জীবন পথের এক প্রান্তে

শুন্যতা (অক্টোবর ২০১৩)

মীর মুখলেস মুকুল
  • ৩৩
কপাল, তকদির বা ভাগ্য যাই বলেন বলেন না কেন, সেখানে নাকি আমার প্রেম বলে কোন কিছু নেই। এর চেয়ে দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা আর কি হতে পারে। কাক যেমন তার জাত শত্রæ কোকিলের ডিম নিজের ডিম মনে করে দিনের পর দিন ওম দিয়ে বাচ্চা ফুটায়, বড় করে। ঠিক তেমনি এক চির চেনা যন্ত্রনাকে আপন মনের কুঠিরে স্থান দিয়ে, দীর্ঘ দিন ধরে আপন রক্ত ক্ষয় করে বড় করে চলেছি। আর হয়ে উঠেছি প্রেম পিয়সি। প্রেম ভিখারী। এই প্রেম নামক শব্দটা আমার মাথায় ঢুকেছিল প্রেমের জ্ঞান বোধ জন্মাবার অনেক আগে। সেই কিশোর বয়েসে।
সেবার গাঁয়ে এক জ্যোতিষী এসেছিল। মাথায় সাদা পাগড়ি, মুখে পাকা চাপদাড়ি, গায়ে লম্বা সাদা জুব্বা। একজন পাকা হস্তরেখা বিশারদ। কেও কেও বললো- গনক। আমার পতিক্রিয়া ছিল অনেক, তবে কিশোর বয়েসের মত কমপোক্ত, অনভিঞ্জ। তাকে ঘিরে এক জটলা বেধেছিল। বিনি পয়সায় হাত দেখিয়ে ভুত-ভবিষ্যত জানা। দাওয়াই হিসাবে টুটকা তাবিজ, ঝার-ফুক, তেল-পানি পড়া, বিক্রিও হয়েছিল দেদারসে। অবুঝ বয়েসে দুনিয়াবি ঘোর-প্যাঁচ না বুঝে হাত বাড়িয়েছিলাম।
তিনি বলেছিলেন, তোর ভবিষ্যত খুব খারাপ রে, কিছুই নেই তোর কপালে।
জোটলায় পাড়ার সোহাগী ভাবির প্রধান্যও লক্ষ্য করার মত, যেন গনকের প্রধান সাগরেদ। শুধু মুচকি হেসে বলেছিল, প্রেম-ভালবাসাও কি নেই? একটা হাসির ফোয়ারা ছুটল। আমার টনক নড়ল। মনে হলো ডাল ভেঙ্গে গাছ থেকে মাটিতে পড়লাম।
জ্যোতিষী ক্ষানিকটা সময় নিয়ে চোখ বন্ধ করে থেকে ভাল করে হাত দুটো দেখে বললেন, উহু, প্রেমের রেখা মরা, কিছুই নেই...।
তারপর থেকে কথাটা মনের ভিতর আগ্নেয়গিরির মত থেকে থেকে উস্কে উঠত এবং একসময় নির্গত লাভার মত থিতিয়ে স্তরে স্তরে জমাট বেঁধে উঠেছিল- প্রেমের রেখা মরা, কপালে প্রেম নেই, ভাগ্যে প্রেম বলে কিছু নেই...।
একটু পরিণত বয়স হলেই নিজের শংকিত ধারণাকে আরও একটু পরখ করার জন্যে আমি উস খুস করি। বানরের মত ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে এদিক ওদিকে তাকাই, খোঁজাখুজি করি। এভাবে সাপের খোলস বদলের মত অলস দেহের অবসরে একটা মওকা মিলেও গেল...।
আমি তখন এসএসসি পরিক্ষার্থী। ক্লাসের ঝামেলা নেই। বাড়িতে আলসেমির ঢংয়ে লেখা-পড়ার ফাঁকে পাড়ার এক কয়লা-সুন্দরীর পাত্তা পেলাম। পড়ার টেবিলের জানালায় উঁকি দেয়। হাসে। চলে যাওয়ার সময় ফিরে ফিরে চায়। আমি তো মহা খুশি। তবুও মাঝে মাঝে গনকের হতাশ করা ভবিষ্যত বাণী মনের পর্দায় ভেসে ওঠে এবং মুষরে পরি। লম্বা সময় নিয়ে পরীক্ষাগুলো শেষ হবার আগেই আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। মনে মনে ¯^প্নগুলো সাজিয়ে ফেললাম; পরীক্ষার পর কিভাবে প্রেমের আকাশে সুন্দরীটিকে নিয়ে উড়াল দেয়া যায়...।
আপসোস! পরীক্ষা শেষে দেখা গেল দীর্ঘ সময়ের ভর সইতে না পেরে সে আর একজনের প্রেমের নৌকার পা দিয়ে ভাটিতে তর তর করে অনেক দূরে চলে গেছে। নিজের ভাগ্যটাকে সেদিন সত্যিকার এক দূরভাগ্য ভেবে শান্তনা খোঁজার বৃথা চেষ্টা করেছিলাম...।
পরীক্ষার ফল বেরুতে তিন চার মাস বাকি। বাউণ্ডেলের ¯^ভাব পেয়ে বসেছে। বেড়াতে গেলাম দুরের এক দেশ; মেঝ খালার বাড়িতে। খালা-খালু খুব খুশি। তাদের আদর-আপ্যায়নের তৃপ্ত-রসনায় মন রোচে না। পাখিহীন শূন্য খাঁচা দমকে দমকে কাঁদে। ফিরে যাব-যাব ভাব; এমন সময় খালুর এক ভাইঝির সাথে পরিচয় হয়ে গেল...।
ডাগর ডাগর চোখ। সমস্যা একটাই পেটটা পটকা মছের মত। তাতে কি? হস্তরেখা বিশারদের কথা মিথ্যে প্রমাণ করতে আমি তখন আবারও মরিয়া। ললনার প্রেম দরিয়ায় একটু দোলা দিতেই ঢেউ উতলে উঠল। আমার মত মরচে ধরা আধুলিকে পূর্ণ পঞ্চদশীর চাঁদ ভেবে বসল। আমার খাই খাই মনে ঝড়, যেন পবন উনপঞ্চাশ ধারায় বইছে...। ভাব জমিয়ে ফেললাম। কিন্তু সময়কে হাতের তালুতে বেঁধে রাখতে পারলাম না। প্রথম টের পেলাম উঞ্চ সময় দ্রুত যায়...।
বিদায় বেলায় ঝর ঝর কেঁদে বলল, মাঝে-মাঝে পত্র দিও, ফের দেখা করো, এস কিন্তু...।
মুখে কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে একশ’একবার কিরে কাটলাম, জরুর আসব। এবার গনকবেটার ভবিষ্যত বাণীকে কথার কথা ভেবে মন চাঙা করে বাড়ি ফিরলাম।
ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হলাম। একদিন কলেজ থেকে ফিরে বাসায় পড়ার টেবিলে পটকা সুন্দরির লেখা একটা চিঠি পেলাম। আনন্দে খাম খুলছি আর ভাবছি- এবার আর ঠেকায় কে, ক্লাসের গুষ্টির পিন্ডি, বন্ধু ভেবনা আমি এলাম বলে। কিন্তু একি! এ যে ওর বিয়ের নিমন্ত্রন পত্র! একেই বলে পোড়া-কপাল...!
বিছানায় শুয়ে শুয়ে গনকমশাইকে মহাশ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলাম। মনে মনে তাকে গুরু মেনে নিয়ে প্রতিজ্ঞাও করলাম- তুমিই আমার গুরু, তোমাকে আার কখনও অবজ্ঞা করব না, যদি করি তবে, সপ্তাহে একবার করে নাড়া হব, প্রতিদিন একঘন্টা করে বেলতলা যেয়ে বসে থাকব।
কলেজের প্রেমহীন জীবন পানসে, ঘাস ঘাস লাগে। তবুও নতুন করে প্রেম-ভালবাসা দূরে থাকি, বন্ধু-বান্ধবীর কথাও ভুল করে মুখে আনি না। একে তো আমি বেরসিক এবং ঘর-কুনো, আড্ডা থেকে নিরাপদ দূরে থাকি। তারপরও নিজেকে মুরুব্বিগোছের কিছু ভাবতে শুরু করে দিলাম। একরকম সন্ন্যাস বেশ ধারণ করে ফেললাম। আমি একটা খাঁটি মেনি এবং ওটাকে জাহির করার সর্বত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এতে আমার দিন দিন বন্ধুর সংখ্যা কমে যেতে থাকলো।
এতদসত্বেও আমাদের কলেজের ক্লাসমেটদের একজন আমাকে পছন্দ করে ফেলল। অনেকটাই একতরফা। আমি তাকে সর্বাত্মক এরিয়ে চলি। কিন্তু সে আঠার মত লেগে থাকে। আবার আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত পেয়ে ভিত হলাম। ভয়ের আরও বড় কারণ; ও সম্ভ্রান্ত ঘরের হিন্দু, কায়স্ত। নওগাঁ জেলা শহরের পোস্টঅফিস পাড়ায় বাড়ি। ওর বড়দা পাবনায় সরকারি কৃষি বিভাগের এজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বড়দার সাথেই থাকে। তাই অন্যদের বেলায় যেভাবে এক পা দু’ পা করে এগিয়েছিলাম ঠিক তার কয়েকগুন বেগে পিছানোর পথ খুঁজতে থাকি।
মান্যবর গনকগুরুর ভবিষ্যত বাণীই যেহেতু আমার জীবনে সত্য হয়ে গেছে, জীবনের পরতে পরতে সেটা ফলে যাচ্ছে, তাই আমার বিশেষ করে তার মঙ্গলার্থে এই মুহূর্তে ঐ বন্ধুটির নাম না বলাই ভাল মনে করছি।
আমি লুকিয়ে থাকি, পালিয়ে ফেরার পথ খুঁজি; একদিন ওকে বলেই ফেললাম, অসম্ভব! তোমার সাথে আমার কখনও বন্ধুত্ব হতে পারে না। কোথায় তুমি আর কোথায় আমি? ফারাক; আকাশ-পাতাল। কিন্তু ঐ একই সমস্যা। আঠা, আইকা এবার সুপার গ্লুতে রূপ ধারণ করেছে। অবশেষে বললাম বন্ধুত্ব যদিও হয় মাঝে পুরু দেয়াল থাকবে এবং মজবুত এক শর্তে; লেখা-পড়ার বাইরে অন্য কোন কথা থাকবে না।
ও সাথে সাথে সহজ সুন্দর মোলায়েম হাতটা বাড়িয়ে দিল; তাই হবে। আবারও শংকিত হলাম, হায় আল্লাহ্, একি করলাম? ভুল হলো না তো...?
আমি গরিব ঘরের ছেলে। নিজের আলাদা কোন ঘর নেই। পড়ার পরিবেশ বলতে কিছুই ছিল না। অন্যেকে কিভাবে টেনে নিয়ে আসি? বন্ধুর অনুরোধে অনিচ্ছা সত্বেও লেখা-পড়ার জন্য তাদের বাড়িতেই যেতে হত। ওদের পরিবারের সবার মধ্যে, বিশেষ করে বন্ধুটির ভেতর এক অসাধারণ গুন ছিল- ছোট-বড়, ধর্ম-বর্ণ ভেদা-ভেদ খুব একটা মানত না। এক কথায় সেকুলার ফ্যামিলি। অসাধারণ...!
ওর বৌদিটি ছিল অসম্ভব রূপবতী এবং গুনবতী। যার চোখ-মুখে কখনও মুসলিম বলে আড় দৃষ্টিতে দেখা বা ঘৃণার ছায়াটি লক্ষ্য করিনি। গরীব এবং মুসলিম বিধায় নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখতাম। কিন্তু ওদের আচার-আচরণ, অভিব্যক্তি; আমাকে মোটেই ওসব প্রোকট হবার সুযোগ দিত না। জানিনা আমি কেন যেন নরম তুলার মত এলিয়ে যেতে লাগলাম...।
ওর তিন-চার বছরের এক ভাতুষ্পুত্র ছিল, নাম রণি। তুলতুলে ফর্সা ছোট্ট একটা বুড়া। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। সে ছিল ওর নয়নের মনি। মনে হয় আমারও...।
নওগাঁ থেকে মাঝে মাঝে ওদের আত্মীয়-¯^জন আসত। একদিন দেখলাম ওদের বাসায় সাদা পোষাকে পরীর মত এক মেয়ে। আমি ছোটবেলায় মায়ের মুখে এত বেশি রূপকথার গল্প শুনেছি এবং সেসব গল্পে এত বেশি পরীদের সম্বন্ধে জেনেছি যে তাদের রূপ-লাবণ্য-পোষাক-আষাক বিষয়ে আমার স্পষ্ট একটা ধারণা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। যেন ওরা; দুগ্ধ-ফেনিল শুভ্র বসনাবৃত, দুধে-আলতা গায়ের অপূর্ব সুন্দরী এবং সেই সাথে সাদা বড় বড় পালকঅলা দুটি পাখা।
সেদিনের সেই মেয়েটাকে দেখে মনে হল; এই বুঝি সেই পরী। ব্যতিক্রম বলতে শুধু পাখা। মিষ্টি ব্যবহারের ¯^ল্প-ভাষীনি ওর প্রিয় ছোটবোন; অর্চনা। আমার ছোট বোন নেই; মনে হলো ও আমার সেই আদরের ছোট বোন...।
এতোকিছুর পরও নিজের মনকে কঠিন শাসনে রেখে, গনকগুরুর কাছে করা শপথের কথা বার বার মনে করি তারপরও বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। এমনিতেই আমার বন্ধুদের সংখ্যা হাতে গোনা। তাদের ভেতর থেকে ও কেমন করে যেন আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেল! মনের উপর ভয়াবহ স্টীমরোলার চালিয়েও কোন এক সময় ফ্রেন্ডশীপটা এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যে, একটা দিনের জন্যেও আমরা পরশপরকে না দেখে থাকতে পারি না। সমস্যা হলো সেখানেই; আমি কখনও একদিন ওদের বাসায় না গেলে, সে-ই চলে আসে আমাদের বাড়িতে। তাই বাধ্য হয়ে বেশিরভাগই আমাকে ওদের বাড়িতে যেতে হয়। এবং কখনও কখনও ওদেরই পিড়াপিড়িতে সেখানে রাতে থেকে যেতাম।
লেখা-পড়ার ফাঁকে-ফাঁকে রং-তামাসা, গোপনীয় কথাও চলে। দুষ্টুমিও করি। কখনও টিভি দেখি, ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনি...। আরও কত কি...। সেসব ভারতীয় পুরনো গানের কথায় কোথায় যে আমরা হারিয়ে যেতাম তার ঠিক নেই। তাতে পাড়া-প্রতিবেশী তো বটেই খোদ বন্ধু মহলেই আমাদেরকে নিয়ে নানান মুখরোচক কথার খৈ ফোটে। কিন্তু তারপরও কেন যেন অনেকটা নিজের অজান্তেই একটু একটু করে অন্যরকম হয়ে যেতে লাগলাম। তুলা গলে একসময় পানি হয়ে গেল। পানির ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দিলাম। খোদ আমিই এখন মানুষের কথা ড্যাম কেয়ার করি। বোধ হয় আমি নিশ্চিত প্রেমের দ্বার প্রান্তে ...।
এমন কঠিন শৃংখলার ভিতর প্রেম? এও কি সম্ভব? বোধহয় সেটাই সম্ভব হতে চললো। গনকের কথা আবারও কেন যেন মিথ্যে মনে হতে লাগল। একটা নিশ্চিত ধোকায় পড়ে গেলাম। তবে কী ও বেটা একটা বিশ্ব ভন্ড, ধোকাবাজ, চিট...? হবে হয়তো...।
কিন্তু হায়! এই ভাবনাও বেশি দিন স্থায়ি হল না।
ভাগ্যের গোল চাকা ঘুরে ফিরে প্রেমহীন গলিতেই বার বার থেমে যেতে লাগল। দীর্ঘ প্রায় দু’বছরের থিতান প্রেম জমাট বাধিয়ে শক্ত কাঠামোতে দাঁড় করিয়ে আকৃতিতে এনেও ওর প্রকৃত রূপকে ধরে রাখতে পারলাম না। আবার সেটা দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হল। বাস্তবতার রোষাণলে পরে সত্যি সত্যিই অবাক প্রেম জমতে না জমতে আবারও ভাঙনে পড়ল। আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। কলেজ ডিঙিয়ে ও এগ্রি-ইউনিভার্সিসিটিতে, আমি মেডিকেলে। মাঝে মাঝে পত্র বিনিময় হয়। কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাতও হয়।
মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয়? আরে ধ্যাত ও না, আমি...। ও আমাকে এড়িয়ে চলেনি বটে! আমার সাহস একেবারেই কম!
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হল। নদীর জল অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। দিন যতই যায় যোগাযোগ ততই কমতে থাকে। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয় বটে। বলতে গেলে যোগাযোগ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। শুধুমাত্র কল্পনার আকাশে ডানা মেলে ওর সাথে যোগাযোগ হত। হয়তবা ওর ক্ষেত্রেও তাই। তারপর সেটাও একদিন শুন্যের কোঠায় যাবে বাবতেও পারিনি...।
ইতোমধ্যে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। মাঝে একটা ঘটনা ঘটল। তবুও সেটা আজ থেকে সাত-আট বছর আগে। আমার চাকুরির সুবাদে নওগাঁ জেলায় বদলি হই। নওগাঁয় আমি এক মেস-এ থাকতাম। দিনভর চাকরি-বাকরি নিয়ে ব্যস্ত। বিকালে ব্যাপক অবসর। এটাই সর্বনাসের মূল। অবসর মনই স্মৃতী হাতরানোর হাতিয়ার হয়ে উঠলো।
পুরনো ফিকে হয়ে যাওয়া প্রেম নতুন করে মাথা-চারা দিয়ে উঠলো। হায়রে কপাল! এই প্রৌঢ়তেও আগের মত ভাবুক প্রেমিক হয়ে গেলাম...? বিকালের অবসরে শুধু নয়, এখন সরাক্ষনই ওকে মনে পরে...। মন আকু-পাকু করে। কী করে পুরনো প্রেম নতুন করে জোড়া দেয়া যায়। এসব কী আর এখন সম্ভব? সম্ভব নয় মানে? মনকে কিছুতেই বুঝ দিতে পারছি না। একটু বুঝ মানে তো আবার সেই আগের জায়গাতেই ফিরে আসি। তার মানে? মানে, হেরে গেলাম!
অবশেষে এক নির্ঘুম অলস বিকালে শহরের কোলাহলে গা ভাসিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পোস্ট অফিস পাড়ায় আসছিলাম। পথে কত কথাই না মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম ও দেখতে এখন কেমন হয়েছে। আমার বয়সের ছাপ পরেছে, ওর পরেনি নিশ্চয়। কোথায় বিয়ে হয়েছে, ছেলে-মেয়ে ক’টা, ইত্যাদি। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় ঠিক ঠিক বাড়িটা পেয়ে গেলাম। একগাদা উদ্দিপনা আর উদ্বেগ নিয়ে দরজার কড়া নাড়লাম। দরজা সহজে খুলছে না। বোঝা গেল লোকজন কাছে-কোথাও নেই। যতই দেরি হয় ততই দেহে উত্তেজনা পুনঃ পুনঃ ঝাকুনি দিতে থাকে একের পর এক...। চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ কড়া নেড়েছিলাম বলতে পারবো না, হঠাৎ...
খটাস করে দরজা খুলে গেল। চমকে উঠলাম। আমি নিশ্চিত যে দরজায় ওকেই দেখব...। ও কী আমাকে দেখে চিনবে? নিশ্চই চিনতে পারবে। তখন খুব বিশ্মিত হবে...। বিশ্ময়ের ঘোর কাটালে, ও চমকে উঠে বলবে, আরে মুকুল তুমি...? কখন এলে...? কেমন আছ...? অস্থির হয়ে যাবে...।
কিন্তু একি! চোখ খুলে দেখি- অচেনা এক ভদ্রলোক। মুখ শুকিয়ে কাঠ, জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে কাঁপা কণ্ঠে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম ও আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। মাঝে মধ্যে চোরা চোখে এদিক ওদিক তাকাই, যদি দেখা পাই। কিন্তু হতাস হলাম। মনের ভিতর খাঁ খাঁ করতে লাগলো...।
তিনি বললেন, সে তো নাই। বুকের ভিতরে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভুত হলো।
একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি কোথায় বিয়ে হয়েছে?
নিজেকে আনাকাংখিত ভেবে এসব বলা থেকে বিরত থাকলাম। আমার মোবাইল নম্বরসহ কার্ডটি দিয়ে বললাম, দয়া করে তার মোবাইল নম্বরটা যদি দিতেন...।
তিনি আমাকে বিশ্বাস করলেন কিনা; কিছু একটা ভেবে বললেন, সে মোবাইল ব্যবহার করে না। একটা ধাক্কা খেলাম...! এই বয়েসেও কী সম্ভব...? তবে কেন...? সমস্যা কী...?
শুধু আমি বললাম, বেশ, ওকে তাহলে আমার নাম্বারে ফোন করতে বলবেন।
আমি আশায় আশায় আছি...। আমার প্রিয় বন্ধু নিশ্চয় ফোন করবে...। আমি নওগাঁ আছি শুনলে ঝড়ের বেগে ছুটে আসবে...। আসবে না মানে? গভীর, খাঁটি প্রেম...। হীরের চেয়ে দামি। মিথ্যে আশ্বাসে আমি বিশ্বাসি নই...।
এভাবে বেশ কিছু দিন গেল। কারোর পদশব্দে চমকে উঠতাম, এই বুঝি এলো। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না ও আসবে না। শেষে একটু হতাশই হলাম। নিজেকে একসময় শান্তনা দিলাম। নিশ্চয় তিনি নাম্বার দিতে ভুলে গেছেন বা হারিয়ে ফেলেছেন।
মাস দ’ুয়েক যেতে না যেতে আবারও ওই একই সমস্যা। অলস বিকেলের নির্লজ্জ যন্ত্রনাগুলোয় ত্বারিত হতে থাকলাম...। এ যন্ত্রনা যে কী, অন্যেকে বোজাব কী করে...?
একদিন লাজ-শরমের মাথা খেয়ে আবারও গেলাম। ত্রস্ত পায়ে দরজার কড়া নাড়লাম। এবার দরজা খুললেন ওর এক বৌদি। নিজের পরিচয় দিলাম। বড়দা, রবীন্দ্র কুমার মজুদার, তার কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, তিনি রিটায়ার্ড।
তা তো হবারই কথা, অনেক দিনের কথা তো...।
বড় বৌদি কেমন?
ভাল।
রণি?
বড় হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত কথাতে একটু হতাসই হচ্ছিলাম। অর্চনার কথা জানতে ইচ্ছা হচ্চিল না আর। অনেকটা জোর পূর্বক আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ও কোথায়? ওর সাথে একটু...।
তিনি বললেন, বাড়ি নাই। এবার অনেকটাই প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম...। ভেবেছিলাম এসব কিছুই মনে করবো না, দেখা হলে হবে না হলে নাই...। এ দুনিয়ায় কে কয়দিন কাকে মনে রাখে...? কিন্তু...?
মাথাটা শুন্য হয়ে গেল, পেটের মধ্যে সবকিছু গুলিয়ে যেতে থাকল। দরজার চৌকাঠ ধরে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলাম। ফোন নাম্বার চেয়েও পেলাম না। কেন যে, জানি না। লজ্জার মাথা খেয়ে আমার নাম্বারটা আবারও দিলাম। এবং বিনীত অনুরোধ করলাম, অন্ততঃ যেন একটিবার হলেও ফোন করে। ইতিপূর্বে একবার এসেছি, কিচুটা হলেও আমার সম্বন্ধে ধারণা হয়েছে। তাই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছিল, ও ফোন করবেই...। কিন্তু...। কই...? তবে কী সব মিথ্যে...? না না, সময় পেলেই করবে। ব্যাস্ত মানুষ তো, তাই দেরি হচ্ছে...। অপেক্ষায় থাকলাম...।
আজ অব্দিও প্রতিক্ষায় আছি...।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবন যদি একটি পথ হয়, আর যদি পথের এক প্রান্তে থাকে ভালবাসা আর অপর প্রান্তে নিশ্চয় ঘৃনা...।
আমাদের এই প্রেমময় জীবনে আমি এখন কোন প্রান্তে?
জীবন সায়‎েহ্ন এ প্রশ্নের জবাবে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, আমি অবশ্যই মাঝে নই, বরং কোন না কোন এক প্রান্তে...।
গল্পটার এখানেই শেষ নয়। আরও একটু আছে। সম্প্রতি আমার ঐ বন্ধুটি ঢাকার আর এক বাল্যবন্ধু মাসুমের মাধ্যমে আমার মোবাইল ফোন নম্বরটি সংগ্রহ করেছিল। সেটা আমি পরে জানতে পারি...।
মাসুম হঠাৎ একদিন আমাকে ফোন করে বলল, মুকুল, তুমি কী নওগাঁর অমুককে চেন?
আমি বললাম, চিনতাম...।
চিনতাম মানে? তোমার নাকি বেস্টফ্রেন্ড? ফোন নম্বর চেয়েছিল, দিয়েছি।
বেশ তো, ভাল করেছ।
তোমাকে ফোন করতে পারে। তার মোবাইল নম্বরটাও রাখ।
ঠিক আছে দাও, তবে আমি ফোন করবো কিনা জানি না, সে করলে নিশ্চয় খুশি হব।
মাসুম আরও বলেছিল, ও নাকি আমাকে খু-উ-ব ফিল করে। আমার সাথে তার নাকি ম্যা...লা..., ম্যা...লা... কথা।
আমি পথ চেয়ে আছি...। আজও...।
বন্ধুটি যদি ফোন করে, ‘পুরানো সব দিনের কথা’, ‘আর একটি বার’ ঝালায় করে নেব।
কিন্তু সেসব কথাও এখন পুরনো হতে চলল। প্রিয়বন্ধুটি আজও ফোন করেনি। আর কবে করবে...?
পাঠক! ভাবছেন এটা কোন কল্পকাহিনি। মোটেও না। অপ্রিয় কথা প্রিয়জনকে বলা কষ্ট। কিন্তু কখনও কখনও অপ্রিয় কথাগুলো মনের অজান্তেই গল্প হয়ে যায়। সেসব কথা রূপকথার মতই মনে হয়। আসলেই তাই। এই অপ্রিয় সত্য কথাটি আজ না বললে হয়তো অতৃপ্তই থাকতে হবে। তাই বলেই ফেলি- আমার ‘বেস্টফ্রেন্ড’ অর্থাৎ ‘প্রিয়বন্ধু’র নাম ‘নৃপেন্দ্র কুমার মজুমদার’। ডাক নাম ‘বাবু’...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Farid Ali গল্পে গল্পময়তা আছে ।
জাকিয়া জেসমিন যূথী রোজ বেশি রাত জাগতে জাগতে বাজে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিলো ভেবে আজ ভেবেছিলাম, অন্যান্য রাতে চেয়ে আগেই ঘুমোতে যাবো। গল্পের সার্চ দিতে গিয়ে আপনার লেখায় চোখ পরে যাওয়ায় ঢুকে গেলাম। পড়তে পড়তে মুগ্ধতা ছড়ালে শেষ না করে উঠা গেলো না। ...ঠিকই বলেছেন, কিছু কিছু কথা প্রিয় কিংবা অপ্রিয় হলেও এগুলো লিখতে গেলে গল্পই হয়ে যায়। আপনার গল্পটিও তাই গল্প হলেও মন ছুয়ে দিয়েছে। ভালো থাকুক, আপনার সেই বন্ধুটি। অনেক প্রিয় বন্ধুর সাথে বহুদিন দেখা না হলে ইচ্ছের গভীরতা থাকলেও জড়তা আসে বলেই হয়তো আর সে কথা বলতে পারেনি। অথবা, যৌবন পেরিয়ে এসে অনেকেই বোঝা হয়ে যায় যে অন্যের সংসারে!! তেমন কিছুও হতে পারে। ক্ষমা করে দিয়েন তাকে।

০৬ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী