরবার চার্জ ছিল না। বিশ্বাস কর, ইচ্ছা থাকা সত্বেও ফোনটা ধরতে পারি নি। যেন আকাশ জবাবদিহি করছে।
এসব কি বলছো আকাশ? প্রফেসর, চার্জ ছিল না, ফোন ধরা।
মাত্র তিন সেকেন্ড। আকাশ বুঝে নেয় ওগুলো তাহলে তমিস্রার ফোন ছিল না।
নাহ্, কিছু না, একটা ভয়ানক স্বপ্ন দেখছিলাম। তোমার ফোন পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
কি দেখছিলে, বল না, নিশ্চয় কোন সুন্দরী...?
কি যে বল? রিপ্রেজেন্টেটিভ’রা কি আর ওসব দেখে? তবে কখনও কখনও জীবনের বাস্তব ঘটনা গুলোই স্বপ্ন হয়ে কাউকে কাউকে সতর্ক করে দেয়। বাদ দাও। তোমার আমেরিকা কেমন লাগছে?
উফ! কি যে ধকল গেল। টানা তিন দিন বিমান ভ্রমন। দুই দিন বিশ্রাম। তার পর গুছিয়ে উঠতে এই সব মিলে আট দশ দিন কেটে গেল। এখনও তেমন কোথাও যাওয়া হয় নি। এরই মধ্যে যা চোখে পড়েছে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
তমিস্রার যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটা মনে হচ্ছে বহু দূর-দূরান্ত থেকে ভেসে আসছে আর কেমন যেন বাতাসের গতির মত উঠা-নামা করছে। তার সাথে অতিরিক্ত একটা শব্দ, শো..., শো..., শো...। আকাশ যেন সারা দিনের প্রতিটা মূহুর্ত তমি¯্রা আর ঐ সব শব্দের সাথে একাকার হয়ে থাকে। যেন এক অনন্তের পথে সীমাহীন বিরহ যাত্রা...।
প্রায় বছর সাতেক আগে মনে না রাখার মত গুরুত্বহীন এক দিনে তমিস্রার সাথে আকাশের প্রথম পরিচয়। আকাশ তখন ঢাকা ভার্সিটির বায়োকেমিষ্ট্রির তৃতীয় বর্ষে। আর তমিস্রা মাইক্রোবায়োলজীর প্রথম বর্ষে। পরিচয়ের সূচনা ছিল নিতান্তই ফ্যাকাশে।
তমিস্রা আর দশ জনের মতই সাধারণ। তবে বান্ধবীরা ঈর্শা করতো ওর বাগপটুতার কাছে বার বার হেরে যেত বলে। এ ব্যাপারে সে ক্যাম্পাসে শীর্ষ স্থান নিয়ে আছে। সাধারণ মানের পারিবারিক পটভূমির এই মেয়ে যে চন্দ্রকলার নিরস তত্তে¡র মত একদিন অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে অন্ধকার রাতে আলো ছড়াবে কেউ তা ভাবার সময় পায়নি। দরিদ্র ঘরে সীমাহীন অভাব অনটনের ভয়াল মূর্তির প্রতিচ্ছবি তার মাঝে কেউ কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। সদা চঞ্চলা চকিত ঐ হরিণী নয়না ক্যাম্পাসে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। পারুক বা না পারুক, অন্তত ডজন খানেক যুবক তার জন্য যে কোন সময় বুক চিরে নিজের কলিজা নিজ হাতে বের করে তার সামনে রাখতে প্রস্তুত ছিল। পরিবারের অভ্যন্তরেও তার জনপ্রিয়তার কমতি ছিল না। দুই ভাইয়ের একমাত্র ছোটবোন সে। ডি ভি-১০ তাদের ভাগ্য বিধাতা হয়ে তার বড় ভাইয়ের ঘাড়ে একদিন ভর করেছিল। বিধায় বৃদ্ধ বাবা-মা, ভাই-ভাবীরা বছর পাঁচেক ধরে আমেরিকার বাসিন্দা। এখন সে নিজেও।
আকাশের পারিবারিক দিকটা এক কথায় তিমিরাচ্ছন্ন এবং করুণ। ফুফুই সব। বলতে গেলে একমাত্র সেই তার সকল মায়া-মমতা, সুখ-দুখ, হাসি-কান্নার আধার। সেই ফুফুর কাছে সে যা পেয়েছিল তাতে কোন দিন জানতে আগ্রহটুকু হয়নি কে তার আসল মা এবং বাবা। বুদ্ধি হবার পর শুনেছিল, শিশু অবস্থায় তার বাবা মারা যায়। তার কিছুদিন পর আকাশকে ফেলে তার জন্মদাত্রী একদিন এক অশুভ সকালে লাপাত্তা হয়। বোধ হয় তাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট আশ্চর্যরকমভাবে তমিস্রার থেকে বিপরীত।
অনেক দিন হয়ে গেল। বারান্দার ওপাশের বাগানে নানা জাতের ফুলের মাঝে পলাশ গাছটা আগুন রঙা ফুলে ছেয়ে গেছে। আকাশ প্রতিদিন সকালে মেসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করে। পাখিদের মিষ্টি কন্ঠের গান শোনে আর বাগানের ফুলগুলোর সাথে মনে মনে কথা বলে। প্রতিটি পলাশ ফুল যেন এক একটি ভিন্ন ভিন্ন সত্ত¡ার তমিস্রা। হাজার তমিস্রা ফুলের মাঝে আকাশ কেবল একটাই ভ্রমর। এমনিভাবেই কেটে যায় তমিস্রা আর আকাশের চাঁদ-তারা সাদৃশ্য জীবন। ঐ আকাশের চাঁদ আর তারার যেমন দুরত্ব, ঠিক অমনটা না হলেও আকাশ আর তমিস্রার মধ্যেকার দূরত্ব অনেক। একমাত্র যোগাযোগ ফোন। আকাশের ফোনের সীমাবদ্ধতা ব্যাপক। আর তমিস্রার কাছে সেটা ভাত মাছ। তাইতো তাকে নিয়ত হা করে থাকতে হয় চাঁদের মত সূর্যের কাছ থেকে আলো পাবার আশায়। সেদিন রাত এগারটার মত হবে। তৃষিত আকাশে চাতকের কাছে এক ফোটা জলের মত তমিস্রার ফোন পায়...।
হ্যাঁ আকাশ, কি কর?
কি আর করবো, ব্যাগ টানা মানুষের যা করণীয় তাই।
কেন, ঐ চাকরিটা তুমি এখনও ধরে রেখেছ? বিশ্বাস কর, আমার ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু উপায় কি, বল। আমি তো তোমার মত ইয়া বড় কপাল নিয়ে জন্মায় নি।
ওহ হো! তোমাকে তো বলিনি, আমি হার্বার্ড ইউনিভার্সিসিটিতে ‘প্যাথলোজিক্যাল মাক্রোঅর্গানিজম অব হিউম্যান বিং’ এর উপর পিএইচ.ডি. করছি। আর তুমি তো জান আমি একটা হেল্থ কেয়ার সেন্টারে মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসাবে পার্ট টাইম যব করছি।
তোমার শুভ কামনা করি।
আকাশ! একটা কথা বলি?
বল, তমি¯্রা।
যদি কোন দিন সুযোগ হয়, তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে আসার, তবে কি আসবে? তোমার তো আবার নাক উঁচু ভাব আছে।
থাকার ভেতর আছেই ঐ এক নাক। তাকেও তুমি ছেঁটে ফেলতে বল?
নাহ বাবা! তোমার সাথে কথায় পেড়ে ওঠা দায়। হাজার হলেও তুমি আমার বিতর্ক প্রতিযোগীতা দলের দলনেতা।
তমিস্রা!
হু! শুনছি, বল।
ওখানে কি বসন্ত কাল হয়? জানো, এখানে এখন বসন্ত। তোমার কি মনে পড়ে সেসব দিনের কথা।
একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পায় আকাশ। সেটা যেন দুজনের যোজন যোজন দুরত্বকে আরও অসীম করে তোলে...।

সেদিন আকাশ ঠিক সকাল ন‘টার সময় পরি-মরি করে মটর সাইকেল থেকে নেমে ফার্মগেটের ‘জননী রেস্টুরেন্টে’ ঢোকে। সোহরাব মৃধা রাগে ফোঁস ফোঁস করছেন। তিনি ধমকে উঠেন, চাকরি করার ইচ্ছা আছে না নাই। দেরি করাটা আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর গত শুক্রবার কোথায় ছিলেন? মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল। এভাবে চলতে থাকলে রিজিওন্যাল ম্যানেজারের কাছে কমপ্লেইন করবো।
আকাশের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যায়, শুক্রবার ছুটির দিন আমি যেখানে খুশি যেতে পারি। ফোনটা নিতান্তই ব্যক্তিগত। কম্পানির দেওয়া নয়। সেটা খোলা রাখা না রাখটাও আমার ব্যক্তিগত ব্যপার।
গলা নামিয়ে কথা বলেন। কম্পানির শৃংখলা মানছেন না। চাকরি নট করে দেব।
পারলে করেন।
ঐ দিন বেলা এগারটার দিকে আকাশ মগবাজারের ‘প্রশান্তি নাসিং হোম’-এর অন ডিউটি ডক্টোর’র চেম্বারের সামনে আকাশ পায়চারি করে। নাসিং হোমের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান ডাঃ রাকা রাউন্ডে আছেন। তিনি কাজ শেষ করে চেম্বারে আসার পথে আকাশকে দেখে মিষ্টি হেসে হাত নেড়ে বলে, হাই, আকাশ ভাই, কেমন আছেন?
আকাশ অন্যমনস্ক ছিল। তড়িঘড়ি সটাং দাঁড়িয়ে, আস্সালামুআলায়কুম, ম্যাডাম কেমন আছেন।
ওয়ালায়কুমুস্সালাম, আসুন ভিতরে বসি।
চেম্বারে বসতে বসতে ডাঃ রাকা বলে, আচ্ছা আকাশ ভাই আপনাকে কতদিন বলেছি আমাকে ম্যাডাম বলবেন না। আমি প্রফেসর, না কি আপনার বস? আমি কিন্তু আপনার ফুফাত ছোট বোন রুহির বান্ধবী।
জানি, কিন্তু একটা কম্পানিতে ছোট পোস্টে চাকরি করি। তার তো কিছু রুল্স রেগুলেশান আছে।
বেশ তো। সেটা যেখানে প্রয়োগ করার করবেন। ভাল কথা রুহির কাছে শুনেছি আপনি নাকি খুব সুন্দর কবিতা লেখেন। বিশ্বাস করিনি। সেদিন ‘কালের কন্ঠে’ দেখলাম। কি যেন, কি ...। মাথা চুলকিয়ে মনে করার চেষ্টা করে ডাঃ রাকা। তারপর বিড় বিড় করে আবৃত্তি করে...
তুমি যদি যাও
সদা প্রসারিত ঐ আকাশে
সং সেজে, চুপি চুপি,
কৃঞ্চ গহŸর, আকাশগঙ্গা, গ্রহাণুপুঞ্জের মিছিলে
গহীন অলীক নীলে, এই বুকে মিশে...।
কি আকাশ ভাই, কিছু বলছেন না যে?
আকাশ লম্বা একটা শ্বাস লুকিয়ে গেল, সত্যি বলতে কি, এই প্রফেশানে যব সেটিস্ফ্যাকশান নাই। ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব।
বেশতো, তার আগে একটা কিছু তো করতে হবে, নাকি?
দেশে থাকতে ইচ্ছা করে না।
তো কোথায় যাবেন? মিড্ল ইস্ট? মালায়েশিয়া? খুব একটা লাভবান হবেন বলে মনে হয় না।
ওসব না, আমেরিকা।
সেখানে যাওয়া চারটিখানি কথা না।
জানি। আমার এক ফ্রেন্ড আছে ওখানে। ওই সব ব্যবস্থা করবে, বলেছে।
যেতে পারলে ভাল। তবে সহজ ব্যাপার নয়। ভিসা দেয় না। আমার বিশ্বাস হয় না, আপনি যেতে পারবেন।
আই ক্যান চ্যালেঞ্জ। আমি যাবোই যাবো।
আকাশ লক্ষ্য করে ডাঃ রাকা ধীরে ধীরে কি একটা চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে। গভীর থেকে গভীরে...।

মাস তিনেক পরের ঘটনা। জ্যৈষ্ঠ মাসের আম পাকা গরম। আজ যেন সেটা হঠাৎ তেতে উঠেছে। গাছের পাতাগুলো ওদের সাথে যুদ্ধে হেরে ঝিমিয়ে পড়েছে। থম থমে অবস্থা। ঝড়-বৃষ্টির সংকেত বলে মনে হয় আকাশের। বৃহস্পতিবারের রাত আজ। মেসে ফিরে দরজা খুলতে যাবে ঠিক সে সময় মেসের কেয়ার টেকার একটা খাম দিয়ে গেল। আকাশ খাম খুলে চিন্তিত হয় তবে অবাক হয় না।
আকাশের মনের ভেতর একটা অশুভ ইংগিত সূঁচের মত খোঁচাতে শুরু করে। কাল-বৈশাখির কালো মেঘে ছেয়ে যায় তার মন। রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। ইতোমধ্যে ঝড় আর একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কেন যেন বার বার কবিতার ছন্দগুলো মনের কোনে ভাব জমাতে শুরু করে। আকাশ বসে গেল তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে। লেখাটা শেষ পর্যায়ে। হঠাৎ সেল ফোন বেজে উঠে...।
ডঃ রাকা এত রাতে?
ক্লিনিকে নাইট করছি, হাতে কাজ নেই, চোখে ঘুম নেই। তাই ফোন করলাম। আকৃষ্ট করে এমন, বাঁশীর মত মিষ্টি একটা কণ্ঠ।
ও! আচ্ছা।
কি করছেন? আকাশের চোখের সামনে রাকার হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠে।
নাহ! তেমন কিছু না।
আমি জানি আপনি কি করছেন। আমার ইন্ট্যুশন পাওয়ার সাংঘাতিক।
বেশ বলুন, মিলিয়ে দেখি।
আকাশ ভাই! আমি রুহির বেস্ট ফ্রেন্ড, আমাকে তুমি বললে খুশি হব। রাকার কন্ঠে মিষ্টি শাসনের সুর।
বেশ, তাই হবে, বল, কি করছিলাম?
আপনি কবিতা লিখছিলেন।
জানতাম তুমি এটাই বলবে।
একটু শোনান না, প্লিজ! প্লি-জ।
শেষ হয়নি।
যতটুকু হয়েছে ততটুকুই বলেন।
ভাল্লাগবেনা।
লাগবে, প্লি ...জ ...।
তবে শোনÑ

‘ভালবাসার সাত কাহন’

সাত মহাদেশের পথে পথে
সাত সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে
তোমাকে নিয়ত খুঁজি
রাকা।
অবশেষে তুমি এলে
ঘোর তমিস্রা পেরিয়ে
রামধনুর সাত রঙ ভালবাসা নিয়ে
সাত আসমানের ওপাড়ে
চাঁদের ত্বকে পাথরের ঘরে
বাসর সাজাব বালু নদীর পাড়ে।
সাত সুরে গান গেয়ে
তুমি অদৃশ্য হলে
‘সপ্ত ঋষির’ আড়ালে।
সাত সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে
সাত আসমানের ওপাড়ে
তোমাকে নিয়ত খুঁজি
রাকা।

একটা কথা সত্যি করে বলবেন? রাকা বলে।
কি কথা?
কবিতাটা কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন?
যে লিখেছে এবং যাকে উদ্দেশ্যে লেখা, তারা ঠিক ঠিক বুঝে নেবে।
বিপ বিপ বিপ...। হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল...। আকাশ ঘুমিয়ে পড়ে...।
ভাদ্র মাসের প্রথম দিকের এক রাত। কখনও ঝুম বৃষ্টি, আবার গুড়ি গুড়ি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমক আর মেঘের গর্জন। ঢাকাবাসীদের দূর্ভাগ্য ব্যাঙের ডাক শোনা থেকে তারা বঞ্চিত। এমনি এক রাতে তমিস্রার ফোন আসে...।
ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
হাই তুলে আকাশ বলে, নাহ্, ঘুমাই নি, শুনছি বল।
ফুফু কেমন আছে?
খুব একটা ভাল নেই। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম। আমাকে জড়িয়ে খুব কাঁদলো। বললো, যাদের পেটে ধরেছিলাম তারা আমাকে ফিরেও দেখে না। তোকে পেটে ধরিনি, বুকে ধরেছিলাম। আর কত দিন আমাকে এভাবে টানবি। ছোটবেলা তুই ছিলি এক হতভাগা, তাই তোকে অভাগা বলে ডাকতাম। ওরে আমার অভাগা, আয় বাপ, আয়, আমার বুকে আয়। আকাশ চোখের পানি মুছলো...।
তারপর বল তুমি কেমন আছ, চাকরি কেমন চলছে?
ল্যাংড়ার আবার দৌড়।
তোমাকে পাশপোর্ট তৈরী করতে বলেছিলাম, করেছ?
করেছি।
পাসপোর্ট, ছবি রেডি রাখবে। আমি কিছু কাগজ-পত্র পাঠাব, ফিল-আপ করে দেবে। ব্যাংক সলভেনসির ব্যবস্থা আমি করে দেব।
আমিা সত্যি ওখানে যেতে পারবো?
তো।
আচ্ছা, তোমাদের ঐ দেশে খুব বৃষ্টি হয় নাকি, এখানকার মত।
বোধ করি হয়, খেয়াল করা হয়নি।
তখন কি ব্যাঙ ডাকে?
তমি¯্রা কোন উত্তর দেয় না। মনে হয় সে কিছু একটা ভাবছে...।
আকাশ আবার বলে, তোমার কি মনে আছে, টি এস সি-র সেই সব দিনের কথা? তুমি বৃষ্টি দেখলে কেমন যেন হয়ে যেতে। আর উঠতেই চাইতে না। এক দিন তো বৃষ্টি যেন আমাদের পেয়ে বসেছিল। হচ্ছে তো হচ্ছেই। অথচ পরের দিন তোমার পরীক্ষা। অপেক্ষা করে করে, শেষ-মেশ যেতে থাকলে, রোকেয়া হলের দিকে। আমাকেও টেনে নিয়ে গেলে। তারপর দুজনে ভিজে কুড়ে একাকার। হঠাৎ অন্ধকার একটা জায়গায় যেতেই বিদ্যুৎ চমকালো, অবিশ্বাস্য ভাবে কেমন যেন ঘনিষ্ট হয়ে গেলাম আমরা। আমি বললাম, যাও, কাল না তোমার পরীক্ষা? তুমি আমার বুকের ভিতর মুখ নিয়ে চুপি চুপি বললে, পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে...।

আকাশের মোটর সাইকেলটা এসে থামে ঢাকা ভার্সিসিটির লাইব্রেরীর পাশে ঠিক শিমুল গাছের নীচে। আকাশের মন যেদিন ভীষণ খারাপ হয় অথবা খুব ভাল হয়, সেদিন সে সব কিছু ফেলে এখানে আসে। বসে থাকে ততক্ষন, যতক্ষন মন চায়। বলা যায় আজ ভাল-মন্দ দুটোর সংমিশ্রন। গত মাঘের আগের মাঘে যেদিন তমিস্রা আমেরিকায় যাবে সেদিনও এখানে আকাশ তমি¯্রার সাথে বসে প্রায় দুই ঘন্টার মত কাটিয়েছিল। বিদায় মূহুর্তগুলো দুজনে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। আকাশ বরাবরই কম কথা বলে। তমিস্রার ননস্টপ কথা বলার অভ্যাস। সেদিন কেন যেন ও চুপসে গিয়েছিল...।
ঘুরেফিরে একই কথা, যেতে ইচ্ছা করছে না, যেতে ইচ্ছা করছে না, যেতে ইচ্ছা করছে না।
আকাশ বলেছিল, এটা কি তোমার মনের কথা?
তমিস্রা আর কথা বলেনি। যাবার বেলায় আকাশ ওর দিকে তাকাতে পারে নি। সেদিন শিমুল গাছটা মৃত প্রায় মনে হচ্ছিল। শীতার্ত গাছটাতে একটা পাতাও অবশিষ্ট ছিল না। ওটা সেদিন শোকের মাতমে অংশ নিয়েছিল আর এটা ওদের মাঝে আজীবন সাক্ষী হয়ে থাকবে। আহত পাখির মত সেদিন আকাশ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অবশেষে বিমান বন্দরে গিয়েছিল। যদিও শেষ দেখা হয়নি।
এই শিমুল তলার আর একটা গুরুত্ব আছে ওদের দুজনের কাছেই। ঢের দিন আগে তমিস্রার সাথে পরিচয় পর্ব পার করে, এক বসন্তে পরিনয়ের সূত্রপাত হয়েছিল এই শিমুল তলায়। সেদিন তমিস্রা শিমুল রঙের লাল শাড়ী পরেছিল। আকাশ হাসতে হাসতে বলেছিল, বিয়ের পিড়িতে বসার আগেই নতুন বউ সেজে এলে? তারপর একভাবে তাকিয়ে ছিল শিমুল গাছটার দিকে...।
তমিস্রা নিজের পিঠ আকাশের পিঠে সেটে রেখে বসেছিল আর অভিমান ভরা কন্ঠে বলেছিল, আমাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করছে না, বললেই পার।
আকাশ ঘুরে তমিস্রার চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেছিল, তমিস্রাকে কি কেউ দেখতে পায়?
বসন্তের সেই দিনে ঐ শিমুল গাছকে লাল বেনারশি শাড়ী পরা নতুন বউ এর মত লাগছিল...।
আজ আবার সেই বসন্ত, সেই শিমুল গাছ, সেই রঙ্গে সেজেছে। শুধু ও নেই...।
আকাশ বার বার ঘড়ি দেখে। মনে হল কারোর অপেক্ষায় আছে। তাকে উত্তেজিতও মনে হচ্ছিল। হাতে দুটো কাগজের খাম। ঠিক বেলা সাড়ে দশটায় ডঃ রাকা এল।
সেই প্রথম দূর থেকে চিৎকার দিয়ে মুক্তার মত দাঁতে ঝিলিক দিয়ে টেনে টেনে কথা বলে যা কিনা আকাশ তার দিকে না চেয়েও অনুমান করতে পারে, আকাশ ভাই, অনেক দিন পর জরুরী তলব। ব্যাপার কি? আমি তো ভেবেছিলাম আপনে কব্বে আটলান্টিক সাগড় পাড়ি দিয়েছেন।
শোন রাকা- দুটো খবর আছে, একটা ভাল আর একটা মন্দ। কোনটা আগে শুনবে?
মন্দ কিছু শুনতে চাই না, ভালটাই বলুন।
মন্দটা নিয়ে আমি চিন্তিত নই, তবুও ওটাই আগে বলছি। ছোট খাম থেকে একটা চিঠি বের করে রাকার হাতে দেয়, কম্পানির টারমিনেশান লেটার। আই ডোন বদার ইট। আর এই যে বড় খামটা দেখছো এটা আমি এখনও খুলিনি। এটা তোমার সামনে খুলবো। কাল রাতে পেয়েছি। সেই থেকে উত্তেজনা চেপে রেখেছি। তুমি একদিন চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলে, বলেছিলে জীবনেও ভিসা হবে না। এটা আমার ফ্রেন্ড পাঠিয়েছে, এই দেখো, আকাশ খামটা ছিড়ে কিছু কাগজ পত্র বের করে। রাকা আর আকাশ দেখে ভিসার কগজ-পত্রের সাথে ছোট্ট একটা হাত চিঠি। আকাশ চিঠিটা পড়েতে থাকেÑ

আকাশ,
এখানে আমার সাথে চাকরি করে বাংলাদেশের একটা ছেলে, ডাঃ রফিকুজ্জামানের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তিন মাস পর বিয়ে। দাওয়াত পত্র পাঠালাম। এটা আমেরিকান এ্যাম্বাসিতে দেখালেই ভিসা হবে। অন্যথায় ভিসা হবে না। পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সব কাগজ-পত্রই দেয়া আছে। আশা করি ভিসা আটকাবে না। ভাল থেকো।
ইতি,
তমিস্রা।

আকাশের হাত থেকে খাম দুটো মাটিতে পড়ে যায়।
মনে হয় অনেক দুর থেকে একজন ওকে ডাকছে, ওরে আমার অভাগা, আয় বাপ, আয়, আমার বুকে আয়...।
আকাশ সেদিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত ছুটছে...।
রাকা অদুরে লাইব্রেরীর দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। দুহাত বুকে ভাঁজ করা। মুখটা একটু কাত। সে মৃদু হাসছে। ও আকাশকে বলে, অন্ধকার রাত্রি পেরিয়ে একদিন কি আকাশে পূর্ণিমা ওঠে না?
আকাশ হাটতে হাটতে পিছনে মুখ না ঘুরিয়েই বলে, পূর্ণিমার নিজের কোন আলো নেই।

































































চাকা




রাত শেষে সূর্যের আবির্ভাব হতে না হতে এলাকার সব অর্ধসভ্য অর্ধউলঙ্গ মানুষেরা হর পিল্লার কাঠ লতা গুল্মের তৈরী সব চেয়ে সুন্দর বাড়িটার চার পাশে জড় হয়। সে তখন খেজুরের থ্যাবড়ান ডাল দিয়ে মেছওয়াক করছিল। সুঠাম দেহের ঝাকড়া জটাধরা চুলঅলা উঠতি বয়সি যুবক মাকালা নেতৃতে ছিল, উজ্জ্বল চোখে উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে, সর্দার আর কত দিন এখানে না খেয়ে মরার জন্যে পড়ে থাকব?
পরপর কয়েক বছর খড়ায় ফসল পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে। বন উজার। শিকার বানিয়ে খাওয়ার মত বন্য পশু-পাখিরা অনেক আগেই উপত্যকা ছেড়ে চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। হর পিল্লার দাদার দাদারা অথবা তার পূর্বপুরুষেরা অনেক অনেক আগে আরও পশ্চিমে বাস করত পাহাড়ের ঢালে উচু উচু জায়গাগুলোতে। তারা সেখানে পাথরের হাতিয়ার বানাতে শিখেছিল। পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। পশু-পাখি শিকার করে ঝলসিয়ে খেতে যেয়ে বুঝেছিল মাটি পুড়ে শক্ত হয়। তখন কাদা মাটি পুড়িয়ে তৈজস-পত্র, লাঙ্গল, হাতিয়ার, খেলনা বানানোর কায়দা রপ্ত করেছিল। সেখানকার প্রায় বন্য স্বভাবের লোকেরা কাউকে ভয় করত না। সামান্য ব্যাপারেই একজন আরেকজনের মাথা পাথর দিয়ে গুড়িয়ে দিত। হাত পা ভেঙে লুলা বানিয়ে দিত। একসময় হর পিল্লার দাদার দাদারা তাদের কিছুটা সভ্য করে গড়ে তোলে। ওদের কওমভুক্ত নারীরা সেইসব পুরুষের অধীনে থাকত যারা তাদেরকে খেতে পরতে দিতে পারত। একটা বয়স অবধি নারীরাই শিশুদের দেখভাল করত। তারা ভয় করত বিকট বিশাল কাল পাহাড়কে। সেটাকে তারা দেবতা ভেবে মাথা নত করে পূজা দিত। তারা শপথ করত কাল পাহাড়ের সামনে ভাল কাজ করার জন্যে, মানুষ হত্যা না করতে আর অন্যের অধীনস্ত নারীদের সম্ভোগ না করার জন্যে। তাদের বিশ্বাস ছিল এতে তাদের মঙ্গল হবে। শপথ ভাঙলে অমঙ্গল হবে। একদিন তাদের কওমের ভিতর একদল উলঙ্গ অসভ্য আদিম মানুষ অতর্কিতে হামলা চালায়। তারা স্থানিয়দের হত্যা করতে থাকে, নারীদের শ্লীলতাহানী করে, খাদ্য-শস্য শেষ করে ফেলে এমন কী কাঁচা ফসল খেয়ে ফেলতে থাকে। হর পিল্লার অবশিষ্ট লোকেরা কোনমতে জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচে এবং এক মাসের পথ পাড়ি দিয়ে এই উপত্যকায় আবাস গড়ে তোলে। এসব পিল্লার কওমের লোকেরা তার মুখ থেকে বহুবার শুনেছে।
হর পিল্লা গড়গড়া ও কুলি করে ঢকঢক করে পানি পান করে তাদের দিকে বেদনার্ত চোখে তাকায়, সারা রাত সেটাই ভেবেছি। শুনেছি পূব দিকে আরও একমাসের রাস্তা পাড়ি দিলে একটা নদী আছে, পানির অভাব নাই। পশু-পাখি, টোল-টোপলা, খাদ্য আর হাতিয়ার নিয়ে রওনা কর। বাপ-দাদার গড়ে তোলা এই বসতি ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হয়। তবুও যেতে হয় বেঁচে থাকার জন্যে।
হর পিল্লার দল নিয়ে সিন্ধুর তীরে পৌঁছতে এক মাসের বেশি সময় লেগে যায়। তারা তীর ঘেষে গাছ-পাতা-লতা-গুল্ম দিয়ে বাড়ি-ঘর বানিয়ে থাকে আর বনের ফল-মূল পশু-পাখি শিকার করে খায়। বেশ যাচ্ছিল। কিন্তু দুই-চার বছর পরপর তারা কখনও কখনও বন্যার কবলে পড়ে। ¯্রােতে বাড়ি-ঘর তৈজসপত্র খাদ্য ভেসে যায়। ভেসে যায় আদম সন্তান। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভাল থাবায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে তাদের মেরুদণ্ড নাকাল করে পেলে। শিশু অসুস্থ্য বৃদ্ধ আর অসহায়দের হাত পেতে খাওয়ার যে প্রবণতা অনেক আগে থেকেই চালু ছিল সেটা এখন অনেক বেশি হয়ে যায়।
যে পানির জন্যে তারা নদীর তীরে আশ্রয় নিয়েছিল পানিই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। নদীর তাণ্ডব-লীলা দেখে তারা তাকে দেবতার আসনে বসায়। মানত করে, কৃত কুকর্মের জন্যে আফসোস করে। তবুও আর কত কাল খোলা আকাশের নিচে? একসময় তাদের পাত্তারি গোটাতেই হয়। দূর্দমনীয় মানব সন্তান ভাঙা মন জোড়া লাগায়। সরে যায় নদীর অদূরে উচু নিরাপদ স্থানে। এবার ঠুনকো ঘর নয় মজবুত কিছু। পাথর কেটে কেটে বাড়ি বানায়। তাতে অনেক কষ্ট। মাথায় নতুন বুদ্ধি খেলে মাটি পুড়িয়ে ইষ্টক খণ্ড বানিয়ে কাদা মাটি গেথে মনের মত ঘর বানায়। একটার পর একটা নতুন ইমারত গড়ে উঠে। আস্তে আস্তে সেখানে নতুন জনপদের পত্তন হয়। হর পিল্লা আর কওমের লোকেরা এসব দেখে, চোখ জ্বলজ্বল করে, ভবিষ্যতের ভাবনায় ত্বারিত হয়।
একদিন হর পিল্লা সবাইকে ডাকে, এই যে মাথার উপর অগ্নি-গোলক সূর্য, খড়-¯্রােতা নদী, অজেয় পাহাড় সবই দেবতা। তোরা তাদের পূজা কর, অবাধ্য হবি না। না হলে ওরা তোদের পুড়িয়ে মারবে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, খেতে দেবে না। ওদের স্বাক্ষি রেখে এই জনপদের নাম রাখলাম হরোপ্পা।
মাকালার বয়স এখন মাঝারি। তার অধীনে তিনজন নারী। কিন্তু কারোর প্রতি মন নেই। সে শুধূ মদিরাকেই খুঁজে বেড়ায়। একদিন তেতে উঠা উষর দুপুরের নিঃশব্দ ক্ষণে দেখে মদিরা খনন করা কুপ থেকে পানি তুলে কাদা দিয়ে মাথা ঘষে স্নান সেরে ঝামা দিয়ে পা ঘষছে। আস্তে আস্তে কাছে যায়, শোন মদিরা, পিল্লাকে বলে তোকে ঘরে তুলে নেব, তুই খাওয়া-পরার জন্যে অন্য পুরুষের সাথে মিলিস না।
মদিরা দীর্ঘশ্বাস নেয়, আদি ব্যাবসা ছাড়ি কিভাবে?
মাকালার মন খারাপ হয়। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। হঠাৎ পায়ের আঘাতে একটা গোল পাথর গড়াতে থাকে। মাথার ভিতর বিদ্যুৎ খেলে যায়। ওটাকে নিয়ে বাড়ি যায়। ঘষে ঘষে চাকার মত বানায়। খাওয়-দাওয়া সব ভুলে একবার এদিক থেকে ওদিক ওদিক থেকে ওদিক গড়ায়। দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকলে অধীনস্ত মেয়েরা বিরক্ত হয়, হুমকি দেয়, মর্দা মানুষ কাজ করিস না, খেতে পরতে না দিলে অন্য পুরুষের ঘরে উঠব।
সেই যুগে মানুষ ভারি জিনিস মাথায় বহন করত, অথবা পশুর পিঠে চাপিয়ে দিত। অনেক বেশি ভারি জিনিস হলে গাছের গুড়ি তলে দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এক জায়গা অন্য জায়গায় নিয়ে যেত।
মাকালা আলসেগোছের শ্রমিক। মাথায় ইট টানা জমিতে ফসল ফলান তার ইচ্ছা নয়। কাজে মন বসেনা। পাথরের গোল চাকতি তার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। সে নদীর ধারে, জঙ্গলের পাশে বসে কী যেন ভাবে ভাবে।
একদিন সে পাথরের চাকতিটা ফুটো করে তার ভিতর একটা লাঠি ঢুকিয়ে ওটাকে চালাতে চালাতে বৃদ্ধ হর পিল্লার কছে গেল, দেখ দেখ সর্দার কী বানিয়েছি।
বেশ করেছিস, এখন ইট টান, অনেক ঘর বানাতে হবে। এখনও অনেক মানুষ খোলা আকাশের নিচে। পিল্লা তিরস্কার করে।
মাকালার খুব রাগ হয়, কিছু না বলে চলে যায়।
শীতের শেষে প্রকৃতি যখন ফুলে ফলে ভরে যায়, পাখিরা বনে বনে গান গায়, মানুষের তনু-মন নেচে উঠে। পিল্লা কওমের সকলকে ডেকে ফুলের উৎসব শুরু করে। সেখানে চলে ঘরে বসে তৈরী নানা জিনিস বেচা-কেনা সেই সাথে নানা প্রকার খাওয়া-দাওয়া। তারা মজা খেজুরের রস খেয়ে মাতাল হয়, নাচে গায়, আনন্দ উপভোগ করে। মাকালা আর তার বন্ধুরা জঙ্গলে একটা বিশেষ গাছের সন্ধান পেয়েছে, চিকন চিকন পাতা ফুল হয়। একদিন না জেনে ওগুলো খেয়ে মাথা পাতলা হয়ে গিয়েছিল, পৃথিবীর সবকিছু যেন ঘুরছিল, নেশা হয়েছিল, রাতে খুব ঘুম হয়েছিল। এখন ওরা সেটা মাঝে মাঝে খায়। মজা খেজুরের রসের মত খুব নেশা হয়। ফুল-পাতা শুকিয়ে ধোঁয়া করে টানলে আরও বেশি রং ধরে মনে।

সবকিছুর মাঝে মাকালার চাকার ভাবনা মন থেকে হারায় না। একদিন সে পাথরের চাকার মত, মোটা কাঠের গুড়ি কেটে যাচ্ছেতাই গোছের আর একটা চাকা বানায়। তার মাঝে ফুটো করে তিনটা ডাল তিন কোনা করে জুড়ে দেয়। তার মাঝে একটা ডালা বসিয়ে উর্ধশ্বাসে ঠেলতে ঠেলতে হর পিল্লার বাড়ির দিকে যায়। মাকালার চোখে মুখে পূর্ণিমার চাঁদ হাতে পাওয়ার আনন্দ।
এসময় বয়সের ভারে নুয়ে পড়া পিল্লাকে নিয়ে মানুষের একটা জটলা বাধে। তাকে বাড়ির বাইরে খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। মাকালা সেখানে পৌঁছে রাজ্যের হাসি হাসে, সর্দার দেখ, সবাই দেখ, এটা কী। এবার তোদের দশজনের কাজ একাই করব।
শ্রমিকেরা তার কথায় খেপে যায়, শালা আমাদের না খাইয়ে মারার বুদ্ধি করেছিস।
একজন বয়োস্ক বলে, ওর সাথে গরু জুড়ে দিলে আরও ভাল হয়। আমাদের আর এত কষ্ট করতে হবে না।
কেউ একজন বলে, এরকম চাকতি দিয়ে চড়কা বানিয়ে উন্নতমানের সুতো কাটাও সহজ হবে। আমাদের নি¤œ মানের পোষাকে কেবল কোনরকম লজ্জাস্থান ঢাকা যায়।

হর পিল্লার ন্যাতান দেহ নড়ে-চরে উঠে। ঠোঁট জোড়া কাঁপে। বোধ হয় কিছু বলতে চায়। কিন্তু অস্পষ্ট ক্ষীণ সে শব্দ। কিছুই বোঝা যায় না। এবার সে অনেক চেষ্টায় ডান হাতটা মাকালার মাথার উপর রাখে। হর পিল্লার শ্বাস দ্রুত হয়। হঠাৎ তার ঘোলা চোখ বড় বড় হয়, একবার এদিক ওদিক ঘোরে। তারপর বন্ধ হয়ে যায়। তার অন্তচক্ষু আলোয় উদ্ভাসিত, সেখানে ভেসে উঠে বিরাট বিশাল আধুনিক হরোপ্পা নগরি।

বিংশ শতাব্দীর এই বাঁকে মাকালার সেই যাচ্ছেতাই চাকা হর পিল্লার স্বপ্নের পৃথিবীতে আজও ঘুরছে কল্পনাতীত আধুনিক হয়ে নানা কাজে নানা যন্ত্রে আর হর পিল্লার হরোপ্পা পৌঁছে গেছে সভ্যতার শিখরে। সেই চাকা আরও কতদিন ঘুরবে আর কোথায় পৌঁছবে কেউ তা জানে না...। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, চাকা একদিন থেমে যাবে সৃষ্টি ধ্বংসের লক্ষ্যে অনেকটা হরোপ্পার মত...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
অম্লান অভি অনেক দিন পরে গল্পকবিতায় এলাম। অনেক গল্পের ভিড়ে নামের টানে আর ফেলে রাখা ইচ্ছার আকর্ষনে পড়ে ফেললাম এক নিশ্বাসে- দারুণ। বাস্তবতাকে খুব সচেতন ভাবে তুলে এনেছেন বাক্যের ছটায়। সাদামাঠা এবং তথ্য গড়নের বিশাল গল্পই। নাট্যরুপ প্রত্যাশায় ভোট দিলাম।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৫
শেখ শরফুদ্দীন মীম ভিন্ন ধরনের গল্প। বেশ ভালো লাগলো। অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আমার ছোট্ট লিখাটুকু সময় করে পড়বেন।
ভালো লাগেনি ২২ জানুয়ারী, ২০১৫
রাজু অনেক বড় । তবে ভালো লাগলো ।
ভালো লাগেনি ১২ জানুয়ারী, ২০১৫
জাতিস্মর লেখা বেশ ভালো লাগলো। আমারো একটা ছোট্ট গল্প আর একটা ছোট্ট কবিতা আছে। সময় পেলে পড়ে দেখবেন।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভাই।আমার কবিতা ও গল্প পড়ার আমন্ত্রন রইল।
জুন অসাধারণ। খুব সুন্দর একটি গল্প পড়লাম।ভাবগুলো চমতকার। শুভ কামনা আপনার জন্য।

০৬ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী